সৌমিত্র সৌম্য
চেরাপুঞ্জীর ‘সোহারা’য়, যে হোমস্টেতে আমরা ছিলাম তার নাম ‘লিন্ডিগো হোমস্টে’। সন্ধ্যার পর আমরা সেখানে চেক ইন করাতে বুঝতেই পারিনি আমরা কোথায় ছিলাম। সকালে উঠেই চোখ চড়ক গাছ! এতদিন হলিউডের মুভিতে প্রকৃতির কাছাকাছি বাড়ি বলতে যা দেখতাম এটা হয়তো তার চাইতেও বেশি বললে ভুল হবে না। বারান্দার ঠিক কিনারা ঘেঁষেই চলে গেছে পাহাড়ি পিচ ঢালা রাস্তা এবং তার পরেই শুরু বিশাল বিশাল পাহাড় আর ঝর্ণা। যে পাহাড়ের গা ঘেষে আমাদের কটেজ সেটার ঠিক সামনের রাস্তা হচ্ছে 'থ্রি হেডেড স্টোন, ওহাকাবা ফলস ও লাত্তারা ফলস' এর ভিউ পয়েন্ট।
সকাল ১০টার মধ্যে আমরা নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লাম চেরাপুঞ্জিকে দেখতে। বড় জীপ না পাওয়ায় ২২০০ রুপিতে সারাদিনের জন্য চলার সঙ্গী দুইটা ক্যাব। আমাদের গাইড ‘জন’ বলল আমাদের ভাগ্য নাকি খুবই ভাল। এমন রোদেলা আবহাওয়া নাকি চেরাপুঞ্জিতে দেখতেই পাওয়া যায় না। অবশ্য চেরাপুঞ্জিকে বলা হয় ‘সবচাইতে বৃষ্টিপাতের শহর’। এখানে বৃষ্টি আর রোদ টম অ্যান্ড জেরির মতো খেলা করে।
প্রথমেই আমরা গেলাম 'উই-স-ডং ওয়াটার ফল' (wei-saw-dong water fall) এ। অপূর্ব সুন্দর এই ঝর্ণা দেখতে আমাদের পাড়ি দিতে হয়েছে কিছুটা রিস্কি রাস্তা। ছয় লেয়ারের এই সুবিশাল ঝর্ণার আওয়াজ শোনা যায় সেই রাস্তা থেকে। ঝর্ণার সামনে পৌঁছেই দেখি একটা ছোটখাট ন্যাচারাল সুইমিংপুল। এমন একটা জায়গায় এসে শরীর না ভেজানোটাই অন্যায় ভেবে স্নান সেরে রওনা দিলাম পরবর্তী স্পটের উদ্দেশে।
রাস্তা দিয়ে যখন চলতে শুরু করলাম গাড়িতে তখন বাজছে ‘বাটারফ্লাই সং’। আঁকাবাঁকা ছবির মতো সুন্দর রাস্তার সাথে মিশে যাওয়া ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিক যোগ করল এক অনন্য মাদকতা। সুরে যখন সবাই বিভোর তখনই গাড়ি থামল রাস্তার পাশে 'ডেইনথ লেন' ঝর্ণার পাশে। তীব্র বেগে যে লাফিয়ে পড়ছে প্রায় ৯০ মিটার উচ্চতা থেকে। মূলত এই ঝর্ণাটাই অনেকটা দূরে গিয়ে নাম নিয়েছে, 'উই-স-ডং ওয়াটার ফল' নামে।
এরপর আমরা চলে এলাম 'আরওয়াহ লুমসাইন্ন্যা কেভ' (Arwah lumshynna cave) দেখতে। এখানে গাড়ি পার্কিং বাবদ ২০ রুপি এবং গুহায় এন্ট্রি ফি বাবদ জনপ্রতি ২০ রুপি করে নিয়ে থাকে। গা ছমছম করা চুনাপাথরের এই গুহা লম্বায় প্রায় ৩৩ কিলোমিটার। ধারণা করা হয়ে থাকে প্রায় ৩০ মিলিয়ন বছর যাবত সামুদ্রিক ফসিলস এর দ্বারা এ গুহার সৃষ্টি। শুনশান নীরব এ গুহার ভেতরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকলেও হুট করে উড়ে আসা বাদুরের ঝাঁক মুহূর্তিই অসাড় করে দেয় হৃদয়।
আগের পর্ব পড়তে : মেঘের বাড়ি ‘মেঘালয়’ (প্রথম দিন)
ঠান্ডা জলে পা ভেজাতে ভেজাতে চোখে পড়ে গুহা মানবদের আঁকা প্রাচীন ইতিহাস। অবশ্য এই ভয় ধরানো গুহার দর্শনের আগে আমদের ঘুরে আসতে হয়েছে প্রায় ২০০ মিটার পাহাড় কেটে বানানো খুব সুন্দর পথ, যার কিনারায় দেখা যায় গভীর গিরিখাত, ঝর্ণা আর সবুজে ঢাকা পাহড়ি গ্রাম। আর পুরোটা পথ জুড়েই শুনতে পাওয়া যায় নিস্তব্ধতা ভেদ করা ঝি ঝি পোকার চিৎকার।
আমাদের গাড়ি এবার ছুটতে ছুটতে চলে আসে মেঘালয়ের অন্যতম আকর্ষণ ‘নোহকালিকাই’ এর উদ্দেশে। প্রায় সময়ই ভেসে আসা মেঘে, ঢেকে যাওয়া এই ঝর্ণা হচ্ছে চেরাপুঞ্জির বৃহত্তম এবং ভারতের অন্যতম সুউচ্চ ঝর্ণা যার উচ্চতা ১১১৫ ফিট। এই ঝর্ণার নামকরণের পেছনে আছে এক বেদনাদায়ক ইতিহাস।
‘নোহকালিকাই’ এর অর্থ হচ্ছে কালিকাই এর লাফিয়ে পড়া। প্রচলিত আছে, ‘লিকাই’ নামের এক নারীর দ্বীতিয় স্বামী তার সৎ মেয়ের প্রতি হিংসার বর্শবর্তী হয়ে সে বাচ্চা মেয়েটিকে হত্যা করে এবং সে নর মাংস তার মাকে অর্থাৎ লিকাইকে রান্না করে খাওয়ায়। পরে যখন সে এ নির্মম সত্য জানতে পারে তখন সে এই ঝর্ণার ওপর থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ঝর্ণার নামকরণ হয় ‘নোহকালিকাই’।
বিকাল যখন পড়ন্ত ঠিক তখন আমরা হাজির হই বিখ্যাত সেভেন সিস্টার্স ফলসের কাছে। সাত ধাপে পড়ে বলেই নাকে একে এই নামে ডাকা হয় বলে জানালো আমাদের গাইড।
অস্তমিত হওয়া সূর্যকে সাথে নিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের আবাসে। পরদিন রবিবার হওয়ায় আর কিছু কেনাকাটা থাকাতে আমরা দ্রুতই বের হয়ে গেলাম বাজারে। সোহারায় রবিবার প্রায় সব কিছুই বন্ধ থাকে। রাত আটটার মধ্যে হোটেলের খাবার শেষ হয়ে যায় বিধায় আগেই খেয়ে নিতে হলো।
এখানে খাবারের দাম একটু বেশি। খাবার হিসেবে পেলাম, ভাত, গরুর মাংস, মুরগির মাংস, খাসির মাংস, শুয়োরের মাংস, ডিম আর ডাল। ভাত এখানে ২০ টাকা প্লেট আর যে মাংস খান না কেন সেটা পাবেন ৪০ রুপি করে।
চলবে...
প্রয়োজনীয় কিছু টিপস-
#আগে থেকেই ভ্রমণ ট্যাক্স কেটে নেবেন। #সেখানে যেহেতু অধিকাংশ সময় বৃষ্টি হয় তাই অবশ্যই মনে করে ছাতা অথবা রেইনকোট নিয়ে নিবেন। #ডাউকি বাজারে তেমন মানি এক্সচেঞ্জ চোখে পড়েনি তাই আপনি যদি ইন্ডিয়ান রুপি না নিয়ে যান তবে স্থানীয়রা বিএসএফ এর চোখের আড়ালে তাদের দোকানে মানি এক্সচেঞ্জ করে থাকেন সেখান থেকেও করে নিতে পারেন। #শিলং, চেরাপুঞ্জিতে আবহাওয়া ঠান্ডা তাই অবশ্যই হালকা গরম কাপড় সাথে নিয়ে নিবেন। #প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে নিতে ভুলবেন না। পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যেহেতু হাঁটবেন সেহেতু মশা বা পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচতে অডোমাস নিতে পারেন। #এছাড়া পলিব্যাগ, পাওয়ার ব্যাংক, টর্চলাইট নিয়ে নিবেন। #ইন্ডিয়াতে সিম কিনে চালু হতে ২ দিন সময় লাগে তাই দুই দিনের আগে কেউ যদি পুরাতন ইন্ডিয়ান সিম দিয়ে যোগাযোগ করতে চান তাহলে অবশ্যই ইন্ডিয়ান বর্ডারে ঢুকে কাস্টমার কেয়ার থেকে সিমটি চালু করে নিবেন। # মেঘালয় খুব সুন্দর একটা রাজ্য। সেখানে রাস্তায় ময়লা আবর্জনা দেখা যায় না বললেই চলে। তাই দয়া করে কেউ রাস্তায় ময়লা ফেলবেন না। #আপনার আচরণ আপনার ব্যক্তিত্ব, পরিচয় বহন করে। তাই স্থানীয়দের সাথে ভালো ব্যবহার করবেন।
ভ্রমণ মানুষের তৃতীয় চোখ খুলে দেয়। তাই বেশি বেশি ঘুরুন, নিজেকে আবিষ্কার করুন প্রতিনিয়ত এই বিশালতার মাঝে।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড