• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘হতভাগ্য বাতিওয়ালা’-এর ৯ম পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : হতভাগ্য বাতিওয়ালা

  মুহাম্মদ বরকত আলী

১৭ এপ্রিল ২০১৯, ১৪:৪৬
কবিতা
ছবি : প্রতীকী

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলাম সবাই। অষ্টম শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা আবার আবেগ প্রবণ হয় বেশি। কি করতে কি করেছে কে জানে। ক্লাস রুমে ঢুকে দেখি এলাহি কাণ্ড। ছেলেমেয়েরা প্রায় সকলেই হাই বেঞ্চে দাঁড়িয়ে মিনুকে ঘিরে আছে। মিনু বসে আছে একটা বেঞ্চে। আমরা যেতেই মিনু আড় চোখে তাকালো আমার দিকে। হেড স্যার বললেন, কি হয়েছে? মিনু জিভ বের করে বলল, এ এ এ । তোমরা সবাই বসো আমি তোমাদের পড়াবো। হা হা হা হা। এমন অদ্ভুত ভাবে হাসলো যে আমি নিজেও ভয় পেয়ে গেলাম। কিছুটা নাকে কথা বলছে। অন্য ক্লাসের ছেলেমেয়েরা এসে ভিড় জমিয়ে ফেলেছে। লিটন বলল, কী হয়েছে মিনু বাবু? এত বড়ো মেয়েকে বাবু বলা হচ্ছে। এমনিতে বলেননি, স্যার নিশ্চয় ভয় পেয়েছে। ভূতে আবার আমারও কম ভয় নেয়। স্যার একটু ঝুঁকে গিয়ে বলল, কোনো সমস্যা হলে বলো? স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, মিনু বাবু, কী হয়েছে তোমার? কোনো সমস্যা হলে বলো? কথাগুলো রিপিট করলো। সাথে মুখটা বাকিয়ে বল অদ্ভুত একটা হাসি দিলো। লিটন নিকটে গিয়ে বলল, এরকম কাণ্ড করছিস কেন? ফাজলামি করছিস? তোর নাকে কিন্তু শুকনো মরিচ পোড়া ধরবো।

লিটনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘কে তুই? আমি তোকে চিনি না। আমি এখানে এসেছি পড়াতে। আমার বাড়ি আফ্রিকার জঙ্গলের সেই বিখ্যাত শেওড়া গাছে। এই স্কুলটা আমার পছন্দ হয়েছে। তাই এখানে আমি পড়াতে চাই। আমি এম এ পাশ।’ কথাটা বলে শুরু করলো কান্না। আস্তে আস্তে নাকে কান্না করছে। মৌসুমি আপা বললেন, ‘ওরে বাবারে ভুতে পেয়েছে। এই হলো মেয়ে মানুষের সমস্যা। তিলকে করে তাল। আপাততো মৌসুমি আপা এক দৌড়ে অফিস কক্ষে।’

ভুত বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। আছে জ্বীন। জ্বীনেরা তো আগুনের তৈরি। তাহলে কিভাবে একটা আগুনের তৈরি জ্বীন মানুষের দেহে প্রবেশ করে তা আমার বুঝে আসে না। তারপরও আমার কেমন জানি ভয় হয়।

সফদার চাচা একটু ভাব নিয়ে হেড স্যারকে বলল, ‘স্যার আমি ভূত তাড়াতে পারি। একবার চেষ্টা করে দেখতে দেখবো? তেমন কিছুই না। শুধু মাত্র একটা পানাই আর কিছু শুকনো মরিচ পোড়া।’

হেড স্যার ঘাড় কাত করে বলল, ‘ওসব আমাদের দরকার নেই। যাদের মেয়ে তারাই নিয়ে যাক। এই তোরা কেউ ওর বাড়িতে খবরদে।’

চার জন ছেলে ছুটলো মিনুর বাড়ি। মিনু এবার হাত-পা এলিয়ে বেঞ্চে শুয়ে পড়ল। কৃষি স্যার বললেন, ‘ভূত-টুত কিছুই না মাথায় একটু সমস্যা হয়েছে। তাই এমন ভুল বকছে।’ কথাটার সাথে আমিও একমত। একটু সাহস নিয়ে বললাম, ‘ভূত-টুত কিছু না। ভূত বলে পৃথিবীতে কিছুই নেই। যা আছে তা হলো জ্বীন। জ্বীনেরা আগুনের তৈরি যা কখনো মানুষের শরীরে প্রবেশ করা সম্ভব না।’

সফদার চাচা বললেন, ‘যেদিন পড়বা ঠেলায় সেদিন বুঝবা ভূত আছে কি নেই।’ মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে শুয়ে আছে। এক গ্লাস পানি নিয়ে আসতে বললাম। গ্লাসটা হাতে নিয়ে একবার ফাতেহা শরীফ আর তিন বার ইখলাস শরীফ পাঠ করে ফু লাগালাম। দেখি কাজ হলেও হতে পারে। ওর মুখে কয়েক বার পানির ছাটা মারতেই জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। আমার ধারনা সত্যি যদি জী¡নে ভর করেও নিশ্চয় আমার কোনো ক্ষতি করবে না। কারণ আমি শিক্ষক। শুনেছি ওরা শিক্ষকদের খুব মান্য করে। আমার কেরামতি শেষ হতে না হতেই মিনুর মা হাজির। মিনুর মা হাউ মাউ করে শুরু করেছে কান্না। সে বাড়িতে যাবেই না তবুও কোনো মতে পাঠানো হলো। বিকেল বেলা। স্কুল শেষ করে একটু ঘুরতে বের হয়েছি। বড়োজোর কদমতলা চাএর দোকান। এই সময়টা বেশ কষ্টের। অন্তত আমার জন্য। কারণ এ সময় বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে সময় কাটাতে বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু এখন আর তেমন কাউকে পায় না। সবাই জীবনের তাগিদে ছড়িয়ে গেছে পৃথিবীময়। যারা ছিলো তারা এখন পড়ালেখা শেষ করে ঢাকা মুখি হয়েছে। আমাকে বলেছিলো ঢাকায় গিয়ে কিছু একটা করতে। আমি রাজি হয়নি। ওখানে সব সময় দৌড়ের উপর থাকতে হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে। অফিসে দেরি হলো কি না এনিয়ে টেনশনে থাকতে হয়। কোনো রকম নাস্তা করে দৌড়াও অফিসে। বাসে ঝুলে ঝুলে অফিসে যাও আবার বাসে ঝুলে ঝুলে বাড়ি ফেরা। সাথে যানজট তো আছেই। রাস্তায় পচা ময়লার দুর্গন্ধ ফ্রি। এরচে গ্রাম অনেক ভালো। শান্তশিষ্ট পরিবেশ। চলাচলের কোনো সমস্যা নেই। খায় আর না খায় গ্রামের মানুষের সাথে দেখা হচ্ছে কথা হচ্ছে এই ভালো। চা’য়ের দোকানে যেতেই দেখি গাজী স্যার একই পোশাকে এখনো বসে আছে। মন মরা হয়ে চুপচাপ বসে কি যেনো ভাবছে।

- আসসালামু আলাইকুম। - ওয়ালাইকুম আসসালাম। - কী ব্যাপার স্যার, আপনি এখনো বাড়ি যাননি? - এইতো এখনি যাব। - স্যার, আপনাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। কিছু হয়েছে? কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলেন? স্যার মাথাটা নিচু করে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল, ‘আমার মেয়েটাকে নিয়ে একটু টেনশনে আছি, তপু। এই গেল বছর বিয়ে দিয়েছি। বনেদি ঘর দেখে বিয়ে দিলাম। কিছু টাকা দাবি ছিলো ছেলে ব্যবসা করবে বলে। জীবনে যা সঞ্চয় করেছিলাম তার সবটুকু দিয়ে একটা ব্যবসা শুরু করে দিয়েছিলাম। এই কয়েক মাসে ব্যবসাটাও শেষ করে আবার টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। মেয়েটাকে ওরা ঠিক মত খেতেও দেয় না। অসুখ হলে চিকিৎসাও করায় না। বনেদি ঘর হলে কি হবে, মেয়ের শশুর মশাই একটা চামার মানুষ। মেয়েটা গতকাল কাউকে না জানিয়ে চলে এসেছে। এখন আমি কি করব?’

স্যারের চোখ ভিজে এসেছে। জলে চিকচিক করছে। আমার কাছে এর কোনো সমাধান নেই। কারণ মানুষকে বলে কয়ে বদলানো যায় না, যতক্ষণ না সে নিজে বদলায়। টেনশন নিবেন না স্যার। সব ঠিক হয়ে যাবে। এই সহজ বাক্যটা ব্যয় করলাম। স্যার উঠে দাঁড়ালেন। তাহলে আমি উঠি এখন। বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। হাঁটতে শুরু করলেন। পাশের গ্রাম ফুলতলা, সেখানেই স্যারের বসবাস। প্রতিদিন হেঁটেই যাতায়াত করেন সেই স্কুল শুরু অব্ধি। এই ফুলতালার রাস্তা এতটায় চেনা যে, স্যার এখন চোখ বন্ধ করেই বাড়ি ফিরতে পারে।

আজ গাজী স্যার স্কুলে আসেননি। গাজী স্যার মাঝে মধ্যে স্কুলে আসেন না। উনার অনুপস্থিতির ব্যাপারে কেউ কোনো কথা বলেন না। অন্যান্য শিক্ষকদের সংসার মোটামুটি চলে যায়। মধ্যবিত্ত পরিবারের কষ্টের কথা কেউ টের পাই না। তারা বাইরের ঠাট বজায় রেখে চলে। আমি যা কিছু বলি না কেনো, এতটুকু তো বুঝি যে, যতই সম্পদ থাকুক না কেনো কিছু একটা আয় না থাকলে চলে না। যেটুকু বলি তা মাত্র সান্ত্বনা ছাড়া কিছুই না। কিন্তু গাজী স্যারের তেমন কিছু নেই। মানবেতর জীবন যাপন করেন। আর এজন্য মাঝে মধ্যে স্কুলে না এলেও কেউ উনার ব্যাপারে অভিযোগ করেন না। স্যারের মেয়ের ব্যাপারে আলোচনা করছিলাম অফিস কক্ষে। এমন সময় হেড স্যার আসলেন হন্ত দন্ত হয়ে। সাইকেলটা রেখে মন মরা হয়ে অফিস কক্ষে ঢুকলেন। হঠাৎ হেড স্যার বললেন, ‘সফদার আলি ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে দেন।’ কেনো, কি হয়েছে? কলিমদ্দিন স্যার জিজ্ঞেস করলেন। স্যার মনটা ভার করে বললেন, ‘গাজী স্যারের মেয়েটা মারা গেছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাউন।’ কথাটা শুনে গায়ের পশম গুলো খাড়া হয়ে গেলো। শরীর ভারি হয়ে এলো। এই না কালকেই স্যার তার মেয়েরে কথা বললেন। এই একটি মাত্র অবলম্বন নিয়ে স্যার বেঁচে ছিলেন। শুনেছি এই মেয়েটা জন্মেও আট বছরের মাথায় স্যারের বৌ মারা গেছেন বিনা চিকিৎসায়। সৎ মা মেয়েটাকে আদর মমতা দেবে কিনা সেই সন্দেহে স্যার আর দ্বিতীয় বিয়েতে বসেননি। তিল তিল করে মেয়েটাকে নিজে আদর সোহাগ দিয়ে বড় করেছে। পাড়া প্রতিবেশিরা যে যেমন পারতো সে তেমন সাহায্য করতো। কেউ গোসল করিয়ে দেওয়া, কেউ খাইয়ে দেওয়া। প্রতিবেশীদের এই অবদান স্যার কখনো ভুলবেন না। তাই প্রতিবেশী সব ছেলেমেয়েদের বিনা পারিশ্রমে পড়ান। তাহলে মেয়েটা শেষ পর্যন্ত হেরে গেল? সে হয়তো বুঝেছিলো তার বাবার কিছুই করার নেই। তাই বাবার কাছে এবার আর টাকা চাইতে পারল না। স্যার একবার তার বাড়িটা বিক্রি করার জন্য প্রস্তুত নিচ্ছিল। কিন্তু মেয়ে তা হতে দেয়নি। বাড়ি বিক্রি করলে বাবার ঠায় হবে কোথায়? কথা গুলো হেড স্যারের কাছ থেকে শুনেছি। এখন আর যৌতুকের টাকা চাইবে না। হতভাগী আত্মহত্যা করে নিজেকে মুক্তি দিয়েছে, না কি তার হতভাগ্য বাবাকে? মৌসুমি আপা বললেন, কি ভাবে কি হলো স্যার? হতভাগী গলায় ফাঁস দিয়েছে। তাহলে শেষ পর্যন্ত মেয়েটা গলায় ফাঁস দিয়ে মরলো! আহারে, গাজী স্যারের আর কেউ রইল না। কলিমদ্দিন স্যারের আফসোস। আনোয়ার স্যার বললেন, যৌতুকের জন্য কাদের স্যারের উপর এই অভিশাপ? বেচারার বয়েস হয়েছে, না জানি কি করে এই শোক সামলাবে। ফরিদ সাহেব বললেন, সবই আল্লাহর ইচ্ছে। স্যারকে আল্লাহ ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতা দান করুন। আমিন। এতক্ষণে ছুটির ঘন্টা বেজে গেছে। স্কুল এখন ফাঁকা।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড