আফসানা রিজোয়ানা সুলতানা
ফারাক্কা বাঁধ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গা নদীর ওপর অবস্থিত একটি বাঁধ। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২২৪০ মিটার। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এই বাঁধটি অবস্থিত। ১৯৬১ সালে এই বাঁধটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৭০ সালে এবং সেই বছরেই ২১শে এপ্রিল থেকে বাঁধটি চালু হয়।
ফারাক্কা বাঁধ ভারত মূলত তৈরি করে কলকাতা বন্দরকে পলি জমার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু প্রকৃতিতে মানুষের হস্তক্ষেপ প্রকৃতি ভালোভাবে মেনে নেয়নি। এর ক্ষতিকর দিক হলো এটি বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনে। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে মাত্র ১৮ কিমি উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এই ব্যারেজ যে প্রকৃতির জন্য এক বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়াবে সেটা বাংলাদেশ ও ভারতের বিশেষজ্ঞরা তখনই বুঝতে পেরেছিলেন। এমনকি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তার জীবনের সর্বশেষ আন্দোলনও করেন এর প্রেক্ষিতেই। কিন্তু কোনো আন্দোলনই ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।
ফারাক্কা বাঁধ গত ৪০ বছর ধরে আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। এর কারণে আমাদের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কৃষি, মৎস্য, বনজশিল্প, নৌ পরিবহন, পানি সরবারহ ইত্যাদি খাতে ব্যাপক লোকসান দেখা দিয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদীর নাব্যতা উদ্বেগজনকভাবে কমে গেছে। নদীর তলদেশ প্রায় ১৮ ফুট ভরাট হয়ে গিয়েছে। আগে পদ্মা প্রায় ১৫ লাখ কিউসেক পানি ধারণ করতে পারত। কিন্তু এখন পদ্মা নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা প্রায় অর্ধেক। ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। আর এর ফলে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। ইউনেস্কোর রিএ্যাক্টিভ মনিটরিং মিশন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সেখানে বলা হয়েছে সুন্দরবনের পানি প্রবাহ মূলত পদ্মা, মেঘনা এবং ব্রহ্মপুত্রের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বাংলাদেশের সীমানার মাত্র ১৫ কিমি উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে ভারত সরকার উজান থেকে বিপুল পরিমাণ পানি সরিয়ে ফেলে। এতে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে যায়। ফলে জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি জমে গিয়ে বনের ভূমি উঁচু হতে থাকে। আর তাই দীর্ঘ মেয়াদে জোয়ারের পানি বনের ভিতর প্রবেশ করতে পারে না। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ১৯৮৫ সালের পর সুন্দরবনের মাঝারি লবণাক্ত এলাকাগুলো বেশি লবণাক্ত এলাকায় পরিণত হয়েছে।
ফারাক্কা বাঁধের মারাত্মক ফল ভোগ করতে হচ্ছে দেশের কৃষি খাতকে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের সেচ প্রকল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাটির লবণাক্ততা এবং মিঠা পানির অপ্রাপ্যতা কৃষির মারাত্মক ক্ষতি করছে।
ফারাক্কা বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের ৩২০ কিমি ও বেশি নৌপথ চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। তাছাড়া পলি পড়ে পদ্মা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় এর শাখা প্রশাখাগুলোর পানি প্রবাহের ধরন, পানি প্রবাহের বেগ এবং লবণাক্ততার পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু এই বিষয়গুলো মাছের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলশ্রুতিতে মাছের সরবারহ কমে যাচ্ছে এবং বেকার হয়ে পড়ছে কয়েক হাজার জেলে।
ফারাক্কা বাঁধ আমাদের জন্য মরণ ফাঁদ। শুষ্ক মৌসুমে এই ফাঁদ আমাদের দেশকে মরুভূমিতে পরিণত করে। আবার বর্ষার মৌসুমে দেশে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। পাশাপাশি অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই। তাই এর হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের অনতিবিলম্বে ভারত সরকারের সাথে ফলপ্রসু আলোচনা করতে হবে। ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সাথে সীমান্ত চুক্তি, ছিটমহল বিনিময় ইত্যাদি বড় বড় ইস্যুগুলো সমাধান করে ফেলেছেন। বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা নিয়ে ভারত আর মায়ানমারের সাথে যে বিরোধ ছিল তার সমাধান তারই আমলে। দেশ তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এগিয়ে চলছে। তাই আমরা আশা করতেই পারি যে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই মরণ ফাঁদ ফারাক্কা বাঁধের ব্যাপারেও একটি দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়ে আমাদের দেশ ও বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবেন।
শিক্ষার্থী, কৃষি অনুষদ পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড