• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

নবারুণ ভট্টাচার্যের পাঁচটি বিখ্যাত কবিতা

  সাহিত্য ডেস্ক

২৩ জুন ২০১৯, ১০:০৫
কবিতা
ছবি : কবি ও কথাসাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না

যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায় আমি তাকে ঘৃণা করি- যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে আমি তাকে ঘৃণা করি- যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না আমি তাকে ঘৃণা করি- আটজন মৃতদেহ চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি আট জোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে আমি চিৎকার করে উঠি আমাকে তারা ডাকছে অবেলায় উদ্যানে সকল সময় আমি উন্মাদ হয়ে যাব আত্মহ্ত্যা করব যা ইচ্ছা চায় তাই করব।

কবিতা এখনই লেখার সময় ইস্তেহারে দেয়ালে স্টেনসিলে নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে কোলাজ পদ্ধতিতে এখনই কবিতা লেখা যায় তীব্রতম যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন মুখে সন্ত্রাসের মুখোমুখি-ভ্যানের হেডলাইটের ঝলসানো আলোয় স্থির দৃষ্টি রেখে এখনই কবিতা ছুঁড়ে দেওয়া যায় ’৩৮ ও আরো যা যা আছে হত্যাকারীর কাছে সব অস্বীকার করে এখনই কবিতা পড়া যায়

লক-আপের পাথর হিম কক্ষে ময়না তদন্তের হ্যাজাক আলোক কাঁপিয়ে দিয়ে হত্যাকারীর পরিচালিত বিচারালয়ে মিথ্যা অশিক্ষার বিদ্যায়তনে শোষণ ও ত্রাসের রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে সামরিক-অসামরিক কর্তৃপক্ষের বুকে কবিতার প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হোক বাংলাদেশের কবিরাও লোরকার মতো প্রস্তুত থাকুক হত্যার শ্বাসরোধের লাশ নিখোঁজ হওয়ার স্টেনগানের গুলিতে সেলাই হয়ে যাবার জন্য প্রস্তত থাকুক তবু কবিতার গ্রামাঞ্চল দিয়ে কবিতার শহরকে ঘিরে ফেলবার একান্ত দরকার। এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব বুকের মধ্যে টেনে নেব কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল ও ভাসান সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকি না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম অগণিত হৃদয় শস্য, রূপকথা ফুল নারী নদী প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেব ইচ্ছে মতো ডেকে নেব টলমলে হাওয়া রৌদ্রের ছায়ায় মাছের চোখের মত দীঘি ভালোবাসা-যার থেকে আলোকবর্ষ দুরে জন্মাবধি অচ্ছুৎ হয়ে আছি- তাকেও ডেকে নেব কাছে বিপ্লবের উৎসবের দিন।

হাজার ওয়াট আলো চোখে ফেলে রাত্রিদিন ইনটারোগেশন মানি না নখের মধ্যে সূঁচ বরফের চাঙড়ে শুইয়ে রাখা মানি না পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা যতক্ষণ রক্ত ঝরে নাক দিয়ে মানি না ঠোঁটের ওপরে বুট জ্বলন্ত শলাকায় সারা গায় ক্ষত মানি না ধারালো চাবুক দিয়ে খণ্ড খণ্ড রক্তাক্ত পিঠে সহসা আ্যালকোহল মানি না নগ্নদেহে ইলেকট্রিক শক কুৎসিৎ বিক্রত যৌন অত্যাচার মানি না পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা খুলির সঙ্গে রিভলবার ঠেঁকিয়ে গুলি মানি না কবিতা কোন বাধাকে স্বীকার করে না কবিতা সশস্ত্র কবিতা স্বাধীন কবিতা নির্ভিক। চেয়ে দেখো মায়কোভস্কি হিকমেত নেরুদা আরাগঁ এলুয়ার

তোমাদের কবিতাকে আমরা হেরে যেতে দিইনি বরং সারাটা দেশ জুড়ে নতুন একটা মহাকাব্য লেখবার চেষ্টা চলছে গেরিলা ছন্দে রচিত হতে চলেছে সকল অলংকার। গর্জে উঠুক দল মাদল প্রবাল দ্বীপের মত আদিবাসী গ্রাম রক্তে লাল নীলক্ষেত শঙ্খচূড়ের বিষ-ফেনা মুখে আহত তিতাস বিষাক্ত মৃত্যুসিক্ত তৃষ্ণায় কুচিলা টণ্কারের সূর্য অন্ধ উৎক্ষিপ্ত গাণ্ডীবের ছিলা তীক্ষ্ম তীর হিংস্রতম ফলা- ভাল্লা তোমার টাঙ্গি পাশ ঝলকে ঝলকে বল্লম চর-দখলের সড়কি বর্শা মাদলের তালে তালে রক্তচক্ষু ট্রাইবাল টোটেম বন্দুক কুরকি দা ও রাশি রাশি সাহস এত সাহস যে আর ভয় করে না আরো আছে ক্রেন, দাঁতালো বুলডজার বনভয়ের মিছিল চলামান ডাইনামো টারবাইন লেদ ও ইনজিন ধ্বস-নামা কয়লার মিথেন অন্ধকারে কঠিন হীরার মতো চোখ আশ্চর্য ইস্পাতের হাতুড়ি ডক জুটমিল ফার্ণেসের আকাশে উত্তোলিত সহস্র হাত না ভয় করে না ভয়ের ফ্যাকাশে মুখ কেমন অচেনা লাগে যখন জানি মৃত্যু ভালোবাসা ছাড়া কিছু নয়। আমাকে হ্ত্যা করলে বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে যাব আমার বিনাশ নেই- বছর বছর মাটির মধ্য হতে সবুজ আশ্বাস হয়ে ফিরে আসব আমার বিনাশ নেই- সুখে থাকব, দুঃখে থাকব সন্তান-জন্মে সৎকারে বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন।

একটা ফুলকির জন্যে

একটা কথায় ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে পড়বে কবে সারা শহর উথাল পাথাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে কাটবে চিবুক চিড় খাবে বুক লাগাম কেড়ে ছুটবে নাটক শুকনো কুয়োয় ঝাঁপ দেবে সুখ জেলখানাতে স্বপ্ন আটক একটা ব্যথা বর্শা হয়ে মৌচাকেতে বিঁধবে কবে ছিঁড়বে মুখোশ আগ্নেয় রোষ জুলবে আগুন পুতুল নাচে ভাঙবে গরাদ তীব্র সাহস অনেক ছবি টুকরো কাচে একটা কুঁড়ি বারুদগন্ধে মাতাল করে ফুটবে কবে সারা শহর উথাল পাথাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।

একটি অসাধারণ কবিতা

আমার ভালোবাসায় যে নিজেকে উৎসর্গ করেছিল সেই মেয়েটি এখন আত্মহত্যা করছে। নীল ও বিন্দু বিন্দু আমার কপালে ঘাম তার কাছে আমি গভীর সার্থকতা ছিলাম আমার তরফে কিছু প্রবঞ্চ নাও বুঝি ছিল অথবা সে কোনোদিনও সমুদ্র দেখেনি। সে এখন আত্মহত্যা করছে তার আঙুল, লুকোনো নরম রক্ত, সাদা গলা এখনও বেঁচে আছে শুধু তার চোখের পলক পড়ছে না। স্থির সম্মতির মতো অপলক আয়নায় সে এখনও বেঁচে আছে কোনোদিনও সমুদ্র দেখেনি। আমাদের একইসঙ্গে সমুদ্রে যাওয়ার কথা ছিল সে এখনও বেঁচে আছে এখনও হয়তো যাওয়া যায় নীল ও তুষারকণা আমার কপালে ঘাম। এখনও তাকে সারারাত্রি চুমু খাওয়া যায় এমনকী মৃত্যুর পরেও তাকে সারারাত চুমু খাওয়া যায় ঘুমন্ত তাকে এত সুন্দর দেখাত আরও গভীর ঘুমে সৌন্দর্য আরও জন্ম নেয় কিন্তু সে এখনও বেঁচে আছে শুধু তার চোখের পলক পড়ছে না। তার আঙুল কঁপিছে দ্বিধায় ও বিভিন্ন কোণে বসানো পাথরে নরম রক্ত নিভে যাচ্ছে ভয়ে সাদা গলার মধ্যে স্বচ্ছ বাতাস ও রাত্রি আমি এই ঢেউ ও ঝড়ের বিপদসঙ্কেতের কাছে কিছু না এত ফেনা আর গভীর অন্ধকার প্রবালদ্বীপের মধ্যে সামুদ্রিক অশ্বের হ্রেষায় আমার নিজের ঠোঁট নিজেরই অচেনা। অতল সার্থকতা ছিলাম মৃত্যু, মরে যাওয়া, মরণের মতো নীল ও বিন্দু বিন্দু আমার কপালে মুহূর্ত। আমার ভালোবাসায় যে নিজেকে উৎসর্গ করেছিল সেই মেয়েটি এখন আত্মহত্যা করছে।

আমার খবর

আমি সেই মানুষ যার কাঁধের ওপর সূর্য ডুবে যাবে। বুকের বোতামগুলো নেই বহুরাত কলারটা তোলা ধুলো ফ্যা ফ্যা আস্তিন হাওয়াতে চুল উড়িয়ে পকেট থেকে আধখানা সিগারেট বার করে বলব দাদা একটু ম্যাচিসটা দেবেন? লোকটা যদি বেশি ভদ্র হয় সিগারেট হাতে রেখে এগিয়ে দেবে দেশলাই আর আমি তার হাতঘড়িটার দিকে তাকাব, চোখে জ্বলে উঠবে রেডিয়াম ম্যায়নে তুঝসে মহববত করকে সনম—লেন দেন

খবরের কাগজ নয় পুলিশের খাতায় আমার দুটো ছবি থাকবে—একটা হাসিমুখ, একটা সাইড ফেস তার নিচে লেখা ম্যাচ কেস পেট ভরে পেট্রোল খেয়ে হল্লা গাড়ি ছুটবে আমার খোঁজে হেঁটমুণ্ডু শহর আমাকে খুঁজবে আমি সেই মানুষ বুকের বোতামগুলো নেই বহু রাত যার কাঁধের ওপর সূর্য ডুবে যাবে।

আমাকে দেখা যাক বা না যাক

কে আমার হৃদ্‌পিণ্ডের ওপরে মাথা রেখে ঘুমোয় কে আমাকে দুধ ও ভাতের গন্ধ দিয়ে আড়াল করে কে আমার মাটি যেখানে আমি বৃষ্টির মতো শুষে যাই আমি যখন দূষিত আকাশে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে উড়ি আমার পালকে ছাই জমে জমে ধূসর হয়ে যায় তখন আমার সামনে সবুজ গাছ হয়ে ওঠে কে কে আমাকে চোখের পাতা বন্ধ করে আড়াল করে কে আমাকে আগুন দিয়ে মশালের মতো জ্বালায় কে আমার পৃথিবী যার ভেতরে আমি লাভার মতো ফুটতে থাকি আমি যখন পথ থেকে গলিতে তাড়া খেতে খেতে দৌড়ই আমার পায়ের তলায় হাইওয়ে, আলপথ সব ফুরিয়ে যায় তখন আমার সামনে আশ্রয় হয়ে ওঠে কে এইসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমার ওপরে অনেক অত্যাচার করতে হবে এত অত্যাচার করার ক্ষমতা, দুর্ভাগ্যবশত, কোনো শোষক, নিপীড়ক বা রাষ্ট্রমেশিন এখনও জানে না যখন জানবে তখন আমার প্রশ্নের সংখ্যাও অনেক বেড়ে যাবে আমি প্রশ্নগুলোকে ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগোতেই থাকব আমাকে দেখা যাক বা না যাক প্রশ্নগুলো ফেটে অনেক সপ্তর্ষিমণ্ডল আকাশে দেখা যাবে।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড