• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

কার্ল উইলহেম শিহিল : একজন মন্দ ভাগ্যের বিজ্ঞানী

  মোঃ সাইফুল ইসলাম

০৮ নভেম্বর ২০১৯, ১৪:৫০
কার্ল উইলহেম শিহিল
কার্ল উইলহেম শিহিল; (ছবি-ইন্টারনেট)

বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত আমাদেরকে নিত্য নতুন আবিষ্কারের সাথে পরিচয় করে দিয়েছেন। যে সকল আবিষ্কারের কোনোটা হয়তো মানব কল্যাণে ব্যবহৃত হচ্ছে, আবার কোনোটা ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষের ক্ষতির কারণ হিসেবে। এই আবিষ্কারগুলো যেমন অনেকের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে, তেমনই কারও কারও ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার আবিষ্কারকদের ভাগ্যও নিঃসন্দেহে খুলে গিয়েছে। কিন্তু অনেকেই ছিলেন মন্দ ভাগ্যের অধিকারী। তাদের আবিষ্কার দিয়ে অন্যরা উপকৃত হলেও নিজেরা হয়তো সামান্য আবিষ্কারের কৃতিত্বটুকুও পাননি। এমনই একজন মন্দ ভাগ্যের বিজ্ঞানী হচ্ছেন কার্ল উইলহেম শিহিল। আজ এই মন্দ ভাগ্যের বিজ্ঞানী সম্পর্কেই চলুন জেনে নিই- কার্ল উইলহেম শিহিল ১৭৪২ সালে বর্তমান জার্মানির স্ট্রালস্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী। বাবার ইচ্ছা ছিল শিহিল বড় হয়ে তার ব্যবসাকে পরিচালনা করবেন। কিন্তু শিহিলের মন ব্যবসায় বসেনি। তিনি রসায়নকে বেছে নিয়েছিলেন চর্চার মাধ্যম হিসেবে।

বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ শিহিলকে আকৃষ্ট করত। মাত্র ১৪ বছর বয়সে সুইডেনের গুটেনবার্গের একটি ফার্মেসিতে কাজের সুযোগ পান। যেখানে তিনি প্রথম রাসায়নিক দ্রব্য নিজ হাতে নাড়াচাড়া করার সুযোগ পান। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ তাকে কাজের জন্য খুবই উদ্দীপ্ত করত। তাই তিনি ফার্মেসির কাজ শেষে গভীর রাত অব্দি রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন।

নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নাড়াচাড়া করতে করতেই তার ভাগ্য একদিন বেঁকে বসে। এক সন্ধ্যায় উদ্বায়ী পদার্থের মিশ্রণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। যার ফলে তার মালিক রেগে গিয়ে তাকে চাকরি থেকে বিদায় দেন। তবে খুব শিগগিরই এরচেয়েও ভাল কাজ খুঁজে পান শিহিল।

মি. সি. এম. খিয়ালস্ট্রম নামক একজনের মাধ্যমে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক জগতের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হন শিহিল। ১৭৬৭ সালে শিহিল স্টকহোমে চলে যান এবং ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করেন।

শিহিলের প্রথম আবিষ্কার ছিল টারটারিক এসিড। টারটারিক এসিড হচ্ছে সাদা বর্ণের জৈব এসিড যা প্রাকৃতিকভাবে অনেক ফলমূল, যেমন আঙ্গুরে পাওয়া যায়। যারা মদ্যশিল্পের সাথে জড়িত তারা শত শত বছর ধরে টারটারিক এসিডের কথা জানতেন। কিন্তু শিহিলের পূর্বে রাসায়নিকভাবে টারটারিক এসিড নিষ্কাশন করার পদ্ধতি কেউ বের করতে পারেননি।

শিহিল হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি নষ্ট দুধ বা টক দই থেকে ল্যাকটিক এসিড পৃথক করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হাইড্রোজেন ফ্লুরাইড আবিষ্কার করেছিলেন শিহিল। পচা ডিমের গন্ধের কথা কে না জানি? সেই গন্ধের জন্য দায়ী গ্যাস হচ্ছে হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস। এটিও আমাদের জানা। কিন্তু আমরা ভুলে গিয়েছি শিহিলের নাম। যিনি এই হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস আবিষ্কার করেছিলেন।

অক্সিজেনও আবিষ্কার করেছিলেন শিহিল। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হওয়ায় অক্সিজেন আবিষ্কারের কৃতিত্ব আজ জোসেফ প্রিস্টলির। ঠিক যেমন বেতার আবিষ্কারে আজ আমাদের বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর নামের পরিবর্তে আমরা দেখি মার্কনীর নাম। শিহিল প্রিস্টলীর তিন বছর পূর্বে অক্সিজেন আবিষ্কার করলেও তা পাবলিকেশন করতে সময় নিয়েছিলেন ছয় বছর। আর এরই মধ্যে প্রিস্টলি তার গবেষণালব্ধ তথ্য উপাত্ত প্রকাশ করে অক্সিজেন আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিয়ে নেন।

শিহিল কমপক্ষে আরো ৬টি মৌল আবিষ্কারের কাছাকাছি গিয়েছিলেন। মৌলগুলো হচ্ছে– বেরিয়াম, ক্লোরিন, মলিবডেনাম, ম্যাঙ্গানিজ, নাইট্রোজেন ও টাংস্টেন। যেগুলো থেকেও তিনি কোনো প্রকার স্বীকৃতি পাননি অথবা সামান্য খ্যাতি পেয়েছিলেন।

ক্লোরিনের ক্ষেত্রে শিহিল মনে করতেন হাইড্রোক্লোরিক এসিড থেকে প্রাপ্ত অক্সাইড। কিন্তু চার দশক পরে স্যার হামফ্রে ডেভি বলেন অক্সাইড নয়। একটি মৌল ছিল সেটির নাম দেন ক্লোরিন। বেরিয়াম যে মৌল এটা শিহিল জানলেও তা পৃথক করতে পারেননি। পরবর্তীকালে এটিরও কৃতিত্ব নেন হামফ্রে।

মলিবডেনাম যে সীসার আকরিক নয় বরং একটি আলাদা মৌল তা সঠিকভাবে উত্থাপন করেছিলেন শিহিল। মন্দ ভাগ্য ছিল ম্যাঙ্গানিজ আবিষ্কারের সাথেও। তিনি চিহ্নিত করেছিলেন ম্যাঙ্গানিজকে। কিন্তু পারেননি নিষ্কাশন করতে।

শিহিলের নাম হয়তো অনেক কিছুর জন্যই স্মরণ করা যেতে পারত। কিন্তু বর্তমানে তাকে প্রায় ভুলতে বসা যৌগের জন্য মনে করা হয়। যৌগটি হচ্ছে ‘শিহিলের সবুজ যৌগ’ যা দেখতে হলুদাভ সবুজ। এটি বিভিন্ন ধরনের রঙ্গিন কাগজ, পত্রিকার অক্ষর, ওয়ালপেপার, বস্ত্রের রং ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হত।

শিহিলের সবুজ যৌগটি নানা কাজে ব্যবহারের মাধ্যমে অসংখ্য লোককে হত্যা করা হয়েছিল। ধারণা করা হয় নির্বাসিত নেপোলিয়ানও এই শিহিলের যৌগের কারণেই মারা যান। সবুজ যৌগটিতে প্রচুর আর্সেনিক ছিল। তৎকালে আর্সেনিকের বিষাক্ততার কথা কেউ জানত না।

নেপোলিয়নকে যখন সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয় সেখানকার ঘরটিকে উজ্জ্বল সবুজ রঙে রঙ্গিন করা হয়েছিল। যদিও নেপোলিয়ান মারা গিয়েছিলেন পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। পরবর্তীকালে তার চুলের নমুনা পরীক্ষা করে প্রচুর আর্সেনিক পাওয়া যায়। মূলত আর্সেনিক পাকস্থলীর ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে।

শিহিল অনেকগুলো মৌল ও যৌগ আবিষ্কারের মাধ্যমে তৎকালে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার নাম সেসবের সাথে পরিচিতি না পেলেও পরিচয় পেয়েছে একটি মারাত্মক বিষের সাথে। হয়তো মন্দ ভাগ্য বলেই এমনটি হয়েছে। অথবা মানুষ যে আপনার ভাল কাজকে ছড়িয়ে না দিলেও মন্দ কাজকে বাতাসের আগে ছড়িয়ে দেয় সেটিও হতে পারে।

যা-ই হোক, মন্দ ভাগ্যের বিজ্ঞানীর ভাগ্যটা মৃত্যু পর্যন্ত মন্দই ছিল। বছরের পর বছর বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে থাকায় তার স্বাস্থ্যহানি হয়েছিল। শিহিলের অভ্যাস ছিল বিভিন্ন বস্তুর ঘ্রাণ নেওয়া ও জিহ্বায় দিয়ে স্বাদ গ্রহণ করা। যে কারণে পারদের বিষক্রিয়ায় কিডনিজনিত সমস্যায় পড়েছিলেন। ফলে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মৃত্যু হয় এই মন্দ ভাগ্যের বিজ্ঞানীর।

তথ্যসূত্র: নিউ ওয়ার্ল্ড এনসাইক্লোপিডিয়া, ন্যাচার ডট কম।

ওডি/এনএম

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড