রহমান মৃধা
মরতে তো একদিন হবেই। এই চিরন্তন সত্যকথন সবাই জানে। মৃত্যুতে কি মজা? না কি সাজা? তা শুধু সেই জেনেছে যে মরেছে। তবে সহজ ও সরল ভাষাতে কাগজের পাতায় লিখে গেছেন শরৎচন্দ্র তার শ্রীকান্ত উপন্যাসে,- ‘মরতে তো একদিন হবেই’। এ এক চিরন্তন সত্য কথা এবং যা ঘটতে পারে যে কোনো সময়। তার পরও থেমে নেই জীবন। জীবন চলমান, ভালো মন্দের এক মিশ্র প্রতিক্রিয়াই চলছে মানবজীবন। জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানে রয়েছে সময়। এই সময়ের মধ্যে চলছে সংগ্রাম, বেঁচে থাকার সংগ্রাম। এই সময়ে আপন হচ্ছে পর, পর হচ্ছে আপন, ধনী হচ্ছে গরীব, গরীব হচ্ছে বড়লোক। রাত হচ্ছে দিন, দিন হচ্ছে রাত। মরার পর কি হচ্ছে? তা জানিনে, তবে ধর্মীয় মতে নানা ধর্মে নানা বিশ্লেষণ রয়েছে।
আজ কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করব, আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সময়ের উপর। এমন একটি সময় অক্টোবরের শেষের দিন এবং নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের উইকেন্ডে, এখানকার বেশিরভাগ কাজকর্ম বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে। তাই প্রায় সবাই করিডোর ছেড়ে কেও বাড়িতে, কেও ছুটিতে। বন্ধু-বান্ধবীরা বলেছে কেন এই ছুটি? এবং কিসের জন্য ছুটি? অক্টোবরের শেষের দিন এবং নভেম্বরের প্রথম উইকেন্ড ধর্মীয় ভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই উইকেন্ডে এরা সেজে গুজে ফুলের তোড়া সাথে মোমবাতি নিয়ে ‘সির্কগোর্ডেন’ বা কবরস্থানে যেয়ে মৃত ব্যক্তিদের আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়া- প্রার্থনা করে থাকে।
এখানে সবাই তাদের সময়টাকে মৃত ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসা দেখাতে তাদের কবরে বাতি জ্বালানো, স্মৃতি চারণ করা এটাই এই সময়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান যা এদের ভাষাতে বলা হয় ‘আল হেলগোন’ বাংলায় বলা যেতে পারে সপ্তাহের বা উইকেন্ডের পবিত্র দিন। একই সঙ্গে অ্যামেরিকাতে এবং আরও কিছু দেশে এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়ে থাকে, যাকে বলা হয় ‘হ্যালোইন উইকেন্ড’। হ্যালোইন উৎসব পালন সর্বপ্রথম আয়ারল্যান্ড থেকে শুরু হয়, পরে ১৮০০ সালে আইরিশ জাতি জীবনের সুখের সন্ধানে পাড়ি জমাতে শুরু করে অ্যামেরিকাতে।
আইরিশদের অ্যামেরিকা আগমনে এরা নিয়ে আসে এদের ঐতিহ্য যাকে বলা হয় ‘হ্যালোইন’। হ্যালোইন বড় আকারে এবং ট্রেডিশনালি পালন হয়ে আসছে অ্যামেরিকাতে তখন থেকে। তখনকার সময়ে আইরিশদের ধারণা ছিল মৃত ব্যক্তিরা পৃথিবীতে ফিরে আসে এই উইকেন্ডে, এক বিস্ময়কর ও ভয়ংকর রূপ ধারণ করে, যার কারণে হ্যালোইনের পোশাক- আশাকেরও এক ভিন্ন রূপ যা আমাদের ভাষাতে অনেকটা ভূত-পেত্নীর রূপে সেজে দিব্বি এক ভয়ানক দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে তাদেরকে। যা দেখলে ভয় না পাবার কোনো কারণ নেই, যদি কেও বিষয়টি সম্পর্কে না জানে।
আমেরিকাতেই প্রথম একে অন্যকে ভয় দেখানো, ভূত-প্রেত সেজে ঘরে ঘরে গিয়ে খাদ্য, অর্থ সংগ্রহ করার আনুষ্ঠানিকতা, প্রচলন। আমেরিকাতে প্রাপ্তির সহজলভ্যতার জন্য মিষ্টিকুমড়া (পাম্পকিন) নকশা করে লেনটান বানানোর প্রচলন হয়, নকশা করা ‘পাম্পকিনের লেনটান’ হয়ে ওঠে হ্যালোইন অনুষ্ঠানের অপরিহার্য বিষয়।
জেক ওভলেনটানের একটি দীর্ঘ মজার কাহিনী প্রচলিত আছে। সংক্ষেপে গল্পটি হলো, ধান্দাবাজ, কৃপণ জ্যাকের সঙ্গে এক অমানিশা রাতে দেখা হয়ে যায় শয়তানের। জ্যাক শয়তানকে পানে আপ্যায়ন করে, দুজনে নেশা করে। কিন্তু পয়সা না থাকায় দাম পরিশোধ করতে পারে না জ্যাক। জ্যাক তাই পটিয়ে-পাটিয়ে শয়তানকে রাজি করায় একটি পয়সায় রূপান্তরিত হয়ে যেতে, শয়তান পয়সা হয়ে গেলে সে পানীয়ের দাম দিয়ে দেবে, পরে শয়তানের পূর্ণরূপে ফিরে যাবে। শয়তান রাজি হলে জ্যাক দাম না দিয়ে পয়সাটি তার পকেটে পুরে ফেলে। জ্যাকের পকেটে একটি রুপালি ক্রস থাকায় শয়তান তার পূর্বরূপ ধারণ করতে পারে না। জ্যাক তাকে এক বছর কোনো জ্বালাতন না করা ও প্রাণে না মারার শর্তে শয়তানকে পূর্বরূপে ফিরে আসার সুযোগ দেয়।
আরও পড়ুন : ভ্রমণে আনন্দ ভ্রমণে বিষাদ
এক বছর পর শয়তানকে জ্যাক আবার ঠকায়, ফল পাড়তে গাছে উঠিয়ে আঙুল দিয়ে ক্রস বানিয়ে গাছে আটকে রাখে। এবার মৃত্যুর পর তার আত্মা না নেওয়ার শর্তে তাকে গাছ থেকে নামতে দেয় জ্যাক।
জ্যাক মারা যাওয়ার পর প্রতারণার জন্য স্বর্গে তার স্থান হয় না। ও দিকে শয়তানও তার কথা রাখে, সে কথা দিয়েছিল, তার আত্মা নেবে না, সে-ও তাকে নরকে ঢুকতে দেয় না। বেচারা জ্যাকের আত্মা বাধ্য হয়ে ঘুরে বেড়ায় মর্ত্যে। অন্ধকার রাতে একটি জ্বলন্ত কয়লা ওলের খোলের মধ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এদিক-ওদিক দিকশূন্যভাবে। এটাই জ্যাক ওভলেনটান বা জ্যাকের বাতির কাহিনী।
পশ্চিম ইউরোপ থেকে যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান আমেরিকা গিয়েছিল আঠারো শ শতাব্দীতে, বিংশ শতাব্দীতে একটি সর্বজনীন আন্তর্জাতিক উৎসব হয়ে ইউরোপে ফিরে আসে, তাই অনেক ইউরোপীয় হ্যালোইনকে আমেরিকান ট্র্যাডিশন মনে করেন।
একই সময় এবং একই ধর্মে বিশ্বাসী মানবজাতি এই ধর্মীয় উৎসবকে ভিন্নভাবে পালন করে চলেছে, শুধু পার্থক্য এদের বাস দুই ভিন্নদেশে। বহু বছর হতে চলছে দেখা যাচ্ছে যে সুইডেনেও এই অ্যামেরিকান হ্যালোইন একই উইকেন্ডে পালন হচ্ছে। নরমালি শুক্রবার রাতে হ্যালোইন উৎসব পালন করা হয় এবং শনি বারে আল হেলগোন পালন করা হয়ে থাকে। ছোট ছোট বাচ্চারা ভূত-পেত্নীর রূপে সেজে বেশ আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে এই উইকেন্ড পালন করে।
মিষ্টি কুমড়া নানা ভাবে ডেকোরেট করা হয় এবং এই মিষ্টি কুমড়ার ওপর খাবারের বিশেষ আইটেম তৈরি করা হয় এই দিনে। মৃত ব্যক্তিকে স্মরণ করা হয় ঠিকই, তবে ধরণ এবং কারণটি কিছুটা ভিন্ন। এই উইকেন্ডের একই উদ্দেশ্য তবে পালন করা হয় ভিন্ন রকমে। প্রশ্ন— তাহলে কি মৃত্যুর পর ভালো কর্মের ফলে কেও হবে এঞ্জেল, খারাপ কর্মে কেও হবে ভূত-পেত্নী, তাই কি এমনটি করে পালন করা? যাই হোক না কেন, এত বছর ধরে বিষয়টি লক্ষণীয় সত্বেও এমনটি করে ভেবে দেখিনি এর আগে যা আজ লিখতে বসেছি। কারণ একটাই।
১৯৮৫ সালের ৩১ অক্টোবর মাস ভীষণ ঠাণ্ডা বাইরে। খুব অন্ধকার। আশে পাশে তেমন কেউ নেই, বেশ একাকী। ওয়েদার খুবই জঘন্য বলতে হয়, ঠাণ্ডা বাতাস, তুষার বৃষ্টি আকারে পড়ছে, সব মিলে যাকে বলে ন্যাস্টি ওয়েদার, বিশেষ করে সুইডেনে। অন্ধকারে বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে আমি একা। বন্ধু-বান্ধবী কেও করিডোরে নেই। উইকেন্ড, তাই সবাই যার যার বাড়িতে চলে গেছে। করিডোরে শুধু আমি। হঠাৎ দরজার বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই সামনে তাকিয়ে দেখি দুই পেত্নীর চেহারা। পেত্নী কি? শুধু কল্পনাতে বাংলাদেশে থাকতে শুনেছি অনেকের থেকে যে চেহারাই এক কুৎসিত ভয়ংকর রূপ। চোখে দেখিনি শুধু শুনেছি। ভূত দেখতে কেমন তাও তো জানিনে?
আরও পড়ুন : সুইডেনের শিক্ষা ব্যবস্থা
মানুষের আকৃতির এক কুৎসিত চেহারার সমন্বয়। হঠাৎ এই অন্ধকার রাতে আমার রুমের সামনে কেন বা কিসের জন্য দুই পেত্নীর চেহারাযুক্ত জীবের আবির্ভাব? গা অবশ হয়ে গেছে দেখা মাত্রই। সুইডেনে ভূত? বাংলাদেশে এর নাম শুনেছি, চোখে দেখিনি। আজ সরাসরি ভূতের দেখা, তাও দরজার সামনে? দরজা খুলতেই নিচে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। কিছুক্ষণের জন্য মৃত্যুর সাধ গ্রহণও করেছি মনে হচ্ছে, তবে কিছুই মনে নেই। আমি তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি, মরে গেছি।
হঠাৎ হুঁশ হতেই স্মৃতি চারণের সাথে সাথে উপলব্ধি করতে শুরু করছি, দুই সুন্দরি রমণী আমার বিছনাতে এবং আমার জ্ঞান ফেরাতে মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস দিতে চেষ্টা করছে। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বেশ এক মধুময় আবেগের সৃষ্টির সাথে আমি আমাকে ফিরে পেতেই চোখ মেলে দেখি দুই রমণী, সাথে চলছে রমণীদের চুম্বনের ঢেউ। জ্ঞান ফিরছে এবং ভালোই লাগছে। একই সাথে নড়াচড়া করতে ভয় হচ্ছে, ভুত-পেত্নীর ব্যাপার কখন কি করে?
হঠাৎ তাদের কথা শুনতে পারছি। পরিচিত নাম। আমারই করিডোরের দুই বান্ধবী, ছারা আর ছুজান, কী ব্যাপার? চোখের পাতা তুলতেই তো তারা মহা খুশি। এদিকে এ্যাম্বুলেন্স এসে পড়েছে। বান্ধবীরা আমাকে হ্যালোইনের পার্টিতে সারপ্রাইজ দিতে যে প্লান করেছিল তা পুরোপুরি সার্থক না হলেও আংশিক পূর্ণ হয়েছিল ঠিকই তবে ভয় তারাও পেয়েছিল সেদিন, কারণ তারা মনে করেছিল আমি হার্টফেল করেছি।
সেদিন সেই রাতের আদর-যত্ন ছিল ক্ষণিকের এক ব্যস্ত সময়। তাদের মুখে আর মুখোশ নেই, শরীরের কালো কাপড় ছেড়ে স্বাভাবিক পোশাকে আমার পাশে দুই সুন্দরী বান্ধবীর সব গল্প এবং ঘটনা শুনতে শুনতে কখন রাত যে সকালে পরিণত হয়েছিল জানিনে, তবে সেদিন প্রথম জেনেছিলাম হ্যালোইন দিনটির কথা। দিনের মূল উদ্দেশ্য নানা ভাবে সেজে-গুঁজে একে ওপরকে ভয় দিতে চেষ্টা করা।
আরও পড়ুন : দেখা হয়েছিল পূর্ণিমা রাতে
ভালো ভয় পেয়েছিলাম সেদিন। ঘটনা ঘটেছিল সুইডেনের জীবনের শুরুতে, করিডোরে দুই সুইডিশ বান্ধবীর সমন্বয়ে। আজ মনে পড়ে গেল সেদিনের সেই মেমোরি। আজ সুইডেনে হ্যালোইন সাথে আল হেলগোনের দিন। এমন দিনে আমরা পৃথিবীর সকল মানবজাতি ভালোবাসার সমন্বয়ে, অন্য, বস্ত্র, ভাষা, কালচার, ধর্ম, বর্ণ, ক্লাইমেট ও নেচারের পরিবর্তনের সত্বেও সুন্দর ভাবে একত্রে বসবাস করছি — With mutual respect, understanding, tolerance and love.
লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
ওডি/কেএইচআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড