• মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৪ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ (২৫তম পর্ব)

  রিফাত হোসেন

২৫ নভেম্বর ২০১৯, ১৩:৫৮
গল্প
ছবি : প্রতীকী

মিটিং শেষ আবারও রিসোর্টে ফিরে এলো সবাই। ইতি রিসোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর পাশে মিস্টার চৌধুরী এবং রোদ। রোদ বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে ইতির দিকে। ব্যাপারটি ইতির বেশ দৃষ্টিকটু লেগেছে। এভাবে তাকিয়ে থাকার কি আছে ও বুঝতে পারছে না। লোকটা যে প্রচণ্ড রকমের লুচ্চা, সে ব্যাপারে ইতি পুরোপুরি নিশ্চিত। এর প্রমাণও পেয়েছে বেশ কয়েকবার। প্রায় অধিকাংশ মানুষই টুকটাক লুচ্চামি করে বটে, তবে রোদ মাত্রাতিরিক্ত। ইতির ধারণা লুচ্চামিতে রোদের কম করে গেলেও হাজারটা ডিগ্রি আছে। নাহলে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে এভাবে ওর দিকে তাকাতে পারতো না। রোদ ওর পুরো শরীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, এটা ভাবতেই ইতি বিব্রত হচ্ছে বারবার। যদিও যথাসম্ভব ও নিজেকে আড়ালে রাখছে। তবুও এতগুলো ডিগ্রি তো আর সে এমনি এমনি পায়নি। নিশ্চয়ই কঠিন কঠিন টেকনিক তার জানা আছে। সন্ধ্যা হয়েছে অনেকক্ষণ। মিটিং অনেকটা সময় ধরে চলেছে। ইতি ভাবতে পারেনি জীবনের এই প্রথম মিটিংটাই এতটা লম্বা সময় নিয়ে হবে। রোদ যখন প্রেজেন্টেশন দিচ্ছিল, তখন ইতির মনে হয়েছিল, রোদ অত্যন্ত ভালো মনের একজন মানুষ। কেমন দায়িত্ব নিয়ে সবার সামনে নিজের প্রেজেন্টেশন দিচ্ছিল। কিন্তু না, রোদের মুখে ছিল এক, আর মনে ছিল আরেক।

ইতি মিস্টার চৌধুরী এবং রোদের কাছ থেকে কিছু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। বেশ শীতল বাতাস বইছে। শরীরে শিরশিরে অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে। ইতি ফোনটা হাতে নিলো। ফোনটা এখন অফ করা আছে। এখন অবশ্য অন করাই যায়। কোনো বাধা নেই। ইতি ফোন অন করার আগে একবার পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখল। তারপর মৃদু হাসি দিয়ে বলল, ‘আমি যেখানেই থাকি না কেন, শকুনের চোখের মতো এক জোড়া চোখের দৃষ্টির আড়াল হতে পারব না। হুম পারব, কিন্তু সেটা তখনই, যখন ওই চোখ জোড়াই থাকবে না। শালা রোদের বাচ্চা।’

রোদ ইতির পাশে এসে দাঁড়াল। ইতি কিছুটা সরে গিয়ে রোদের থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘মিটিং তো শেষ, এবার ঢাকার উদ্দেশ্যে যাওয়া যাক।’

রোদ হেসে দিয়ে বলল, ‘এখনি চলে গেলে স্পেশাল মুহূর্তগুলো যে মিস করবে ইতি।’

ইতি অবাক হয়ে বলল, ‘স্পেশাল মুহূর্তগুলো মানে?’

রোদ ঘাড় বাঁকা করে তাকালো ইতির দিকে। অন্ধকারের মধ্যে ল্যাম্পপোস্ট এর আবছায়া আলোয় রোদের চোখ জোড়া চকচক করতে দেখল ইতি। ভ্রু জোড়া কুঁচকানো। চুলগুলো বাতাসে এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি করছে। মুখে একটা মায়াবী ভাব আছে৷ কিন্তু মাথায় সবসময় কু-বুদ্ধি ঘুরাঘুরি করে। লোকটা অসম্ভব হ্যান্ডসাম। বাট মানসিকতা অবিশ্বাস্যকর ঘৃণ্য। নাহলে এভাবে কারোর পিছনে লাগে! ইতি ওর প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগল। স্পেশাল মুহূর্ত বলতে কি বুঝাচ্ছে রোদ? কিন্তু না, ও যে উত্তর দেবে সেরকম কোনো লক্ষ্মণই দেখল না ইতি। উল্টো ফিক করে হেসে দিয়ে ওর প্রশ্নটা উড়িয়ে দিলো। ইতি রাগে চোখ কপালে তুলে রোদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অসভ্য লোক একটা।’

এবারও ইতির কথার গুরুত্ব দিলো না রোদ। পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করল। ইতি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি সিগারেট খান! মানে আসলেই কি আপনি সিগারেট খেতেন আগে থেকে?’

রোদ সিগারেট মুখে দিয়ে বলল, ‘জানো তো ইতি, মানুষ সবসময় নিজের কারণে খারাপ হয় না, কিছু কিছু সময়, মানুষ অন্যের কারণেও খারাপ হয়ে যায়। খারাপ পথে যায়। আমার থেকে বড় উদাহরণ আর হয় না। আমি আগে এই সিগারেট সহ্য করতে পারতাম না। কিন্তু সেদিনের পর থেকে সিগারেট খাওয়া শুরু করেছি। আরো যতরকম নেশা আছে, সবই করি এখন৷ এর একমাত্র কারণ হলো তুমি।’

ইতি নিজের দিকে আঙুল তাক করে ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘আমি?’

- ইয়েস মাই ডেয়ার। আমার এই খারাপ হওয়ার একমাত্র কারণ তুমি। আমি বিদেশ থেকে বড় হয়েছি। একপ্রকার বিদেশিদের মতোই। পরিবারের লোকজন ছাড়া এই দেশের কেউই আমাকে চিনতো না। সাধারণত রাজনীতিবিদদের ছেলেরা একটু বখে যায়। বাট আমি ছিলাম একেবারে ভিন্ন। অথচ তুমি আমাকে বিয়ে না করে, ফাহাদকে বিয়ে করার জন্য আমাকে মিথ্যে অপবাদ দিলে। নেশাখোর থেকে শুরু করে আরো কত কি! যেহেতু পরিবারের চোখের আড়ালে ছিলাম ছোট থেকেই। তার উপর রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বাড়ির ছেলে। আমি যে বখে গেছি, সেটা সবাইকে বুঝাতে কোনো কষ্ট হলো না তোমার। আমার বাবা-মা আত্মীয় স্বজনরা সবাই ধরে নিলো তোমার সব অভিযোগ সঠিক। অতঃপর আমি ভালো হয়েও খারাপ হয়ে গেলাম সবার কাছে৷ কাউকে যখন বলতাম আমি খারাপ কোনো কাজ করি না। আমি নেশা করি না। তখন সবাই বলতো, এতকাল তো বিদেশেই ছিলে, ওখানে কি করেছ না করেছ, তা তো আর আমরা জানি না। আর ওই মেয়েটা তো সব প্রমাণ দেখালোই৷ সুতরাং আমাদের কাছে পরিষ্কার তুমি কেমন ছেলে। কি আর করব ইতি, কিছু না করে দোষ কাঁধে নিয়ে বয়ে বেড়ানোর চেয়ে কিছু করে দোষ কাঁধে নেওয়াই তো ভালো, তাই না?

ইতি লক্ষ্য করল রোদ চোখ মুছছে। ইতি বলল, ‘রোদ প্লিজ, আমি আপনার কাছে হাজারবার ক্ষমা চাইতেও রাজি আছি। কিন্তু আপনি আমার সাথে এমন কিছু করবেন না, যার দ্বারা এই যে অফিসের লোকদের সামনে যে ভালো সেজে আছেন, সেটাও নষ্ট হয়। আপনি সব ভুলে যান প্লিজ। আমরা নাহয় বন্ধুর মতো থাকি।’

রোদ হঠাৎ ইতির হাত ধরে, ইতিকে কাছে টেনে দিলো। ইতির কোমড়ে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল ইতিকে। ইতি অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে কোমড় থেকে রোদের হাতটা সরিয়ে দিয়ে রোদকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘অসভ্যতার একটা সীমা থাকে মিস্টার রোদ৷ আপনি বারবার সেটা অতিক্রম করেন। আপনার প্রতি আমার করুণা কাজ করতো, কারণ আমি আপনার সাথে অন্যায় করেছি৷ কিন্তু আপনার কর্ম-ই আপনার বিপদ ডেকে আনছে।’

রোদ হেসে দিয়ে বলল, ‘আমার বিপদ! হা হা হা। বিপদ তো তোমার জন্য অপেক্ষা করছে ইতি। শুধু একটু অপেক্ষা কর। সেদিন তো সায়েম তোমাকে বাঁচিয়েছিল, আজ সে-ও তোমাকে পারবে না বাঁচাতে। এখন ফোন দিলেও তোমার ভাই এখানে এসে সঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারবে না। কারণ ততক্ষণে সব শেষ।’

ইতি উৎকণ্ঠায় বলল, ‘কি বলতে চাচ্ছেন?’

- সেটা সময় হলেই বুঝতে পারবে। এখন ভিতরে চল, তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।

রোদ হুট করে চলে গেল তাড়াহুড়ো করে। ইতি তীক্ষ্ণ ভাবে তাকিয়ে রইল রোদের যাওয়ার দিক দিয়ে। কিন্তু রোদ কোনোদিকে না তাকিয়ে চলে গেল ভিতরে। হঠাৎ ইতির ফোনে টুং করে একটা শব্দ এলো। একটা ম্যাসেজ এসেছে। ইতি ম্যাসেজটা দেখে চারিদিকে একবার চোখ বুলালো। এরপর মুচকি হাসি দিয়ে রিসোর্টের ভিতরে চলে এলো। রিসিপশনের কাছে আসতেই বিস্ময়ে ইতির চোখ ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। কোনোমতে নিজেকে সামলে ওদের অফিসের স্টাফদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। হঠাৎ ওর জুনিয়র একজন বলে উঠল, ‘অভিনন্দন ম্যাডাম।’

ইতি অবাক না হলেও রোদকে দেখে অবাক হওয়ার ভান করল। কারণ এই ব্যাপারটার মুখোমুখি ও বেশ কয়েকবার হয়েছে। কিন্তু কোনোবারই এর সঠিক উত্তর পায়নি। তবুও একটা চাঁপা রাগ দেখিয়ে বলল, ‘মানে কি? আজ কি এমন দিন, যে সবাই আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছ। সমস্যাটা কি?’

কথাটা একটু জোরেই বলে ফেলেছিল ইতি। যার কারণে অনেকেই তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিছুটা দূর থেকে মিস্টার চৌধুরী এসে বল, ‘কি হয়েছে ইতি? এভাবে কথা বলছ কেন?’

ইতি মিস্টার চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সবাই আমাকে অভিনন্দন কেন জানাচ্ছে? আর এখানে এত আয়োজন কীসের?’

- সেটা তো আমিও জানি না। এইসব রোদ করেছে। আমাকে শুধু বলেছে আজ তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিবে। বাট কি সারপ্রাইজ, আই ডোন্ট নো। তবে প্লিজ, এমন ভাবে কিছু বলো না, যাতে করে এখানে আসা প্রত্যেকটা মানুষের সামনে আমার প্রেস্টিজে আঘাত লাগে। বুঝতেই পারছ এদের সাথে নতুন ডিল করেছি। তাই খুব ভয়ে ভয়ে আছি। এরা বিদেশি মানুষ। আমাদের এই চেঁচামেচি এদের নাও পছন্দ হতে পারে। তাই বলছি, যা ইনজয় করার একটু সাবধানে করো।

মিস্টার চৌধুরী আবারও চলে গেলেন সাদা দবদবে দুইটা লোকের সাথে কথা বলতে। ইতির মাথাটা বিগড়ে গেল। এরা পছন্দ করে না বলে কি ও কোনো প্রশ্ন-ও করতে পারবে না? এ কেমন জীবন রে বাবা! মনে মনে ইতি লোকগুলোকে গালাগাল দিতে লাগল। কিছুক্ষণ কেটে গেল এভাবেই। হঠাৎ রোদ এসে ইতির পাশে দাঁড়াল। রোদ ওর পাশে দাঁড়িয়ে যা যা বলল, সবটা শোনার পর বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো ইতি। যদিও এমন কিছুই অনুমান করতে পেরেছিল। তবুও এতগুলো মানুষের সামনে অপ্রস্তুত হলো। বিদেশী লোকগুলো এসে ইতিকে অভিনন্দন জানাতে লাগল। ইতি মিস্টার চৌধুরীর কাছে এসে বলল, ‘এইসব কি হচ্ছে স্যার?’

- তোমাদের বিয়ে হবে এখন। রোদ তো সেটাই বলল।

ইতি শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল। রোদ এসে বলল, ‘কাজী এসে গেছে ইতি। চলো আমরা বসি।’

ইতি রোদের কানের মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘এমন একটা কিক মারব যে, ওঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাবেন না।’

রোদ হঠাৎ চোখ গরম করে তাকালো ইতির দিকে। ইতি ঘাবড়ে গিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। রোদ চেঁচিয়ে বলল, ‘কাজটা একেবারেই ঠিক করছ না ইতি? তুমি এতবছর আমার সাথে প্রেম করে, এখন বলছ আমাকে বিয়ে করবে না?’

রোদের কথা শুনে ইতির মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। এতটাও আশা করেনি ও। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, ‘এইসব কি বলছেন আপনি?’

রোদ কিছু বলার আগে মিস্টার চৌধুরী পাশ থেকে বলল, ‘কি হয়েছে রোদ? কোনো সমস্যা?’

রোদ আবারও চেঁচিয়ে বলল, ‘এই প্রতারক মেয়ে একবছর আমার সাথে নাটক করেছে। আমার সাথে পবিত্র ভালোবাসার অভিনয় করে অন্য একজনের সাথে সবরকম ডেট করেছে। রুমডেট থেকে শুরু করে পার্ক ডেট, রিকশা ডেট, ফুটপাত ডেট পর্যন্ত।’

মিস্টার চৌধুরী ইতির দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘ছি ইতি। তুমি এইরকম মেয়ে, তা আমি ভাবতেও পারিনি।’

ইতি অবাক চোখে তাকিয়েই আছে।পৃথিবীতে অবাক হওয়ার কোনো প্রতিযোগিতা হলে আজকের এই অবাক হওয়ার জন্য নিশ্চিত প্রাইজ পেতো ইতি৷ জীবনের সবচেয়ে বড় অবাক আজকে এই রোদের কথা শুনে হয়েছে ও। ধাক্কাটা হঠাৎ এমন জোরে লেগেছে যে, সামলানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। ইতি প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। চোখে ছলছল করছে জল। আশেপাশে কয়েকবার চোখ বুলালো। এরপর মনে মনে বলল, ‘তুমি কোথায় ভাইয়া? একটু আগেও তো এখানেই ছিলে। এই মুহূর্তে যে তোমাকে খুবই প্রয়োজন আমার।’

আশেপাশে কোথায় সায়েমের দেখা পেলো না ও। অপমান আর লজ্জায় প্রায় মরে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো ওর। হঠাৎ রোদ বলল, ‘মিস্টার চৌধুরী, ওর এই প্রতারণা আমি মেনে নিবো না। আমি এখুনি ওকে বিয়ে করব।’

মিস্টার চৌধুরী কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ইতি হঠাৎ মৃদু হাসি দিয়ে চোখ মুছল নিজের। এরপর রোদকে বলল, ‘হারামজাদা রোদ, আগে পিছনে তাকিয়ে দেখুন একবার। আপনার বিয়ের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে রূপ নিবে।’

রোদ কৌতূহলী হয়ে পিছনে তাকালো। আর তখনই কেউ একজন ওর দুই পায়ের মাঝ বরাবর সজোরে লাথি মেরে দিলো। আগের মতো এবারও একহাত মুখে, আরেক হাত অশ্বপতিতে দিয়ে নিচু হয়ে গেল রোদ। আর ইতি তখনই পিছন থেকে ওর দুই পায়ের মাঝ বরাবর লাথি মেরে দিলো। ভাই-বোন মিলে পরপর আরো দু’টো লাথি মারল রোদকে। ওর অশ্বপতি প্রটেক্ট করার জন্য পরের বার হাত থাকলেও প্রথমবারেই যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। রোদ ফ্লোরে গড়াগড়ি খেতে লাগল। হঠাৎ এইরকম কাণ্ড দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল সবাই। বাইরে থেকে কালো কুচকুচে দু'জন লোক সায়েমের দিলে এলে ফাহাদ আর আবির দু’টোকে ঘুষি মেরে দিলো। লোকগুলো আবার ওদের মারার জন্য এগিয়ে আসতে চাইলে মিস্টার চৌধুরী একটা ঝাড়ি মেরে লোক দু'টোকে থেমে যেতে বলল। রোদ ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে মিস্টার চৌধুরীর দিকে অবাক চোখে তাকালো। ইতি সায়েমকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘থ্যাংক ইউ ভাইয়া। তোমাদের হঠাৎ দেখতে না পেয়ে তো ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম রোদ আবার তোমাদের দেখতে পেয়ে কোনো ক্ষতি করে দিয়েছে।’

সায়েম বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ওর মতো একটা চামচিকা আমার কি ক্ষতি করবে রে? এইসব মারামারি তো আমার নেশা। ওর মতো দুই তিনটাকে আমি একাই খেয়ে ফেলতে পারব।’

সায়েমের কথা শুনে হেসে দিলো ইতি। চোখ থেকে আনন্দের জল পড়ছে। ইতির এক জুনিয়র হঠাৎ মিস্টার চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কিছু একটা করুন স্যার, উনারা তো রোদ স্যারকে মেরে ফেলবে।’

মিস্টার চৌধুরী ঘৃণার স্বরে বলল, ‘ওর মতো একটা শয়তানের মরে যাওয়াই উচিত। ওকে আমি বিশ্বাস করে খুব বড় ভুল করেছিলাম।’

মিস্টার চৌধুরীর কথা শুনে উপস্থিত সবাই অবাক হলেও সায়েম, ফাহাদ, আর আবির একটুও অবাক হয়নি। ইতি সায়েমকে ছেড়ে দিয়ে মিস্টার চৌধুরীর সামনে এসে দাঁড়ালো। চোখ ড্যাবড্যাব আকার ধারণ করে বলল, ‘স্যার আপনি এই কথা বলছেন? মানে আপনি জানেন রোদ আমার সাথে অন্যায় করার চেষ্টা করছিল? একটু আগেই যে আপনি আমাকে দোষারোপ করলেন।’

- ওটা অভিনয় ছিল। অনেকক্ষণ আগেই আমি সবটা জানতে পেরেছি।

ইতি আরো অবাক হওয়ার মতো করে তাকালো৷ তবে এটা ভান ধরে নয়, বরং ও আসলেই খুব অবাক হয়েছে। রোদ শোয়া থেকে ওঠার চেষ্টা করল। কোনোরকমে বসে বলল, ‘স্যার আপনি অন্তত আমাকে অবিশ্বাস করবেন না। এরা সবাই আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। সেই সাথে এই সায়েম নিজের বোনের দোষ ঢাকার চেষ্টা করছে।’

মিস্টার চৌধুরী রোদকে ধমক দিয়ে বলল, ‘চুপ কর তুমি। তোমার মতো ছেলের মুখে বিশ্বাস, অবিশ্বাসের কথা মানায় না। তুমি নিজেই তো বিশ্বাস ঘাতকতা করলে আমার সাথে। আমার বিজনেসের সাথে তোমার সম্পর্ক খুবই গভীর ছিল। তুমি কি জানো, এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ স্রষ্টার কোনো একটা সৃষ্টিকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। তুমিও ভেবে দেখ, তোমার জীবনে স্রষ্টার সৃষ্টি এমন কোনো জিনিসের অস্তিত্ব আছে, যাকে তুমি অন্ধের মতো বিশ্বাস কর। হয়তো স্বীকার করবে না, বাট বিশ্বাস কর। আচ্ছা অন্ধের মতো বিশ্বাস করা কাকে বলে জানো?’

পাশ থেকে ইতি বলে উঠল, ‘স্রষ্টার সৃষ্টি চাঁদ-সূর্যকে বিশ্বাস করাকেও অন্ধের মতো বিশ্বাস বলে। যেমন আমি একজন ব্যক্তি৷ যে সারাজীবন চোখ বন্ধ করে থাকলেও আমার বিশ্বাস দিনের শুরুরে সূর্য উদয় হবে৷ আর দিন শেষে সূর্য অস্ত যাবে৷ চাঁদের ক্ষেত্রেও সেইম। মোটকথা, আমি যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, আমি অন্ধের মতো বিশ্বাস করি, চাঁদ-সূর্য নিজ-নিজ সময়ে উদয় এবং অস্ত হবেই।’

মিস্টার চৌধুরী ইতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘সঠিক উত্তর দিয়েছ। তো রোদ, এই চাঁদ-সূর্যের প্রতি আমাদের যে অন্ধ বিশ্বাস আছে, ব্যক্তিগত ভাবে তোমার প্রতিও আমার সেইরকম অন্ধ বিশ্বাস ছিল। বাট তুমি আমার বিশ্বাস ভেঙে দিলে। আমি আবারও বুঝতে পারলাম মানুষের প্রতি কখনোই অন্ধ বিশ্বাস করা যায় না। এরা স্বার্থের জন্য প্রতারণাও করতে পারে। তবে তোমার একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য, বিকজ তোমার কু-কর্মের জন্যই আমার একটা ভুল ধারণা ভেঙে গেছে আজ। একসময় নিজের নিঃসন্তানের জায়গায় তোমাকে বসিয়ে দিয়ে জায়গাটা পূরণ করে নিয়েছিলাম। আমার সবকিছু তোমার হাতে তুলে দিতাম। কারণ তোমার জন্যই আমি এতবড় একটা প্রতিষ্ঠান করতে পেরেছি। খুব অল্প সময়ে সাফল্য পেয়েছি। সায়েম, তোমাকেও ধন্যবাদ, আমাকে ধারণা পালটানোতে সাহায্য করার জন্য।’

রোদ মাথা নিচু করে বসে আছে। ইতি সায়েমকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আচ্ছা ভাইয়া, স্যার কীভাবে জানলেন রোদের আসল জঘন্য চেহারাটা?’

সায়েম মৃদু হাসি দিয়ে বলল, ‘অফিসে বসে কাজ করছিলাম আমি। তোর জন্য চিন্তা হচ্ছিল। তাই তোর সাথে কথা বলার পর আমি তোর স্যারকে ফোন দেই। আমার পরিচয় দিয়ে তোকে নিয়ে কিছু কথা হলো তার সাথে। তিনি আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন তোকে সাথে সাথে রাখবেন। সেই সাথে হুট করে বলেন রোদের কথা। রোদের নাম শুনে তো আমি থতমত খেয়ে গেলাম। স্যার বলল রোদ তোর বস। আর তখনই আমার মনে পড়ল রোদের নম্বর আমার কাছে আছে। রাফার মোবাইলে ‘অদৃশ্য মানব’ নামে যে নম্বরটা দেখেছিলাম, সেটাই রোদের নম্বর ছিল। এরপর সব হিসেবে আস্তে আস্তে মিলাতে লাগলাম। ফাহাদ, জয়, আর আবিকে সাথে নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।’

সায়েমকে থামিয়ে দিয়ে ইতি বলল, ‘তারমানে আমি যখন তোমাকে বললাম রোদ আমার ক্ষতি করার কোনো প্ল্যান করছে, তখন তুমি গাড়িতে ছিলে। আর আমি বলার আগে থেকেই তুমি জানতে।’

- ইয়েস মাই ডেয়ার সিস্টার।

রোদ হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমি তো সারাক্ষণ তোমার উপর নজর রেখেছিলাম। আর মিটিং রুমে তোমার ফোন অফ ছিল। তাহলে সায়েমকে এইসব বললে কখন?’

ইতি হেসে দিয়ে বলল, ‘মিস্টার রোদ, আপনি নিজেকে খুবই বুদ্ধিমান ভাবেন, তাই না? কিন্তু আপনার থেকে আমিও কম যাই না। আপনি যখন প্রেজেন্টেশন দিচ্ছিলেন, তখনই আমি ফোন অন করে ভাইয়াকে ম্যাসেজ দিয়েছিলাম।’

রোদ দাঁতে দাঁত চেপে মাথা নিচু করল। ইতি সায়েমকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কিন্তু স্যারকে তুমি এতসব কীভাবে বুঝালে? সে তো রোদকে খুবই বিশ্বাস করে। এত সহজে মেনে নিলো তোমার সব কথা।’

- উঁহু। প্রথমে মেনে নেয়নি তিনি। উল্টো আমাকে বকাঝকা শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা হঠাৎ এমন একজনকে পেয়ে গেলাম। যে আমার বিয়ে থেকে শুরু করে আজকের ঘটনা পর্যন্ত, সব সময় রোদের সাথে ছিল৷ এই ষড়যন্ত্রে সে-ও বড় একটা চরিত্র। ভিডিও কল এ এসে স্যারকে সব বুঝালাম। সেই ব্যক্তিটি সবই স্বীকার করেছে। একসময় স্যার সব প্রমাণ পেয়ে আমাদের বিশ্বাস করল। আমরা তো অনেকক্ষণ আগেই এসেছি এখানে। শুধু এই সময়টার অপেক্ষায় ছিলাম।

ইতি বলল, ‘কিন্তু সেই ব্যক্তিটি কে?’

পাশ থেকে ফাহাদ বলল, ‘কে নয়, ওটা হবে কারা। কারণ তিনজন মিলে এইরকম জঘন্য একটা খেলায় মেতেছিল। এখজন রোদ। আর একজন আমাদের সাথে আছে অবশ্য। অন্যজন নেই এখানে। যাকে আজকে ধরতে পেরেছি, তাকে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য পাশের ফার্মেসীতে নিয়ে গেছে জয়। একটু কেঁটে গেছে কপালে। এক্ষুনি চলে আসবে।’

ফাহাদের কথা শেষ হতেই জয় এলো রিসোর্টের রিসিপশনে। রোদ হাঁসের ডিমের মতো চোখ করে তাকিয়ে রইল।

(চলবে...)

আরো পড়ুন ২৪তম পর্ব- ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড