• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ (২৬তম পর্ব)

  রিফাত হোসেন

২৬ নভেম্বর ২০১৯, ১৩:০৩
গল্প
ছবি : প্রতীকী

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রোদ অবাক হয়ে বলল, ‘কাশেম তুই এখানে? তোর তো সায়েমের উপর নজর রাখার কথা ছিল। কিন্তু সেটা না করে তুই গেছিলি কই?’

কাশেম অপরাধীর মতো চেহারা করে বলল, ‘মাফ করেন ভাইজান। আমি সায়েম ভায়ের অফিসের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু হুট কইরাই আমার আম্মা অসুস্থ হয়ে যায়। বাড়ি থেকে ফোন পেয়েই আমি ওখান থেকে চলে যাই। তারপর বাড়িতে এসে দেখি মায়ের অবস্থা খারাপ। তাই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু মারে হাসপাতালে রেখে যখন আমি বাইরে আইলাম। তখন কোত্থেকে জানি সায়েম ভাই এসে আমারে মারতে শুরু করল। তারপর আমারে গাড়িতে উঠাইয়া জেরা করল। কি আর করমু ভাইজান, জানের ডর তো আমারও আছে৷ তাই আর কোনো উপায় না পাইয়া সব বলে দিয়েছি। আর উনারা সেগুলো রেকর্ড করে নিছে।’

রোদ বিড়বিড় করে বলল, ‘স্টুপিড কোথাকার।’

পাশ থেকে সায়েম বলল, ‘কাশেম, স্রষ্টা বড়ই অদ্ভুত। তিনি কখন কি করে বসেন সেটা কেউই জানে না। তিনি যা চান, সেটা তিনি করেনই। এই যেমন দেখ, তোমার মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেল। এর কারণ হতে পারে স্রষ্টা রোদের অন্যায় মেনে নিচ্ছিল না। আর রোদের অন্যায়ের মোকাবেলার জন্য আমাকে প্রয়োজন। সেজন্যই তোমার মা অসুস্থ হলো হঠাৎ। এরপর আমাকে অফিসের বাইরে বের হওয়া থেকে শুরু করে তোমার সাথে দেখা এবং এখানে এসে এইসব কাণ্ড ঘটানোর ক্ষমতা দিয়েছেন। রাফার সাথে আমার বিয়ের সব চক্রান্ত এই রোদ করেছে। এর একটাই কারণ, ও আমাকে আমার ভালোবাসার মানুষকে পেতে দিবে না। তাই নানানরকম প্ল্যান করে রাফা আর কাশেমকে নিজের দলে নিয়ে এইসব করেছে। এই কাজে রাজি হওয়ার পিছনে রাফার উদ্দেশ্য ছিল আমাকে পাওয়া। আর কাশেম রাজি হয়েছে টাকার জন্য। গোপনে গোপনে আমার আর রাফার কিছু ছবি তুলেছে লোক লাগিয়ে। সেগুলো আমার বাবা-মাকে দেখিয়েছে। ফলস্বরূপ ওদের ফাঁদে পা দিয়েছে আমার বাবা-মা। এদের প্রথম প্ল্যান সাকসেসফুল হওয়ার পর দ্বিতীয় প্ল্যান সাকসেসফুল করার জন্য কাজ শুরু করে দেয়। আমাকে সারাক্ষণ নজরে রাখে। বাড়িতে রাফা, অফিসে রোদের ঠিক করা একটা লোক, আর অফিসে বাইরে আগে কাশেম আমার উপর নজর রাখতো। কিন্তু এই কয়দিন অন্যজন ছিল। অফিসে ইতির সিভি দেখে এইসব পরিকল্পনা করে রোদ। ও খুব ভালো করেই জানতো ইতি ওদের অফিসে জব পাবেই। ঠিক তাই হলো। জব পেয়ে গেল ইতি। অফিসে জয়েন্ট করার দিন থেকেই ইতিকে বিরক্ত করা শুরু করে রোদ। কিন্তু এতে তো ওর প্রতিশোধের আগুন নিভবে না। আর এই প্রজেক্টের কাজে চট্টগ্রাম ইতিকে আসতেই হতো। রোদ সবকিছু রেডি করেই রেখেছিল। কাজী সাহেবও এসেছে। কিন্তু ওর উদ্দেশ্য তো শুধু ইতিকে বিয়ে করা নয়। তাই ইতিকে শায়েস্তা করার জন্য ওর নামের পাশে প্রতারক শব্দটা লাগাচ্ছিল। আরও খারাপ কিছু বলতো নিশ্চয়ই, কিন্তু এর আগেই তো আমরা এসে গেছি।’

সায়েমের কথা শেষ হতেই মিস্টার চৌধুরী রেগে-মেগে বলে উঠল, ‘ও যখন ইতির নামে খারাপ কথা বলছিল, তখন আমার ইচ্ছে করছিল বন্দুকটা এনে ওর মুখ দিয়ে পরপর কয়েকটা গুলি ঢুকিয়ে দেই। বাট আমি তোমাদের অপেক্ষায় ছিলাম।আমি বিশ্বাস ঘাতকতা একদম সহ্য করতে পারি না। তাই হুটহাট কাউকে বিশ্বাস ও করি না। কিন্তু এই রোদকে করেছিলাম। কারণ ও বিশ্বাস করার মতো যোগ্যতা দেখিয়েছিল। বাট ও আমার সাথে এইরকম করল। আমি ভাবতেই পারছি না রোদ এত নৃশংস মানসিকতার মানুষ। ওকে আর সহ্য করতে পারছি না আমি। আমি এক্ষুনি পুলিশ ডাকছি। ওর কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আমি করব। আমিও দেখব ও কার ক্ষমতায় শাস্তি ছাড়া জেল থেকে ছাড়া পায়।’

রোদ ওঠে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে ইতির সামনে এসে করুণ কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করে দাও ইতি। তুমি তো জানো আমি এইসব কেন করেছি? তুমি অন্তত বুঝবে আমার কষ্টটা।’

ইতি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আমি আপনাকে পুলিশের দেবো না রোদ। এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন৷ কারণ আপনার অপরাধ জগতে আসার পিছনে আমার অবধান আছে কিছুটা। কিন্তু আপনার অপরাধটা গুরুতর। আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করার কোনো উদ্দেশ্য আপনার ছিল না। আমার জীবনটা নষ্ট করে দেওয়াই আপনার উদ্দেশ্য ছিল। আর ভাইয়ার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছেন আপনি। এটাও অনেক বড় অপরাধ। তবুও আপনাকে আমি পুলিশে দেবো না। আরেকটা সুযোগ আপনি পাবেন। তবে আমার একটা শর্ত আছে।’

রোদ ভ্রু-কুঁচকে বলল, ‘কীসের শর্ত?’

- আমি আপনাকে আমার আত্মীয় করতে চাই। খুবই গভীর আত্মীয়।

ইতির কথা শুনে সবাই ভ্রু-কুঁচকালো। সায়েম সামনে এসে বলল, ‘এইসব কি বলছিস তুই?’

ইতি সায়েমের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হেসে দিলো। রোদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি আজ থেকে আমার বাবা।’

সায়েম আবার ফাহাদ ড্যাবড্যাব করে তাকালো ইতির দিকে। ইতি আবার বলল, ‘যদিও কথাটা বলতে আমার লজ্জা লাগছে খুব। তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, কিছুদিন পরই আমার আর ফাহাদ ভাইয়ার বিয়ে হবে৷ আমি চাইলে আপনাকে ভাই বানিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু সেটা করা যাবে না। কারণ আমি আমার হবু স্বামীকেও ভাইয়া বলে ডাকি। আমার নিজের বাপটা খুবই বজ্জাত। আমাকে শুধু বকা দেয়। কিন্তু আপনি অনেক ভালো। অনেক হ্যান্ডসাম। কিছুটা শয়তান বটে। বাট আমার বাবার থেকেও স্বভাবের দিক দিয়ে ভালো। তিনি সারাদিন বকবক করেন। তাই আমি চাই আজ থেকে আপনি আমার আরেকজন বাবা। কাকা বলেও ডাকতে পারি। আমার কোনো সমস্যা নেই। আপনি যাকে বিয়ে করবেন, তাকে আমি মা, কিংবা কাকি বলে ডাকবো। ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর, তাই না? আমার বাবা। নিজের বাবা না অবশ্য। বাট ওই যে হয় না, পাতানো বাবা। সেরকম আরকি। পাতানো বাবা, আপনি প্লিজ তাড়াতাড়ি বিয়ে করে একটা পাতানো মা উপহার দিন আমাকে। আর হ্যাঁ, বাবা হয়ে মেয়ের সাথে খারাপ কিছু করার চেষ্টাও করবেন না আর।’

ফাহাদ আর সায়েম শব্দ করে হেসে উঠল। মিস্টার চৌধুরী মুখ চেপে হাসলেন। ইতি রোদের দিকে তাকালো। রোদের মুখটা একদম ছোট্ট হয়ে গেছে। খুবই অসহায় লাগছে ওকে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেঁদে দিবে। যাকে কিছুক্ষণ আগেও বিয়ে করার স্বপ্ন দেখেছে, তাকে এখন মেয়ের চোখে দেখতে হচ্ছে। ভাবা যায় এগ্লা। কিয়েক্টাবস্থা!

ইতি রোদের কাছে এসে বলল, ‘কি মিস্টার রোদ, মেয়ে হিসেবে আমাকে মেনে নিয়েছেন তো?’

রোদ এবারও কোনো কথা বলল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ও। হয়তো অনুশোচনা হচ্ছে৷ নিজের অন্যায়টা উপলব্ধি করতে পারছে৷ প্রতিশোধ নেওয়ার আগ্রহ থাকা ভালো। স্বাস্থ্যের পক্ষে না হলে মানসিক ভাবে ভালো। এতে মনের ভিতরের ক্ষোভটা কমে গিয়ে, তাকে একটা নতুন মস্তিষ্ক দেয়। বিকজ সে নিজের প্রতিশোধ নিতে পেরেছে। কিন্তু সেই ব্যক্তিটি যখন ক্ষমা চেয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়, তখন উচিত তাকে ক্ষমা করে দেওয়া। কারণ ক্ষমা করে দেওয়াটা এর থেকেও উত্তম। এতে এপার-ওপার, দুই পারেই মানসিক ভাবে ভালো থাকা যায়। মস্তিষ্ক হয় স্বাধীন। ইতি ক্ষমা চেয়েছিল আগেই। কিন্তু রোদের ক্ষোভের পরিমাণ এতই বেশি ছিল যে, ক্ষমা করে দেওয়ার কথা চিন্তা-ও করেনি।

রোদ হঠাৎ মৃদু হাসি দিলো। সায়েম বলল, ‘এভাবে হাসার কারণ কি মিস্টার রোদ? তোমার সময়টা তো এখন খারাপ যাচ্ছে। তোমার হাসিটা ভিন্ন হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল।’

রোদ আবারও সেভাবে হেসে দিয়ে বলল, ‘হাসির মাঝেও ভিন্নতা খুঁজছেন।’

- অবশ্যই। হাসি কয়েক ধরনের হতে পারে। এই যেমন তুমি হঠাৎ করে মুচকি হাসি দিলে, এর মানে হলো তুমি কিছুটা লজ্জা অনুভব করছ। বা তুমি একটু বেশিই আনন্দিত, কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে চাচ্ছ না। আর থামাতেও পারছ না। যার ফলস্বরূপ এই মুচকি হাসি বের হয়। এরপর ধর তুমি উচ্চস্বরে হেসে উঠলে। এর মানে হলো তুমি ইচ্ছে করেই হাসতে চাচ্ছ। বা কেউ তোমাকে হাসাচ্ছে। আর তুমি যেই হাসিটা দিলে, সেটা হলো মৃদু হাসি। এই মৃদু হাসির অর্থ হলো, তোমার মনের ভিতর শয়তানি কিছু চলছে। অথবা তুমি কিছুটা তাচ্ছিল্যের চোখে দেখছ কোনো কথা। এক কান দিয়ে ঢুকালে, অন্য কান দিয়ে বের করে দিলে। যেমন ইতির কথাটা তুমি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলে। আর সেজন্যই তোমার এই মৃদু হাসি। এই হাসিগুলো নিয়ে অনেক গবেষণা করেছি আমি। এত সহজে এটা ভুল হবে না।

রোদ চুপ করে গেল। আর এতেই সবাই বুঝে গেল সায়েমের কথা একদম ঠিক। সবাই কিছুক্ষণ চুপ করেই রইল। হঠাৎ সায়েম বলল, ‘শোন মিস্টার রোদ, কাশেমের কাছ থেকে আমি শুনেছি তুমি কেন আমাদের সাথে এইরকম করেছ। আমি মানছি ইতি তোমার সাথে অন্যায় করেছে। বাট ও আবার ক্ষমাও চেয়েছে। কিন্তু তুমি ওকে ক্ষমা না করে প্রতিশোধের নেশায় মেতে উঠলে। এটা তোমার অন্যায়। তুমি আবার এখন আমাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছ, তাই আমরা তোমাকে ক্ষমা করে দিচ্ছি। তোমার মতো করে আমরা আবার প্রতিশোধ নিলে হয়তো বাইরে থেকে শান্তি পেতাম। বাট আমাদের মানসিক চাপ থাকতো । তাই আমরা সেরকম কিছুই করলাম না। তোমার একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ আছে। আমি আশা করব ভবিষ্যতে এমন কিছু করবে না, যার দ্বারা পুনরায় এইরকম মুহূর্তের মুখোমুখি হতে না হয় আমাদের। এতে তোমার এবং আমাদের জন্য ভালো হবে না।’

রোদ মাথা নিচু করে বলল, ‘আচ্ছা।’

যদিও রোদ মুখে ‘আচ্ছা’ বলল। কিন্তু ওর মনে কি আছে, সেটা ও ছাড়া এই পৃথিবীর আর কেউই বলতে পারছে না। সায়েম নিজের মনে মনে বলল, ‘তোমাকে এত সহজে আমি ছাড়তাম না রোদ। আমি জানি এত সহজে রোদ হেরে যাবে না। হয়তো নতুন কোনো প্ল্যান করছ। কিন্তু তোমাকে এখন কোনোভাবেই পুলিশে দেওয়া যাবে না। তাহলে রাফা এর সাথে জড়িয়ে যাবে। আর কাশেমের মা অসুস্থ। যত খারাপ কাজই করুক, ও ছোট থেকেই আমাদের সাথে আছে। ও মা আমাদের পরিচিত। তার কথাও ভাবতে হবে।’

ইতির কথায় সায়েম রোদের দিকে ফিরে তাকালো। ইতি বলল, ‘রোদ, আমি জানি আপনি এবার ভালো হয়ে যাবেন। বাবার মতো শ্রদ্ধেয় একজন নিশ্চয়ই মেয়ের মতো স্নেহের একজনের ক্ষতি করবে না।’

রোদ চুপচাপ এখনো। সায়েম আর সময় নষ্ট না করে মিস্টার চৌধুরীকে বলল, ‘স্যার, এবার আমরা রওয়ানা দেই। আর রোদকে একটা সুযোগ দিন।’

মিস্টার চৌধুরী বলল, ‘বিশ্বাস ঘাতককে আমি সুযোগ দেই না কখনো। আমার মতে বিশ্বাস ঘাতকতার থেকে বড় অপরাধ আর নেই। তাই রোদকে ক্ষমা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়।’

- ও তো নিজের ভুল স্বীকার করে নিয়েছে স্যার।

- ওর পোস্টের চাকরিটা তো পার্মানেন্ট ছিল। তাই হুট করে তো আর চাকরি খেয়ে দিতে পারি না৷ তাই ও চাকরি করবে। বাট আগের সেই বিশ্বাস আর পাবে না।

অগত্যা আর কোনো উপায় না পেয়ে ওরা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো।

রাত ১২ টার সময় ফাহাদ একটা ধাবায় গাড়িটা ব্রেক করল। জয় আর আবির কোনোদিকে না তাকিয়েই ভিতরে গিয়ে খাবার অর্ডার দিয়ে দিলো। সায়েম ওদের পিছনে পিছনে গেল। ফাহাদ গাড়িটা একপাশ করে রেখে গাড়ি থেকে নামলো। চারিদিকে নিস্তব্ধ আর শুনশান একটা পরিবেশ। কোথাও কোনো কোলাহল নেই। মাঝে মাঝে দূরে কোথাও থেকে কুকুরের ডাক ভেসে ভাবছে। ইতি শরীরটা কেমন যেন ছিমছাম করছে। ফাহাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ও। সবাই ভিতরে থাকলেও ওরা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন যেন একটা ভয় ইতির মনের ভিতর বাসা বেধেছে। ভয়টা কিছুতেই সরাতে পারছে না মন থেকে। একেবারে গেঁথে গেছে। ফাহাদ ইতিকে আনমনে দেখে এগিয়ে এলো। ইতিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে, ইতির গালের সাথে নিজের গাল মেশালো। ফাহাদের গালের দাড়ির খোঁচা খেয়ে আচমকা ঘাবড়ে গেল ইতি। পিছনে তাকিয়ে ফাহাদকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ফাহাদ ভাইয়া তুমি। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম।’ ফাহাদ ইতিকে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে নিলো। গাড়ির একপাশে হেলান দিয়ে, ইতির দুই পাশের কোমড়ে হাত দিলো। ইতিকে উঁচু করে জড়িয়ে ধরল। ইতি তাকালো ফাহাদের চোখের দিকে৷ ফাহাদের চোখের রংটা খুবই গাঢ়। সাদাটুকু একেবারে সাদা। আর কালোটুকু একেবারে কালো কুচকুচে। বেশ ভালোই লাগে ফাহাদের এই চোখের দিকে তাকাতে। ফাহাদ যখন ইতির দিকে তাকায়, তখন ইতির মনে হয় ফাহাদ ওকে চোখ দিয়েই গিলে খাবে। ফাহাদ মানুষ হিসেবেও বেশ অদ্ভুত। হাজারো কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা সে রাখে৷ দুঃখ, কষ্ট যেন তার জীবনের সঙ্গী। সেজন্যই তো ইতি কখনো ফাহাদের সাথে উঁচু গলায় কথা বলে ওকে কষ্ট দেয় না। ওর কথার অবমাননা করে না। সবসময় ভালোবাসা দিয়ে ফাহাদকে খুশি করার চেষ্টা করে। ফাহাদের প্রতি ইতির যেমন ভালোবাসা আছে, তেমনি আছে শ্রদ্ধাবোধ। সেজন্য নিয়ম করে সম্মানের সাথে সালাম দিয়ে কথা বলে সবসময়। অত্যন্ত ভদ্র ও শালীনতা বজায় রেখে কথা বলে। ইতির এই দিকগুলো ফাহাদেরও বেশ ভালো লাগে। হঠাৎ ফাহাদ বলল, ‘এত ভয় পাচ্ছ কেন? সব তো মিটে গেছে। ভুলে যাও ওসব। আমরা সবাই আছি তোমার পাশে। তুমি জানো, তোমার বিপদের কথা শুনে আবির আর জয় শত ব্যস্ততার মাঝেও ছুটে এসেছে। ওরা তোমাকে নিজেদের বোনের মতোই ভালোবাসে। এতগুলো মানুষ তোমার পাশে আছে সারাক্ষণ। তোমার কিছুই হবে না ইতি।’

- বাট আমি যে রোদকে ভুলতে পারছি না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এত সহজে ও সবটা মেনে নিবে না। ও তোমারও ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে লাগবে এখন থেকে।

- আহা। এইসব আর মনে করে টেনশন করো না তো। অন্যসব কথা ভাবো। এই যে এতগুলো মানুষের সামনে তুমি বলে দিলে কয়েকদিনের মধ্যে তোমার আর আমার বিয়ে হবে। এই কথাটা বলতে গিয়ে কী একটুও লজ্জা পাওনি তুমি? সত্যি বলতে তখন আমি একটু লজ্জা পেয়েছিলাম। কারণ তোমার মুখ থেকে কথাটা শোনার পর কেউ কেউ আড়চোখে আমাকে দেখছিল।

ইতি মুচকি হাসি দিয়ে ফাহাদের কপালের সাথে নিজের ঠোঁট ঠেঁকালো। আস্তেধীরে ফাহাদের থুতনির কাছে নিজের মুখটা নিয়ে এলো। দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বলল, ‘দেখি তো, এবার আমি লজ্জা পাই কি-না।’

কথাটা শেষ করতেই ফাহাদের থুতনিতে আলতো করে কামড় বসিয়ে দিলো ইতি। ফাহাদ ‘উফ’ একটা শব্দ করে ইতির দিকে অবাক হয়ে তাকালো। ইতি ফাহাদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো। ধাবার ভিতরে তাকিয়ে দেখে আবির আর জয় রাক্ষসের মতো খাচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্য, ওদের ডাকতেই ভুলে গেছে সবাই। আসলে ক্ষিদের পেটে নিজের বাবা-মাকেও ভুলে যায় অনেকে। আর এটা তো মাত্র খাওয়া কথার।

ফাহাদ ইতিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘চলো আশেপাশে একটু হাঁটাহাঁটি করি।’

ইতি অবাক হওয়ার মতো করে বলল, ‘সে-কি! তোমার কী ক্ষিধে পায়নি?’

- পেয়েছে তো।

- তাহলে দাঁড়িয়ে আছ কেন? চল ভিতরে যাই।

- বাইরে এত সুন্দরী একটা যুবতী মেয়ে থাকতে কোন দুঃখে আমি ভিতরে গিয়ে ওইসব ছাইপাঁশ খাবো।

- মানে কী?

ফাহাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্রিয়তমা, আমি যে তোমাকে মন ভরে খেতে চাই৷ একটু একটু করে খাবো। যাতে সারাজীবনেও শেষ না হয়।’

ইতি নাক-মুখ কুঁচকে বলল, ‘ছি, তুমি একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে খাওয়ার চিন্তা করছ। তোমাকেও শায়েস্তা করা প্রয়োজন। রোদকে তো বাবা বানিয়ে দিলাম। তা তোমাকে কী বানাবো বলো তো?’

- আমাকে স্বামী বানাও।

ইতি লজ্জা পেলো। যদিও লজ্জা পাওয়াটা উচিত হয়নি। কিন্তু লজ্জা তো আর কোনো রুলস মেনে পায় না মানুষ। তাই ইতি লজ্জা ঢাকতে প্রতিউত্তরে কিছু না বলে ধাবার ভিতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। ফাহাদ খপ করে ইতি হাতটা ধরে বলল, ‘আরে যাচ্ছ কোথায়? একবেলা না খেলে মোটা হয়ে যাবা না। অবশ্য আরেকটু মোটা হলে তোমাকে আরো আকর্ষণীয় দেখতে লাগবে।’

ইতি ‘ধ্যাত’ বলে রোদের হাত ধরে হাঁটতে লাগল। চাঁদের আবছায়া আলোয় হাঁটছে ওরা। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে চারিপাশটা। হঠাৎ যদি কোনো অঘটন ঘটে। ইতির বুকটা চিনচিন করে উঠল।

সায়েম জয়কে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এতক্ষণ হয়ে গেল, অথচ ইতি আর ফাহাদ ভিতরে আসছে না। ওরা কী ভুলে গেছে খাওয়াদাওয়া শেষ করে তাড়াতাড়ি আমাদের ফিরতে হবে ঢাকায়।’

জয় আর আবির কোনো উত্তর দিলো না। ওরা খাওয়ায় ব্যস্ত। অগত্যা সায়েম গাড়ির কাছে এলো। কিন্তু গাড়ির ভিতরে তো দূরে থাক, আশেপাশের কোথাও ওদের দেখতে পেলো না সায়েম। হঠাৎ ওর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। বিপদের আভাস পাচ্ছে সায়েম। এখন সায়েমের মনে হচ্ছে রোদ নিজের ভুল বুঝতে পারেনি। ওটা ওর নাটক ছিল। সায়েম প্রথমেই ফাহাদকে ফোন দিলো৷ কিন্তু ফাহাদের ফোনটা বন্ধ পেলো৷ সায়েম বেশ চিন্তিত হয়েই ইতির নম্বরে ফোন দিলো। কিন্তু ফোনটা গাড়ির ভিতরে বেজে উঠল। সায়েম ছলছল চোখে চারিদিকে তাকালো বেশ কয়েকবার। কিছুক্ষণ পর জয় আর আবির এলো। সায়েম ওদের নিয়ে ধাবার চারিদিকটা তন্নতন্ন করে খুঁজল৷ কিন্তু পেলো না। সায়েম আবিরকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে বলল - " আমার খুব বড় ভুল হয়ে গেছে আবির। ওদেরকে একা ছাড়া উচিত হয়নি আমার। আমার বুঝা উচিত ছিল রোদ এত সহজে দমে যাবে না। অন্তত ওর এইসব নিখুঁত প্ল্যান দেখে আমার এটা বুঝা উচিত ছিল। আমি নিশ্চিত রোদ ওদের দু'জনের কোনো ক্ষতি করে দিয়েছে।"

আবির আর জয় সায়েমকে সান্ত্বনা দিতে লাগল৷ কিন্তু সান্ত্বনা দিলে তো আর ওরা ফিরে আসবে না। এটা খুব ভালো করেই জানে সায়েম। তাই বারবার ডুকরে কেঁদে উঠছে।

(চলবে...)

আরো পড়ুন ২৫তম পর্ব- ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড