• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

শামসুর রাহমানের পাঁচটি মুক্তিযুদ্ধের কবিতা

  সাহিত্য ডেস্ক

১৭ আগস্ট ২০১৯, ১১:১২
কবিতা
ছবি : বাংলা সাহিত্যের নাগরিক-কবি শামসুর রাহমান

স্বাধীনতা তুমি

স্বাধীনতা তুমি রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা- স্বাধীনতা তুমি শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা স্বাধীনতা তুমি পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল। স্বাধীনতা তুমি ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি। স্বাধীনতা তুমি রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার। স্বাধীনতা তুমি মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী। স্বাধীনতা তুমি অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক। স্বাধীনতা তুমি বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ। স্বাধীনতা তুমি চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ। স্বাধীনতা তুমি কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা। স্বাধীনতা তুমি শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন। স্বাধীনতা তুমি উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন। স্বাধীনতা তুমি বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ। স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার। স্বাধীনতা তুমি গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল, হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম। স্বাধীনতা তুমি খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা, খুকীর অমন তুলতুলে গালে রৌদ্রের খেলা। স্বাধীনতা তুমি বাগানের ঘর, কোকিলের গান, বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা, যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ? আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?

তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা, সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো, সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর। তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা, শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো দানবের মত চিৎকার করতে করতে তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা, ছাত্রাবাস বস্তি উজাড হলো। রিকয়েললেস রাইফেল আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র। তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম। তুমি আসবে ব’লে, বিধ্বস্ত পাডায় প্রভূর বাস্তুভিটার ভগ্নস্তূপে দাঁডিয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর। তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা, অবুঝ শিশু হামাগুডি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ? আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ? স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুডো উদাস দাওয়ায় ব’সে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নডছে চুল। স্বাধীনতা, তোমার জন্যে মোল্লাবাডির এক বিধবা দাঁডিয়ে আছে নডবডে খুঁটি ধ’রে দগ্ধ ঘরের।

স্বাধীনতা, তোমার জন্যে হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে বসে আছে পথের ধারে। তোমার জন্যে, সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক, কেষ্ট দাস, জেলেপাডার সবচেয়ে সাহসী লোকটা, মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি, গাজী গাজী ব’লে নৌকা চালায় উদ্দান ঝডে রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস এখন পোকার দখলে আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুডে বেডানো সেই তেজী তরুণ যার পদভারে একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হ’তে চলেছে – সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।

পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি তুলে, মতুন নিশান উডিয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক এই বাংলায় তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।

আসাদের শার্ট

গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায় ।

বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষতায় বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।

ডালীম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর- শেভিত মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট শহরের প্রধান সড়কে কারখানার চিমনি-চূড়োয় গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে উড়ছে, উড়ছে অবিরাম আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে, চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।

আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক; আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।

তুমি বলেছিলে

দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার। পুড়ছে দোকান-পাট, কাঠ, লোহা-লক্কড়ের স্তূপ, মসজিদ এবং মন্দির। দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।

বিষম পুড়ছে চতুর্দিকে ঘর-বাড়ি। পুড়ছে টিয়ের খাঁচা, রবীন্দ্র রচনাবলি, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, মানচিত্র, পুরনো দলিল। মৌচাকে আগুন দিলে যেমন সশব্দে সাধের আশ্রয় ত্যাগী হয় মৌমাছির ঝাঁক, তেমনি সবাই পালাচ্ছে শহর ছেড়ে দিগ্বিদিক। নবজাতককে বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত জননী বনপোড়া হরিণীর মত যাচ্ছে ছুটে। অদূরে গুলির শব্দ, রাস্তা চষে জঙ্গী জীপ। আর্ত শব্দ সবখানে। আমাদের দু'জনের মুখে খরতাপ। আলিঙ্গনে থরো থরো তুমি বলেছিলে, ‌'আমাকে বাঁচাও এই বর্বর আগুন থেকে, আমাকে বাঁচাও, আমাকে লুকিয়ে ফেলো চোখের পাতায় বুকের অতলে কিংবা একান্ত পাঁজরে আমাকে নিমেষে শুষে নাও চুম্বনে চুম্বনে।'

দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার, আমাদের চৌদিকে আগুন, গুলির ইস্পাতী শিলাবৃষ্টি অবিরাম। তুমি বলেছিলে আমাকে বাঁচাও। অসহায় আমি তাও বলতে পারিনি।

বন্দী শিবির থেকে

ঈর্ষাতুর নই, তবু আমি তোমাদের আজ বড় ঈর্ষা করি। তোমরা সুন্দর জামা পরো, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ জমাও, কখনো সেজন্যে নয়। ভালো খাও দাও, ফুর্তি করো সবান্ধব সেজন্যেও নয়।

বন্ধুরা তোমরা যারা কবি, স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে আমি বড়ো ঈর্ষান্বিত আজ। যখন যা খুশি মনের মতো শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার তোমরা সবাই। যখন যে শব্দ চাও, এসে গেলে সাজাও পয়ারে, কখনো অমিত্রাক্ষরে, ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনো-বা। সেসব কবিতাবলী, যেন রাজহাঁস দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মানুষের অত্যন্ত নিকটে যায়, কুড়ায় আদর।

অথচ এদেশে আমি আজ দমবদ্ধ এ বন্দী-শিবিরে মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ মনের মতন শব্দ কোনো। মনের মতন সব কবিতা লেখার অধিকার ওরা করেছে হরণ। প্রকাশ্য রাস্তায় যদি তারস্বরে চাঁদ, ফুল, পাখি এমনকি নারী ইত্যাকার শব্দাবলী করি উচ্চারণ, কেউ করবে না বারণ কখনো। কিন্তু কিছু শব্দকে করেছে বেআইনী ওরা ভয়ানক বিস্ফোরক ভেবে।

স্বাধীনতা নামক শব্দটি ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বারবার তৃপ্তি পেতে চাই। শহরের আনাচে কানাচে প্রতিটি রাস্তায় অলিতে-গলিতে, রঙিন সাইনবোর্ড, প্রত্যেক বাড়িতে স্বাধীনতা নামক শব্দটি আমি লিখে দিতে চাই বিশাল অক্ষরে। স্বাধীনতা শব্দ এত প্রিয় যে আমার কখনো জানিনি আগে। উঁচিয়ে বন্দুক, স্বাধীনতা, বাংলাদেশ- এই মতো শব্দ থেকে ওরা আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে সর্বদা।

অথচ জানেনা ওরা কেউ গাছের পাতায়, ফুটপাতে পাখির পালকে কিংবা নারীর দু’চোখে পথের ধুলায় বস্তির দুরন্ত ছেলেটার হাতের মুঠোয় সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড