রহমান মৃধা
ভ্রমণ করতে পছন্দ করে না এমন লোকের সঙ্গে আমার আজও দেখা হয়নি। ছোটবড় সবাই ভ্রমণ করতে পছন্দ করে। ছোটবেলা নৌকায় করে নদীপথে নানা বাড়ি যখন যেতাম সারাদিন লেগে যেতো। তবুও ক্লান্তি অনুভব করিনি কখনো। কারণ নৌকা ভ্রমণে নানা বাড়ি যাওয়ার আনন্দ দূর করত সব ক্লান্তি।
বাড়ি থেকে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনলেই আনন্দে আটখানা হয়ে পড়তাম। এখনো দেশ বিদেশ ভ্রমণ করা, নতুন নতুন শহর এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখা ও উপভোগ করার মাঝে রয়েছে এক মনোমুগ্ধকর অনুভূতি, যা শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। আমি আমার ভ্রমণের বর্ণনায় সব সমস্যার সমাধান দিতে পারব না। কিন্তু কয়েকটি বিষয়ের উপর আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং ভ্রমণে সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখতে কি করনীয় হতে পারে তার ওপর কিছু তথ্য তুলে ধরব।
ভ্রমণে সব সময় পরিবেশ বা পরিস্থিতি মনপূত হয় না, তা সত্ত্বেও ভ্রমণের সময়টুকু সবাই চেষ্টা করে ম্যানেজ করে চলতে। যারা নিয়মিত দেশ বিদেশ ঘোরাঘুরি করে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে বলবে, সব ভ্রমণ সব সময় সমপরিমাণ বিনোদন দেয় না। ভ্রমণে বেদনা এবং আনন্দ দুটোই থাকে। যেমন অনেক সময় দেখা যায় প্লেনের ভ্রমণ ভালো হয় না, কারণ প্লেনের ছিটের স্পেস কম বা ভালো সার্ভিসের অভাব।
কখনো হোটেলের সার্ভিস ভালো হয় না যেমন নোংরা টয়লেট, কখনো আবার রেস্টুরেন্টের খাবার এবং সার্ভিস মনপূত হয় না। কখনও সাগরের আশপাশের পরিবেশ বা সমুদ্রসৈকতের পরিবেশ পছন্দ মত হয় না ইত্যাদি। আবার ভ্রমণ হতে পারে একাকী, স্বামী-স্ত্রী বা একটি পুরো পরিবার মিলে। তবে ভ্রমণে যাবার আগে কোথায় ভ্রমণ কেন ভ্রমণ এ বিষয়ের উপর সবার মতামত এবং একটি বাজেট নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
সবাই যেন ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করতে পারে তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ ভ্রমণে একটি জিনিস সচরাচর ঘটে তাহলো নিজেদের মাঝে মনোমালিন্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পশ্চিমা দেশগুলোতে ডিভোর্স পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে বা হয়ে থাকে যদি আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের অভাব হয় ভ্রমণকালীন সময়ে। হোটেলে থাকা কালীন ভালো সার্ভিস পেতে হোটেলের স্টাফদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।
আরও পড়ুন : ঘুমের ঘোরে রগে টান
অনেকে হোটেল থেকে বিদায় নেওয়ার সময় হয়ত বকশিস বা টিপস দেয়, ভালো সার্ভিসের কারণে। আমি হোটেলে ঢুকেই প্রথম দিন টিপস দেই যাতে করে তারা ভালো সার্ভিস দেয় প্রথম থেকেই। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে বিশেষ করে ইউরোপে যে রেস্টুরেন্টে লোকাল লোকজন বেশি যায় সেখানে খাবার এবং সার্ভিস ভালো হয়ে থাকে। এশিয়ায় বিশেষ করে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ার স্ট্রিটফুড সবসময় সুস্বাদু এবং দামও কম হয়ে থাকে।
ওয়েস্ট ইউরোপ এবং আমেরিকায় কোনো কিছু ভালো না হলে কমপ্লেইন করা যেমন সহজ তেমনটি সহজ নয় মধ্যপ্রাচ্য বা ইস্ট ইউরোপে। কারণ আমেরিকা এবং ওয়েস্ট ইউরোপে ক্রেতার প্রাধান্য সব সময় বেশি দেওয়া হয়ে থাকে। অন্য দিকে তুরস্কে কমপ্লেইন করে তেমন ভালো ফল পাওয়া দুষ্কর। এদের উগ্র মেজাজ এবং দুর্ব্যবহার বেশ লক্ষণীয়। ভালো সার্ভিস না পেলে সেখানে দ্বিতীয় বার না যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে করি। ইদানীং ইউরোপের হোটেলে সিটি ট্যাক্স নেওয়া শুরু হয়েছে যা চেক আউটের দিন পে করতে হয়।
একটি উদাহরণ তুলে ধরি- গত বছর সামারে বুকিং দিয়েছি সেন্ট্রাল প্যারিসে একটি ফোর স্টার হোটেল যা পঞ্চাশ পারসেন্ট ডিসকাউন্ট অফার করেছে। হোটেলের ছবি, লোকেশন এবং ডিল সব মিলে ভালোই মনে হয়েছে তাই বুকিং দিয়েছি। হোটেলে ঢুকে দেখি কিছুই মনপূত নয়, পয়সা দিয়েছি আগে বিধায় তা আর ফেরত পাওয়া যাবে না।
দুদিন থেকেছি, প্রতিদিনই সকালে নক করে ঘুম থেকে আমাদের তুলেছে তাড়াতাড়ি রুম পরিষ্কার (early clean) করার জন্য। শেষের দিনও একই কাজ করেছে, যদিও আমাদের চেক আউটের সময় দুপুর বারোটা। আমার বেশ মেজাজ খারাপ হয়েছে বার বার বিরক্ত করার কারণে। ক্লিনারদের রিসিপশন ডেস্ক থেকে চেক করার কথা রুমে গেস্ট আছে কি-না! তা না করে, বার বার নক করে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে যা ছিল খুবই বিরক্তিকর।
আরও পড়ুন : সুইডেনের শিক্ষা ব্যবস্থা
বিষয়টি ম্যানেজারকে জানাতেই সরি বলল। পরে চেক আউটের সময় সিটি ট্যাক্স হাতে ধরিয়ে দিতেই রাগ করে বললাম তোমার শহরের মেয়রকে শুভেচ্ছা দিও যে তার সিটিতে গেস্ট নিরিবিলি ঘুমাতে পারেনি, হোটেলের ক্লিনারের বার বার দরজায় নক করার কারণে। সে জন্য গেস্ট সিটি ট্যাক্স পে না করে সুইডেনে চলে গেছে। একথা বলার পর হোটেল ম্যানেজারের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, তৎক্ষণাৎ বলল যে আমাকে সিটি ট্যাক্স দিতে হবে না।
আমেরিকায় যদি এমন ঘটনা ঘটে কাস্টমার তার ন্যায় বিচার পেয়ে থাকে, কিন্তু ইস্ট ইউরোপে এধরনের সার্ভিস পাওয়া কঠিন। আমি মনে করি ভালো ব্যবহার, ভালো সার্ভিস সবসময় দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক তৈরি করে। সে ক্ষেত্রে সব দেশের উচিৎ পর্যটকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা এবং তাদেরকে ভালো সার্ভিস দেওয়া। ইন্টারনেটের যুগে অনেক কিছুই জানা সম্ভব তাই এর সাহায্যে একটু রিসার্চ করে অনেক বিষয়ে ভ্রমণের আগে অবগত হওয়া ভালো।
যেমন অনেক সময় লাইনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে ইন্টারনেটে টিকিট কেনা যেতে পারে যা কিছুটা সস্তাও বটে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার তা হলো ছোটদের হাতে সিটি ম্যাপ তুলে দেওয়া এবং তাদেরকে ট্যুর গাইডের দায়িত্ব দেওয়া। এতে করে ছোটরা ভ্রমণের সঙ্গে সম্পৃক্তি লাভ করে এবং কাজের উপর দায়িত্ববান হতে শেখে।
যদি লন্ডনের আন্ডার গ্রাউন্ডে পুরো পরিবারকে গাইড দিয়ে এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে নেওয়ার দায়িত্ব তারা পায় এবং যদি সত্যি সত্যি ম্যানেজ করতে পারে তবে বলতে হবে ‘wow what a great success!’ একই সঙ্গে হতে পারে সিটি ম্যাপ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ যা প্রশিক্ষণের এক বিরল নিদর্শন।
ভ্রমণে শুধু বিনোদন নয় রয়েছে শিক্ষা, জানা, শোনা, শেখা এবং দেখার সুযোগ। ভ্রমণে মানসিক চিন্তাশক্তির বৃদ্ধি ঘটে। মন মানসিকতা বড় হয়। অন্যান্য মানুষের সাংস্কৃতিক, রীতিনীতিক সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়। বাংলাদেশ তার সুন্দর ব্যবহার এবং নিরাপত্তার মাধ্যমে বিশ্বের পর্যটকদের বিলাসিতা নিশ্চিত করতে পারে। যে সব ন্যাচারাল সৌন্দর্য রয়েছে আমাদের দেশে তা সত্যিই উপভোগ করার মত। কিন্তু তা উপভোগ করা সম্ভব হচ্ছে না।
আরও পড়ুন : দেখা হয়েছিল পূর্ণিমা রাতে
কারণ দেশের অস্থিতিশীলতা, দুর্বল ম্যানেজমেন্ট এবং সর্বোপরি নোংরা পরিবেশ এর জন্য দায়ী। আমি আশা করি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়গুলোর ওপর কড়া নজর দেবেন সত্বর এবং বিশ্বের পর্যটকদের নতুন করে বরণ করতে সক্ষম হবেন। বাংলাদেশের অনেকেই বিশ্বের নানা দেশ ঘুরছে বা ঘুরতে শুরু করেছে তাই মনে হলো শেয়ার করি আমার কিছু অভিজ্ঞতা। সেই সাথে কামনা করি ভ্রমণের দিনগুলো আনন্দের হোক সবার জন্য।
লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
ওডি/কেএইচআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড