• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘লাবণ্যপ্রভা’-এর তৃতীয় পর্ব

ধারাবাহিক গল্প : লাবণ্যপ্রভা

  সাবিকুন নাহার নিপা

১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৫:৫১
উপন্যাস
ছবি : প্রতীকী

তুনিড় ভাইয়া মালয়েশিয়া থেকে ফিরেছিল ১৪ মাস পর। আর সাথে করে আমার জন্য যে সারপ্রাইজ নিয়ে এসেছিল তার নাম ছিল প্রগতি ফ্রান্সিস।

মালয়েশিয়া যাওয়ার সপ্তাহ খানেক পর থেকে তুনিড় ভাইয়া কেমন বদলে যেতে শুরু করল। আমার সাথে সারাদিনে ফোনে কথা হতো একবার। তাও একটু কথা বলে ফোন রাখার জন্য অস্থির হয়ে যেত। আমি ভেবেছি হয়তো ব্যস্ত তাই। এভাবেই চলছিল মাস দু’য়েক। একদিন আমি বললাম, ‘ভাইয়া তুমি বদলে গেছ, সারাদিনে একবার কথা বলি তাও ফোন রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাও?’ তুনিড় ভাইয়া রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলেছিল, ‘এখানে তো আর ঘোড়ার ঘাস কাটতে আসিনি। আমি পড়তে এসেছি। আর শুধু পড়া না। এখানে আমাকে খেয়ে পরে বেঁচেও থাকতে হবে। আর তার জন্য আমাকে কাজও করতে হবে।’

আমি সেদিন কথাটা এমনিতেই বলেছিলাম। কিন্তু তুনিড় ভাইয়া যে তার উত্তরে এতো শক্ত কথা শুনিয়ে দেবে সেটা আমি ভাবিনি। তারপর আর আমি তুনিড় ভাইয়া ফোন করতাম না। আশ্চর্য ব্যাপার সেও আমাকে আর ফোন দিতো না। দু’দিন তিনদিন পর দায়সারা একবার ফোন দিতো।

তুনিড় ভাইয়া বদলে গিয়েছিল সেটা বুঝতাম কিন্তু ঠিক বিশ্বাস করতে পারতাম না। বিশ্বাস করতে পারতাম না বললে ভুল হবে বিশ্বাস করতে চাইতাম না।

তুনিড় ভাইয়ার আচরণ দিন দিন পাল্টাতে শুরু করল। আর তার সাথে বাড়তে লাগল আমার ডিপ্রেশন। তুনিড় ভাইয়া কি আমাকে ছেড়ে যাবে, তাহলে আমার কি গতি হবে! আমি যে তাকে বিশ্বাস করে সব সপে দিয়েছিলাম!

এই কথাগুলো শেয়ার করার মতো কেউ ছিলো না। বরাবরই নাক উঁচু স্বভাবের কারণে আমার মেয়ে বন্ধু কম ছিলো। তবুও দুই-একজন ক্লাসমেট যারা ছিলো তাদের কাছে ব্যাপারটা শেয়ার করার পর তারা বলেছিল, ‘দেখ পুরুষ মানুষ চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল। এটা মুরুব্বি দের কথা। দেখ ওখানে গিয়ে কাকে না কাকে জুটিয়ে ফেলেছিল।’

আবার কেউ কেউ বলছিল, ওসব পড়াশোনার চাপ বুঝিস তুই! সারাদিন এই ক্লাস ওই ক্লাস, রিসার্চ, তারপর যদি সে পার্টটাইম জব করে তাহলে রেস্ট নেবার টাইম ই তো পায় না। প্রেম করার টাইম কোথায় পাবে!!

আমার কাছে দ্বিতীয় দফার কথাগুলো সেদিন যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল। কেননা তখনও পর্যন্ত নিজের রূপ নিয়ে আমার অহংকার ছিলো। আমাকে রেখেও যে তুনিড় ভাই অন্য কাউকে ভালোবাসবে সেটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।

এরপর তুনিড় ভাইকে আমি নিজেই ফোন করতাম। তুনিড় ভাই কখনো বিরক্ত হতো, কখনো বা ভালো করেই কথা বলতো। আবার মাঝেমধ্যে অকথ্য ভাষায় গালাগালিও করতো। পরে অবশ্য সরি বলতো। আর আমি ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে সব পজিটিভ ভাবে নিতাম।

তারপর এলো সেই দিন। এক বিকেলে মা ঘুম ভাঙিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘লাবণ্য তুনিড়ের সাথে তোমার সব ঠিক আছে তো? কোনো সমস্যা নেই তো?’ আমি চমকে উঠলাম। চমকালাম দুটো কারণে। মায়ের চোখে ছিলো উৎকণ্ঠা। আর মা হঠাৎ কেনই বা তুনিড় ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করবে! আমি কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে?’ মা বললেন, ‘তুনিড় ফিরে এসেছে। তুমি কি সত্যিই জানতে না?’ আমি কিছু না বলে গায়ে ওড়না চাপিয়ে যে পোশাকে ছিলাম সে পোশাকেই বেরিয়ে গেলাম। মা আমাকে বার দুয়েক ডাকল। বলল, ‘লাবণ্য আমার পুরো কথা শুনে যাও। আমি দাঁড়ালাম না। ছুটে গেলাম রাজপুত্রের কাছে।’

রাজপুত্রের কাছে গিয়ে বুঝলাম সে একা আসেনি। সাথে করে নিয়ে এসেছে অচিনপুরের রাজকন্যা। যে আমাকে দেখে মিষ্টি করে হেসে বলেছিল, ‘তুমি বুঝি লাবণ্য?’

অচিনপুরের রাজকন্যার রূপের বর্ণনা দেয়ার ভাষা আমার সত্যিই জানা নেই। আজ এতো বছর পর এসেও মনে হয় সেরকম রূপ আমি আর কারও দেখিনি। প্রগতি ফ্রান্সিস ছিলো হায়দ্রাবাদের মেয়ে। কিন্তু মায়ের বাড়ি ছিলো যশোরে। তাই হয়তো পরিষ্কার বাংলায় কথা বলতে পারতো। যদিও কথা বলতো বাংলিশে।

অচিনপুরের রাজকন্যা লম্বায় ছিলো পাঁচ ফিট চার। কোমর সমান চুলগুলি ছিলো কোঁকড়া। চোখ দুটো বড় আর ভীষণ গভীর। পাতলা ঠোঁট ছিলো হালকা গোলাপি। আর গায়ের রঙ ছিলো গোলাপি ফর্সা। সব মিলিয়ে তাকে দেখলে যে কেউ বলতে পারতো বলিউডের অভিনেত্রী আমাদের পাড়ায় এসেছে। প্রগতির সামনে আমার নিজেকে মনে হলো বাসার কাজের বুয়া। রাতে ঘুমাতে না পেরে চোখে কালি পড়া, এলোমেলো চুল, আর পাটকাঠির মতো শুকিয়ে যাওয়া শরীর।

তুনিড় ভাইয়া আমাকে দেখে একটুও অপ্রস্তুত হলেন না এমন কি বিরক্তও হলো না। স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, ‘প্রগতি ওই লাবণ্য। যার কথা তোমাকে বলেছিলাম।’

আমার তখন চারপাশের কোনো দিকে খেয়াল নেই। কিছুক্ষণ ওখানে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বাসায় ফিরে আসলাম। বাসায় ফিরতেই একটার পর একটা প্রশ্নের মুখে সম্মুখীন হতে লাগলাম। বাবা বললেন, ‘এই ছেলের জন্য নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়েছ। এখন দেখ তার প্রতিদান স্বরূপ কি পেলে।’

মা তেমন কিছু বললেন না। হয়তো সেও মেয়ে বলে আমার দুঃখটা কিছুটা হলেও অনুভব করার চেষ্টা করলেন। মা ঠাণ্ডা গলায় বলেছিলেন, ‘কি হয়েছিল লাবণ্য? তুনিড় যাওয়ার আগে তুমি অসুস্থ ছিলে তখন কি তোমাদের ব্রেকআপ হয়েছিল। আমি কিছু বললাম না।’

পরদিনই জানতে পারলাম তুনিড় ভাই এসেছে বিয়ে করার জন্য। আমি তখন প্রচন্ডরকম অসুস্থ। আমার বাবা সমানে কথা শুনিয়ে যাচ্ছিলেন। অসুস্থতার সময় ঠিক কি ঘটেছিল মনে নেই আমার। শুধু মনে আছে মা সারাক্ষণ আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলতেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে লাবণ্য। আমি নিজে গিয়ে তুনিড়ের সাথে ওর বাবা মায়ের সাথে কথা বলবো।’

আর বাবা সে বলতেন, সব তোমার মেয়ের ভুজুংভাজুং। কিচ্ছু হয়নি। উঠিয়ে দুই-তিনটা থাপ্পড় দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি সুস্থ হলাম সপ্তাহ খানেক এর মধ্যে। তখন পুরোদমে তুনিড় ভাইয়ের বিয়ের আয়োজন চলছে। আর মা আমার সাথে শীতল আচরণ করতে শুরু করল। কিছুদিন আগেও যে আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছিল সে তখন পুরো নীরব।

মোটামুটি চলতে ফিরতে পারি তখন সেরকম একদিন সময়ে মা বলল, ‘সব গুছিয়ে নাও লাবণ্য। তুমি তোমার ছোট খালার বাসায় যাবে।’ আমি কঠিন গলায় বলেছিলাম, ‘যাবনা। তুনিড় ভাইয়ের সাথে কথা বলবো।’ মা আমাকে থাপ্পড় মেরে বলেছিলেন, ‘আরে বোকা মেয়ে তুই তুনিড় ভাইয়া, তুনিড় ভাইয়া করে মরছিস আর সে তো বেমালুম সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে গেছে। বলেছে তোকে সবসময় ছোট বোনের মতো দেখেছে।’

ঘেন্নায় আমার সমস্ত শরীর মন বিষিয়ে গেল। নিজেকে তখন নর্দমার কিট মনে হলো। আমি তখনই বেরিয়ে পড়লাম তুনিড় ভাইয়ের বাড়ির উদ্দেশ্য। বাড়িতে ঢুকে সোজা তুনিড় ভাইয়ের রুমে গেলাম। তুনিড় ভাই তখন বিছানায় আধশোয়া। আর প্রগতি তার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। দু’জনেই ঘনিষ্ঠ ভাবে শোয়া। আমাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। প্রগতি বলল, ‘কারও ঘরে ঢুকতে পারমিশন নিতে হয়। অন্তত দরজায় নক তো করবে!’ আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। আমি চিৎকার করে বললাম, ‘বেজাতের বাচ্চা তুই বের হ এই ঘর থেকে। আমি তুনিড়ের সাথে কথা বলবো।’

প্রগতি আমার আচরণে হতভম্ব হয়ে গেল। সে তখনও দাঁড়িয়ে রইলো। আমি নিজে চুল ধরে রুম থেকে বের করে দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলাম। তুনিড় ভাইয়া আমার কাছ থেকে প্রগতিকে ছাড়াতে এসেছিল কিন্তু পারেনি। ওই সময় মনে হয় আমার উপর পিশাচ ভর করেছিল।

আমি সরাসরি তুনিড় ভাইয়া জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এসবের মানে কি? এতদিন আমার সাথে প্রেম করে এখন ওই খ্রিস্টান টাকে বিয়ে কেন করছ?’ - আমার ইচ্ছে তাই। আমি চিৎকার করে বললাম, সব তোমার ইচ্ছে মতো হবে? ইচ্ছে হলো কাছে আসলাম আর ইচ্ছে হলো দূরে গেলাম? - হ্যাঁ একটা সম্পর্কে ছিলাম। কিন্তু তাই বলে তো আর বিয়ে করবো সেরকম কমিটমেন্ট করিনি। আমার এখন ভালো লাগছে না তাই সম্পর্ক কন্টিনিউ করতে চাইছি না। - বাহ! সেটা আমাকে না জানিয়ে? - হ্যাঁ, মুখে বলিনি। কিন্তু আচরণে প্রকাশ করেছি। বুঝতে না পারলে সেটা তোমার সমস্যা। আমি গলার স্বর স্বাভাবিক করে বললাম, ‘এখন আমাকে পছন্দ না হবার কারণ কি ওই বেজাত মেয়েটা?’ - মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ লাবণ্য। দরজায় তখন আমার মা আর তুনিড় ভাইয়ের মা সমানে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। প্রগতি ডেকে এনেছিল হয়তো।

তুনিড় দরজা খুলতে গেলে আমি তার দুই হাত আমার বড় নখ দিয়ে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিয়ে যখন করবে না তখন আমাকে কেন দিনের পর দিন ভোগ করেছ?’ তুনিড়ের চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তুই কেন তখন বাঁধা দিসনি? তুই তো নিজেই এসেছিলি শরীরের ঝাঁঝ মেটাতে। আরও কতজনের কাছে যে গেছিস কে জানে! না হলে এতো সচেতন ছিলাম তবুও কি করে প্রেগন্যান্ট হলি! সেদিন ই বুঝে গিয়েছিলাম ভাগ্যিস! না হলে তোর মতো বেশ্যা নিয়ে সারাজীবন চলতে হতো!’

আমার তখন কি হলো জানিনা স্যান্ডেল খুলে আমি তুনিড়কে মারতে শুরু করলাম। যতক্ষণ পারলাম জুতা দিয়ে মারলাম। কোনো ভাবে একটু ছাড়া পেতেই সে দরজা খুলল। আমি দৌড়ে গিয়ে গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে হাত কামড়ে ধরলাম। মা আর প্রগতি দু’জন মিলেও আমাকে ছাড়াতে পারছিলেন না। যখন শক্তি শেষ হয়ে গেল তখন ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার মুখের চারপাশে তখনও রক্ত লেগে আছে। চারদিক অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। অজ্ঞান হওয়ার আগে মনে হয়েছিল, ‘রূপসা আপুর কাছ থেকে সেদিন কেন জানতে চাইলাম না তার ব্রেক আপের কারণ’।

আর এখান থেকেই শুরু হলো জীবনের আরেক অধ্যায়।

(চলবে...)

‘লাবণ্যপ্রভা’-এর দ্বিতীয় পর্ব- ধারাবাহিক গল্প : লাবণ্যপ্রভা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড