রহমান মৃধা
জানার শেষ নেই। আমি যা জানি সেটাই চূড়ান্ত, এটা চূড়ান্তভাবে মনে করার কারণ নেই। বই কিনে ঘরে সাজিয়ে রাখলেই সেটি পড়া হয়ে যায় না। ভাসা-ভাসা ভাবে পড়লেও তা পড়া হয় না। জটিল বিষয়গুলো সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা লাভ করতে হলে আমাদেরকে সূক্ষ্মভাবে পড়তে হবে, বুঝতে হবে। বইয়ের দোকানে হাজার হাজার বই, কিন্তু বইয়ের দোকানদার বইয়ের ভেতরে কী আছে তা হয়তো জানে না।
এখন এই জানা এবং না জানার উপর আলোচনা করতে গেলে সমস্যার সমাধান হবে না তবে এতটুকু পরিষ্কার করা সম্ভব সেটা হচ্ছে আমরা কতো কম জানি বা আদৌ জানি কি-না। এবং আমাদেরকে শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে যে “A little knowledge is a dangerous thing.” অর্থাৎ অল্প জ্ঞান ভয়ঙ্কর।
এখন যদি প্রশ্ন করা হয় দেশ এবং রাষ্ট্র বলতে কী বোঝায় এবং এদের মধ্যে পার্থক্য কী? অনেকেই বলবে এ ধরণের প্রশ্নের উত্তর জেনে কী লাভ? এখন সারাক্ষণ যদি শুধু লাভ লোকসানের হিসাব নিকাশ করে চলি তাহলে অনেক কিছুই করা বা জানা হবে না। অনেক সময় দেখা যায় অনেক কাজের সরাসরি কোনো আউটকাম নেই, তবে মনে আনন্দ দেয়।
যদি বলি ক্রিকেট খেলা দেখে লাভ কী? প্রশ্নের উত্তর অনেকভাবে দেওয়া যেতে পারে। লাভ বলতে যেমন ক্রিকেট খেলা মনের মধ্যে আনন্দ দেয় বা মন খারাপ করতে এর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। আনন্দ বা কষ্ট নির্ভর করে জয় বা পরাজয়ের উপর। তা সত্ত্বেও আমরা ক্রিকেট খেলা দেখি, বিশেষ করে যখন নিজ দেশ খেলে। জীবনে এ রকম অনেক কিছুই রয়েছে যার লাভ ক্ষতির বিচার ছাড়াই আমরা তা করে থাকি।
দেশ ও রাষ্ট্রের আলোচনা নিশ্চয়ই গুরুত্বহীন আলোচনা হতে পারে না। আমরা সবসময়ই দেশ ও রাষ্ট্র শব্দ দুটি ব্যবহার করি। কিন্তু এ দুয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি না তা নিয়ে আমরা কখনো কি ভাবি? ভাবি না তবে ভাবি ভাবা উচিত। সেই ঔচিত্যবোধ থেকেই আমার আজকের আলোচনা।
আলোচনাটা শুরু করেছি ফেসবুকে কোনো এক পোস্টে আমার এক ছোট ভাইয়ের মন্তব্যের আলোকে। পুরো আলোচনাটি চালিয়ে নেব তার করা আরেকটি মন্তব্যের ভিত্তিতে। ছোট ভাইয়ের নাম জুলফিকার আলী। সে যশোর শহরে অবস্থিত একটি বেসরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। বয়সে আমার অনেক ছোট এবং এ কারণে পুরো লেখায় তাকে আমি সেভাবেই বর্ণনা করবো। রাষ্ট্র ও দেশের মধ্যে পার্থক্য কী এ রকম প্রশ্ন সম্বলিত একটি পোস্টে সে মন্তব্য করেছে এবং এই দুয়ের মধ্যেকার পার্থক্য বিশ্লেষণ করেছে। সেটি আমার নজরে পড়ে।
পরে তাকে ফোন করে বিষয়টির উপর কিছুক্ষণ আলোচনা করলাম। রাষ্ট্রের সংজ্ঞা আমরা সবাই কম বেশি জানি। নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমত্বের সমন্বয়ে গঠিত সংগঠনই রাষ্ট্র। দেশ সম্পর্কেও আমাদের ধারণা আছে। কিন্তু রাষ্ট্র ও দেশের মধ্যে পার্থক্য বা সম্পর্ক নিয়ে ভাবিনি। আর এখানেই আমার কৌতূহল।
আরও পড়ুন : এ যুগের একজন সৃজনশীল শিক্ষক
ছোট ভাই যেহেতু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক কাজেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিয়েছে। যেটা আগেই বলছিলাম, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমত্বের সমষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্র। তার মতে রাষ্ট্র হচ্ছে একটা যন্ত্র যা গড়ে ওঠে আইনসভা, আদালত, সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র প্রভৃতি সমন্বয়ে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি এক একটি রাষ্ট্রের উদাহরণ।
দেশ সম্পর্কে তার ধারণা হলো, দেশ হলো একটি অঞ্চল বা স্থান বা ব্যক্তির জন্মভূমি। দেশের নির্দিষ্ট হোক আর অনির্দিষ্ট হোক একটি ভূখণ্ড ও একটি জনসমষ্টি থাকতে হয়, সরকার ও সার্বভৌমত্ব থাকা বা না থাকার সাথে দেশের কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণে কখনও কখনও রাষ্ট্রকেও দেশ বলা যেতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র ও দেশ সম্পূর্ণ পৃথক দুটি ধারণা।
যেমন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমানের বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের আগেও দেশ ছিল এখনো দেশ আছে। তবে ১৯৭১ সালের পরে এটি দেশ ও রাষ্ট্র উভয়ই। তাই বলে এ কথা বলা যায় না যে, সব রাষ্ট্রই দেশ কিন্তু সব দেশ রাষ্ট্র নয়।
তাহলে রাষ্ট্র হচ্ছে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমত্ব এই চারটি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত একটি সংস্থা। পক্ষান্তরে একটি অঞ্চলের ভূমি, গাছগাছালি, পাহাড়-পর্বত, সাগর-নদী-নালা সবকিছু মিলেই দেশ। ছোট ভাইয়ের ব্যাখ্যাতে আসি,
"লক্ষ করুন :
- ভাই আপনার দেশ কোথায়?
- নোয়াখালী।
- আপনার দেশ?
- চট্টগ্রাম।
এখানে দেশ বলতে জন্মভূমিকে বোঝানো হচ্ছে। অর্থাৎ একটি স্থানকে বোঝানো হচ্ছে, একটি অঞ্চলকে বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী বলতে অবশ্যই একটি জেলা বা বিভাগকে বুঝানো হচ্ছে না। এভাবে নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, সিলেট ইত্যাদি একেকটি দেশ কিন্তু অবশ্যই এগুলোর কোনোটি রাষ্ট্র নয়। কারণ এগুলো সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। এভাবে আমাদের প্রত্যেকেরই পৃথক পৃথক দেশ রয়েছে। আবার আমাদের সকলেরই জন্মভূমি বাংলাদেশ। অতএব বাংলাদেশ আমাদের সকলের অভিন্ন দেশ।
আমার ছোট ভাই রাষ্ট্র দেশে মধ্যে পার্থক্য করতে গিয়ে লিখেছে: রাষ্ট্র প্রধানত একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, দেশ প্রধানত ভৌগলিক প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয়ত, আমাদের মধ্যে যে অর্থে দেশপ্রেম জাগে সেই অর্থে রাষ্ট্রপ্রেম জাগে না। এ কারণে আমরা জাতীয় সংগীত গাই কিন্তু রাষ্ট্রীয় সংগীত গাই না। দেশের গান গাই, রাষ্ট্রের গান গাই না। ১৯৭১ সালের পূর্বেও এই পূর্ব বাংলাই ছিল আমাদের দেশ কিন্তু রাষ্ট্র ছিল পাকিস্তান। মুক্তিযুদ্ধে আমরা আমাদের দেশকে স্বাধীন করেছি, বিজয়ী করেছি। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের পরিবর্তন হতে পারে দেশের পরিবর্তন হয় না। ১৯৭১ সালের পূর্বে আমাদের রাষ্ট্র ছিল পাকিস্তান কিন্তু পূর্ব বাংলা ছিল আমাদের দেশ। পূর্ববাংলা এখনো আমাদের দেশ রয়েছে। সেই সাথে পূর্ববাংলা বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্রও বটে।
আরও পড়ুন : সোনার বাংলা গড়তে সঠিক পরিকল্পনা ও দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি দরকার
ছোট ভাই জুলফিকার আলী দেশ ও রাষ্ট্রের মধ্যে যে পার্থক্য করেছে তা পড়ার পরে মনে হচ্ছে কখনো কখনো দেশ ও রাষ্ট্র এক ও অভিন্ন হয়ে যায়। এমনটি হলে নাগরিকদের সৌভাগ্য। কিন্তু যখন দেশ ও রাষ্ট্র আলাদা হয়ে যায় তখন নাগরিকদের দুর্ভাগ্য বলতে হয়। এই দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে বাঙালিদেরকে তেইশ বছর শোষিত, বঞ্চিত এবং নির্যাতিত হতে হয়েছিল।
তার কারণ আমাদের সবটুকু আবেগ আর ভালোবাসা ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশকে ঘিরে, অথচ আমাদেরকে ঘর করতে হয়েছে পাঞ্জাবিদের সাথে। ব্যাপারটা এই রকম, হৃদয়ে বাসা বেঁধে আছে একজন আর বিয়ে করতে হয়েছে অন্য একজনকে। নরক যন্ত্রণা কাকে বলে!
সবকিছুর পর রাষ্ট্র এবং দেশ সম্পর্কে কী বোঝা গেল? আমি সুইডেনে বসবাস করছি। সুইডেন আমার রাষ্ট্র এবং দেশ। বাংলাদেশ হচ্ছে আমার জন্মভূমি। সেই সূত্রে জন্মভূমি হচ্ছে আমার দেশ, তবে দুর্নীতিবাজরা দেশকে দখল করে কেবল রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। এর ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ হলেও আমাদেরকে পরাধীন দেশের যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে।
আমার এতক্ষণ আলোচনার সারমর্ম হলো দেশ হচ্ছে জন্মভূমি যাকে সব দেশপ্রেমিক ভালোবাসে। আমি যেমন দেশে যাইনে কিন্তু আমি আমার দেশের জন্য দূরপরবাস থেকে কাজ করে চলছি। অন্যদিকে অনেকে দেশে বসবাস করছে, দেশের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ভোগ করছে। তা সত্ত্বেও তারা দেশকে শাসন এবং শোষণ করছে রাষ্ট্র নামক যন্ত্রের সাহায্যে। ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর মতো এই শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্র ও দেশকে পৃথক করে ফেলেছে।
তাদের কাছে দেশের চেয়েও রাষ্ট্র অনেক বেশি বড় এবং এ কারণে দেশের জনগণের চেয়ে সরকারি কর্মচারীদের গুরুত্ব তাদের কাছে অনেক বেশি। দেশপ্রেম জলাঞ্জলি দিয়ে রাষ্ট্রপ্রেমে হাবুডুবু খাওয়া এই শ্রেণিটি যেভাবে মজা লুটে চলেছে তাতে শেষ পর্যন্ত আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রটি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা চিন্তা করতে গেলে কপালে ভাঁজের সংখ্যা বাড়ে বৈ কমে না।
রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে দেশের সম্পদ লুণ্ঠনকারী শাসকশ্রেণি দেশের মানুষের কাছে দুর্নীতিবাজ, দেশের শত্রু। এদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে এদের পতন ঘটাতে হবে। সেজন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। কারণ দেশ স্বাধীন করেছিলাম রাষ্ট্রযন্ত্রের পতন ঘটাতে। ব্রিটিশ শাসনে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা হতো বাংলার সম্পদ লুট করে ব্রিটেনে পাঠাতে। পাকিস্তান শাসনে বাংলার সম্পদ লুট করে পাকিস্তানকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে মেহনতি মানুষের রক্ত শোষণ করা হচ্ছে এবং দেশের সম্পদ কানাডা, দুবাই সহ অন্যান্য দেশে পাচার করা হচ্ছে যা ব্রিটিশ বা পাকিস্তান শাসনের চেয়ে হাজারও গুণে জঘন্য বলে আমি মনে করি। আজ একথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে পাকিস্তানিরা ও ইংরেজরা ছিল দেশপ্রেমিক তারা বাংলাদেশ থেকে সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে নিজেদের দেশ গড়েছে আর আমাদের বর্তমান বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণিকে দেশপ্রেমিক বলার সুযোগ নেই। তারা বাংলাদেশ থেকে সম্পদ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করছে, বিদেশে বেগমপাড়া গড়ে তুলছে। পাকিস্তানি ও ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকদের চেয়েও বর্তমান শাসকশ্রেণি দেশের জন্য ভয়ংকর।
আরও পড়ুন : দেখা হয়েছিল পূর্ণিমা রাতে
সবশেষ বলছি আমার ছোট ভাই রাষ্ট্র ও দেশের মধ্যে যে পার্থক্য করেছে তা আমার দৃষ্টি অনেকখানি খুলে দিয়েছে, অনেক অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। আমাদের শাসকগোষ্ঠী আসলে নিজেদেরকে দেশপ্রেমিক বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা রাষ্ট্রপ্রেমিক। রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ পেতে তারা মরিয়া। এই যন্ত্র হাতে থাকলে যা খুশি তাই করা যায়। কিন্তু আমরা চাই দেশ প্রেমিক মানুষ, দেশপ্রেমিক রাজনীতিক, দেশপ্রেমিক শাসক। কবে হবে এমনটি বাংলাদেশে? খুব জানতে ইচ্ছে করে..।
লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
ওডি/কেএইচআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড