• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বৃষ্টি স্নাত নীল বেদনা

  সোনিয়া তাসনিম খান

১৭ মে ২০২০, ১১:০৪
বৃষ্টি স্নাত নীল বেদনা
বৃষ্টি স্নাত নীল বেদনা

আজ বিকেল থেকেই হাওয়া দিচ্ছিল বেশ। সাথে শীতল ঠাণ্ডা স্পর্শ। মনে হচ্ছে আশেপাশে কোথাও বুঝিবা একপশলা স্বস্তির বৃষ্টি জলকণার স্বর্গীয় পরশ লেগেছে। জল ময়ূরের নৃত্য শেষে চপলা বালিকার মত তার আগমনের চঞ্চল বার্তা সে ছড়িয়ে দিয়েছে বাতাসের পালকিতে। হিমেল বাতাস চোখে মুখে স্পর্শ করতেই বুকের ভেতরে কোন রকমে ধুক পুক করতে থাকা দুর্বল অলিন্দ নিলয় প্রকোষ্ঠে কেমন প্রাণের ছোঁয়া লেগে উঠে কৌশিকের।

আজ কতদিন গরমও পড়েছিল যা! তা আর বলার নয়। ভেতরটা যেন ফুটি ফাটা ধরিত্রীর মতই বিদীর্ণ করে ফেলেছিল একদম। গরমের প্রখর তাপে পিচ ঢালা রাস্তার কালো রঙ আরও কুচকুচে কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করেছে। রাস্তার পাঁজর ভেদ করে যেন গরম তাপের হলকা ঘূর্ণিকারে পাক খাচ্ছে অবিরত। সামনেই চোখে পড়ছে প্রাণহীন সড়কের মাঝে বিভাজন তুলে দেওয়া মলিন ডিভাইডারের ইটের ফাঁক ফোঁকর। সেই প্রস্তর খণ্ডের কঠিন শাসন উপেক্ষা করে প্রবল জীবনী শক্তিতে উজ্জীবিত কিছু নবীন শিশু চারাগাছের নরম কচি ডগাদের উঁকি ঝুঁকি দিতে দেখা যাচ্ছে। দুর্বল নুয়ে পড়া কাঁটা তারের প্রহসনের প্রাচীর ভেদ করে জঙ্গুলে পাতাবাহারের গাছগুলো তাদের ঝাপড়া মাথাগুলি বের করে নিয়েছে।

দু একটি নেড়ি কুকুর ইত:স্তত এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। থেকে থেকে মাটির সাথে নাক লাগিয়ে কিসের বা ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করছে তো আবার অবোধ দৃষ্টিতে এদিক ওদিক কি যেন দেখে বেড়াচ্ছে।বোবা প্রাণীর মুখের ভাষা না থাকলেও চোখের ভাষাটা রয়েছে ঠিকই। একটু খেয়াল করলে বেশ বুঝা যায় অব্যক্ত চোখের চাহনিতে ক্ষুধার যন্ত্রণা স্পষ্ট।

কৌশিক দৃষ্টি সরিয়ে নেয় সেই দিক থেকে।রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক কালের ঝলমলে শপিং মল। সেটি কেমন প্রাণহীন নিস্তেজ ভাবে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।তার সামনে প্রসারিত সিঁড়ির ধাপের ওপর বসে কতজন ভিক্ষুক দের কে বিশ্রাম নিতে দেখা যায়। এক মহিলা নিমগ্ন হয়ে তার হাতে থাকা বাঁকা টিনের পাত্রে থাকা খুচরা পয়সাগুলি গুণে যাচ্ছিল। তার পাশে বসে এক নগ্ন শিশু।মনে হয় ঐ মহিলারাই সন্তান।শিশুর কোমরে কালো সুতো বাঁধা, তাতে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন রকমের তাবিজের খোল।নিজের খেয়ালে সে সেইসব নিয়ে খেলে যাচ্ছে। আচমকা শিশুটি কেঁদে উঠলে রমণীর মনোযোগ ভ্রষ্ট হয়। মুখে তার চরম বিরক্তির ছাপ।কোনরকম কালবিলম্ব না করে সে সজোরে একটা চড় কষিয়ে দেয় অবুঝ শিশুটির পিঠে।সশব্দে কেঁদে উঠে বাচ্চাটি। মহিলাটি যেন দেখেও দেখল না।আবার পয়সা গুণতে ব্যস্ত হয়ে গেল।

নিজের মনে ভাবতে থাকে কৌশিক। পৃথিবীতে টাকার মায়া কেউ ছাড়তে পারে না। হোক সে ধনী কিংবা গরীব। যার নেই সে জীবন ধারণের প্রয়োজন মেটাতে ব্যাকুল আর যার আছে তার আরও চাই। আরও...। আজ সেও তেমনি বের হয়েছিল প্রয়োজনের তাগিদে।আজ কতদিন রোজগার তেমন হচ্ছে না।প্রাইভেট জব। মাইনেটাও অর্ধেক করে দেওয়া হয়েছে। সংসার খরচ, ছোটভাইয়ের পড়া লেখা, বৃদ্ধা মা আর নিজের চিকিৎসা খরচ সব মিলিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে অন্যের দ্বারস্থ হওয়া।

চার মাস হয় এক আত্মীয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার চেয়েছিল।আশ্বাসও পেয়েছিল সাহায্যের। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব বদলায় যেমন তেমনি বদলে যায় কথার মূল্যটাও। অনেক অনুনয় করে শেষ পর্যন্ত কিছু ধার পাওয়া গেল। সাথে তোতাপাখির মত আওড়াতে হলো যত দ্রুত সম্ভব তা ফিরিয়ে দেবার। এমনিতেই এমন ধরনের লোকজনদের খুব একটা কাছ ঘেঁষে না কৌশিক। কিন্তু যাদের মাথার ওপর ছাদটা ধরে রাখা আর পায়ের তলার মাটি টা কামড়ে পড়ে থাকাটাই একটা কঠিন ব্যাপার।তাদের এত আত্মসম্মানবোধ থাকতে নেই। তাদের এসব অলংকার শোভা পায় না। নিজেকে ইদানীং কেমন বড় খেলো মনে হয়। ধীরে আত্মসম্মান আর আত্মবিশ্বাসের মজবুত প্রাচীরে মরীচিকার প্রলেপ পড়তে শুরু করে দিয়েছে কেমন যেন।কেমন যেন ফাঁকা লাগে ওর নিজের চারপাশ। মনে হয় বিধাতাও কি স্বয়ং তবে একপেশেদেরই সহায় হয়? তার মত দুর্বলরা তবে কি সবদিকেই উপেক্ষিত হবে এমনটাই নিয়ম?

চিন্তা ভ্রষ্ট হয় মায়ের ডাকে।

কি এত ভাবিস বাবা? এত ভাবিস না।

মা আলতো ছোঁয়া এঁকে দেয় মুখে। মায়ের মুখটাও ঘামে চিক চিক করছে।চশমার আড়ালে থাকা ব্যথিত চোখদুটো খুব চেষ্টা করছে চোখের নোনা জল লুকোতে কিন্তু এক অজানা কারণে তা করা যাচ্ছে না। জলে টলটল করছে নেত্র যুগল। আসলে চোখ কখনও মিথ্যে বলতে পারে না। মা এখনও কৌশিককে আগলে রাখার চেষ্টা করে সেই ছোটবেলার মতই। অংক না বুঝলে ও যখন ঠোঁট বাঁকিয়ে কেঁদে ফেলত।মা বুকের মাঝে জাপটে ধরে বলত

অংকের জন্য এত কাঁদে কেউ বোকা? দেখবি বড় হয়ে পরে তুই আরও কত কত ইয়া বড় বড় অংক কষে ফেলবি।ম্যাথমেটিশিয়ান হবি তুই...

ম্যাথমেটিশিয়ান কি মা?

ক্ষুদে আঙুলগুলি দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে প্রশ্ন করত কৌশিক।

বড় হলে বুঝবি।

মা বুকে ধরে নিয়েই বলত। কৌশিক ছোট করে নি:শ্বাস ফেলে, ভাবে, অংকে ও বরাবরই কাঁচা রয়ে গেল।জীবনের শেষ অংকটাতে কি ভাগশেষ বলে কিছু রাখতে পারবে কিনা কে জানে?

টুং টাং শব্দ তুলে দু একটি রিক্সা চলে যায়। রাস্তার পাশে একজন তরুণ আর বৃদ্ধাকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাদের মনেও কিছু খুচরা আয়ের আশা সঞ্চার হয়। দ্রুত তিন চাকার যানের লাগাম টেনে নেয় চালক। মুখ থেকে নীল রঙা কাপড়ের নিরাপত্তা আবরণ উন্মুক্ত করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ওদের দিকে

কই যাইবেন মামা? জিগাতলা বাস স্ট্যান্ড।যাবে?

উত্তর করে পাল্টা প্রশ্ন করে কৌশিক।

যামু কত? পঞ্চাশ টাকা দিয়েন।

গলায় ঝুলতে থাকা লাল সাদা চেক চেক গামছাটা মুখে বুলিয়ে নেয় চালক আলতো ভাবে।

এ—ত? কেন?

পাশের সফেদ শাড়ী পড়া বৃদ্ধা মৃদু প্রতিবাদ করে উঠলে চালক আবারও বলে চলে

আর খালাম্মা, সারাটা সকাল গেছে কোন খ্যাপ নাই। এই পয়লা প্যাসেঞ্জার আপনেরা। কত খরচ করেন। গরীবেক দিবেন তাও এমন দিনে...

বাদ দাও মা। আচ্ছা চল ভাই..

কথাটা বলতে বলতে হাঁপিয়ে ওঠে কৌশিক। বাম হাতটা বুকের বাঁ পাশের দিকে উঠে যায়। চোখ দুটো ধাঁধিয়ে নিতে শুরু করলে আরেক হাতে মা কে ধরে ফেলে সে। হাতে রাখা কাগজের ফাইলগুলিকে সামলে নেয় কোনমতে। বৃদ্ধা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে। বয়সের ভারে মুখে ফুটে ওঠা বলি রেখাগুলিতে বার্ধক্যেক ছাপ ছাপিয়ে উদ্বেগ আর আতংকের কালো ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তড়িঘড়ি করে ছেলেকে আগলে নিয়ে বলে

খারাপ লাগছে বাবা? তুই ঠিক আছিস তো?

কৌশিকের মুখে হাসি। গরমে মুখের বর্ণ লাল রঙ ধারণ করেছে। নিজেকে কিছুটা শক্ত করে নিয়ে স্বাভাবিক হয় ও বলে

আমি ঠিক আছি মা একদম। তুমি ভেব না তো এত!

ফাইল গুলি সহ দুহাতে জড়িয়ে নেয় মাকে।

বুকের ধড়ফড়ানিটা একটু থিতু হয়ে আসে। ক্লান্ত পিয়াসী হৃদয় একটু খানি সঞ্জীবনীর সঙ্গ পাবার জন্য কেমন দিশেহারা হয়ে উঠেছিল একদম। রোজার মাস। রোজা এখন প্রায় শেষের দিকে গড়িয়ে এসেছে।দিন দশেক পরেই ঈদ। আর ঈদ! এবারে যে আসলেই কি হবে তা বুঝে উঠা ক্রমশ মুশকিল হয়ে পড়ছে।

করোনার দোর্দণ্ড প্রতাপের আজ প্রায় আড়াই মাস হতে চলেছে। লকডাউনে চির পরিচিত কর্ম ব্যস্ত ঢাকা এত দিন অন্য রূপে সেজে ছিল যেন।যেন কোন জাদুকরের জাদুর ইশারায় ঘুমন্ত মায়াপুরীতে পরিণত হয়েছিল হঠাৎ। ধীরে ধীরে পরিচিত নগরী তার পূর্ব রূপে ফিরে যাবার চেষ্টা করছে। কিছু কিছু দোকানপাট, বেসরকারি অফিস এসব মন্থর গতিতে নিজেদের দৈনন্দিন কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে। জীবন জীবিকার তাগিদ। বাঁচতে তো হবে। সেই বেঁচে থাকার তাগিদেই মরণ ব্যাধির ভয় কে সাথে করে নিয়েই পথে নেমেছে মানুষ। কারো মনে কোন স্বতস্ফুর্ততা নেই। আছে কেবল আতংক আর মৃত্যুভয়।

কৌশিকদের রিক্সা এগিয়ে যাচ্ছে।চালকের পায়ের চাপে নিষ্পেষিত প্যাডেল ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ তুলছে। শব্দটা বিরক্তিজনক হলেও কেন যেন বিরক্ত লাগছে না কৌশিকের। বরং কোন এক রহস্যময় কারণে ওর বেশ উপভোগ্যই লাগছে। হালকা বাতাসের আলুথালু স্পর্শ বেশ লাগছিল। দূরে একপায়া সৈন্যের মত দাঁড়িয়ে থাকা দালানের মাথাভরা সব সবুজের সমারোহ জেগেছে। সবুজের মাথার ওপর ভেসে যাচ্ছে আদিগন্ত ব্যস্ত মেঘবালিকাদের দল।কি সুন্দর লাগছে চারিপাশটা হঠাৎ করে। কৌশিক মায়ের দিকে তাকায়। বৃদ্ধার চোখ রাস্তার ওপরে নিবদ্ধ। মায়ের কোমল হাতটা নিজের হাতে তুলে নেয় কৌশিক। তুলতুলে হাতটা কেমন বরফ শীতল। মা বলতে থাকে-

বাস থেকে নেমে লাজ ফার্মা তে আগে যাব। তোর দুমাসের ওষুধগুলি নিয়ে নেব একবারে। আর যে মেডিসিনটা সব সময় পাওয়া যায় না সেটা একেবারে ছ’মাসের জন্য নিয়ে নেই কি বলিস?

সে প্রশ্নের উত্তর না করে কৌশিক হেসে ফেলে। বলে

এসব রাখ তো মা। কতদিন তোমার হাতের কাউনের চালের পায়েসটা খাওয়া হয় না। আজ একটু করবে?

ছেলের মুখ পানে সস্নেহে তাকিয়ে রয় বৃদ্ধা।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড