• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘প্রতিশোধ’ গল্পের চতুর্থ পর্ব

ধারাবাহিক গল্প : ‘প্রতিশোধ’

  রিফাত হোসেন

২০ জুন ২০১৯, ১৬:০৬
গল্প
ছবি : প্রতীকী

তারিন ভিতরে ঢুকে একজন কনস্টেবলকে বলল, ‘ইন্সপেক্টর মাসুদ আহমেদ কোথায়?’

কনস্টেবল একবার তারিনের দিকে তাকালো। তারপর বলল, ‘আপনি কে?’

- অয়ন নামে একজন খুন হয়েছে। সেই ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছি আমি। এই থানা থেকেই আমাকে ফোন করে আসতে বলা হয়েছিল'

- ওহ। আচ্ছা আপনি বসুন আমি স্যারকে ডেকে দিচ্ছি।

- ওকে।

লোকটা চলে গেল মাসুদ আহমেদকে ডাকতে। তারিন চেয়ারে বসে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর মাসুদ আহমেদ এলো। তারিন মাসুদ আহমেদকে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল ওর। মাসুদ আহমেদ ও তারিনকে এখানে আশা করেনি। পলকহীন চাহনিতে তাকিয়ে আছে তারিনের দিকে। মনে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার।

বেশ কিছুক্ষণ পর সে তারিন কে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনি এখানে?’

তারিন কিছুটা ইতস্তত বোধ করল। এই মুহূর্তে কী বলা উচিত সেটা বুঝতে পারছে না ও। মাসুদ আহমেদ একসময় রিফাতের খুব ভালো বন্ধু ছিল। অনেকটা বেস্ট ফ্রেন্ড এর মতো। রিফাতের স্ত্রী হিসেবে তারিনকে খুব ভালো করেই চিনে মাসুদ আহমেদ। সেই মাসুদ আহমেদ আর এই ইন্সপেক্টর মাসুদ আহমেদ যে একি মানুষ তা বুঝতে পারেনি তারিন। আগে থেকে জানলে হয়তো এভাবে আসতো না। এখন নিশ্চয় নানানরকম প্রশ্ন করবেন তিনি। অয়নের সাথে আপনাদের সম্পর্ক কী? ও কে? আপনি ওকে কীভাবে চিনেন? এইসব প্রশ্নের কী উত্তর দিবে তা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না তারিন। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে শুধু।

তারিনকে চুপ থাকতে দেখে মাসুদ আহমেদ আবার বলল, ‘কী হলো বলুন আপনি এখানে কী করছেন? আর মি. অয়নের সাথে আপনার সম্পর্ক কী?’

তারিন তবুও কিছু বলছে না। মাথা তুলে চারিদিকে একবার তাকাল। এরপর করুণ দৃষ্টিতে মাসুদ আহমেদ এর দিকে তাকিয়ে রইল। মাসুদ আহমেদ তারিনের বিষয়টি বুঝতে পেরে বলল, ‘ঠিক আছে আপনি সামনের রেস্টুরেন্টে গিয়ে অপেক্ষা করেন, আমি আসছি।’

তারিন আর ওখানে এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। থানা থেকে বের হয়ে চলে গেল রেস্টুরেন্টে। কিছুক্ষণ পর মাসুদ আহমেদ ও এলো। তিনি এসে তারিনের সামনের চেয়ারে বসে বলল, ‘এবার সত্যি করে বলুন অয়নের সাথে আপনার সম্পর্ক কী?’

দৃঢ় কণ্ঠে তারিন বলল, ‘অয়ন আমার ছোটবেলার বন্ধু।’

রাগান্বিত কণ্ঠে মাসুদ আহমেদ বলল, ‘আমাকে মিথ্যে কথা বলার চেষ্টা করবেন না। আপনি আমার বন্ধুর স্ত্রী বলে এই নয়, আপনি কোনো অন্যায় করলে আমি আপনাকে ছেড়ে দিবো।’

- আমি মিথ্যে কথা বলছি না। আর আমি কোনো অন্যায়ও করিনি। অন্যায় তো করছেন আপনারা, শুধু শুধু আমাকে ডেকে এনে অপমান করছেন। দেখুন, আমিও চাই অয়নের খুনির বা খুনিদের শাস্তি হোক। তাই আমি এসেছি আপনাদের সাথে কথা বলতে। আর আপনি আমাকে ধমকাচ্ছেন এভাবে?

মাসুদ আহমেদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘ঠিক আছে, মেনে নিলাম আপনি কোনো দোষ করেননি। আর অয়ন আপনার ছোটবেলার বন্ধু। কিন্তু অয়নের ফোনে আপনার নম্বরটা জান লিখে সেভ করা কেন? আমাদেরও মেয়ে ফ্রেন্ড আছে। কই আমরা তো কখনো ওদের নম্বর জান লিখে সেভ করিনি। আপনার আর অয়নের বন্ধুত্বের সম্পর্ক এতটাই গভীর যে আপনার নম্বর উনি জান লিখে সেভ করেছেন?’

- কলেজ লাইফ থেকেই অয়ন আমাকে ভালোবাসতো। তখন হয়তো আমার নম্বরটা জান লিখে সেভ করেছিল। কিন্তু আমার বিয়ে হওয়ার পর ওর সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখিনি আমি। ও নিজেও আমাকে আর ফোন দেয়নি। ওর নম্বরটা আমি ডিলিট করে দিয়েছিলাম। কিন্তু ও হয়তো ডিলিট করেনি। তাই সেভাবেই সেভ করা ছিল আমার নম্বরটা।

- কী এমন দরকার ছিল, যার কারণে এতদিন পর দু’জনের মাঝে আবার যোগাযোগ সৃষ্টি হলো?

- মানে?

- মানেটা খুবই সোজা। মি. অয়নের মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেই আপনাকে ফোন দিয়েছিল। এতদিন পর হঠাৎ কেন ফোন দিয়েছিল আপনাকে?

- আসলে হঠাৎ করেই ওর ফোন আসাতে বেশ অবাক হই আমি। চুপ করে শুধু তাকিয়ে ছিলাম ফোন স্ক্রিনের দিকে। বেশ কয়েকবার ফোন দেওয়াতে রিসিভ করতে বাধ্য হই আমি। কিন্তু রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে কান্নাস্বরে ও বলছিল, কেউ ওকে মারার চেষ্টা করছে। বেশ কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে ওর সাথে। বিষয়টি আমি তেমন গুরুত্ব দিলাম না কারণ ওকে কেউ মারার চেষ্টা করলে ও পুলিশকে ফোন না দিয়ে আমকে কেন দিয়েছে! তাই আমি কোনো কথা না বলে ফোন কেটে দিয়েছিলাম। রাতে আর কোনো ফোন আসেনি ওর নম্বর থেকে। সকালে একজন ইন্সপেক্টর ফোন করে বলল অয়নকে কেউ খুন করেছে।

- ঠিক আছে আপনি এখন বাড়িতে যান।

তারিন রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো। সকাল পেড়িয়ে দুপুর হয়ে এসেছে। প্রচণ্ড রৌদ্রের মধ্যেও রাস্তা দিয়ে হাঁটছে তারিন। এমনভাবে হেঁটে যাচ্ছে যেন রৌদ্রের তাপ ওকে স্পর্শ করতে পারছে না। অনুভূতিহীন একটা মানুষের মতো সামনের দিকে তাকিয়ে শুধু হেঁটেই যাচ্ছে৷ এখন আর তারিনের মনে কোনো ভালোবাসা নেই, নেই বেঁচে থাকার কোনো আগ্রহ । শুধু মনের ভিতর একটা অপরাধবোধ কাজ করছে। খুব জঘন্যতম অপরাধ। আজ তারিনের মনে হচ্ছে সেদিন নিয়তিকে মেনে নিয়ে যদি রিফাতের সাথে সুখে সংসার করতাম, তাহলে হয়তো আজ এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না৷ নতুন করে কাউকে আর মরতেও হতো না। আমার ভুলের জন্যই দু’জন মানুষকে হারিয়েছি আমি।

হঠাৎ কারোর কণ্ঠ শুনে তারিনের ঘোর কাটল। পাশে তাকিয়ে দেখে এক মধ্যবয়সী রিকশাওয়ালা। তারিন কিছু না বলে রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা গলায় পেঁচানো গামছাটা হাতে নিয়ে ক্লান্ত মাখা মুখটা মুছতে লাগল। তারিন তবুও কিছু বলল না।

বেশ কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে রিকশাওয়ালা প্রথমে বলল, ‘আপা, এই রৌদ্রের মধ্যে হাঁইটা হাঁইটা কই যাইতাছেন? রিকশায় উঠেন আমি নামাই দিয়া আহি।’

মৃদুস্বরে তারিন উত্তর দিলো, ‘সামনের বাস স্ট্যান্ডে যাবো আমি। তবে এইটুকু পথ হেঁটেই যেতে পারবো। রিকশা লাগবে না আমার।’

তারিনের কথা শুনে রিকশাওয়ালার মুখটা মলিন হয়ে গেল। গামছাটা দিয়ে আবার মুখ মুছে বলল, ‘এই ঢাকা শহরে ছোট্ট একটা রিকশা থেকে যা আয় হয়, তাতে বউ-পোলাপান নিয়া টিকে থাকা খুবই কষ্টের আপা। তার উপর সারাদিনের আয়ের অর্ধেক টাকা আবার রিকশার মালিকরে দেওয়া লাগে। দিন শেষে হাতে মাত্র তিন থেকে চারশো টাকা নিয়া ঘরে যাই। ঘরে দুইটা ছেলে আছে। একজন কলেজে পড়ে, আরেকজন স্কুলে পড়ে। আমি একা মানুষ হয়ে ওদের খরচ চালাইতে গিয়া হিমশিম খাই। তাও থেমে থাকি নাই, প্রতিদিনই এই রিকশা নিয়া বাইর হই রাস্তায়। কারোর কাছে দশটাকা বেশি চাইতে পারি না। বড়লোকদের কাছে ঠাট্টার কথা হইলেও এইডাই সত্যি যে, আমার মতো গরীবের ও আত্মসম্যানে লাগে অন্যের কাছে হাত পাততে। তাই যেটুকু কামাই, তা নিয়েই খুশি থাকি। আজ সকাল থেকে তেমন ক্ষ্যাপ পাই নাই। আপনারে দেখলাম রৌদ্রের মধ্যে হাঁটতাছেন, তাই জিজ্ঞেস করলাম। সমস্যা নাই আপা, সামনের দিকে গিয়ে দেখি কোনো ক্ষ্যাপ পাই নাকি।’

রিকশাওয়ালা আর কোনো কথা বলল না। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে সামনের দিকে যেতে লাগল। তারিন একবার ফোন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নিলো। তারপর ওই রিকশাওয়ালাকে ডাক দিলো। তারিনের ডাক শুনেই রিকশাওয়ালা থেমে গেল। তারিন তার দিকে এগিয়ে গেল। রিকশাওয়ালা সেই ক্লান্তময় মুখে বলল, ‘কিছু কইবেন আপা?’

- আসলে ভেবেছিলাম অনেকটা সময় এখনো হাতে আছে। তাই হেঁটেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু এখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি একদম সময় নেই। তাই ভাবলাম রিকশা দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবো।

তারিনের কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো রিকশাওয়ালা। তারিন মুগ্ধ হয়ে রিকশাওয়ালার স্বার্থহীন হাসির দিকে তাকিয়ে রইল। তারিন এই হাসিই শেষ দেখেছিল রিফাতের দুই ঠোঁটের কোণে।

রিকশাওয়ালা বলল, ‘কী হইলো আপা, উঠেন আপনারে নামাই দিয়া আহি।’

- হ্যাঁ উঠছি।

তারিন রিকশায় ওঠে বসল। রিকশাওয়ালা খুশি মনে সামনে চলতে শুরু করল। তারিন মনে মনে বলল, ‘ কারোর উপকারে আসতে পারা যে এতটা আনন্দের, এতটা শান্তির আগে বুঝতে পারিনি। আমার এই সামান্য টাকা ছাড়া যে রিকশাওয়ালা কিংবা তাঁর পরিবার বাঁচতে পারবে না এমনটা নয়। কিন্তু এই সামান্য টাকা কিছুটা হলেও তাঁর উপকারে আসবে।’

তারিন মাথা নিচু করে এইসব কথা ভাবছিল। হঠাৎ রিকশাওয়ালার কথায় সামনের দিকে তাকাল। রিকশাওয়ালা আবার সেই হাসি দিয়ে বলল, ‘আপা, আইসা পড়ছি স্ট্যান্ডে।’

তারিন বলল, ‘আমি এখানে নামবো না। আপনি সামনের স্ট্যান্ডে নিয়ে চলুন আমাকে।’

- আপনি তো বললেন এই স্ট্যান্ডে নামবেন। আপনার তো খুব তাড়াতাড়ি যাইতে হইবো। রিকশায় গেলে তো আপনার দেরী হইয়া যাইবো।

- সমস্যা নেই। আপনি সামনের স্ট্যান্ডে চলুন।

- আচ্ছা।

রিকশাওয়ালা আবার চলতে শুরু করল। সামনের স্ট্যান্ডে গিয়ে রিকশা থেকে নামল তারিন। ভাড়া মিটিয়ে স্ট্যান্ডে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। রিকশাওয়ালা টাকাটা শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে চলে গেল। তারিন ইচ্ছে করেই এমনটা করেছে। আগের স্ট্যান্ডে নামলে তারিন আরো আগে গাড়িতে উঠতে পারতো। কিন্তু সেটা না করে রিকশা দিয়েই এই স্যান্ডে এসেছে। যাতে লোকটার আরো কিছু টাকা আয় হয়।

মোবাইলটা বের করে আবার সময়টা দেখে নিলো তারিন। তারপর বলল, ‘এখনি সামনের শপিংমল থেকে ড্রেসটা চেঞ্জ করে নেই। পরে হয়তো আর চেঞ্জ করার সময় পাবো না।’

শপিংমল থেকে ড্রেস চেঞ্জ করে নিলো তারিন। ড্রেস চেঞ্জ করা বলাতে শুধু কালো বোরকাটা পরেছে আরকি, যাতে কেউ চিনতে না পারে। স্ট্যান্ডে এসে গাড়িতে উঠল।

(চলবে....)

‘প্রতিশোধ’ এর তৃতীয় পড়ুন- ধারাবাহিক গল্প : ‘প্রতিশোধ’

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড