• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দেখে এলাম তিনাপ সাইতার

  সিলভী রহমান

০৭ এপ্রিল ২০১৯, ১৫:৪৭
তিনাপ সাইতার
মনে হচ্ছিল এখানেই থেকে যাই। (ছবি : লেখক)

যাত্রা শুরু করেছিলাম কুরবানি ঈদের পরের রাতে। ১২ জনের একটা টিম। যাব বান্দরবানের অনেক গহীনে, বাংলাদেশের প্রশস্ততম ঝর্ণা তিনাপ সাইতার দর্শনে। বান্দরবানের বাসের টিকিট না পাওয়ায় রাত সাড়ে ৯ টায় চেপে বসলাম কক্সবাজারের বাসে। কারো চোখে ঘুম নেই, সারা রাস্তা চলতে থাকলো আমাদের গান, আড্ডা। ভোর চারটার কিছু আগে বাস নামিয়ে দিল কেরানীহাট নামক জায়গায়। সেখান থেকে মাহেন্দ্র গাড়িতে চেপে পৌঁছলাম বান্দরবান শহরে। অন্ধকার তখনো কাটেনি, পরিচিত অনেকের সাথেই দেখা হয়ে গেল। কারো গন্তব্য নাফাখুম, কেউবা যাবে কেওক্রাডং। আমাদের যেতে হবে প্রথমে রোয়াংছড়িতে। এটি বান্দরবনের একটি উপজেলা।

সময় নষ্ট না করে আগে থেকে ঠিক করে রাখা চান্দের গাড়িতে করে রওনা দিলাম রোয়াংছড়ির পথে। প্রায় মিনিট চল্লিশ পরে পৌঁছে গেলাম। পথে স্বাগত জানালো পাহাড়ি বৃষ্টি। রোয়াংছড়িতে আমাদের রিসিভ করলেন গাইড রুয়াল দাদা। সেখানে নাস্তা সেরে আশেপাশে ঘুরে দেখলাম সবাই। কিছুদূর পথ নৌকায় যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু নৌকা না পাওয়ায় ঠিক হল চান্দের গাড়িতে যাব কিছুদূর, বাকী পথ ট্রেকিং করে পৌছাব রনিন পাড়ায়। প্রায় আধঘন্টা মত গাড়িতে লক্করঝক্কর শেষে নামতে হল, আর গাড়িতে যাওয়া সম্ভব না। সবাই হাঁটতে প্রস্তুত।

তিনাপ সাইতার

জুড়িয়ে দিল চোখ আমার। (ছবি : লেখক )

পাহাড়ি লালমাটির রাস্তা বৃষ্টির কারণে কাদায় একাকার, হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল সবার। হাঁটছি তো হাঁটছি পথে পেয়েছিলাম একটা যাত্রীছাউনি আর একটা পাড়া। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু। এদিকে দুপুর হয়ে গেছে। সূর্য মাথার উপরে। সাথে কাঁধের ব্যাগ আর সাথে নিদ্রাহীন রাতের ক্লান্তি। অবশেষে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা হেঁটে রনিন পাড়ায় পৌঁছলাম। থাকার জায়গা হলো গাইড দাদার কাঠের দোতলা বাড়িতে। এরপরই স্বাগত জানালো পাহাড়ি বৃষ্টি আর ঝকঝকে চাঁদ। রাতে খেয়ে তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছিল সবাই।

পরদিন সকালে খাবার খেয়ে যাত্রা শুরু করলাম। ব্যালান্স রক্ষার জন্য হাতে বাঁশ নিয়ে হেঁটে চলেছি পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে। ঘন সবুজ ঘাসের মধ্য দিয়ে সরু পথ। দূর পাহাড়গুলোতে সাদা মেঘ জমে আছে। উঁচুনিচু পাহাড় পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। কখনওবা চড়তে হচ্ছে উঁচু পাহাড় আবার কখনও ঢাল বেয়ে নিচে নামছি। সবচেয়ে কষ্ট দিয়েছিল নুড়িপাথরে ভর্তি খাড়া পাহাড়টা। বেকায়দায় পা ফসকে গেলেই সোজা খাদে। অনেক্ষণ হেঁটে যখন পা আর চলছিল না তখন দেখা পেলাম ঝিরিপথের। এবার আলো আঁধারী ঘেরা ঝিরিপথ ধরেই সামনে এগোতে হবে।

ঠান্ডা পানিতে পা দিতেই সব ক্লান্তি যেন উধাও হয়ে গেল। এক জায়গায় একটা পিচ্ছিল পাথর পার হতে গিয়েই আমি ধপাস। আছাড় খেয়ে উঠে দেখি হাতের কনুই আর হাঁটু সামান্য কেটে গেছে। ওই একই জায়গায় আমাদের টিমের কয়েকজন ধরাশায়ী হয়েছে বলে পড়ে জেনেছি। এরপর সামনে এগোতে কোন জায়গায় বাঁশ ধরে ঝুলে উঠতে হয়েছে তো কোন জায়গায় গাইডের পায়ে ভর দিয়ে নামতে হয়েছে। অনেক চড়াই উৎরাই পাড় করে সেই কাঙ্ক্ষিত শব্দ কানে আসতেই বুঝলাম তার খুব নিকটে চলে এসেছি।

তাকে দেখার তর যেন আর সইছিল না। ধীরে এগিয়ে যেতেই হুট করে সামনে দেখা দিল তার সেই চঞ্চলা মূর্তি। প্রলংয়করী ছিলনা সে মোটেও, তবে তার সাবলীল রূপেই মন কেড়েছে সবার। এরপর চলল পানিতে দাপাদাপি সাথে সুন্দরীর সাথে ফটোসেশন। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রশস্ত জলপ্রপাত জয় করে এবার ফেরার পালা।

ফেরার পথে ক্লান্তি আরো দ্বিগুণ। শক্তি জোগাচ্ছিল পাহাড়ি কলা, গ্লুকোজ, সাথে থাকা চকলেট, বিস্কুট আর ঝর্ণার সুপেয় পানি। আমাদের টিমের কয়েকজন বেশ এগিয়ে গেছে। পেছনে গাইডসহ আমরা কয়েকজন।হাঁটছি,জিরোচ্ছি আবার হাঁটছি। সবুজের মাঝখান দিয়ে যাচ্ছি আর আকাশে রঙের বিচিত্র খেলা দেখছি। কন্ঠে সবার "ধন ধান্য পুষ্প ভরা।" মনে একটাই প্রশ্ন স্বর্গ কি এরচেয়েও সুন্দর!

তিনাপ সাইতার

স্বচ্ছ্ব পানির ধারা মুহূর্তেই কেড়ে নিয়েছিল সব ক্লান্তি। (ছবি : লেখক )

পথে একবার ঝিরঝিরে বৃষ্টি হলো। সেই সাথে প্রাণ জুড়িয়ে দেয়া ঠান্ডা হাওয়া। দূর আকাশে বার দুয়েক বিজলি চমকে গেল যেন। কোনপাশে আকাশ হালকা নীল, কোনপাশে আবার আগুনরাঙা। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে, দলের বাকী সবাই অনেক সামনে পেছনে কেবল আমরা চারজন। ফেরার কোন তাড়া নেই যেন!

গাইড বারবার তাড়া দিচ্ছে তখন একটু গতি বাড়ছে। অন্ধকার নেমে আসার পর ঘরে ফিরলাম। দেখি আকাশে ঝকঝকে পূর্ণিমার চাঁদ কটেজের উঠোন আলো করে আছে। খাওয়া গোসল সেরে উঠোনে পাতানো বেঞ্চে বসলাম ক'জন। সারাদিনে প্রায় ১০ ঘন্টা হাঁটার ক্লান্তি গায়েব মুহূর্তেই। কণ্ঠে কণ্ঠে তখন "চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে, উছলে পড়ে আলো......।"

ওডি/এসএম

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড