• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : উপহার

  কাজী সাবরিনা তাবাস্‌সুম

১১ এপ্রিল ২০১৯, ১১:৫৫
গল্প
ছবি : প্রতীকী

পহেলা বৈশাখের দিন ভোরবেলায় ক্যাম্পাসের সবাই যখন প্রভাতফেরীতে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত, শশী তখন দাঁড়িয়ে আছে তার হলের মেইনগেটে। রাহাত বলেছে পাঁচ মিনিটের ভেতর আসছে, পনেরো মিনিট হতে চললো। শশী জানে তাকে আরো পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। কিংবা তারও অনেক বেশি সময়। রাহাত কখনোই সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করতে পারেনা। সে একজন ঝামেলাযুক্ত ছেলে। যেখানেই যায়, ঝামেলা তার চারপাশে ঘুরঘুর করে। পাঁচ মিনিটে জীবনেও আসবেনা জেনেও শশী ঘুমঘুম চোখে তিন মিনিটের মাথায় পাঁচ তলা থেকে দৌড়ে চলে এসেছে হলের গেটে। কারণ রাহাতের জন্য অপেক্ষা করতে তার অসম্ভব ভাল লাগে!

এত সকালে রাহাতের জরুরী তলবের কারণটা সে জানে। রাহাত তাকে পহেলা বৈশাখের উপহার দিবে। তার রুমমেটরা ভালবাসার মানুষের কাছ থেকে আগেই পেয়ে গেছে উপহার। লাল পেড়ে শাড়ি, কাঁচের চুড়ি, টিপ। গত কয়েকদিন ধরে তো রুমে এসব নিয়েই হইচই। কিন্তু রাহাত তাকে কোন উপহার দেয়নি। শশী এই নিয়ে তেমন চিন্তাও করেনি। সে জানে, রাহাত এসব বোঝে না। হয়তো তাকে বলে দিলে সে করবে। কিন্তু বলে কয়ে উপহার পেতে চায়না শশী। তার উপর ঝামেলাপ্রিয় রাহাত শাড়ি কিনতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ে পহেলা বৈশাখটাই মিস করে কিনা! তার চেয়ে এই ভাল, গত বছরের মত তারা ঘুরে বেড়াবে রিকশায়, ছবি তুলবে, চারুকলায় গান শুনবে আর একসাথে কাটাবে অনেকটা সময়। শশীর এটুকুই চাওয়া।

কিন্তু বলা নেই কওয়া নেই, সাতসকালে রাহাত ফোন করে তার ঘুম ভাঙিয়ে দিলো! বললো পাঁচ মিনিটের ভেতর হলের গেইটে চলে আসতে। তাকে পহেলা বৈশাখের উপহার দিবে! শশী নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারলোনা। তাড়াহুড়া করে হলের গেইটে গিয়ে তার মনে পড়লো সে তো ব্রাশই করেনি! ছি! কি বলবে রাহাত? তাড়াতাড়ি নিচতলার বাথরুম থেকে ভাল করে মুখ ধুয়ে নিলো। আঙুল দিয়ে দাঁতগুলো ঘষে নিলো কয়েকবার। যা আছে কপালে! এখন আবার পাঁচতলায় ওঠা সম্ভব না।

ফোনের দিকে তাকালো শশী। আধ ঘণ্টা হয়ে গেছে। রাহাতের দেখা নেই! প্রভাতফেরীর সময় হয়ে গেছে বোধহয়। হল থেকে মেয়েরা সেজে গুঁজে বের হয়ে যাচ্ছে। পরিচিত কয়েকজন তো বাঁকা হাসি দিয়ে চলে গেল। যার অর্থ, তারা বুঝতে পেরেছে শশী কার জন্য দাঁড়িয়ে আছে! শশীর এতে কিছু এসে যায়না। সে জানে, মেয়েরা অপেক্ষা করতে পছন্দ করেনা। তাই অন্য কোন মেয়েকে অপেক্ষারত দেখতেও পছন্দ করেনা। হেসে অথবা সহানুভূতি দিয়ে তারা এটাই বোঝাতে চায়। শশী নিজেও অপেক্ষা করতে একদম পছন্দ করেনা। শুধুমাত্র রাহাতের জন্য অপেক্ষা করতে তার ভীষণ ভাল লাগে।

পঞ্চাশ মিনিটের মাথায় রাহাতের ফোন আসলো। হলের মেইনগেটের ভেতরে ছেলেদের ঢোকার নিয়ম নেই। রাহাত তাই হলের সামনে এসে ফোন দিলে শশী বের হয়। এবারও একইভাবে রাহাতের ফোন পেয়ে শশী বের হলো। দেখলো রাহাত দাঁড়িয়ে আছে একটা চটের ব্যাগ নিয়ে! প্রায় আধপাগল চেহারায় উস্কোখুস্কো চোখে শশীর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘স্যরি, তোমার উপহার কিনতে গিয়ে দেরী হয়ে গেছে!’ - তোমার কাছে উপহার চেয়েছি আমি? আজিব এক পাবলিক! - আর বলো না, আমার রুমমেট জয় তার গার্লফ্রেন্ডের জন্য একটা শাড়ি কিনেছে। কাল রাতে আমাকে দেখালো। দেখে হঠাৎ এমন লজ্জা লাগলো। আমার তো মনেই নেই তোমাকে কিছু দেওয়ার কথা। তুমি নিজেও কিছু বলোনা। খুব ইচ্ছা করলো তোমায় কিছু দেই। কিন্তু ততক্ষণে মার্কেট বন্ধ হয়ে গেছে। জয়কে বললাম কিছু একটা বুদ্ধি দিতে। সেও কোন আইডিয়া দিতে পারলোনা। সারা রাত ঘুম হয়নি চিন্তায়। হঠাৎ ভোরবেলায় একটা আইডিয়া আসলো। আর সেজন্যই তোমার ঘুম ভাঙালাম। এই নাও তোমার উপহার।’

শশীর দিকে চটের ব্যাগটা এগিয়ে দিলো রাহাত। শশী ব্যাগের ভিতরে দেখে বিশাল এক ইলিশ মাছ! শুধু তাই না, সাথে আছে চাল, ডাল, তেল, লবণ, পিঁয়াজ, রসুন আর কাঁচা আম! বিস্ময়ে হতবাক শশী চোখ বড় বড় করে রাহাতের দিকে তাকালো। রাহাত অন্য হাতে একটা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ যা শশী খেয়াল করেনি। সেই লাঠি শশীর দিকে বাড়িয়ে বললো, ‘নাও মারো! আমি জানি এটা খুব ফালতু উপহার। এটা দেখেই তোমার আমাকে মারতে মন চাইবে। তাই লাঠিও নিয়ে এলাম! আমার কি দোষ বল? পহেলা বৈশাখের দিন সব মার্কেট থাকে বন্ধ। আমি চাইলে পরে তোমাকে শাড়ি কিনে দিতে পারতাম। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা করছিলো আজকেই তোমাকে কিছু একটা দেই। I’m sorry , শশী।’

শশী একটা কথাও বললো না। ব্যাগটা নিয়ে হনহন করে চলে গেল হলের ভিতরে। ক্রোধে তার সারা শরীর কাঁপছে! রাগটা যতটা না এজন্য যে তার বয়ফ্রেন্ড তাকে পহেলা বৈশাখে ইলিশ মাছ গিফ্ট করেছে, তার চেয়ে শতগুণ বেশি এজন্য যে, তার রুমমেটরা এই ঘটনা দেখে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করার একটা topic পেয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে আর রাগে কিড়মিড় করছে সে। তিনতলা পর্যন্ত উঠে তার মনে হলো, আরে! রাহাত তো তবু তাকে ইলিশ মাছ গিফট করেছে। সে তো রাহাতের জন্য কিছুই করেনি। গিফ্ট পাওয়ার আশা ছিলনা বলে কি সে নিজেও গিফ্ট দিতে পারতো না? প্রচণ্ড লজ্জা লাগলো তার। সেই সাথে রাগটা আরও বেড়ে গেল। এইবার সম্পূর্ণ রাগ হলো নিজের উপর। রাহাতের দেয়া চটের ব্যাগটার ভেতরে আবারও তাকালো সে । কত্ত বড় একটা মাছ! বৈশাখের দিনে তো ইলিশমাছের দাম আকাশচুম্বী হয়। এত বড় মাছ কেনার টাকা পেল কোথায় সে? ছেলেটা বুদ্ধি করে রান্নার সব উপকরণও কিনেছে। সাথে আবার কাঁচা আম। রাহাত জানে শশী কাঁচা আম বলতে পাগল। কিন্তু বৈশাখের প্রথম দিনে কাঁচা আম খুঁজতে নিশ্চয়ই বেগ পেতে হয়েছে প্রচুর। ছেলেটা তবুও ঝামেলা করে খুঁজে বের করেছে। এজন্যই দেরী হলো তার। শশী কাঁচা আমগুলো বের করে পরম যত্নে ছুঁয়ে দিলো। রাহাতও ছুঁয়েছে নিশ্চয়ই। আহারে! ছেলেটা সাতসকালে বাজারে দৌড় দিলো, নাশতাও জোটেনি কপালে! শশী আর ভাবতে পারলো না। অনেক কাজ বাকি তার। ইলিশ মাছ ভাজবে। ভাত রাঁধবে। কাঁচা আম দিয়ে ডাল রাঁধবে। মাছ সে আগে কখনোই কাটেনি। তবে আজ পারবে সে, পারতে তাকে হবেই। সে ঠিক জানে, রাহাত হলের সামনে বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে না যাওয়া পর্যন্ত এভাবেই বসে থাকবে! এক তিল নড়বে না। শশীর রাগ যে তাকে অনেক ভাবায়। শশী যাবে, কিন্তু তার একটু দেরী হবে। রাহাতের উপহার দিয়ে সে রাহাতের জন্যই রান্না করবে আজ। বিশেষ মুহূর্তটা ভেবে নিলো সে, ঠিক যখন রাহাত শশীর রাগ ভাঙানোর কথা চিন্তা করে পাগলপ্রায়, শশী হাজির হবে টিফিনবক্স ভর্তি রান্না করা খাবার নিয়ে। এটাই হবে রাহাতকে দেওয়া তার বৈশাখী উপহার।

ওডি/এসএন

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড