রহমান মৃধা
রহস্য নিয়ে যদি ধ্যানে মগ্ন হতে ইচ্ছে করে তবে কোন ছেলে হাফপ্যান্ট পরল বা কোন মেয়ে বোরকা পরল এটা ধ্যানের বিষয়বস্তু হওয়া উচিৎ নয়- বরং ভূপৃষ্ঠের আলো, বাতাস, পানি, মাটি, তাপমাত্রা, অন্ধকার কী, কেন, কখন, কী জন্য এটাই ধ্যানের বিষয়বস্তু হওয়া উচিৎ। কিছু দিনের মধ্যেই দেখবেন মনের দরজা খুলতে শুরু করেছে।
আমাদের দেহের ভিতরের যে কারুকাজগুলো রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা হবে। সর্বশেষে নিজের অস্তিত্ব যখন পরিষ্কার হতে থাকবে তখন ধীরে ধীরে স্রষ্টা এবং তার রহস্য সম্পর্কে একটি ধারণা গড়ে উঠবে। তখন কে মাথা ঢাকল, কে হাফপ্যান্ট পরল বা কার বুকের উপর কাপড় রাখল না এসব জিনিস খুবই তুচ্ছ মনে হবে।
আজ নৈশভোজে গত দিনের রান্না করা খাবারের কিছুটা যা অতিরিক্ত ছিল খেয়েছি। আমি গ্রামের ছেলে, ছোট বেলা থেকেই মাছ, ডাল সবজি, গোসত এসব খেতে অভ্যস্ত। সুইডেনে প্রায় চল্লিশ বছর বসবাস সত্ত্বেও সেটা দিনে একবার খেতে হবেই।
তাছাড়া খাবার ফেলতে মায়া লাগে যখন ভাবি অনেকের দুবেলা খাবার জোটে না অথচ আমি যদি সেটা ফেলে দেই তাহলে কেমন হয়! বিবেকের কারণে সেগুলো নষ্ট না করে খেতে চেষ্টা করি। কিছু কিছু খাবার আছে যেমন ডাল কোনোভাবেই সহ্য করতে পারিনে, যদি তা একদিনের জন্য হলেও পুরনো হয়। পুরনো রান্না ডাল খেলে ঘুম হবে না, অস্থিরতা দেখা যাবে, গলাবুক জ্বলবে ইত্যাদি।
সবাই এখন দিব্যি ঘুমাচ্ছে আমি বসে লিখছি। ঐযে পুরনো ডাল খেয়েছি। অন্ধকারে ড্রয়িং রুমে টেলিফোনের স্ক্রিনে দিব্যি লিখছি। চারিপাশে অন্ধকার অথচ টেলিফোনের পর্দাটি আলোকিত, চমৎকার এক পরিবেশ ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর।
কে হাফপ্যান্ট বা বোরকা পরল না, সেটা নিয়ে কত ভাবনা! অথচ একদিনের বাসি ডাল খেলাম সঙ্গে সঙ্গে পুরো রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে গেল!
প্রতিদিনই খাবার খাই, দিব্যি চলছে কখনো ভাবা হয় না, যেমন খাবার যে খেলাম এখন, এ খাবার কখন, কোথায়, কী পরিমাণ শক্তি যোগায় এবং কীভাবে কী হচ্ছে পেটের মধ্যে কখনো ভাবিনে, ভাববার সময় নেই। তবে সমস্যা হলে ডাক্তার, কবিরাজ, ওষুধ, বাথরুমে দৌড়াদৌড়ি, সে এক নান্ডিভাস্টি ব্যাপার। তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
দেশে প্রচণ্ড খরা বা মুষলধারে বৃষ্টির কারণে চাষাবাদ বন্ধ, সমস্যা। হঠাৎ সব ঠিক হয়ে গেল, সমাধান। মহামারি রোগ এসেছে, সমস্যা। টিকা উদ্ভাবন হলো, সমাধান। সমস্যা যে কোনো সময়, যে কোনো মানুষের বা জনগোষ্ঠীর মাঝে আসতে পারে, তবে সমাধান খুঁজতে বা করতে যারা আজীবন সংগ্রাম করে চলছে তাদের সারিতে আমাদের ঢুকতে হবে।
আমরা বলতে আমি বাংলাদেশিদের কথা বলছি। আমরা এখনও অবধি কিন্তু ব্যস্ত শুধু পেটের ক্ষুধা মিটাতে। সমাজে যে আমাদের হাজারও সমস্যা রয়েছে তারও তো সমাধান করা দরকার।
আরও পড়ুন : ওয়েলসে দুই রমণীর সঙ্গে একরাত
জাতি হিসাবে আমাদের হাজারও সমস্যা রয়েছে তবে বিশেষ কয়েকটি সমস্যা নিয়ে আমি আলোচনা করবো যেমন বেকারত্ব, দুর্নীতি ও মানবিক অবনতি।
বেকারত্ব
দেশের ফকির মিসকিন থেকে শুরু করে মুচি, মেথর, ঝাড়ুদার পর্যন্ত পেশাদারি মানুষগুলো পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়াই এ ধরণের কর্মে লিপ্ত হয়ে যায় জন্মের শুরুতে। এরা সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে, সত্ত্বেও এদেরকে মানুষ বলে পরিচয় দিতে আমাদের সম্মানে বাধে। তবে এরা কখনো বেকার থাকে না। কারণ এরা সব সময় কিছু না কিছু করে।
কিন্তু দেশের শিক্ষিত শ্রেণির প্রায় ৭০% লোকই বেকার। এরা কিছুই করে না, এদের কাজ শুধু কাজ খোঁজা, কে ঘোমটা মাথায় দিয়ে চলল, কে হাফপ্যান্ট পরল, কে কী করল এসব দিকে কড়া নজর রাখা, সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি করা, বসে বসে অন্ন ধ্বংস করা ইত্যাদি।
অশিক্ষিত লোক কখনো বেকার থাকে না কারণ তারা সমাজের অবহেলিত কাজগুলো শুরু থেকেই করতে শুরু করে। শিক্ষিত লোকের হয়েছে যতো জালা। লেখাপড়া শিখেছে ছোটখাটো কাজ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয় তবে অকাম কুকাম করাতে সমস্যা নেই। যেমন দুর্নীতি, অনীতি।
দুর্নীতি
আরও পড়ুন : পরের পিছে না লেগে নিজের চরকায় তেল দাও
দুর্নীতি করে কারা? সমাজে যার যতো ক্ষমতা বেশি সে ততো অকাম কুকাম করে, বিশেষ করে বাংলাদেশে। এদের সবারই কম বেশি শিক্ষা রয়েছে। ভিক্ষুকের সঙ্গে এদের হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া গেলেও কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। মিলটা হচ্ছে এরা পরস্পরের বন্ধু। যেদেশের মানুষ যত বেশি কালপ্রিট, ধুরন্দার, বাটপার, ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ সেদেশে বেশি ভিক্ষুকের পরিমাণ বাড়ে। কারণ এ ধরনের অন্যায়কারীরা ভিক্ষুককে দান খয়রাত করতে পছন্দ করে, বিবেকের কাছে ভালো থাকার জন্য। বাংলাদেশে ভিক্ষুকের পরিমাণ বেশি থাকার প্রধান কারণ সেখানে দুষ্ট লোকে ভরা।
মানবিক অবনতি
যে সমাজে মানুষ মানুষকে সাহায্যের নামে ভিক্ষা দেয় সে সমাজে মনুষ্যত্বের অবক্ষয় ঘটে। সমাজের দৈনিক শিক্ষায় রয়েছে সমস্যা। কারণ পুঁথিগত বিদ্যায় মনুষ্যত্বের ছোঁয়া নেই, সেখানে শিক্ষা সাধারণত কর্মের উপর দেওয়া হয়। কিন্তু মানুষ মানুষের জন্য এ শিক্ষা নিজ নিজ পরিবার থেকে হওয়ার কথা এবং সেটাই হচ্ছে। প্রশ্ন হতে পারে কীভাবে?
বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজে কয়জন আছে যে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে- আমি কাজের লোককে পরিবারের অন্যান্যদের মতো দেখি বা ট্রিট করি?
ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? কী শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে ঘরে? শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে কিভাবে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করতে হয় এবং সেটা করছে কে? আমি, তুমি এবং সে। মানে? আমরা।
আরও পড়ুন : দেখা হয়েছিল পূর্ণিমা রাতে
উপরের এই তিনটি সমস্যার সমাধান করতে পারলে আমার মনে হয় না আমাদের হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, মুসলিম, লাট, ব্যারিস্টার, মন্ত্রী, জেনারেল, আইজিপি, সচিব, ফকির, মেথর ইত্যাদি পরিচয় থাকবে। আমাদের পরিচয় হবে একটি; আমরা মানুষ।
লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
ওডি/কেএইচআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড