• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : আত্মত্যাগী যুবক

  রিফাত হোসেন

২৩ এপ্রিল ২০১৯, ১৮:৩৭
গল্প
ছবি : প্রতীকী

অদ্ভুতভাবে রূপনগর গ্রাম থেকে মানুষ উধাও হয়ে যায়। এই নিয়ে গ্রামের সবাই খুব চিন্তিত। গ্রামের শেষ প্রান্তে খুব বড় একটা ঘন জঙ্গল আছে। সবার ধারণা মানুষ উধাও হওয়ার পিছনে আছে ওই ঘন জঙ্গল। মূলত ঘরে উনুন জ্বালানোর জন্য কাঠ-খড় কুড়িয়ে আনতে যাওয়া হয় ঘন জঙ্গলে। কিন্তু যে-ই কাঠ-খড় কুড়িয়ে আনার জন্য জঙ্গল পথে পা দিয়েছে সে আর ফিরে আসেনি। তারা কোথায় যায়? কেন যায়? আর কেন ফিরে আসে না? এই নিয়ে গ্রামে বেশ কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যেই গ্রাম প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। এখন শুধু আছে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর প্রিয়জন। কিন্তু তারাই বা আর কতদিন থাকবে।

কিছুদিন পর গ্রামের মাতবর সাহেব জানিয়ে দেয় বিকেল-বেলা পুকুরপাড়ের বটগাছের নিচে গ্রামের সবাই যেন উপস্থিত থাকে। মাতবর সাহেব এর কথা মতো বিকেল হতেই সবাই বটগাছের কাছে চলে যায়। সবার সাথে জয় ও যায় সেখানে।

কিছুক্ষণ পর মাতবর সাহেব ও চলে আসে। তিনি একজায়গায় বসে সবার উদ্দেশ্যে বললেন— আমাদের গ্রাম এখন ভয়ংকর বিপদের সম্মুখে। কিছুদিন পর পর দু’একজন মানুষ উধাও হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে আমাদের গ্রাম একসময় জনশূন্য হয়ে যাবে। আমাদের কিছু একটা করতে হবে। আমরা সবাই জানি হারিয়ে যাওয়া মানুষ গুলোর শেষ গন্তব্য ছিলো ওই জঙ্গলে। কিন্তু তারা আর ফিরে আসেনি। আমাদের জানতে হবে কী আছে ওই জঙ্গলে? আর তা জানতে হলে আমাদের ওই জঙ্গলে যেতে হবে।

মাতবর সাহেবের কথা শেষ হতেই একজন মধ্যবয়স্ক লোক বললেন— আমি আপনার কথায় একমত হতে পারছি না কারণ জীবনের ভয় আমারও থাকে। আমি এই বিপদের সম্মুখীন হতে চাই না। আমাকে মাফ করবেন।

লোকটা কথাগুলো বলে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো। তার দেখাদেখি একে একে সবাই বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো। সবাই এভাবে চলে যাচ্ছে দেখে মাতবর সাহেব নিরাশ হয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো। কিছুক্ষণ এভাবে বসে থাকার পর তিনি উঠতে যাবে ঠিক তখনই সামনে এক যুবককে দেখতে পায়।

মাতবর সাহেব নরম কণ্ঠে বল — একি জয়, সবাই তো চলে গেছে। কিন্তু তুই এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

জয় মৃদু হাসি দিয়ে বলল— গ্রামের সকল মানুষ এবং এই গ্রামকে মুক্ত করার জন্য ওই ঘন জঙ্গলে যেতে আমি প্রস্তুত।

— কিন্তু তুই কী পারবি?

— ১৯৭১ সালে সবার উদ্দেশ্য ছিলো দেশ এবং মায়ের ভাষা কে রক্ষা করা। সমনে বিপদ আছে জেনেও তারা পিছিয়ে যায়নি। যুদ্ধ করেছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীদের সাথে। আর তারা শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছিলেন। আজ আমার উদ্দেশ্য এই গ্রাম এবং গ্রামের সকল মানুষকে মুক্ত করা। ইনশাআল্লাহ আমিও সফল হতে পারবো।

মাতবর সাহেব কিছু বলল না। জয় কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। জয় ঠিক করলো আজ রাতেই বেরিয়ে পড়বে ওই ঘন জঙ্গলের পথে। যেই কথা সেই কাজ। বেরিয়ে পড়লো অন্ধকার রাতে ভয়ংকর জঙ্গলের পথে। ঘন জঙ্গলে চাঁদের আলো পৌঁছায় না। তবুও যে-টুকু আলো আসছে তা দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে জয়। জঙ্গলের প্রায় মাঝে চলে এসেছে । দূরে থেকে অদ্ভুত রকম আওয়াজ ভেসে আসছে। জয় কিছুতেই বুঝতে পারছে না এই অদ্ভুত আওয়াজ কোথা থেকে আসছে। হঠাৎ করে জয় থেমে গেল। পিছন ফিরে তাকিয়ে বলল— আমার পিছনে কেউ একজন ছিলো।

কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না। পরক্ষণেই আবার বলল— কই কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না। নিশ্চয় আমার মনের ভুল এটা। এই ঘন জঙ্গলে মুক্ত অবস্থায় আমি ছাড়া আর কোন মানুষ আছে বলে মনে হয়না। কিন্তু আমি কী আসলেই মুক্ত। নাকি কোন গোল চক্রের মধ্যে বন্দী হয়ে আছি।

অনেক হাঁটার পরে- ও জঙ্গলের কোন কূলকিনারা খুঁজে পেলো না জয়। হঠাৎ করে শনশন করে বাতাস আসতে লাগলো। জয় কিছুতেই বুঝতে পারলো না হঠাৎ করে কোত্থেকে এত বাতাস আসছে? শুধু মনে হচ্ছে আর বোধহয় রূপনগর আর হারিয়ে যাওয়া মানুষ গুলোকে মুক্ত করতে পারলাম না।

বাতাস এমন দ্রুত গতিতে জয়কে আঘাত করছে যে জয় নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। মনে হচ্ছে কোন শূন্যে ভাসছে। কোথাও উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে জয়কে? কিন্তু কে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা কিছুতেই বুঝতে পারছে না? জয় চিৎকার করে বলছে— কে তুমি? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? কী তোমার উদ্দেশ্যে? কী হলো চুপ করে আছো কেন?

হঠাৎ করেই জয় মাটিতে পড়ে গেল। মাথায় অনেক আঘাত পেয়েছে। মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো জয়। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সব কিছু অন্ধকার। এতক্ষণ যা-ও দেখা যাচ্ছিলো এখন সেটুকুও দেখা যাচ্ছে না। জয় অন্ধকারের মধ্যেই চিৎকার করে বলল— কে আছো? কেউ থাকলে দয়া করে সারা দেও। আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে? কোথায় তুমি? এভাবে লুকিয়ে আছো কেন? সাহস থাকলে সামনে এসো।

হঠাৎ করেই অদ্ভুত কন্ঠে হাসির আওয়াজ ভেসে এলো। মেয়েলী কণ্ঠে হাসি। ঘাবড়ে গেল জয়। নিজেই মনে মনে বলল— এইরকম ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর কোন মানুষের হতে পারে না।

হাসি থেমে গেল। কিছুক্ষণের জন্য সব কিছু চুপচাপ হয়ে গেল। চারদিক স্তব্ধ। কিছুক্ষণ পর সেই অদ্ভুত ভয়ঙ্কর মেয়েলী কণ্ঠে বলল- খুব ভয় পাচ্ছিস তাই না? ‘হা হা হা’।

আবারও সেই ভয়ঙ্কর হাসি। জয় নিজের কান দু’টো চেপে ধরে জোরে জোরে বলল- কে তুমি? আর কেন আমাকে এভাবে ধরে নিয়ে এসেছো? আর আমাদের গ্রামের সবাই কে কোথায় আটকে রেখেছো? তোমার কণ্ঠস্বর ও অন্য সবার মতো স্বাভাবিক নয়।

— সব প্রশ্নের উত্তর পাবি। তোদের গ্রাম এবং গ্রামের সবাইকে আমি মুক্ত করে দেবো। কিন্তু আমার একটা কাজ তোকে করে দিতে হবে।

— কী কাজ বলো?

— এখান থেকে বের হয়ে ৫০০ পা সামনে হাঁটবি। তারপর ১০ পা ডানে গিয়ে আবার সামনে ৫ পা। ঠিক তখনই একটা ছোট ভাঙা বাড়ি দেখতে পাবি। সেই বাড়ির ভিতরে একটা পুরনো বই আছে। সেই বইটা এখানে নিয়ে আসবি। তারপর আমার কাছে দিবি।

জয় বেশ কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো— এই সাধারণ একটা কাজ তো তুমিই করতে পারো।

জয় এর কথা শুনে মেয়েটি আরও রেগে গেল। জয় কে ধমক দিয়ে বলল— আমি পারলে কী আর তোকে বলতাম। এখন তোকে যা করতে বলেছি তুই সেটাই কর। তা না হলে তোর সাথে সাথে বাকি সবাইকে ও মেরে ফেলবো।

জয় ভয় পেয়ে বলল— দয়া করে ওদের কোন ক্ষতি করো না। আমি তোমার কাজ করে দেবো।

— আমি তোকে বাহিরে বের করে দিচ্ছি। তুই তাড়াতাড়ি বইটা নিয়ে আবার এখানে চলে আসবি। আমি তোর জন্য এখানে অপেক্ষা করবো।

— ঠিক আছে।

জয় সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ করে আবার শনশন শব্দ করে বাতাস আসতে লাগলো। জয় কে আবার শূন্যে তুলে নিয়ে বাহিরে বের করে দিল। জয় কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর মেয়েটার কথামতো সামনে ৫০০ পা গেল। তারপর ডানে ১০ পা আবার সামনে ৫ পা। মেয়েটার কথা অনুযায়ী জয় সামনে একটা ছোট ভাঙা বাড়ি দেখতে পেলো। এবার ভিতরে ঢুকতে হবে। জয় আস্তে আস্তে ভিতরে গেল। একটা কাঠের তাক ছিলো ভিতরে। আর সেটার ওপরেই ছিলো বইটা।

এদিকে অদ্ভুত কন্ঠের মেয়েটি জয় এর জন্য অপেক্ষা করে আছে। উদ্দেশ্য হলো বইটা হাতে পাওয়া। অনেকক্ষণ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরে-ও জয় এর কোন খবর নেই। মেয়েটি তো রেগে পুরো আগুন হয়ে আছে। অনেকক্ষণ পর জয় ফিরে আসে। বাহিরে দাঁড়িয়ে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল — আমি বই নিয়ে এসে গেছি।

— বইটা তোর পায়ের কাছে রাখ।

— কিন্তু আমাদের গ্রামের মানুষগুলো কোথায়?

— সবাই সঠিক সময় নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছে যাবে।

জয় আর কোন কিছু না ভেবে বই পায়ের কাছে রাখলো। হঠাৎ দেখে বইটা শূন্যে ভাসছে। বেশ অবাক হলো জয়।

ভয়ঙ্কর কণ্ঠে মেয়েটি হো হো করে হেসে উঠলো। জয় অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো— কী হলো তুমি এভাবে হাসছো কেন?

মেয়েটা কোন কথা বলছে না। শুধু হো হো করে হাসছে। খুব জোরে জোরে হাসছে। জয় পকেট থেকে ফায়ারফক্স বের করে হাতে থাকা বই এর পাতা গুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়। ভয়ঙ্কর কন্ঠে মেয়েটি হাসি থামিয়ে আর্তনাদ করতে শুরু করলো। মেয়েটার আর্তনাদ শুনে জয় জোরে জোরে হাসতে লাগলো।

একসময় জয় এবং মেয়েটি দুজনেরই শব্দ থেমে যায়। কেউ আর কোন কথা বলল না। সব কিছু স্তব্ধ হয়ে গেল।

পরেরদিন সকালে সবাই গ্রামে ফিরে আসে। হারিয়ে যাওয়া সকল মানুষ মুক্তি পেয়ে গেছে। শুধু মুক্তি পায়নি জয়। সে নিজের জীবন ত্যাগ করেছে। আস্তে আস্তে সব আবার আগের মতো হয়ে গেলেও মাতবর সাহেব এখনো জয় এর পথ চেয়ে বসে আছে।

সেই অন্ধকারে রাতে ছোট ভাঙা বাড়ির ভিতরে যে বইটা ছিলো সেটাতে ভয়ঙ্কর মেয়েটি কে ধ্বংস করার উপায় লেখা ছিলো। এক সাহসী যুবক এর তাজা রক্ত দিয়ে বই এর পাতাগুলো ভিজিয়ে দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দিলেই মেয়েটি মারা যাবে। মেয়েটি ছিলো এক অশুভ আত্মা । এক ফকির এই বইটি সংগ্রহ করে রেখেছিলো বহুকাল আগে। সেই ফকির এক সাহসী যুবক এর অপেক্ষায় ছিলো। কিন্তু সাহসী যুবক আসার আগেই সেই ফকির মারা যায়। জয় মেয়েটিকে বইটা দেওয়ার আগে নিজে একবার পড়েছিলো বইটি। তারপর বই এর পাতাগুলো ছিড়ে নিজের কাছে রেখে দেয়৷ শুধু উপরের অংশটুকু মেয়েটির হাতে তুলে দেয়। সেই ঘরে একটা লোহার পাত ছিলো, যা দিয়ে জয় নিজের পেটে আঘাত করে রক্ত বের করে বই এর পাতায় মাখিয়ে দেয়৷ তারপর মেয়েটির সামনেই সেগুলো পুড়িয়ে দেয়। মেয়েটির সাথে সাথে জয় ও সেদিন শেষ হয়ে যায়।।

গ্রামের সবাই যেনে যায় জয় ওদের মুক্ত করার জন্য জঙ্গল পথে গিয়েছিলো। কিন্তু সে আর ফিরে আসেনি। সবাই জয় কে ভুলে গেলেও মাতবর সাহেব এখনো ভুলেনি। সে আজও জয় নামক সাহসী যুবক এর অপেক্ষায় আছে৷ হয়তো এভাবেই অপেক্ষা করতে থাকবে। কিন্তু মৃত্যুর আগে সেই অপেক্ষার পহর শেষ হবে না।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড