• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

শূন্য দশকের কয়েক জন কবির কবিতা বিশ্লেষণ

  অধিকার ডেস্ক    ২৬ এপ্রিল ২০১৮, ১০:২১

কবি- সবুজ তাপস, ফেরদৌস মাহমুদ, অরূপ কিষাণ, ফুয়াদ হাসান, বিনয় সরকার, সিদ্ধার্থ শংকর ধর, সোহেল হাসান গালিব,নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

কোনো একটা কিছুকে অবলম্বন করে বা কোনো কিছুকে পাওয়ার আশায় মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। যার কোনো চাওয়া নেই, সে মানুষ নয়, দেবতাও নয়, ঈশ্বরও নয়। অভাবের ভেতরেই চাওয়ার ব্যাপারটা নিহিত। ঈশ্বরের অভাব (যদিও বলা হয়, ঈশ্বর অভাবমুক্ত) হল মানুষের পূজা বা আরাধনা প্রাপ্তি। শূন্য দশকের অন্যতম আলোচিত কবি সবুজ তাপস ‘দোটানা ও টানা’ কবিতার ‘দোটানা‘ অংশে সাবলীল ভাষায় চিত্তাকর্ষী পরিস্থিতি দাঁড় করে তার বেঁচে থাকার কারণ তুলে ধরেছেন। যখন তিনি দেখতে পান হানাহানিপূর্ণ কাজকারবার, বৈষয়িক-সাংসারিক দরকষাকষি, মানুষের চালাকিপূর্ণ আচরণ, আত্মহত্যা করবার ইচ্ছা পোষণ করেন, ঠিক তখনই রাস্তায় বের হয়ে যদি কোনো সুন্দর-সোমত্ত নারীর দর্শন পান, ভাবেন বেঁচে থাকা জরুরি। অর্থাৎ জৈবনিক জটিলতা তাকে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলে এবং পাশাপাশি সোমত্ত নারীর সৌন্দর্য করে তোলে বাঁচনপ্রিয়। কবি এখানে ‘দোটানা’ দ্বারা বোঝাতে চেয়েছেন, তার মধ্যে আত্মহত্যা ও বেঁচে থাকার মতোন দু’বৈপরিত্যের দ্বন্ধ চলছে এবং বরাবরই বেঁচে থাকছেন। এই অংশে ‘জৈবনিক জটিলতা’ ও ভাবের ভাইব্রেশন’ এর মতোন, তার নিজস্ব, আনুপ্রাসিক ব্যবহার রয়েছে। ‘টানা’ অংশ খুবই হৃদয়স্পর্শী। আমাকে দু’হাতে টেনে নাও বুকের ভেতর, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ফার্নিচার হাতে যেমন টেনে নাও চোখের তলে কাজলের নৌকোচাঁদ।

দৈনিক পূর্বকোণের সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত শাহিনুর শায়লার লেখার কার্টিংয়ের স্ক্যান কপি

পাঠক এমন সহজ-সরল ভাষার আবেদনময় কবিতাই চান। ‘কাজলের নৌকোচাঁদ’ দৃশ্যকাব্যময় ও শিল্পসম্মত। যেকোনো পাঠক বলতে বাধ্য হবেন, ‘দোটানা ও টানা’ পুরোটাই নতুন কথার কাব্যানুষঙ্গ।

‘স্বীকারোক্তি’ কবিতার শ্রুতিসুন্দর পঙক্তি- পাশে ডিসিহিল আর আশীষ সেন: সবকিছু ভুয়া সত্য কেবল অরুণ দাশগুপ্ত, জ্যোতির্ময়, জ্যোতির্ময়। আর গতিসম্পন্ন পঙক্তি-

তোমরাও দেখ, নন্দন কানন-জামাল খাঁ আর মোমিন রোড দৌড়ে এসে একসাথে ঢুকে পড়ে চোখে, মুখের ভেতর এই কবিতায় কবি কর্ণফুলির মতোন কতকগুলো অনুষঙ্গ তুলে ধরে বলেছেন, তিনি কোন কবি নন, কবি হল অনুষঙ্গগুলোই। এগুলো তার হাত-পা দখলে রেখে কবিতা লিখে নেয়। এটা এক ধরনের আবেগের কথা। কবিতাতো আবেগের হাত ধরে হাঁটে। অনুষঙ্গগুলোকে যদি প্রকৃতি বা পবিবেশ হিসেবে ধরি, তবে বলা যায় এখানে সবুজ তাপস নিজেকে প্রকৃতির কলম হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি হয়তো বুঝিয়েছেন, কর্ণফুলিরা তাকে প্রলুব্ধ করলে কাগজ-কলম টানেন এবং কবিতা লেখা হয়। তো এর ক্রেডিট কর্ণফুলিদেরই। কেননা তারা তাকে প্রলুব্ধ না করলে কবিতার জন্ম হতো না। অর্থাৎ যা ভাব জাগায় তা-ই আসল। এ-জাতীয় কাব্যদর্শন কারো কারো মনপূত না হলেও নতুন কিছু। প্রাসঙ্গিক বক্তব্য যে, এই কবিতায় যতি চিহ্নের ব্যবহার উপযুক্তভাবে নেই। যেমন, ‘জ্যোতির্ময়, জ্যোতির্ময়’-এর পর ‘।’ (দাঁড়ি) চিহ্ন থাকার কথা, কিন্তু ‘!’ (আশ্চর্যবোধক) চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। একটু আগে উল্লেখ করেছি, কবিতা আবেগের হাত ধরে হাঁটে। এর অর্থ এই নয় যে, এই আবেগের কোনো ৗেক্তিকতা থাকবে না। কবিতায় থাকবে কবির যৌক্তিক আবেগ। এই আবেগ রিয়েলিস্টিক। অদৃশ্য বস্তু সম্পর্কে যে আবেগ তা রিয়েলিস্টিক নয়, যৌক্তিকতাবর্জিত। তরুণ কবি ফেরদৌস মাহমুদের ‘দৈব, বিশ্বাস ও ধ্যান’ এমন এক ধরনের লেখা যা বস্তুধর্ম তথা যৌক্তিকতাবর্জিত। তিনি প্রথমেই উল্লেখ করেছেন, পৃথিবী নাকি দৈবের চিড়িয়াখানা। মধ্যযুগমনস্ক তথা ‘সীমা লঙ্ঘন করো না’ বিশ্বাসীরা এমন বলতে পারেন। কিন্তু আধুনিক পাঠক এ-সময়ের কোন তরুণের কাছে এজাতীয় বক্তব্যের কোনো কবিতা আশা করেন না। বলা হয়েছে, তিনি নাকফুল বানানোর কৌশল শিখেছেন বানরের কাছে। তা তিনি লিখে রেখেছেন জলডাঙার প্রাচীন দলিলগুলোতে। সূর্যোদয়ের দেশ বলতে আমরা জাপানকেই জানি। তিনি উল্লেখ করেছেন, ভিক্ষার থালায় ফুল বিক্রি করতেন, জাপানি নাবিকেরা কয়েনের বিনিময়ে তা কিনে নিতো, দিয়ে যেতো ভিন্ন সৌরজগতের অভিন্ন সামুদ্রিক পাথর। ব্যাপারটা উদ্ভট ধরনের মনে হয়েছে। এটাকে কবিতার নামে তার প্রলাপ বকাই বলব। তবে এটা উপলব্ধ হল যে, তিনি দেশাত্মবোধ থেকে ভ্রমাত্মক তথ্যসম্বলিত লেখাটি লিখেছেন। ‘এক থালা লিচু’তে কবিতার নামে মদোন্মক্ততা প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি মদমাতাল হলেন, সম্ভবত প্রিয়াও। তা না হলে বলতে পারেন না, রাতের বেলায় ‘আকাশ গাঢ়ো নীল…, চাঁদ উঠেছে…।’ মদমত্ততা নিয়ে ভালো কবিতা হতে পারে। এটা তেমন ধরনের কিছু নয়। আমরা যখন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার ভেতর ডুব দিই, তখন দেখতে পাই মদোন্মক্ততা কীরূপে কবিতা হয়েছে।

এ সময়ের বেশির ভাগ তরুণ কবিতার নামে দুর্বোধ্য কথার চাষাবাদ করছেন। অথচ দেশের প্রধানতম কবি নির্মলেন্দু গুণ ও সৈয়দ শামসুল হকের কবিতাও বোধ করা যায়। পাঠক কবিতার ভেতর ঢুকতে না পারলে, কবিতার ভবিষ্যৎ…। তরুণদের কবিতা দুর্বোধ্য হওয়ার পেছনে পদ ও পঙক্তির ভ্রমাত্মক ব্যবহারকে দায়ী করা যায়। নিতুপূর্ণার ‘পাখির উঠোন হতেও পারে বধ্যভূমি’ কম বাক্যের লেখাটিতে পদের ভ্রমাত্মক ব্যবহার বেশি। প্রথম বাক্যটি ‘লাগে’ পদের জন্য শ্রুতিকটু। দ্বিতীয় বাক্যে ‘ঝাঁ ঝাঁ বৃষ্টি’ ভ্রমাত্মক। কেননা বৃষ্টির ক্ষেত্রে ‘ঝাঁ ঝাঁ’ অনুপযুক্ত, ‘ঝাঁ ঝাঁ’ অব্যয় পদ। পদের দিক থেকেও এটি ভুলভাবে প্রযুক্ত। এটি এমন ধরনের পদ, যা প্রচন্ড উত্তাপের ভাবব্যঞ্জক, যন্ত্রণার ভাবপ্রকাশক, নিস্তব্ধতার ভাবদ্যোতক, অতিক্ষিপ্রতাপ্রকাশক। এর কয়েকটি ব্যবহার: ‘রোধে ঝাঁ ঝাঁ করা’, ‘মাথা ‘ঝাঁ ঝাঁ’ করা’, রাত ‘ঝাঁ ঝাঁ’ করা ও ‘ঝাঁ ঝাঁ’ করে কাজ করা। তাছাড়া এর ‘এদেশ এখন শিকারি/ হত্যা ও খুনি/ নানান রকম শোকের বাতি’ ভ্রমাত্মক। ‘শিকারি হত্যা ও খুনি’-এর মধ্যে ভুলটা আবিষ্কার করা যাবে। নিতুপূর্ণার ‘লটারি ও টিকিটির মতো যাপন-০২’-তে গভীরবোধের কিছু নেই। দুটোতে যতিচিহ্নের ব্যবহার নেই, যার ফলে কোনো কোনো লাইনকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। প্রথমটির ‘যে সব অঞ্চলে আহত পাখিরা উড়ে গেছে উপদ্রুত ভাবতে পার তাদের’ লাইনটি অপ্রয়োজনীয়। তাছাড়া আহত পাখির ব্যাপারটা প্রাসঙ্গিকভাবে আসেনি। দ্বিতীয়টির ‘সময়কে মনে হয় হঠাৎ-ই বাক্সময় করতোয়া’ বক্তব্যে নতুনত্ব নেই। কেননা সময়কে স্রোত কিংবা নদীজলের সাথে তুলনা করার ব্যাপারটা অনেক আগের। এর ভাবরস একটি গদ্যময় বাক্যে নিহিত: জাগতিক ঘটনা যেমন আমাদের প্রেম জিঘাংসা-শুশ্রুষা ও কাব্য প্রকৃতির অন্যথা নয়’।

এ সময়ের কবিতার আরেকটা দোষ, এতে অপ্রয়োজনীয় বা বাড়তি বিষয়ের উপস্থিতি থাকছে। অথচ কবিতাতে কবিতাঘনিষ্ঠ বিষয়ই থাকবে। অরূপ কিষাণের ‌উপলব্ধি’ কবিতার ‌কুড়াতে গিয়ে ঝিনুক, তুলে নিলাম সমুদ্র/ করতলে আটে না, ছুইয়ে পড়ে নিরন্তর…’ অংশটি বাড়তি। কবিতাটিতে যা বলা হচ্ছে, তার জন্যে এটি নিষ্প্রয়োজন। তিনি শাখের করাতীকে বলছেন, তিনি একটা নীল সমুদ্র গিলে ফেলেছেন।

শূন্য দশকের অন্যতম প্রধান আলোচিত তরুণ কবি সবুজ তাপসের কবিতা সরল এবং গভীরবোধবহ। উল্লেখিত কবিতাদুটো (‘উৎসর্গ: ময়ুখ চৌধুরী’ ও ‘সামুদ্র সংলাপ’) পড়লেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কালধারায় প্রকাশিত তার ‘উৎসর্গ: ময়ুখ চৌধুরী’ কবিতার মূল কথা: মানুষের স্বভাব এমনই, সে বিভিন্ন উপায়ে অপরের কাছে যাবে এবং অপরকে বুঝাতে চা’বে। এর অর্থ- সে অপরকে বোকা মনে করে। অপরকে বোকা মনে করার এই যে-দর্শন, ইতোপূর্বের কোনো কবিতায় পরিলক্ষিত হয় না। কবিতাটির শিরোনামও ব্যতিক্রান্ত। কবিতার শিরোনামও যে এই রকম হতে পারে, তা সবুজ তাপসের কাছে শিখতে পেরেছি। প্রশ্ন হতে পারে, কেনো এই শিরোনাম। অনুমান করতে পারি, এই কবিতায় তিনি কবি ময়ুখ চৌধুরীর আচরণ মাথায় রেখে মানুষের শাশ্বত স্বভাব তুলে ধরতে গেছেন। এই কবিতার ‘বিচিত্র চিত্র’, ‘কথার খই’, ‘ঈশ্বরের বাড়ি’, ‘বে-আন্দাজ কাজ’, ‘ভাবনার বৃষ্টিপাত’, ‘তর্ক-বিতর্কের ধোঁয়া’, ‘কথার কাঁথা’ ও ‘সবুজ অবুঝ’ খুবই দৃশ্যমান শব্দবন্ধ। এগুলোর কোনোকোনোটিতে আনুপ্রাসিক বুনন পরিলক্ষিত। এই যে আনুপ্রাসিক বুনন ও দৃশ্যময়তা, কবিতাটিকে ঝকঝকে করেছে। তৃতীয় চোখ এ প্রকাশিত তার ‘সামুদ্র সংলাপ’ কবিতাটি শ্রুতিসুখকরও। সমুদ্র দেখে আসতে তাকে কেউ একজন (হয়তো বন্ধু) সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। তিনি এতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। তাকে জানালেন, নারীর প্রতারণায় তার কবি হয়ে ওঠা। সমুদ্র দেখতে গেলে যদি সমুদ্রও তাকে প্রতারিত করে, অগস্ত্যযাত্রার পথ রচিত হতে পারে। সমুদ্র তার সাথে প্রতারণা করতে পারে। কারণ তিনি দেখান, নারীর মতো এটিও খোঁজে চাঁদের হাসি, অমাবস্যার দাসী এবং ভাসায়-ডোবায়। বলতে পারি, আর প্রতারিত হতে না চাওয়ার মানসিকতা থেকেই তার এই অসম্মতি প্রকাশ। আবার যদি নারীর কাছে গিয়ে কবি হওয়া আর সমুদ্রের কাছে গেলে মৃতবস্তু হওয়াকে বিবেচনা করি, তবে নারী ও সমুদ্র এবং কবি হওয়া ও মৃতবস্তু হওয়া – দুটি সমরৈখিক শ্রেণি দাঁড় হয়। সবুজ তাপস নারী ও সমুদ্রের চরিত্র একই সীমারেখায় রেখেছেন। কবি হওয়া আর মৃতবস্তু হওয়াকে একই কিছু বলার পক্ষে যুক্তিও রয়েছে। যুক্তি এই: কবি হওয়া আর সাধারণ মানুষ থাকা এক কথা নয় এবং কবি হওয়াতো সাধারণ মানুষ থেকে রূপান্তরিত কিছু হয়ে যাওয়া। সবুজ তাপস কবি হতে চাননি। তার ভাষায়:

অথচ আমার কবিতা লেখার ইচ্ছে ছিল না এভাবে, সমুদ্রের কাছে গিয়ে প্রতারিত হয়ে মৃতবস্তু হতেও তার ইচ্ছে নেই। তার ভাষায়: তার কাছে যেতে চেয়েছো তো তুমি যাও নিজে পতেঙ্গার বিচে আমি যাব না সে যা-ই হোক, কবিতাটির বিন্যাস খুবই শিল্পিত। দ্যাখো, যত নারীর কাছে গেলাম, সবাই বিমুখ হৃদয়ে ছেড়ে দিলো অসুখ, নিবের চুচুক থেকে প্রতিরাতে কালি ঝরে, অথচ আমার কবিতা লেখার ইচ্ছে ছিল না না বললে নয়, সবুজ তাপস সমুদ্রকে নারীর উপমান হিসেবে দেখেছেন। এই দেখাতে নতুনত্ব নেই। কারণ, ইতোপূর্বে কোনো কোনো কবি নারীকে নদীর উপমায় উপস্থাপন করেছেন। নদী আর সমুদ্র এক না হলেও বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে খুব কাছাকাছি। শূন্য দশকের অন্যতম কবি ফুয়াদ হাসানের কবিতা সরল এবং চটুল ঢঙের। তার বেশির ভাগ কবিতা ক্ষীণকায়। কিন্তু কালধারায় প্রকাশিত ‘কৃতজ্ঞতা স্বীকার’ দীর্ঘকায় এবং বর্ণনামূলক। অথচ এ-সময়ের কবিতায় বর্ণনা তথা বিবৃতি পরিহৃত। এ-কবিতায় তিনি তার বন্ধুদের স্বভাব, অবস্থা, কাজ ইত্যাদি তুলে ধরে বলেছেন, আমার বন্ধুরা আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসে। তিনি বলতে চেয়েছেন, তাকে নিয়ে বন্ধুদের এই যে স্বভাব বা আচরণ, তা তাকে ভালোবাসার কারণেই। বন্ধুত্ব থাকার কারণেই তারা তার, তার কবিতা সম্পর্কে ইতি-নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তিনিও তাদের সম্পর্কে – তাদের কবিতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে চান। তার ভাষায়, ‘আমিও আমার বন্ধুদের মতো হতে চাই’। এটা এক ধরনের বক্রোক্তি। কবিতা এখানেই। না বললে নয়, বন্ধুদের কবিতা সম্পর্কে মন্তব্যপ্রবণ হতে চাওয়া বিষয়ক কবিতাটির জন্য প্রথম স্তবক অপ্রয়োজনীয়। কেবল দ্বিতীয় স্তবক উল্লেক করেও কাজটা নিষ্পন্ন করা যেতো। এই কবিতার কোথাও কোথাও যতি চিহ্নের ব্যবহার নেই, ফলে শ্রুতিকটু লাগবে পাঠকের কাছে। যেমন, ‘সরকারি মন্দলোক ভিড়লে আঁচলে আদিবাসী ক্যাকটাস সাজে প্রয়োজনে নিতান্ত বাঘারু…’। তাছাড়া ‘আমার বন্ধুরা মৃত পিঁপড়ের বিরহে কাতর’ ভ্রমাত্মক। কারণ, যা মৃত, তার বিরহ থাকতেই পারে না।

সোহেল হাসান গালিবের ‘ক্রীতদাসের হাসি’-এর প্রথম স্তবক পঙ্ক্তিবহুল। এতে আরব্য রজনীর গল্পের দৈত্যের যে বর্ণনা দেযা হয়েছে, তা একটি মাত্র মজবুত পঙ্ক্তির মাধ্যমে তুলে ধরা যেতো। ‘জোছনার সরণি’র কারণে দ্বিতীয় স্তবকের ‘তারা সব জোছনার সরণির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নতজানু’ মনের মধ্যে কোনো দৃশ্য হাজির করে না। চতুর্থ স্তবকের ‘অচিরাৎ’ ও ‘খিন্ন’ বহুলাংশে সেকেলে শব্দ। অথচ এগুলোর বর্তমান ও বোধ্য ব্যবহার বর্তমান (‘অচিরাৎ’ মানে ‘অচিরে’ এবং ‘খিন্ন’ মানে ‘অবসন্ন’, ‘কান্ত’, ‘দুঃখিত’ ইত্যাদি। অপরিচিত শব্দ হওয়ার কারণে, পাঠক নয়- অনেক কবিকেও অভিধানের দ্বারস্থ হতে হবে। কবিতা বোধ করা আর বোধ করতে এসে শব্দাবদ্ধ হওয়া এক কথা নয়। প্রথম শব্দটি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ব্যবহার করেছেন এভাবে: ‘উন্মাদনা অচিরাৎ পলাল কোথায়?’ দ্বিতীয়টির ব্যবহার কাজী নজরুল ইসলাম করেছেন এভাবে: ‘খিন্ন মলিন তনুলতা’ এবং কাজী আবদুল ওদুদ করেছেন এভাবে: ‘খিন্ন জীবনখানি একটু সুস্থ’। ‘কিম্ভুত ও কিমাকার’-এর জন্যেই শেষ স্তবকের ‘তবু সত্য, আমি কিম্ভুত ও কিমাকার’ ভ্রান্তিমান। এই জন্যে যে, ‘কিম্ভুত’ ও ‘কিমাকার’ সমপর্যায়ভুক্ত পদ নয়। সংস্কৃত ‘কিম্’-এর সহযোগে গঠিত শব্দদ্বয়ের প্রথমটি বিশেষণ এবং দ্বিতীয়টি বিশেষ্য পদের উদাহরণ। এই ‘কিম্’ এমন ধরনের, শব্দের আগে বসে শব্দকে করে ফেলে বিরূপতাপ্রকাশক। উৎপত্তিগত কারণেই দুটোকে একসাথে বিশেষণ নয়, বিশেষ্য পদও বলা যাবে না। কিম্ভুত = কিম্ + ভূত। কিম্ মানে ‘কি’ আর ভূত মানে ‘যা হয়েছে’। শব্দটিতে কিম্ ‘কিরূপে’ প্রশ্ন নিয়ে বর্তমান, যার জবাব বিশেষণ পদ কামনাকারী, এমন বিশেষণ যা ঐ বিরূপতাপ্রকাশক। ভূত এর উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। এ হিসেবে ‘কিম্ভুত’ এর অর্থ অদ্ভুত। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘অদ্ভুত’এর সমার্থক শব্দ হিসেবে এর ব্যবহার করেছেন। যেমন, ‘ওরে কিম্ভুত! নব্যবর্বরতা’। কিমাকার = কিম্ + আকার। এখানেও কিম্ মানে ‘কি’ এবং আকার মানে ‘আকৃতি’। কিন্তু এই কিম্ ‘কী রূপের’ প্রশ্ন নিয়ে বর্তমান, যার উত্তর বিশেষ্য পদ কামনাকারী, এমন বিশেষ্য যা-ও ঐ বিরূপতাপ্রকাশক। আকার এর উদ্দেশ্য পূরণ করেছে। এ-হিসেবে কিমাকারের অর্থ, অদ্ভুত আকার। বলতে চাচ্ছি, ‘কিম্ভুত ও কিমাকার’ নয়, ‘কিম্ভুত কিমাকার’ই ন্যায্য পদবিন্যাস। শব্দদ্বয়ের উৎপত্তি ও গঠন সম্পর্কে না জানার কারণে সোহেল হাসান গালিব ভুলটা করেছেন। তাছাড়া এ-কবিতায় ব্যবহৃত শব্দগুলোর মধ্যে ঐক্য নেই। উদ্ধৃতি তুলে ধরে দেখানো যাক-

(ক) ‘সমুদ্রের ফেনিল জায়নামাজের ঢেউয়ের পরে খাবে লুটোপুটি, সেজদা থেকে উঠে দাঁড়াবে তিমি খিন্ন খিজিরের স্বপ্ন সম্মুখে’ এবং (খ) ‘কিন্নর বিভ্রম যার! দেবী, তুমি কি তোমার কণ্ঠ শুনতে পাও! শুনতে কি পাও তোমার সঙ্গীতে এক বন্দি দানবের হাসি, হাহাকার?’ ‘দেবী’ ও কিন্নর’-এর সাথে ‘জায়নামাজ’, ‘সিজদা’ ও ‘খিজির’ মোটেই যায় না। দেবী হলেন দুর্গা বা পরমেশ্বরী, যাকে নিয়ে হিন্দুধর্মচার। কিন্নর হচ্ছে পুরাণোক্ত দেবলোকের সুকণ্ঠ গায়ক। দুটোই সনাতনী। উল্লেখিত বাকি শব্দগুলো ইসলামধর্মসাপেক্ষ। যা হোক, ক্রীতদাসের হাসি’ যে বার্তা বহন করছে, তা নতুন কিছু নয়। সমস্যাযুক্ত শব্দ ও পঙ্ক্তির সমাহার রেখে সোহেল হাসান গালিব বলতে চেয়েছেন, তিনি আরব্য রজনীর দৈত্যের মতো অসীম ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও দেবীর দেহের কোটরে কোঠায় বন্দী, হুকুমের দাস। কবি নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের যে কবিতা রয়ছে, তার শিরোনাম নেই। সম্পাদকের অমনোযোগিতার কারণেই হয়তো এমন হয়েছে। নিখুঁত সম্পাদনা সম্পাদকের একাগ্র মনোযোগিতা দাবি করে। ‘৩’ চিহ্নিত অংশে বৃত্তস্থ বৃত্ত, ধাঁধাময় ভূমিজাল, বৃত্তাকার পুকুরের দুপুরচুরি এবং ঠান্ডা কোমল জলে দুপুরের ঝরে পড়া উল্লেখের মাধ্যমে যে-দৃশ্য দাঁড় করানো হয়েছে, তাকে কবিতার মনে হয়েছে। কেনো কবিতা মনে হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। কবিতা এমনও: বোঝা যায়, কিন্তু ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে এ অংশকে বেশির ভাগ পাঠক পাথর বলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারেন। একই কথা তার ‘৪’ চিহ্নিত অংশের ব্যাপারেও। শুধু এইটুকু, কবিতায় দৃশ্য থাকতে পারে- দৃশ্যের মাধ্যমে পাঠককে বোধগ্রস্ত করার ক্ষমতা থাকতে হবে।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড