রহমান মৃধা
আজ থেকে ৭০ বছর আগে ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল গঠন করা হয় উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট বা North Atlantic Treaty Organisation (NATO)। যে দেশগুলো এই ন্যাটো জোট গঠনে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিল এবং নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের মধ্যে আমেরিকার নাম তালিকার প্রথমে রাখলে ভুল হবে না। অন্যদিকে গঠন করা হয় ওয়ারশ জোট।
ন্যাটো একটি সামরিক সহযোগিতার জোট এবং এই জোটের দেশগুলো পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতা প্রদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পাড়ে অবস্থিত উত্তর আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশ এই জোটের সদস্য। ন্যাটোর সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর খরচ পৃথিবীর সকল দেশের সামরিক খরচের প্রায় ৭০ ভাগ। অন্য দিকে ওয়ারশ জোট বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সহায়তার জোট হিসেবে পরিচিত। এই ওয়ারশ চুক্তি বা ওয়ারশপ্যাক ন্যাটোর গঠনের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাদৃশ্যপূর্ণরূপে এবং ন্যাটোর প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে গঠন করা হয়। এই জোটে যুক্ত করা হয় স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন কেন্দ্রীয় ও পূর্ব ইউরোপের আটটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই জোট দুটি গঠন করা হয়। ওয়েস্ট ইউরোপের বেশির ভাগ দেশগুলো বেশ দুঃশ্চিতার মাঝে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ভয়ে। না জানি কখন কোথায় আক্রমণ করে! এমন একটি সময় আমেরিকা সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে কৃপণতা করেনি। যে সমস্ত দেশ আমেরিকার সঙ্গে দল বেঁধেছিল তারা একবারও কি ভাবেনি আমেরিকা আটলান্টিক মহাসাগরের অন্য পাড়ে, কেনো তারা আমাদের বন্ধু হতে চায়? কারণ ছিল একটাই তা হলো সুপার পাওয়ার হওয়ার স্বপ্নের বাস্তব বাস্তবায়ন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন, পুরো ইউরোপ এবং এশিয়া ডোমিনেট করবে তা আমেরিকা কখনো মেনে নিতে পারেনি। তাইতো উঠেপড়ে লেগেছে সব সময় পৃথিবীতে শান্তির চেয়ে অশান্তি ডেকে আনতে। আমাদের এশিয়া মহাদেশে পাকিস্তানকে অনেকবার কাজে লাগিয়ে নানা কুকর্মের ব্যবস্থা করেছে আমেরিকা। যাই হোক না কেনো পশ্চিমা ইউরোপ এবং আমেরিকা শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙ্গেচুৱে তছনছ করতে সক্ষম হয়েছে।
প্রথমে মিখাইল গর্ভাচভ, পরে বরিস নিকোলায়েভিচ য়েলৎসিন এবং শেষে পুতিন। সব চলে গেলেও রাশিয়া রয়েছে এখনও। যারা সোভিয়েত ছেড়েছে তারা যোগ দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে। আবার অনেকে যোগ দিয়েছে সেনজেন দেশগুলোর সঙ্গে।
ন্যাটো জোটের মূল উদ্দেশ্য ছিল- তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন সোভিয়েতকে দাবিয়ে রাখতে চেষ্টা করা। অথচ দেখা গেল ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন রাশিয়ার সঙ্গে বেশ ভালো ভাব রেখেছে, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে, বলতে গেলে তাদের মাঝে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এক্ষেত্রে কী মনে হয়? ন্যাটো মেম্বারদের বুঝতে কিছুটা দেরি হলেও তারা তখন সচেতন।
সচেতন জাতি খোঁজে সমাধান। তাই হয়তো গত ন্যাটো জোট তেমন আনন্দময় মুহূর্ত উপহার দিতে পারেনি মিস্টার ট্রাম্পকে। ন্যাটো মেম্বাররা তাকে মাথায় তুলে নিতে পারেনি যে কারণে সবকিছু ফেলে কাউকে না জানিয়ে এবারের ন্যাটো জোট থেকে গোপনে লন্ডন ছেড়েছিলেন আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইতিহাসের পাতা খুঁজলে এমন ধরনের ঘটনা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আরও পড়ুন : কী অবস্থা তরুণ প্রজন্মের?
উপরের বর্ণনায় পরিষ্কার যে পুর পৃথিবীর রাজনীতি কলুষতায় পরিপূর্ণ। নতুন করে ঢালাই করতে হবে বিশ্ব রাজনীতিকে। সময় এসেছে বিশ্বে নোংরামি না চড়িয়ে নিজ নিজ দেশের সমস্যা সমাধানের। পৃথিবীর মানুষ স্বাধীনভাবে বসবাস করতে চায়। হোক না সে বাংলাদেশি বা আমেরিকান তাতে কিছু যায় আসে না।
এবার আসা যাক বাংলাদেশকে নিয়ে। কী অবস্থা বাংলাদেশের? আমাদের জাতীয় সংগীতে একটি লাইন আছে, ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি।’ এর মানে আমরা দেশকেও মা বলে ডাকি বা মাতৃভূমি বলি।
এখন খতিয়ে দেখা যাক, ‘বাংলাদেশ’ নামের মায়ের ছেলেরা কী করছেন। তারা সবাই যে মাতৃভূমির মুখ উজ্জ্বল করছেন তা নয়। বরং যারা ক্ষমতাবান ও ধনবান, তাদের একাংশ বাংলা মায়ের সব ধনসম্পদ বিদেশে পাচার করছেন। অনেকে দেশের কোটি কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে পাচার করে বিদেশে আরামে আছেন, তারাও কিন্তু এই দেশেরই সন্তান! অথচ নিজ দেশকে ঠকিয়ে বা মায়ের বদন মলিন করে তারা দেশকে ধ্বংস করেছে।
সম্প্রতি পত্রিকায় দেখলাম, সোহেল রানা নামে পুলিশের এক এসআই ই-অরেঞ্জ নামে বেনামে ব্যবসা করে মানুষের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন এবং পালাতে গিয়ে ভারতে ধরা পড়েছেন। ধরা পড়ার পর এই পুলিশ কর্মকর্তা বড়াই করে বলেছেন, ১১–১২ বছর তিনি গুলশান এলাকায় চাকরি করেছেন। তিনি সেখানকার সবকিছু সম্পর্কে জানেন। সদ্য সাময়িক বরখাস্ত হওয়া এই কর্মকর্তা বলতে চেয়েছেন, আমি আরও অনেকের অপরাধ সম্পর্কে জানি।
তিনি যদি সবকিছু জানেনই চাকরিতে থাকতে ফাঁস করলেন না কেন? আমি মাত্র দুইজনের কথা উল্লেখ করলাম। আরও অনেক ‘কীর্তিমান’ সন্তান আছেন, যারা মায়ের বদন মলিন হলে আর চোখের জলে ভাসেন না। বরং নিজেদের অপকর্ম দিয়ে বহির্বিশ্বে দেশের বদনাম করেন।
আবার এই বাংলা মায়ের ছেলেরা যখন বিশ্বসেরা ক্রিকেট দলকে হারিয়ে দেন, যখন গণিত অলিম্পিয়াডে স্বর্ণ কিংবা রুপা জয় করেন, তখন গর্বে আমাদের বুক ফুলে যায়। আর যখন এই বাংলা মায়ের কুসন্তানেরা বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেন, তখন লজ্জিত হতে হয়।
লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশে যেমন সুসন্তানেরা আছেন, তেমনি আছেন কুলাঙ্গার সন্তানেরাও। বর্তমান সরকার যেভাবেই হোক ক্ষমতায় এসেছে। সরকারে কাজ কর্মে ভালো মন্দ দুটোই কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে সত্যিকারার্থে বিরোধী দলের কাজ কর্ম দেখে সেটা খুব একটা নজরে পড়ছে না।
বিরোধী দল সরকারের পতন ঘটাতে যা করার সেটা করছে নিশ্চিত। দীর্ঘ এক যুগ ধরে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা দেশের বাইরে থেকে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সরকারের বদনাম আর দেশের মানুষকে উস্কানি ছাড়া আর কী দিয়েছে? বিরোধী দলের সংগঠন অচল, অধম, অপার। সবাই আমরা বলছি এটা কর, সেটা কর, ওটা কর কিন্তু করবে কে? নেতার অভাব নেই, অভাব নেতৃত্বের।
আরও পড়ুন : টেনিস জগতে নতুন ইতিহাসের এক পূর্বাভাস
অন্য দিকে সরকার তার প্রধানকে গণভবনে আটকে রেখে পুরো দেশের পরিকাঠামোকে ধ্বংস করছে। শেখ হাসিনার অবর্তমানে কে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিবে, আছে কি তেমন নেতৃত্ব?
একটি উদাহরণ দেই তাহলে বুঝতে সহজ হবে। আমি খেলাধুলোর জগতের মানুষ কারণ আমার ছেলে-মেয়ে খেলাধুলোর সঙ্গে জড়িত। টেনিসের জগতে তিন থেকে চার জন খেলোয়াড় একটানা একযুগ ধরে টেনিসের শীর্ষস্থান দখল করে আছে। কেউ তাদের পরাজিত করতে পারছে না, শেষে ডেস্টিনির উপর ভরসা করে বসে আছে কবে তারা নিজ থেকে কুইট করবে। প্রতিযোগিতায় মোকাবিলা করতে হয় এটা যারা করতে ব্যর্থ তাদের দ্বারা কিছু হবে বলে আমি মনে করি না।
যে জাতি গানের সুরে মনের কথা বলে ‘জীবনে যদি দ্বীপ জালাতে নাহি পার সমাধি পরে মোর জ্বেলে দিও’ বা ‘আমি দূর হতে তোমারে ভালোবেসে যাব।’ রাজনীতি প্রেম নয় এখানে রয়েছে প্রতিযোগিতা, রয়েছে জয়-পরাজয়। লন্ডনে বসে বিরোধী দলের নেতৃত্ব দেওয়া বা গণভবনে আবদ্ধ থেকে দেশ চালানো স্যাটেলাইট পদ্ধতিতে, কী আশা করতে পারি!
দেশ স্বাধীন হবার পঞ্চাশ বছরে আমরা বিশ্বউন্নয়নের ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি সত্য, তবে সোনার বাংলা গড়তে হলে তাল মিলালে হবে না। কাঁথা বালিশ সেলাই করে বিশ্বসেরা হবার জন্যই কি দেশ স্বাধীন করেছিলাম? শুধু গার্মেন্টস সেক্টরের উপর লির্ভর করে বা বিদেশে নিম্ন মানের কাজ করে দেশের রেমিট্যান্স বৃদ্ধি করে গর্ব বোধ করলেই হবে কি?
আমাদের সঠিক দিক নির্দেশন কী? সেটা যদি এখনও সেই সোনার বাংলা গড়ার দিকনির্দেশনা হয়, তবে প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি ছেড়ে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে এবং সরকারকে সচেতন হতে হবে যাতে করে বিরোধী দলও দেশ গঠনে অংশ গ্রহণের সুযোগ পায়। প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি চলতে থাকলে এবং বিরোধী দল ক্ষমতায় গেলে বর্তমান যারা ক্ষমতায় তারা যখন পরাজিত হবে একই অবস্থা তাদেরও হবে। কেউ কি ভেবেছে অভাগা দেশের কী হবে!
আরও পড়ুন : দেখা হয়েছিল পূর্ণিমা রাতে
এখন মাঝে মধ্যে মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে দেশ স্বাধীন করার পরও যদি পরাধীনতার অভাব হৃদয়ে থেকে থাকে তাহলে কেন এবং কী দরকার ছিল দেশ স্বাধীন করার? সব কিছুর পরও বলতে চাই সুন্দর পৃথিবী গড়তে আমাদের কুৎসিত রাজনীতি নয় দরকার পরস্পরের সমন্বয়। এগ্রি টু ডিজএগ্রির মধ্য দিয়ে ক্রিয়েটিভ পদ্ধতিতে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সবার সর্বাঙ্গীণ প্রচেষ্টা আশু প্রয়োজন।
লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
ওডি/কেএইচআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড