রোকেয়া আশা
দাদীর হাতে মোবাইল । রিংটোন বাজছে । দাদী ফোন রিসিভ করতে পারে, এখন আমি বাসায় বলে হয়তো করছেনা। ইলেকট্রিক ডিভাইস নিয়ে দাদীর সবসময় একটা টেনশন কাজ করে। বাধ্য না হলে কোন ইলেকট্রিক জিনিসে হাত দেন না।
আমি ফোনটা হাতে নিলাম, দুলাভাইয়ের নাম্বার।
দেখেই গা ঘিনঘিন করে উঠলো আমার, এই লোকটাকে সহ্য করতে পারিনা আমি। আমি পাঁচ বছর আগে আরো ছোট ছিলাম। অনেক ছোট। এই লোকটা তখন আমাকে কোলে নিয়ে যেমন করতো, সেগুলো আমি ভুলিনি। তখন বুঝতাম না আমি, এখন অনেকটা বুঝি। ওটা ভালো কিছু ছিলো না। কিছুতেই না।
ওইসব ঘটনা মনে পড়লে খুব কান্না পায় আমার। আমি রোজ রাতে লাইট বন্ধ করে দেওয়ার পর খুব কাঁদি। কাউকে বলিনি কখনো। এমনকি শাহীন ভাইকেও না। আমার এইটুকু জীবনেই যে কষ্ট পাওয়ার মত এতকিছু ঘটে গেছে কে বুঝবে?
কান্নাটা ভেতরে জোর করে আটকে রেখে ফোনটা রিসিভ করলাম।
- হ্যাঁ, দুলাভাই, বলেন। কোনমতে কথা গুলো বললাম ।
- মেঘনা? তোমার আম্মা কই?
অসহ্য লাগছে আমার। জানোয়ারগুলোও মানুষের মত কথা বলে কিভাবে? রাগের আর কষ্টটা চেপে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে লাগলাম।
- আম্মা স্কুলে।
- শাহীন?
- ভার্সিটি তে গেছে।
ওপাশে কিছুক্ষণ কোন কথা আসেনা। তারপর লোকটা সাপের মত হিসহিস করে প্রশ্ন করে- রূপু নাকি পালায় গেছে?
কথাটা শুনে অস্বস্তি হয় আমার। লোকটা কিভাবে জানলো? আমি বুঝে উঠতে পারিনা কি বলবো! কিছু না বলে ফোনটা কেটে দিই চুপচাপ। সুইচ of করে দিই।
বিয়ের এক বছরের মাথায় বড় আপার যমজ ছেলে হয়। আপা ওদের নাম রেখেছে স্বচ্ছ আর শুদ্ধ। এখন অবশ্য এই নামে ওদের কেউ ডাকে না। আমি আর শাহীন ভাইই শুধু ডাকি। স্বচ্ছ আর শুদ্ধের বড় তিনটা বোন আছে। সৎ বোন অবশ্য। তাদের মধ্যে দুজন আমার চেয়ে বয়সে বড়। আমার খুব ইচ্ছে করে জানতে, লোকটা তার মেয়েগুলোকেও কোলে নিয়ে অমন করে কিনা। আমার কষ্ট হতে থাকে, আবারো। অনেক বেশী। আমার জন্য, বড় আপার জন্য, শাহীন ভাইয়ের জন্য, আব্বুর জন্য।
ফোনটা টেবিলের ওপর রেখে আমি আস্তে করে আব্বুর ঘরে যাই। আব্বুর পাশে বসে পড়ি। বোটকা একটা গন্ধ এখানে। একটা অসুস্থ মানুষ। আমার মনে হতে থাকে আমার পুরো পরিবারটাই এমন । অসুস্থ। প্যারালাইজড। আব্বুর কপালে হাত রাখতেই আব্বু অল্প হাসার চেষ্টা করলো। আমি মাথাটা নামিয়ে আব্বুর মুখের কাছে কান পাতলাম। আব্বু আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো- তুমি ভালো আছো মা?
আমি মাথা তুলে হাসলাম আব্বুর দিকে তাকিয়ে। মাথা ওপর নিচে নেড়ে হ্যাঁ বললাম। আব্বুও হাসলো। মন খারাপ করা হাসি। আমি কিছু না বলে আব্বুর একটা হাত ধরে বসে থাকলাম। ভাই ফিরে এলো দুপুরের খানিক পরেই। মাহিন সাথে। দেখে মনে হলো মেজাজ খারাপ করে আছে কোন কারণে।
- ফোন বন্ধ ছিলো কেন?
আমি প্রশ্ন শুনে মাথা নিচু করে ফেলি। ভাই গলাটা আরো শক্ত করে বলে- কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বলি- দুলাভাই ফোন করেছিলো।
আমি না তাকিয়েও বুঝতে পারি, ভাইও আমার মতই থমকে গেছে। লোকটাকে ভাইও পছন্দ করেনা।
- কি বলেছে?
- রূপু আপার কথা।
ভাই চুপ হয়ে যায় হঠাৎ। তারপর জিজ্ঞেস করে- তুই কি বললি?
- কিছুনা। ফোন কেটে সুইচ অফ করে দিয়েছি। বলেই ভাইয়ের দিকে তাকাই।
তারপর আবার বলতে শুরু করলাম- আমি জানিনা ভাই, আমার কি করা উচিত ছিলো। ভাইয়ের মুখটা কোমল হয়ে আসে, ভাই আমার মাথায় একবার হাত রাখে। তারপর কিছু না বলেই বের হয়ে যায়।
আমি নাইনে ভর্তি হবো এবার। জে এস সিতে কিভাবে যেন বৃত্তিও পেয়ে গেছি। কারো জন্য আসলে পৃথিবীতে কিছু থেমে থাকেনা। রূপু আপা পালিয়ে গেছে দেড় বছর হলো। আপার কথা কেমন যেন এখন আর মনে পড়েনা। একটা সময় রূপসা নামে কেউ এই বাড়িতে থাকতো; এটাও কেমন অচেনা কথা মনে হয়। কিন্তু এই দেড় বছরে সবচে বড় আরেকটা আঘাত এসেছে আমাদের ওপর। বড় আপার মৃত্যু। এতটা কষ্ট আর কখনো পাইনি আমি। গতবছর হঠাৎ এক রাতে ভাই এসে ঘুম থেকে ডেকে তোলে আমায়। ভাই বরাবরই ঠাণ্ডা ধরণের। তারপরও, সেরাতের মত এত শীতল আচরন করতে ভাইকে আর কখনো দেখিনি।
আমাদের বড় আপা তিতাস। আব্বু আম্মার প্রথম সন্তান। এই আপার বিয়ের সময়ই ভাই কেঁদেছিলো। অথচ তখন কি অবলীলায় ভাই বলে ফেললো- বড় আপা মারা গেছে মেঘ।
আমি অবাক হয়েছিলাম খুব। বড় আপা কিভাবে মারা যেতে পারে? এত তাড়াতাড়ি? আমাদের স্বচ্ছ আর শুদ্ধের মা নেই কোন?
আপাকে দেখতে আমরা যখন পৌঁছালাম, তখন রোদ উঠছে । আপা ওদের বাড়ির বড় বারান্দাতে শুয়ে ছিলো। আমি দেখলাম আমাদের তিতাস আপার মুখের ওপর আলো এসে পড়েছে, আমাদের শ্যামলা আপার চেহারা একদম কাঁচা হলুদরঙের হয়ে গেছে। কি যে সুন্দর লাগছে আপাকে! আপার বিয়ের সময় ওকে দেখতে কেমন লাগছিল আমার মনে নেই। কিন্তু আমি একদম নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, আজকের মত এত সুন্দর আপাকে কখনোই লাগেনি।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড