• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

কর্মজীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ‘পহেলা মে’

  রহমান মৃধা

০৮ মে ২০২৩, ১২:৩৬
কর্মজীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ‘পহেলা মে’
ফাইজারের প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের সাবেক পরিচালক রহমান মৃধা (ছবি : সংগৃহীত)

দীর্ঘদিন ঠাণ্ডা তুষারে ভরা শীতের অন্ধকারের স্ক্যান্ডিনেভিয়া দেখা পেতে শুরু করেছে সূর্যের আলোর। ফুলের বাহারে ভরা ফাগুনের এই আনন্দঘন সময় সুইডিশদের বেশ আপ্লুত করে তুলছে, সঙ্গে আমাকেও। এপ্রিলের শেষের দিনে ট্র্যাডিশনাল ওয়েতে মাইব্রসার (বনফায়ার) আগুন জ্বালিয়ে শীতের বিদায় দিতে হয়।

মাইব্রসা হচ্ছে খড়কুটা সহ সকল আবর্জনা এবং জঙ্গলের পড়ে থাকা অকেজো গাছপালা একত্রিত করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া এবং তার চারপাশ ঘিরে সবাই এক সঙ্গে সারিবদ্ধ হয়ে হাতে হাত রেখে নাচ-গান করা। মূলত শীতকে বিদায় জানানো এবং বসন্ত তথা গরমকে অভিনন্দন জানানোর এক অতি পুরানো প্রথা যা হয়ে চলেছে সম্ভবত সেই ১৩০০ সাল থেকে।

তবে সুইডেনে, মাইব্রসা বা ভলবোরি দিনটি সরকারি ভাবে ১৯০১ সালে সুইডিশ পঞ্জিকাতে প্রবর্তিত হয়েছে এবং সেই থেকে দিনটিকে বসন্তের প্রতীক এবং শীতের শেষের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়। সুইডেনের চারপাশে, পৌরসভা এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে বনফায়ারের আয়োজন করা হয়ে থাকে। বন্ধুবান্ধব এবং পরিবার প্রতিবছরই বারবিকিউ, গেট-ট্যুগেদার বা পিকনিক করতে জড়ো হয় এ দিনটিতেও।

গ্রীষ্মের আগমনকে স্বাগতম জানিয়ে রাতের শেষে এক নতুন সূর্যোদয়ে প্রতি বছরের মতো এবারও হাজির হবে পহেলা মে, লেবার ডে। দিনটির গুরুত্ব এবং তাৎপর্য মানবজাতির কর্মজীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। চিরপরিচিত ধর্ম, ন্যায়-অন্যায়, রাইটস এগেইনস্ট ফাইট, পরাধীন থেকে স্বাধীন বা রাজনীতির কারণে যুগ যুগ ধরে সময়ে-অসময়ে ট্রাজেডি এবং অকাল মৃত্যু ঘটেছে হাজারও নির্দোষ মানুষের। ব্যক্তি, সমাজ এবং দেশের স্বার্থে স্মৃতির জানালা খুলে দেখলে অনেক ঘটনার দেখা মেলে।

পৃথিবীর ইতিহাস খুলে দেখলে সানডে ব্লাডি সানডের মতো হাজারও দিনের কথা বেরিয়ে আসবে। যেমন ২১শে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতির ইতিহাসে এক স্মরণীয় রক্তাক্ত দিন। জানুয়ারি ১৯৭২ সালের এক রবিবার, উত্তর আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ব্রিটিশদের সংঘর্ষে ঝরে পড়েছিল ১৪ জন আইরিশ নাগরিকের প্রাণ, কেবল ধর্মীয় ভিন্নমতের কারণে। সেই থেকে বিখ্যাত আয়ারল্যান্ডের রকগোষ্ঠী ইউ-টু ব্র্যান্ডের সানডে ব্লাডি সানডে গানের উৎপত্তি।

বিশ্বের এ রকম হাজারো স্মরণীয় দিনের মতো লেবার ডে, একটি বিশেষ দিন। পৃথিবীর সবখানেই কমবেশি দিনটির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে।

মে ৪ ১৮৮৬ সাল। শিকাগোর হে-মার্কেট স্কয়ারে ঘটেছিল এক রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড, যা ছিল শিকাগোর সাধারণ কর্মচারীদের এক মৌলিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেবার এক হীনপ্রয়াস। তাদের দাবি ছিল ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবসের। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শুরু হবে এবং ৮ ঘণ্টা পর শেষ হবে, যা পরে পুরো বিশ্বের কর্মচারীদের সমস্যার সমাধান ঘটিয়েছে। বলতে হয় 'লোকাল কনসার্ন গ্লোবাল সলিউশনস'।

পহেলা মে সুইডেন, নরওয়ে এবং আইসল্যান্ডে ছুটির দিন। কিন্তু ডেনমার্কে দিনটি অফিসিয়াল ছুটির দিন নয়। দিনটিতে বেশ স্মৃতিচারণ করা হয়ে থাকে বিক্ষোভ মিছিলের সঙ্গে।

বহু বছর আগের কথা। কাজের ফাঁকে হন্যে হয়ে তন্ন তন্ন করে খোঁজার পর সেদিন শিকাগোর হে-মার্কেট স্কয়ারের দেখা পেয়েছিলাম। দূরপরবাসী বন্ধু দীর্ঘ একযুগ ধরে শিকাগোতে বাস করছে। আমার সঙ্গে হে-মার্কেটে আসার পর বলেছিল, তার এ পথেই আসা-যাওয়া প্রায় প্রতিদিন। কিন্তু জানতো না এটাই যে সেই বিখ্যাত জায়গা, যার কারণে দুনিয়াজুড়ে মে দিবস পালন হয়।

গাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে এর আগে হাত নেড়ে মাথা ঘুরিয়ে আমাকে শিকাগোর অলিগলি দেখিয়েছিল বন্ধু সেদিন। তবে একটি বড় বাতাস ভরা বেলুনের মতো হঠাৎ একটু লজ্জা পেয়ে যেন আলপিনের আচমকা টোকায় চুপসে গিয়েছিলাম সেদিন। যখন জানলাম বেশিরভাগ আমেরিকানও জানে না মে দিবস কী। জিজ্ঞেস করলে বেশিরভাগই বলবে, সেটা আবার কী?

এখানে পহেলা মে একটি কাজের দিন। ছুটি নেই। এখানে পালন করা হয় লেবার ডে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার, যা এদের ছুটির দিন। সেদিন তারা দলে দলে রাস্তায় নেমে লাল পতাকা নিয়ে গলা ফাটিয়ে মিছিল করে না ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’।

এখানে লেবার ডে পালন করা হয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদযাপন হিসেবে। তবে এদের মে দিবস থেকে লেবার ডে-তে সরে আসার পেছনের কারণ ভিন্ন। সাম্রাজ্য ও পুঁজিবাদের সঙ্গে কম্যুনিজমের দ্বন্দ্ব। পুরোটাই আসলে নীতি ও রাজনীতির ঘূর্ণিপাক। ভিন্ন ভিন্ন অক্ষকে কেন্দ্র করে শুধু নিজেদের চিন্তাভাবনার বিস্তার।

যে চিন্তাভাবনার ঘূর্ণিতে এখানে হে স্কয়ার কিংবা মে দিবস চাপা পড়ে গেছে। হয়তো কম্যুনিজমের ডানাও এখন পুঁজিবাদের গ্রাসে। বাংলাদেশের লাল পতাকার নেতাদের এখন আর পিকিংপন্থি বলা যায় না। সোভিয়েতপন্থি হওয়ার সুযোগ তো নেই-ই। মার্কিনপন্থাকেই তারা বেশ পছন্দনীয় মনে করছেন। সুইডেনের মতো বাংলাদেশের রাজপথও ঝাঁঝালো বক্তব্য থেকে অব্যাহতি পেয়েছে নিশ্চয়ই? পপুলার এক বাম নেত্রীর সাথে স্টকহোমের রাস্তায় কথা হলো।

জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছি? বললাম, পুঁজিবাদী সাম্রাজ্য দেখছি আর ঘুরছি। তিনি একটু ইতস্তত ফিল করলেন মনে হলো। হেসেও দিলেন। যাইহোক, লিখতে লিখতে হঠাৎ সুইডেনের বিশ্বজোড়া পপ স্টার জারা লারসনের কথা মনে পড়লো।

প্যারিসের কাটেড্রল নোট্রে-ড্যামের অগ্নিকাণ্ডের পর মেরামত করার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে গোটা বিশ্ব। এমন একটি সময় জারা গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছে, আফ্রিকার মানুষ না খেয়ে মরছে সেদিকে খেয়াল নেই অথচ কোটি কোটি ডলার ডোনেশন নোট্রে-ড্যামের জন্য। পরের দিন সে ১৫০ হাজার ক্রোনারের শপিং করেছে পোশাক-আশাক কেনার পেছনে। কথায় বলে 'ওয়াক এজ ইউ টক'। কিন্তু বাস্তব এখনও বহু দূরে। মে দিবসের বক্তৃতায় অনেক কথাই বলা হয় অনেক কিছুই লেখা হয়।

আমার প্রশ্ন, করা হয় কি সেগুলো? হাজারও প্রশ্ন, জানিনে এ প্রশ্নের উত্তর আছে কিনা! জানিনা পৌঁছাবে কিনা তাদের কাছে আমার এ লেখা যারা দিতে পারবে এর উত্তর!

বাংলার মেহনতি মানুষ কি দিনের শেষে তার প্রাপ্য পায়? পায় কি সে তার ন্যায্য মজুরি? বাসার কাজের লোক কি ঠিক মতো পেট ভরে খেতে পায় দু’মুঠো ভাত? তাদের কি ঠিক আট ঘণ্টা খাটানো হয় প্রতিদিন? আছে কি তাদের ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের নিরাপত্তা?

আসছে পহেলা মে, বিশ্ব লেবার ডে। এই দিনটিকে সামনে রেখে ১৯০৭ সাল থেকে শুরু করে আজ অবধি একটি ছোট্ট কাগজের ফুল হয়ে ওঠেছে সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতীক। সুইডেনে আমরা বলি মাইব্লোম্যান, সেই ১৯০৭ সাল থেকে সুইডেনে শিশুদের জন্য এই কাগজের তৈরি ফুলটি একটি পার্থক্য তৈরি করেছে।

বেদা হালবার্গ, (Beda Hallberg) যিনি মাইব্লোম্যান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি শিশু এবং যুবকদের প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দ্বারা চালিত ছিলেন এবং প্রত্যেককে একটি ভালো এবং শক্তিশালী সমাজে অবদান রাখার সুযোগ দিতে চেয়েছিলেন। সেই থেকে প্রতি বছর এপ্রিলের শুরুতে ফুলটি নানা ভাবে বিক্রি হয়ে থাকে সুইডেন সহ নর্ডিক দেশগুলোতে এমন কি বিশ্বায়নের আরও অনেক দেশে এটা বিক্রি করা হয় এবং পহেলা মে-কে সামনে রেখে সংগৃহীত অর্থ শিশুদের আর্থিক সহায়তায় বিতরণ করা হয়ে থাকে।

আমরা কি এমন একটি উদ্যোগ নিতে পারি না এবারের পহেলা মে শ্রমিক দিবসকে সামনে রেখে, যেমন কোন শিশুই যেন রাস্তায় ভিক্ষা না করে বরং সব শিশুই যেন সুইডেনের মত সুযোগ সুবিধা পেয়ে সুযোগ্য নাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে পারে!

লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।

[email protected]

(মতামত পাতায় প্রকাশিত লেখা একান্ত লেখকের মত। এর সঙ্গে পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।)

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড