• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

মামলার পরিবর্তে এডিআর কেন করবেন?

  মুহাম্মদ জহিরুল হক

১৫ জুলাই ২০১৯, ১০:৪৬
আইন
ছবি : প্রতীকী

এক্সেস টু জাস্টিস অর্থাৎ ন্যায় বিচারের নাগাল পাওয়া সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অন্যতম প্রধান শর্ত। জাস্টিস বা ন্যায় বিচার এবং এক্সেস টু জাস্টিস বা ন্যায় বিচারের নাগাল পাওয়া এক বিষয় নয়। জাস্টিস হচ্ছে লক্ষ্য আর এক্সেস টু জাস্টিস হচ্ছে সেই লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম। এক্সেস টু জাস্টিস মানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কোনো বিরোধ নিস্পত্তির জন্য আদালতে মামলা করার মাধ্যমে আশ্রয় লাভের ও আদালতের ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার।

ইউএনডিপির প্র্যাকটিস নোট এ বিষয়ে বৃহৎ ধারণা দিয়েছে। ইউএনডিপির মতে, এক্সেস টু জাস্টিস একজন ব্যক্তির আদালতের প্রবেশাধিকার বা আইনগত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা ছাড়াও এটি ফরমাল ও ইনফরমাল বিচার পদ্ধতির উভয় ক্ষেত্রে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সহজে প্রবেশ এবং সেই বিচারের ফল যেন ন্যায় ও পক্ষপাতশূন্য হয়, তা নিশ্চিত করা। ইউএনডিপি বিচার ব্যবস্থায় চারটি প্রধান বিষয় চিহ্নিত করছে, যেগুলো নিশ্চিত করতে পারলে এক্সেস টু জাস্টিস নিশ্চিত হবে।

প্রধান চারটি বিষয় হলো– প্রতিকার চায়তে কার্যকরীভাবে বিচারের জন্য আদালতে প্রবেশাধিকার, প্রতিকার ফরমাল অথবা ইনফরমাল পদ্ধতিতে চায়তে পারা, বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি ফরমাল অথবা ইনফরমাল উভয়ই হতে হবে নায্য, সুলভমূল্য, জবাবদিহিতা সম্পন্ন এবং যাতে প্রয়োজনীয় সময়ের অতিরিক্ত সময় যাতে ব্যয় না হয়, প্রতিকার অবশ্যই পারিপার্শ্বিকের সাপেক্ষে পর্যাপ্ত ও সন্তোষজনক হতে হবে।

উপরোক্ত চারটি বিষয়ের মধ্যে তিন নাম্বার বিষয়ে বিচার প্রক্রিয়া নায্য, সুলভমূল্য, জবাবদিহিতা সম্পন্ন এবং প্রয়োজনীয় সময়ের অতিরিক্ত সময় যাতে ব্যয় না হয় তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিরোধ নিষ্পত্তিতে অযৌক্তিক সময় ক্ষেপণ ও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা ন্যায় বিচার পেতে বিঘ্ন ঘটায়। আদালতে ফরমাল বিচার প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রে-অতিরিক্ত সময়সাপেক্ষ, দীর্ঘসূত্রী, ব্যয়সাপেক্ষ, জটিল, নতুন বিরোধ সৃষ্টিকারী, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত, দুর্নীতিগ্রস্ত, জবাবদিহিতা অনুপস্থিতসহ নানা সমস্যায় যুক্ত।

আদালতের ফরমাল বিচার প্রক্রিয়ার এই সমস্যা নিরসনে ইনফরমাল বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি তথা অলটারনেটিভ ডিস্পিউট রিজলোসন বা এডিআর অধিকতর সহায়ক। কারণ অলটারনেটিভ ডিস্পিউট রিজলোসন বা এডিআর এমন একটি পদ্ধতি যেটিতে বিচার প্রক্রিয়া- অতিরিক্ত সময় সাপেক্ষ নয়, ব্যয় সাপেক্ষ নয়, জটিলতামুক্ত, ইতিবাচক ফল যা সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখে, সমান-সমান ফলা যা বিরোধের পক্ষকে সন্তুষ্ট রাখে, আদালতের অতিরিক্ত মামলার জট কমিয়ে আনে। তাই এডিআর এক্সেস টু জাস্টিস নিশ্চিত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলে এটি বিচার ব্যবস্থায় অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়েছে।

বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা অলটারনেটিভ ডিস্পিউট রিজলোসন (এডিআর) হচ্ছে এমন একটি বিচার প্রক্রিয়া যা আদালতের ফরমাল বিচার প্রক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত, বিকল্প ও ইনফরমাল প্রক্রিয়া। এডিআর এ আদালতের ন্যায় ফরমাল নিয়মগুলো মেনে চলা হয় না। ফলে সময় ও ব্যয় সংকুলান এবং জটিলতা কমে যায়। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা অলটারনেটিভ ডিস্পিউট রিজলোসন (এডিআর) এর দুইটি রূপ। এক. ইনফরমাল বা আদি অর্থাৎ সামাজিক গোষ্ঠী ভিত্তিক এডিআর, দুই. ফরমাল বা আধুনিক অর্থাৎ আদালত সংযুক্ত এডিআর।

ইনফরমাল বা আদি অর্থাৎ সমাজিক গোষ্ঠি ভিত্তিক এডিআর অনেক আগে থেকে সমাজের বিচার ব্যবস্থায় প্রচলিত। আদালত সংযুক্ত বিচার ব্যবস্থায় এডিআর প্রচলনের প্রবর্তক আমেরিকা। ১৯৭০ সালের দিকে আমেরিকার বিচার ব্যবস্থা ব্যয়বহুলতা, দীর্ঘসূত্রিতা, জটিলতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল, যা সাধারণ জনগণের বিচারপ্রাপ্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এর বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠে। পরবর্তীতে আইনজ্ঞদের মতামত ও আন্দোলনের ফলে আমেরিকায় অলটারনেটিভ ডিস্পিউট রিজলোসন অ্যাক্ট ১৯৯৮ পাশ হয়।

আমেরিকায় আদালত সংযুক্ত এডিআর এর ব্যাপক সফলতার কারণে দ্রুত সারা বিশ্বের উন্নত দেশগুলো বিচার ব্যবস্থায় এডিআর গ্রহণ করে। নব্বইয়ের দশকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তাকারী সংগঠন সারা বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এডিআর’র প্রচলন করতে সহায়তা করে। তন্মধ্যে ইউএসএআইডি অন্যতম।

বাংলাদেশে সমাজ ব্যবস্থায়ও সমাজিক মধ্যস্থতার বিধান আদিকাল থেকে প্রচলিত ছিল। শালিস, গ্রাম আদালত ব্যবস্থা ও মুসলিম পরিবারিক আইনে অনেক আগে থেকে মধ্যস্ততার বিধান প্রচলন ছিল। তবে আদালত সংযুক্ত এডিআর প্রচলন খুব বেশি আগের নয়। বাংলাদেশে ১৯৪০ সালে আরবিট্রেশন অ্যাক্ট, ১৯৬৯ সালে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল রিল্যাসন অরডিন্যান্স ও মুসলিম ফ্যামেলি ল’ অরডিন্যান্স এবং ১৯৮৫ সালে ফ্যামেলি কোর্ট অরডিন্যান্সের মাধ্যমে এডিআরের যাত্রা শুরু হয়। সর্বশেষ ২০০৩ সালে দেওয়ানী কার্যবিধিতে এডিআরের বিধান রেখে সংশোধনী আনা হয়।

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ রিপোর্ট অনুযায়ী ৪,৭০,৬৬৭টি মামলা দায়ের করা হয় বিপরীতে নিষ্পত্তি হয় ৪,৫৮,০৬৫টি মামলা। ছয় বছর আগে ২০১৩ আদালতে এডিআরের বিধান আনার আগে মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তির পার্থক্য ছিল এক লক্ষের বেশি। এই পার্থক্য কমে আসার পেছনে বিচার ব্যবস্থায় বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার মধ্যে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান আনা অন্যতম। আদালতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান রাখায় বিচার ব্যবস্থা ব্যয় ও সময় সংকুলান, জটিলতা নিরসন হয়েছে।

সরকার এরই মধ্যে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের নাগালে ন্যায় বিচার পৌঁছে দিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। দেওয়ানী আদালতের মামলা বিভিন্ন পর্যায়ে এডিআর এর বিধান আবশ্যিক রাখা হয়েছে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সুবিধা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী, তাই এই জীবনকে জটিলতায় না রেখে বিরোধ মিমাংসা করায়ই বুদ্ধিমানের কাজ।

তবে এডিআর আদালতের ফরমাল বিচার ব্যবস্থার প্রতিস্থাপক নয় বরং বিকল্প বা সংযুক্ত উপায়। কারণ সকল বিরোধের ক্ষেত্রে সমঝোতা সম্ভব হয় না। অনেক দেশের বিচার ব্যবস্থায় দেওয়ানী মামলায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান কার্যকরীভাবে ব্যবহার হলেও ফৌজদারি মামলায় এখনো ব্যবহার হয়নি। বাংলাদেশেও এর বিধান নেই। কারণ দেওয়ানী বিরোধ আপোষ যোগ্য হলেও ফৌজদারি বিরোধ আপোষ যোগ্য নয়, ফৌজদারি অপরাধ আপোষ করা অনৈতিক। এটি সমাজ বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ। রাষ্ট্র কখনো আপোষ করতে পারে না এবং আইন বলবৎ করতে বাধ্য। তা সত্ত্বেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে ফৌজদারি মামলায় প্লিয়া বারগেনিং সিস্টেম প্রচলন আছে।

প্লিয়া বারগেনিং সিস্টেম হচ্ছে আদালতে ট্রায়াল পূর্ববর্তী আসামী এবং প্রসিকিউশনের মধ্যে সন্ধি স্থাপনের ব্যবস্থা যেখানে আসামী দোষ স্বীকার করে নেয় প্রসিকিউসনের পক্ষ থেকে কিছু অভিযোগ অথবা শাস্তি কমিয়ে আনার বিনিময়ে। প্লিয়া বারগেনিং বা দরকষাকষি দুই প্রকার, ১. চার্জ বা অভিযোগ বার্গ্যান ২. সেনটেসনস বা শাস্তি বারগ্যান। তবে সব অপরাধে প্লিয়া বারগেনিং সম্ভব নয়। যেমন, সমাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন অপরাধ, নারীও শিশুর বিরুদ্ধে অপরাধ, অভ্যাসগত অপরাধ যেমন সিরিয়াল কিলার।

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান মামলার ঝট কমাতে, সধারণ মানুষের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে দেওয়ানী মামলার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলায়ও এডিআর প্রচলন সময়ের দাবি। বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা, ব্যয়বহুলতা ও জটিলতা নিরসনে এডিআর অনেক বেশি ফলপ্রসূ। গত ২৯ এপ্রিল ২০১৯ সালের জাতীয় আইন সহায়তা দিবসের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফৌজদারী মামলায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা এডিআর প্রচলনের ওপর গুরুত্ব দেন।

তিনি বলেন, আমরা চাই প্রতিটি মানুষ ন্যায়বিচার পাক এবং সেই ব্যবস্থাটা যেন চালু হয়। আমরা যেমন বিচার না পেয়ে কেঁদেছি, আর কাউকে যেন এভাবে কাঁদতে না হয়। সকলে যেন ন্যায়বিচার পেতে পারে, সেটাই আমরা চাই।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক মামলার দীর্ঘসূত্রিতা রয়েছে। অনেকে বছরের পর বছর কারাগারে আটকে রয়েছে, কেন যে আটকে রয়েছে, তারা নিজেরাও জানে না। তাদের দোষটা যেমন কেউ কেউ জানে না, তেমনি কীভাবে আইনগত সহায়তা নিতে পারে, তা-ও জানা নেই। সেই বিষয়টা দেখার জন্য আমরা ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছি এবং আমার মনে হয়, আইন মন্ত্রণালয় এই ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।

তিনি তার বক্তৃতায় ন্যায় বিচার ও দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সুতরাং ফৌজদারি মামলায়ও এডিআর প্রচলনের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি। মানুষকে সমঝোতা, মীমাংসার সুবিধা বা গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝাতে হবে যেন বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে আরও আগ্রহী হয়।

লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ (বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ)

ওডি/আরএআর

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড