নাবিলা বুশরা
১৯৮৫ সাল। ‘কথার কথা’ নামক একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান। গ্রন্থনায় হানিফ সংকেত। সে অনুষ্ঠানে কোনো এক পর্বে হানিফ সংকেত স্বকন্ঠে ‘নামটি ছিল তার অপূর্ব’ নামক একটি গান গেয়েছিলেন। আর সে গানের ভিডিওতে মাদকাসক্ত এক ছেলের ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া নিয়ে অভিনয় করেন ইমন নামের এক তরুণ। মিউজিক ভিডিওটি সে সময় জনপ্রিয়তা পেলেও নিয়মিত পর্দায় না আসায় দর্শক তাকে সেভাবে মনে রাখেনি। তার কয়েক বছর পর তিনি আব্দুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজনায় ‘পাথর সময়’ নাটকে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে অভিনয় জগতে পা রাখেন। এরপর কাজ করেন আরও বেশ কিছু নাটক আর বিজ্ঞাপনচিত্রে।
সেই সময়ে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আনন্দ মেলা তিনটি জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার (‘সনম বেওয়াফা’, ‘দিল’ ও ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’) কপিরাইট কিনে নেয়। তারা পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানকে এগুলোর যে কোনো একটির গল্প নিয়ে বাংলা সিনেমা পুনঃনির্মাণ করার কথা বলেন।
কিন্তু সে সময় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এ ধরনের রোমান্টিক ধাঁচের সিনেমাতে অভিনয়ের জন্য উপযুক্ত কোনো জুটি তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। নতুন মুখের সন্ধান শুরু হল। নায়িকা হিসেবে সে সময়ের জনপ্রিয় মডেল মৌসুমীকে নির্বাচন করা হলেও নায়কের দেখা পাচ্ছিলেন না পরিচালক।
সে সময় সোহানকে ইমনের সন্ধান দেন কাশনুর আলমগীর (আঁখি আলমগীরের মা)। সোহান তাকে দেখা করতে অফিসে আসতে বলেন। ইমন তার সাথে দেখা করার জন্য যখন দরজা দিয়ে তার অফিসে ঢুকছিলেন, তখনই তিনি বুঝে ফেলেন তিনি তার নায়ক পেয়ে গেছেন।
এরপর তিনি ইমনকে ‘সনম বেওয়াফা’ ছবির জন্য প্রস্তাব দিলে ইমন তাতে রাজি হননি। ইতোমধ্যে ২৬ বার দেখে ফেলা আমির খান ও জুহি চাওলা অভিনীত ওইসময়ের অন্যতম সুপারহিট হিন্দি সিনেমা ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ সিনেমাটিই যেন তাকে টানছিল বেশি।
শেষ পর্যন্ত সোহান ইমনকে দিয়ে নির্মাণ করেন ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ চলচ্চিত্রটি। এক সময়ের শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন পরবর্তীতে পরিচিতি পায় সালমান শাহ নামে। কোটি ভক্তের হৃদয় জয় করা এই নায়ক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক নতুন অধ্যায় শুরু করেন যার পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে শুধু লেখা ছিল সালমান শাহ’র নাম।
‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ চলচ্চিত্রটি মুক্তির পর সালমান শাহকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৯৩-৯৬ পর্যন্ত এই চার বছরে ২৭টি সিনেমায় অভিনয় করেন সালমান শাহ। এবং তার প্রত্যেকটি সিনেমাই ছিল ব্যবসাসফল।
সালমান শাহের চলচ্চিত্র জীবনের কিছু খন্ড চিত্র :
কেয়ামত থেকে কেয়ামত :
বিগ বাজেটের বলিউড সিনেমার রিমেক হলেও ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমাটিকে এখনও জানা হয় বাংলা সিনেমার মাস্টারপিস হিসেবে। দুই তরুণ-তরুণীর প্রেম আর সর্বশেষ অভিজাত দুই পরিবারের দ্বন্দের কারণে দুইজনের করুণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া সিনেমাটি দর্শকদের চোখ ভেজা অবস্থায় বাড়ি ফিরতে বাধ্য করে। প্রথম সিনেমাতেই দর্শকের ভালোবাসা আর ভালোলাগায় পরিণত হন সালমান শাহ।
সালমান শাহের পাশাপাশি এই সিনেমায় প্রথমবারের মত প্লে-ব্যাক গায়ক হিসেবে নাম লেখান আগুন। তার গাওয়া ‘বাবা বলেছে ছেলে নাম করবে’, ‘ও আমার বন্ধু গো’, ‘এখন তো সময়’ শিরোনামের গানগুলো সে সময়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তো বটেই এখনও সবার মুখে মুখে ঘুরে ফিরে গানগুলো। এই সিনেমার মোট আয় ছিলো ৮ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। যা এখন পর্যন্ত অনেক সিনেমার জন্যই ঈর্ষণীয়।
অন্তরে অন্তরে :
শিবলি সাদিক পরিচালিত ‘অন্তরে অন্তরে’ সিনেমাটি ছিল সালমান শাহ ও মৌসুমী অভিনীত ২য় জনপ্রিয় সিনেমা।
এ সিনেমাতে ধনী গরীবের অসম প্রেমকাহিনীর শেষ মুহুর্তের মিলন দর্শকদের হলে আটকে রেখেছিল পুরোটা সময়ই। প্রথম সিনেমায় দুইজনের বিয়োগান্তক ঘটনা দর্শক মেনে নিতে পারেননি বলেই হয়ত এ সিনেমায় তাদের আকর্ষণ ছিল অনেক বেশি। এ সিনেমার গানগুলোও সে সময় তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
তুমি আমার :
কোনো এক অজানা কারণে হঠাৎ সালমান আর মৌসুমী একসাথে সিনেমা করতে রাজি হননি। তাদের নিয়ে সিনেমা তৈরি করতে চাওয়া অনেক পরিচালকই তখন বিপাকে পড়ে যান।
এরই মাঝে প্রবীণ পরিচালক জহিরুল হক সালমান শাহ আর নবাগত শাবনূরকে নিয়ে নির্মাণ করেন ‘তুমি আমার’ সিনেমাটি। এ সিনেমাটি ছিল পুরোটাই রোমান্টিক একটি সিনেমা যেখানে সালমান বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করা কাপড়-চোপড়, গাড়ী ইত্যাদি ব্যবহার করে নিজেকে একজন ধনীর ছেলে হিসেবে শাবনূর এর সামনে তুলে ধরেন যা পরবর্তীতে প্রকাশ পায় সম্পূর্ণ মিথ্যে ও অভিনয়। পরিচালক অসাধারণ দক্ষতায় প্রতিটি চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
এ সিনেমার ‘জ্বালাইয়া প্রেমের বাত্তি’, ‘আমার জন্ম তোমার জন্য’ শিরোনামের গানগুলো সে সময় তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।
মজার বিষয় হচ্ছে, সে সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণরা কিন্তু শাবনূরকে দেখার জন্য নয়, সিনেমা দেখতে যেতেন সালমান শাহকে দেখার জন্যই!
দেনমোহর :
১৯৯৫ সালের রোজার ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলোর মধ্য অন্যতম ছবি ছিল শফি বিক্রমপুরি পরিচালিত ‘দেনমোহর’ ছবিটি।
বিক্ষোভ :
রোমান্টিক নায়ক হিসেবে ক্রেজ তৈরি করা হার্টথ্রব নায়ক সালমান শাহ নিজেকে এ সিনেমায় প্রকাশ করেন অ্যাকশন ছবির নায়ক হিসেবে।
‘বিক্ষোভ’ এর মধ্য দিয়ে কিভাবে মেধাবী ছাত্রদের রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন সেই সত্যিকারের চিত্রটি পরিচালক মোহাম্মদ হান্নান সাহসের সাথে ফুটিয়ে তোলেন এ যেন আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মম সত্যিকারের চিত্র।
এ সিনেমা মুক্তির সময় টিকিটের মূল্য ছিল অন্য বারের তুলনায় কিছুটা চড়া। তবু তাতে ব্যবসায় কোনো ভাটা পড়েনি। কারণ দর্শক শুধু একবার হলেও সালমান শাহকে দেখার জন্য হলে ছুটে যেতেন।
সালমান শাহের আরও কিছু সিনেমার পোস্টার :
স্বপ্নের ঠিকানা
সত্যের মৃত্যু নেই
তোমাকে চাই
বুকের ভিতর আগুন
ব্যক্তি সালমান :
১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন সালমান শাহ। কমর উদ্দিন চৌধুরী ও নীলা চৌধুরী দম্পতির বড় ছেলে। ১৯৯২ সালে সামিরার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি।
সালমান শাহ এবং সামিরা
অল্প সময়ের অভিনয় জীবনে ২৭টি সিনেমার মাধ্যমে নিয়মিত পর্দায় এসেছেন সালমান শাহ। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অসংখ্য ভক্তকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে যান তিনি। রাজধানী ঢাকার ইস্কাটনে নিজ বাস ভবনে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় সালমানের লাশ পাওয়া যায়। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হলেও তার মৃত্যুর রহস্য আজও রহস্য হয়েই আছে।
সালমান শাহের মৃত্যুর পর আনন্দযাত্রার কোনো এক সংখ্যার প্রচ্ছদ
পারিবারিক জীবনে তো বটেই বন্ধুদের কাছেও তাদের ইমন ছিল বেশ ভালোবাসার একজন মানুষ। জানা যায়, তার নজরুল নামে একজন বন্ধু ছিলো। সালমান মারা যাওয়ার পর যে শুধু পাগলের মতো এফডিসির সামনে ঘুরে বেরাতো। ফারুক নামে আরেকজন বন্ধু ছিলো সালমানের। তার মৃত্যুর পর সে-ও কোথাও যেন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
অল্প সময়ের অভিনয় জীবনে সালমান অসংখ্য ভক্ত রেখে গেছেন। কখনো বড় চুল, কানে দুল, চোখে সানগ্লাস, মাথায় ক্যাপ পরা ছেলেটিকে এখনও ভক্তরা খুঁজে ফেরে। সে সময় যারা হলে গিয়ে সালমানের সিনেমা দেখে চোখ ভিজিয়ে ঘরে ফিরতেন তারা এখনও বলে ওঠেন, ‘আর একবার ফিরে আসা যায় না সালমান?’
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড