রিফাত হোসেন
হঠাৎ তারিনের ফোন বেজে উঠল। পুরোনো ভাবনা বাদ দিয়ে ফোনের দিকে তাকালো তারিন। অয়নের নামটা ভেসে উঠেছে ফোনের স্ক্রিনে। চোখটা মুছে ফোনটা রিসিভ করল তারিন।
ওপাশ থেকে অয়ন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘তারিন, আমার মনে হচ্ছে বড় কোনো গণ্ডগোল হয়েছে।’
- মানে?
- সেদিন রিফাত সত্যি সত্যিই মারা গিয়েছিল তো? আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকে বেশ কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে আমার সাথে। আর প্রতিটি ঘটনায় আমাকে জানান দিয়েছে যে রিফাত এখনো বেঁচে আছে।
- কী কী অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে তোমার সাথে?
- ফোনে এতকিছু বলা যাবে না। কাল সকালে ওই রেস্টুরেন্টে আবার দেখা করবো আমরা।
- ঠিক আছে।
ফোন রেখে দিলো তারিন। অয়নের সাথে কী হয়েছে এই নিয়ে বিরাট একটা ভাবনায় পড়ে গেল ও। ভাবতে ভাবতে একটাসময় দুই চোখের পাতা এক হয়ে যায়।
সকালে ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আবার। অয়ন ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করে তারিন ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ, বল।’
ফোনের ওপাশের মানুষটার কথা শুনে তারিনের বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। সকালবেলা এইরকম একটা কথা শুনবে ভাবতে পারেনি তারিন। মুহূর্তের মধ্যেই পৃথিবী যেন উলোটপালোট হয়ে গেল। ফোনটা কেটে দিয়ে বিছানায় ধুপ করে বসে পড়ল তারিন। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না? একবার মনে হচ্ছে অয়নের কাছে যাওয়া দরকার, আবার মনে হচ্ছে ওখানে গেলে নিজেই ফেঁসে যাবে। তখন ওর দিকেই নানানরকম প্রশ্ন আসবে। কী উত্তর দিবে ও?
বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে চলে গেল তারিন। দীর্ঘক্ষণ মাথায় পানি ঢালার পর আবার ঘরে এলো। তখনই হঠাৎ করে ফোনটা বেজে উঠল ওর। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে অপরিচিত একটা নম্বর। ফোনটা তাড়াতাড়ি করে রিসিভ করল তারিন। ওপাশ থেকে পরিচিত এক কণ্ঠে বলল, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না মিসেস তারিন?’
আমতাআমতা করে তারিন বলল, ‘আমার কষ্ট হবে কেন? আর কে আপনি?’
- তুমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছ আমি কে? তবুও কেন জিজ্ঞেস করছ? হয়তো বিশ্বাস করতে পারছ না, তাই না। যাকে নিজের চোখের সামনে খুন হতে দেখেছো। চোখের সামনে যার শরীরে কাফনের কাপড় পেঁচাতে দেখেছো, সে কীভাবে ফিরে এলো? এটাই ভাবছ তাই না।
তারিন কিছু না বলে চুপ করে রইল। ওপাশ থেকে আবার বলল, ‘এখনো বসে আছো কেন? যাও, তোমার ভালোবাসার মানুষের কাছে যাও।’
অবাক কণ্ঠে তারিন বলল, ‘এইসব কী বলছেন আপনি?’
পৈশাচিক এক হাসি দিয়ে ফোনের ওপাশের লোকটা বলল, ‘একটু আগেই তো একজন ইন্সপেক্টর তোমাকে ফোন করেছিল। আর তিনি বলেছে, রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্ট এর নিচে একটা লাশ পাওয়া গেছে। তাঁর মোবাইল থেকে একটা নম্বর পাওয়া গেছে, নম্বরটা জান লিখে সেভ করা ছিল। আর কালকে রাতে শেষ কলটাও ওই নম্বরেই করেছিল। আর ওই নম্বরটা তো তোমার। সো ইন্সপেক্টর তোমাকে সন্দেহ করছে এবং খুব তাড়াতাড়ি থানায় যোগাযোগ করতে বলেছে।’
- আপনি এত কিছু কীভাবে জানেন?
- সেটা না হয় সময় হলেই জানতে পারবে। আপাতত এইটুকু জেনে রাখো, আমার হাত রেখে তুমি বাঁচতে পারবে না।
তারিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিলো লোকটা। হতভম্ব হয়ে বসে রইল তারিন।
কালো বোরকাটা ব্যাগে ভরে ঘর থেকে বের হলো তারিন। ড্রয়িংরুমে মিসেস রোকসানা বসে বসে টিভি দেখছে। তারিন তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মা, আমি এক ফ্রেন্ডের বাসায় যাবো। ওদের বাসায় দাওয়াত আছে আমার। অনুষ্ঠান তো রাতে হবে, কিন্তু ও বলেছে আমি সকালেই যেন ওর বাসায় চলে যাই। তাই এখন বের হচ্ছি। আর খাওয়া দাওয়া শেষ করতে অনেক রাত হয়ে যাবে। আমি বরং কালকে সকালে বাড়িতে চলে আসবো।’
- ‘নিঝুমকে সাথে নিয়ে যাও, না হলে আমি খুব চিন্তায় থাকবো।’
তারিন মিসেস রোকসানার পাশে বসে বলল, ‘আসলে মা, ও তো আমাকে একাই যেতে বলেছে। এখন নিঝুমকে নিয়ে গেলে ব্যাপারটা কেমন দেখায় না। তাছাড়া আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ও আমার ছোটবেলার বন্ধু৷ এখান থেকে কিছুটা দূরেই ওর শ্বশুর বাড়ি। ওখানেই অনুষ্ঠানটা হবে।’
- ঠিক আছে সাবধানে যেও।
- আচ্ছা।
তারিন বাড়ি থেকে বের হয়ে ওই ইন্সপেক্টর এর নম্বরে ফোন দিয়ে বলল, ‘স্যার আমি কি এখন থানায় আসবো?’
ওপাশ থেকে ইন্সপেক্টর বলল, ‘না। লাশ তো পোস্টমর্টেম করতে নিয়ে গেছে। এখন থানায় গিয়ে লাভ নেই।’
- তাহলে আমি কী করবো এখন?
- আপনাকে একটা ঠিকানা এসএমএস করে পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি। যেখানে লাশটা পাওয়া গেছে আরকি, সেখানে চলে আসুন আপনি। আমি ওখানেই আছি।
- আচ্ছা
ইন্সপেক্টর এর দেওয়া ঠিকানায় তারিন চলে গেল। জায়গায়টা তারিনের খুব পরিচিত। এখানেই শেষ কথা হয়েছিল রিফাতের সাথে। আবার এখানেই ওর ভালোবাসার মানুষ অয়ন, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। বেশ অদ্ভুত বিষয়টা। রিফাতের সাথে শেষ দেখা আর অয়নের খুন, দু’টো ঘটনায় কী কোনো গভীর রহস্য আছে, নাকি পুরোটাই কাকতালীয় ব্যাপার।'
ইন্সপেক্টর এর কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ল তারিনের। ইন্সপেক্টর বলল, ‘আপনি আমার সাথে আসুন। লাশটা যেখানে পাওয়া গেছে, সেই স্থানে আপনাকে নিয়ে যাই।’
- হুম।
ইন্সপেক্টর আরও কিছুটা সামনে এগিয়ে গেল। তারপর বলল, ‘এখানেই ছিল লাশটা। কেউ বা কারা, হিংস্র পশুর মতো শরীর থেকে মাংস খুবলে নিয়েছে। শরীরের চামড়াগুলো ও কেটে কেটে আলাদা করেছে। এদিক সেদিক রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই রাস্তাটা বেশ নির্জন। দিনেরবেলায় কিছু স্থানীয় লোক চলাচল করলেও রাতের বেলা কেউ চলাচল করে না বললেই চলে।’
তারিন কিছু না বলে চুপ করে আছে। কারণ, ও আগে থেকেই জানে এই রাস্তাটা নির্জন। অন্ধকার রাতে এই রাস্তাটা জনশূন্য অবস্থায় থাকে। পাশের এই ল্যাম্পপোস্ট, এই রাস্তা, কিছুটা এগিয়ে গেলে সামনের বাড়িটাসহ সব কিছুই তারিনের খুবই পরিচিত।
তারিনকে চুপ থাকতে দেখে ইন্সপেক্টর বলল, ‘কী হলো চুপ করে আছেন যে?’
আমতাআমতা করে তারিন বলল, ‘না মানে ভাবছিলাম এই খুনটা কে করতে পারে?’
- আপনার কী কাউকে সন্দেহ হয়?
- না আমার কাউকে সন্দেহ হয় না। আচ্ছা আপনি যা জিজ্ঞাসা করবেন তাড়াতাড়ি করুন। আমাকে বাড়িতে যেতে হবে।
- আমি তো কিছু জিজ্ঞেস করব না। এই কেইস তো আমার দায়িত্বে পড়েনি। এটা ইন্সপেক্টর মাসুদ আহমেদ এর দায়িত্বে পড়েছে। যা জিজ্ঞেস করার উনিই করবে।
- তাহলে আপনি আমাকে এখানে আসতে বললেন কেন?
মৃদু হাসি দিয়ে ইন্সপেক্টর বলল, ‘এই এলাকাটা আমার আন্ডারে পড়েছে। তাই আমাকেই এইসব দেখতে হচ্ছে। কিন্তু উপরমহল থেকে মাসুদ আহমেদ স্যারকে এই কেইসের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর মাসুদ স্যারই বলেছেন আপনাকে এই জায়গাটা একবার দেখাতে। ততক্ষণে তার হাতে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ও এসে যাবে।’
- ঠিক আছে। যা করার একটু তাড়াতাড়ি করেন, আমার কাজ আছে।
- আপনি এখন থানায় চলে যান। সেখানেই পেয়ে যাবেন মাসুদ স্যারকে।
- আচ্ছা।
তারিন সেখান থেকে চলে এলো। থানায় ঢুকতে যাবে তখনই পিছন থেকে কেউ একজন ডাক দিলো। তারিন পিছনে তাকিয়ে দেখে রিফাতের বোন নিঝুম। নিঝুমকে এখানে দেখে বেশ অবাক হয় তারিন। সাথে কিছুটা ভয় ও পাচ্ছে কারণ বাড়িতে বলে এসেছে ও ফ্রেন্ড এর বাসায় যাবে। এখন যদি জানতে পারে ও ফ্রেন্ড এর বাসায় না থানায় গিয়েছিল, তাহলে নানানরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে ওকে।
নিঝুম তারিনের কাছে এসে বলল, ‘ভাবী তুমি এখানে কী করছ?’
- আমার একটু কাজ ছিল এখানে।
- থানায় আবার তোমার কী কাজ থাকতে পারে?
- আসলে আমি এক ফ্রেন্ড এর বাসায় যাচ্ছিলাম। ওর স্বামী এই থানার ইন্সপেক্টর। কোনো একটা ঘরের চাবি ওর স্বামী সাথে নিয়ে এসেছে। সেটা এখন ওর দরকার। তাই আমাকে বলল যাওয়ার সময় যেন চাবিটা নিয়ে যাই।'
- আমি আসবো তোমার সাথে?
- না না, আমি একাই পারবো। তুমি বরং তোমার কাজে যাও।
- ঠিক আছে।
নিঝুম আর কোনো কথা না বলে সেখান থেকে চলে এলো। কিছুদূর যাওয়ার পর আমার পিছনে তাকিয়ে দেখে তারিন নেই। হয়তো থানার ভিতরে চলে গেছে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো নিঝুম। তারপর রহস্যময় একটা হাসি দিলো। আর মনে মনে বলল, ‘খেলা তো জমবে কাল সকালে। যখন পরের ব্রেকিং নিউজ পাবে। তোমার জন্য আরও বড় ধাক্কা অপেক্ষা করছে ভাবী। শুধু দেখে যাও কী হয়?’
নিঝুম সেখান থেকে একটা রিকশা নিয়ে চলে এলো। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা বাড়ির সামনে রিকশা দাঁড় করিয়ে একটা নম্বর ফোনে ডায়াল করল।
ওপাশ থেকে ছেলে কণ্ঠে একজন বলল, ‘হুম। আমি তিন’তলায় আছে।’
মুচকি হাসি দিয়ে নিঝুম বলল, ‘ঠিক আছে।’
রিকশা ভাড়া মিটিয়ে নিঝুম বাড়ির ভিতরে ঢুকল।
(চলবে.....)
‘প্রতিশোধ’ এর দ্বিতীয় পড়ুন- ধারাবাহিক গল্প : ‘প্রতিশোধ’
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড