• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

মেঘের বাড়ি ‘মেঘালয়’ (তৃতীয় দিন)

  সৌমিত্র সৌম্য

০৯ নভেম্বর ২০১৮, ১০:২৪
মেঘালয়
ছবি : সম্পাদিত

প্রায় প্রতিটি ট্যুরেই সূর্যোদয় দেখার শখ আমার। তাই খুব ভোরে উঠলাম মেঘালয়ের পাহাড়ের বুক চিঁড়ে কীভাবে সূর্যোদয় হয় সেটার প্রতক্ষ্য সাক্ষী হবার জন্য। এ এক অসাধারণ অনুভূতি যা আসলে প্রকাশ করার মতো নয়।

সকাল ১০টায় কল থাকায় নাস্তা করে সবাই রেডি হয়েই ছিলাম হোমস্টেতে। আজকের গন্তব্য যেহেতু নংগ্রেইট (nongrait) গ্রাম সেহেতু সবাই মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই ছিলাম ট্র্যাকিং এর জন্য। কারণ আমাদের ঐ গ্রামে পৌঁছাতে হলে পাড়ি দিতে হবে মোটামুটি ৩৮০০ সিঁড়ি। সে গল্প না হয় একটু পরেই হবে। তার আগে আমাদের নঙগ্রেইটের আগের গ্রাম ‘তিরনা’ পৌঁছে দেয়া এবং ‘মাওসৌমি’ কেভে ঘুরিয়ে আনার জন্য ২০০০ রুপিতে ভাড়া করা জীপ হর্ন দিয়ে জানান দিল ‘চলে এসো আমি প্রস্তুত’।

প্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম মৌসুমী কেভের সামনের লনে। এখানে প্রবেশের জন্য টিকিট কাটতে হয় যার শুভেচ্ছা মূল্য মাত্র ১০ রুপি। আর এখানে প্রবেশের আগে স্থানীয়রা জুতা খুলে নেন এই বিশ্বাসে, এখানে ঈশ্বর আছেন। তো, আমরাও সে বিশ্বাসের প্রতি সম্মান জানিয়ে কিছুটা হেটে গিয়ে প্রবেশ করলাম কেভে। এই গুহাটির বয়স প্রায় কয়েক কোটি বছর। পাথরের গায়ে চুইয়ে পড়া জল বেয়ে তৈরি জীবাশ্ম যার প্রাণ।

অসম্ভব ভয়ঙ্কর সুন্দর এই গুহার প্রায় সম্পূর্ন মেঝেই ঠান্ডা জলে পরিপূর্ণ থাকে। আর গুহা কিছু জায়গায় প্রায় ৩ ফুট উঁচু হওয়াতে পা ফেলতে হয় খুব দেখে শুনে। মাত্র ২০০ মিটার লম্বার এই গুহার সৌন্দর্য মনভরে দেখতে দেখতেই পৌঁছে যাই গুহার মুখে যার ডান পাশ দিয়ে একটি রাস্তা গেছে আরেকটি গুহার মুখে। কিন্তু সেখানে আলোর ব্যাবস্থা না থাকায় আমরা আর সেখানে পা বাড়াই না, উঠে পড়ি গাড়িতে।

way

পথের পাশে চোখ জুড়ানো দৃশ্য

তিরনার পথে যেতে রাস্তার বর্ণনা আসলে দেবার মত নয়, কারন যাই দেব তাতেই কমতি পড়ে যাবে। দূর থেকে ধেয়ে আসা মেঘ আমাদের ঢেকে দিচ্ছিল কিছুক্ষণ পর পর। আর মেঘালয় রাজ্য যে তাদের পর্যটক আর পর্যটনকে কতটা গুরুত্ব দেয় তার প্রমাণ পাচ্ছিলাম পাথরের গায়ে লেখা ছোট ছোট কিছু দেয়াল লিখনের মাধ্যমে।

দুপুর ১২ টার দিকে আমরা পৌঁছে যাই তিরনা গ্রামে, ছবির মত সাজানো যে গ্রাম সেখান থেকেই মূলত শুরু হয় আমদের ট্র্যাকিং। এখানে নামার পর কিছু কন্ট্রিবিউশন দিতে হয় যা সম্পূর্নটাই ঐচ্ছিক। এটা নেয়া হয় সেখানে রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে। সব জায়গায়ই ভালো মন্দ থাকে এবং তা জীবিকাকে পুঁজি করে।

তো, স্থানীয় গাইডরা আমাদের প্ররোচিত করতে লাগলো যাত্রা পথে বিভিন্ন অসুবিধা দেখিয়ে যাতে আমরা গাইড নিয়ে সেখানে যাই। কিন্তু আমরা নিচে নামার আর ওপরে উঠার রাস্তা দেখে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলাম গাইড না নেয়ার। তাদের বিফল মনকে পেছনে ফেলে আমরা প্রত্যেকে ২০ রুপি করে বাঁশের লাঠি সংগ্রহ করে বেরিয়ে পড়লাম নঙগ্রেইটের উদ্দেশ্যে।

আসলে, ভারত সরকার আর স্থানীয়দের স্যালুট করতেই হয় পর্যটকদের সুবিধার জন্য তাদের ইচ্ছা আর কাজের বাস্তবায়ন দেখে। পাহাড় কেটে তারা যে পাথরের ঢালাই সিঁড়ি বানিয়ে দিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এবং আরেকটি বিষয় তাদের কাজের স্বচ্ছতার জানান দিতে প্রতিটি প্রজেক্টের শুরুতেই তারা খরচ আর ডিটেইলস লিখে টানিয়ে দিয়েছে রাস্তার পাশে। আর একজন বাংলাদেশি হিসাবে খরচের হিসাব দেখে আমাদের মুখে একটিই কথা ছিল, “ওহ মাই গড! এটা আসলেই সত্যি!’’

এখানে আরেকটি সুবিধা হলো, আপনি যদি ভারী ব্যাগ কাঁধে না নিয়ে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে না চান তবে আপনি পটার ভাড়া করতে পারেন। এরা আপনার ব্যাগ গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেবে। আমাদের মধ্যে দুজন দরদাম করে ৪০০ রুপিতে একজনকে ভাড়া করল এবং ফ্রি হিসাবে পেয়ে গেলাম একজন গাইডও।

আগের পর্ব পড়তে : মেঘের বাড়ি ‘মেঘালয়’ (দ্বিতীয় দিন)

প্রায় বেশ কিছুটা হাঁটার পর আমরা পৌঁছে গেলাম এক গ্রামে যেখান থেকে ডান পাশে কিছুটা আগালেই চোখে পড়বে সিঙ্গেল ডেকার লিভিং রুট ব্রিজ, যার নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে ঝর্ণার হিম শীতল জল। আমরা টিকেট কেটে সেখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার রওনা দিলাম আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশে।

way1

তিরনার বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ

এখানে পৌঁছাতে আমাদের থামতে হয়েছে অনেকবার কারণ এই ভারী ব্যাগ নিয়ে এত পথ পাড়ি দেওয়টা আসলেই অনেক কষ্টকর। আমরা চলেছি এমন সব পথ দিয়ে যেখানে খাড়াভাবে প্রায় ৩০০ সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে আবার নামতে হয়েছে ২০০ সিঁড়ি। পাড়ি দিতে হয়েছে এমন কিছু ব্রিজ যেখানে মানুষ উঠলেই দুলতে শুরু করে যাদের ১০০ ফুট নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা ঝর্ণা।

হাঁটতে হয়েছে এমন কিছু পাহাড়ের কিনারে বেয়ে বয়ে চলা রাস্তা যেখানে আপনিই শুধুমাত্র একা, চিৎকারে আপনার সঙ্গী শুধুমাত্র আপনার প্রতিধ্বনি। এভাবেই বিচিত্র সুন্দর সব দৃশ্য, পাহাড়ি ফুল আর ঝর্ণার কলতান শুনতে শুনতে আমরা বিকালের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্য নঙগ্রেইট গ্রামে।

মেঘালয়ের গহীণেও যে এত সুন্দর, পরিপাটি আর আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা সম্বলিত একটা গ্রাম থাকতে পারে তা হয়ত এখানে না আসলে বুঝা যেত না। আমরা যে হোমস্টেতে ছিলাম তার দুটি রুমের ভাড়া ছিল ২২০০ রুপি এবং সাথে ডিনার মেন্ডোটরি। ডিনারের প্যাকেজ মূল্য ১২০ রুপি করে।

sw

ঝর্ণার নিচের স্বচ্ছ জল আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে

এতটা পথ ট্র্যাকিং করার কারণে আমাদের পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছিল। তাই ৩০ রুপিতে ম্যাগি নুডুলস খেয়ে আমরা পা বাড়ালাম পাশেই ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রিজে। সেখানেও প্রবেশ মূল্য ১০ রুপি। এই লিভিং রুট ব্রিজ হচ্ছে মূলত বট গাছের কাণ্ড, শেকড় দিয়ে তৈরি টানা ব্রিজ যা দীর্ঘ সময়ের আবর্তনে তৈরি। এর ঠিক সামনে রয়েছ একটি ঝর্ণা যার নিচে তৈরি হয়েছে একটি ছোট্ট পুল যেখানে খেলা করে ছোট ছোট মাছ। তো, এই স্বচ্ছ জলে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্নান করে আমরা ফিরে গেলাম হোমস্টেতে।

রাত ৮ টার দিকে আমাদের খাবারের জন্য ডাকা হল। এমনিতেই দুইদিনের আধপেটা, তারমধ্যে সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ভারী খাবার। খাবারের আইটেম ছিল ভাত, সবজি, পাঁপড় ভাজা, ডাল আর সালাদ। অনেক দিন পর এমন অমৃত খাবার শেষে বারান্দায় বসে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে আড্ডা দিলাম বেশ কিছুক্ষণ।

যখন লাইট অফ করে বিছানায় ঘুমাতে গেলাম সঙ্গী তখন রুমের ঠিক ২০ ফুট সামনে দিয়ে বয়ে চলা ঝর্ণার শব্দ আর ঝি ঝি পোকার ডাক।

চলবে...

প্রয়োজনীয় কিছু টিপস-

#আগে থেকেই ভ্রমণ ট্যাক্স কেটে নেবেন। #সেখানে যেহেতু অধিকাংশ সময় বৃষ্টি হয় তাই অবশ্যই মনে করে ছাতা অথবা রেইনকোট নিয়ে নিবেন। #ডাউকি বাজারে তেমন মানি এক্সচেঞ্জ চোখে পড়েনি তাই আপনি যদি ইন্ডিয়ান রুপি না নিয়ে যান তবে স্থানীয়রা বিএসএফ এর চোখের আড়ালে তাদের দোকানে মানি এক্সচেঞ্জ করে থাকেন সেখান থেকেও করে নিতে পারেন। #শিলং, চেরাপুঞ্জিতে আবহাওয়া ঠান্ডা তাই অবশ্যই হালকা গরম কাপড় সাথে নিয়ে নিবেন। #প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে নিতে ভুলবেন না। পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যেহেতু হাঁটবেন সেহেতু মশা বা পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচতে অডোমাস নিতে পারেন। #এছাড়া পলিব্যাগ, পাওয়ার ব্যাংক, টর্চলাইট নিয়ে নিবেন। #ইন্ডিয়াতে সিম কিনে চালু হতে ২ দিন সময় লাগে তাই দুই দিনের আগে কেউ যদি পুরাতন ইন্ডিয়ান সিম দিয়ে যোগাযোগ করতে চান তাহলে অবশ্যই ইন্ডিয়ান বর্ডারে ঢুকে কাস্টমার কেয়ার থেকে সিমটি চালু করে নিবেন। # মেঘালয় খুব সুন্দর একটা রাজ্য। সেখানে রাস্তায় ময়লা আবর্জনা দেখা যায় না বললেই চলে। তাই দয়া করে কেউ রাস্তায় ময়লা ফেলবেন না। #আপনার আচরণ আপনার ব্যক্তিত্ব, পরিচয় বহন করে। তাই স্থানীয়দের সাথে ভালো ব্যবহার করবেন।

ভ্রমণ মানুষের তৃতীয় চোখ খুলে দেয়। তাই বেশি বেশি ঘুরুন, নিজেকে আবিষ্কার করুন প্রতিনিয়ত এই বিশালতার মাঝে।

দেশ কিংবা বিদেশ, পর্যটন কিংবা অবকাশ, আকাশ কিংবা জল, পাহাড় কিংবা সমতল ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা অথবা পরিকল্পনা আমাদের জানাতে ইমেইল করুন- [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড