• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

প্রজন্মের পাথেয় ‘৭১

  মো. শফিক ইসলাম, খুবি প্রতিনিধি

২৬ মার্চ ২০১৯, ১২:২৮
স্বাধীনতা
ছবি : প্রতীকী

সপ্তাহখানেক আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। সে ডাকে সাড়া দিয়ে ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম, যুবক থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সবাই হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। যার অস্ত্র চালনার সামর্থ্য নেই, সে মুক্তিবাহিনীকে তথ্য কিংবা আশ্রয় দিয়ে হলেও যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে।

মধ্যবয়সী মকছেদ গাজী তেমনই একজন। তিন ছেলে আর তিন মেয়ে নিয়ে আট জনের পরিবার তার। সবার মুখে দুই বেলা খাবার তুলে দিতেই নাকানিচুবানি খেতে হয় মকছেদকে। তাই হাতে অস্ত্র তুলে না নিলেও বিপদে আপদে মুক্তিবাহিনীর ঠাঁই হতো মকছেদের বাড়িতে। বাড়ির আশপাশে ঘন জঙ্গল হওয়াই মুক্তিবাহিনীর জন্য এটি একটি নিরাপদ জায়গা।

বসন্তের সকাল। খুব ভোরে কাজের সন্ধানে বের হয়েছে মকছেদ। কাজ জুটলে যে টাকা পাবে সন্ধ্যায় তা দিয়ে বাজারসদাই করে বাড়ি ফিরলে সবার পেটে খাবার পড়বে। রাতে খোর্দ্দ’র ওদিক গোলাগুলি হয়েছে পাক বাহিনীর সঙ্গে। রাতের অন্ধকার কাটার আগেই মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন এসে হাজির হয়েছে ঘুমোবে বলে। তাদেরও খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। গ্রামের কাচা রাস্তা ধরে ছিপছিপে গড়নের হাড্ডিসার মকছেদ গাজী হেঁটে চলেছে। পায়ের চটি জোড়া পায়ের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে হাঁটার তালে তালে বিকট আওয়াজে শব্দ করছে। সে শব্দ মুক্তির খোঁজে মিলিয়ে যাচ্ছে দূর দিগন্তে।

রাস্তার বাঁক ঘুরতেই আচমকা একদল পাক বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে গেল মকছেদ। রাতে ধ্বংসলীলা চালিয়ে মানুষের বড় বড় গরু আর মালপাতি হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন বেশ ঘটা করে খাওয়া হবে ক্যাম্পে। ঘটনার আকস্মিকতায় মকছেদ খানিকটা ভয় পেলেও পালানোর চেষ্টা করল না। পাঞ্জাবী, টুপি পরা লোকটি বলে উঠল।

___ কি নাম তোর? ___মকছেদ গাজী। ___মোহাম্মদ নেই? ___জ্বে। মো. মকছেদ গাজী। ___কনে যাচ্ছিস? ___কাজের খোঁজে। বড় বড় দু'টো গরুর রশ্মি হাতে গুজে দিয়ে বলল_ ___কাজ খোঁজা লাগবে না। আমাদের কাজ করবি চল। ___ছেলেপুলে না খেয়ে আছে হুজুর। কাজে না গেলি ওরা না খেয়ে মরে যাবে। ___কয় ছেলে তোর? ___৩ খান।

খানিক ভেবে হুজুর মকছেদের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তাব করে বসল চল, তোর বউর হাতের রান্না খামু। মকছেদ ভাবনায় পড়ে গেল। এ দেখি মহাবিপদ। বাড়ি মুক্তিবাহিনী। এ অবস্থায় বাড়ি ফিরলে আরেকটা ধ্বংসলীলা অপেক্ষা করছে। আবার ওদের সঙ্গে গেলেও মুশকিল, সারাদিন না খেয়ে থাকতে হবে বাড়ির লোকগুলোকে। সঙ্গে প্রাণ যাওয়ার ভয় তো আছেই। তবে ওদের সঙ্গে গেলে অন্তত তার একার প্রাণ গেলেও বেঁচে যাবে অনেকগুলো প্রাণ। তাই বেশি না ভেবে মকছেদ বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, হুজুর, বউ তো আমার গেলবছর মারা গেছে। আপনাগির রান্না করে খাওয়ানোর মতো কেউ নেই। তার চাইতে চলেন আমি যায় আপনাগির সঙ্গে।

মকছেদের বুদ্ধি কাজে দিল। তার নিঁখুত অভিনয় কাজে দিল। ভুরু কুচকে খানিকক্ষণ কী যেন ভেবে ক্যাম্পের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করল। পাকবাহিনীর পিছু পিছু পা চালাতে শুরু করল মকছেদ। দেখল সে একা নয় আরও কয়েকজনকে ধরে এনেছে। চোখে-মুখে আতঙ্ক আর ভয়। বউ-ছেলের মুখ আর দেখা হবে কিনা কেউ জানে না। এসব ভাবনার মাঝে রাজগঞ্জ বাজারে পৌঁছে গেল তারা। এখানে ক্যাম্প করেছে পাকিস্তানী মিলিটারি।

একেক করে গরুগুলো গাছের সঙ্গে বাধা হলো। মকছেদসহ এই কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে একখানা গরু জবাই করে মাংস বের করার। এদিকে, বেলা মাথার ওপর। বাড়ির সবাই না খেয়ে বসে আছে। মাংস কাটার কাজে কেউ পটু না থাকাই কাজ শেষ করতে ঘণ্টা চারেক লেগে গেল। আরও কত কাজ যে করতে হবে এই ভেবে বাড়ি যাওয়ার আশা ছেড়েই দিল মকছেদ। অবশেষে সুযোগ এলো আসরের নামাজের সময়।

অনেক আকুতি-মিনতির পর মসজিদে যাওয়ার অনুমতি পেল সে। হুজুরও বিশ্বাস করে সুপারিশ করল নামাজের জন্য। তবে সে বিশ্বাস আর রাখা হলো না মকছেদের। নামাজ শেষ হতে না হতে মসজিদ থেকে বেরিয়েই দিল ভো দৌড়। অচেনা-অজানা ঝোপঝাড়ের মধ্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে দৌড়াতে থাকে সে। এরইমধ্যে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আজ আর কোনো কাজ জুটবে না। তবু শান্তি লাগে মকছেদের মনে। অস্ত্র হাতে না নিয়েও সে আজ যুদ্ধ করেছে। বাঁচিয়েছে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা হাতগুলোকে।

ওডি/আরএআর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড