• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

সংবাদ সংকট: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজবের ছড়াছড়ি

  দেবারতি রায়

১০ নভেম্বর ২০২০, ২১:১৪
ফেক নিউজ
ছবি : সংগৃহীত

২০১৬ সালের আমেরিকান নির্বাচনের পরে বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক মহলে বড় একটা সাড়া পড়ে যায়। পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে উদ্দেশ্যকৃতভাবে বাছাইকৃত ফেক নিউজ বা গুজব নানান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছিলো যা তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে এই নির্বাচনের ওপর। হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে বাজারজাত পণ্যের মতো ফেক নিউজ বিক্রি করে অনলাইনে বিপুল পরিমাণে টাকা কামিয়েছেন অনেকেই। সেই বছরের একটি জরিপের মাধ্যমে দেখা যায় যে আমেরিকায় কমপক্ষে ৭৫% বাসিন্দা এই সকল গুজবে বিশ্বাস করেছে। কেবল আমেরিকাতেই নয়, ধারণা করা হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নির্দিষ্ট ধাঁচের আশঙ্কাজনক গুজব প্রচারের কারণে সাধারণ নাগরিক হয়ে পড়তে পারে বিভ্রান্ত, যার ফলে ভোটের আদল সম্পূর্ণভাবে পাল্টে যেতে পারে। এই অপপ্রচারের মধ্য দিয়ে নাগরিকদের মাঝে অন্যায়ভাবে ভয় ও বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করা হয়, এবং তাদের স্বতন্ত্র অভিমত প্রকাশের অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করা হয়। তবে গুজবের প্রচার শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই।

রয়টার্স ইন্সটিটিউট এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির যৌথ উদ্যোগে ২০২০ সালের ডিজিটাল নিউজ রিপোর্টে দেখা গিয়েছে বর্তমানে পৃথিবীর ৫৬% মানুষ ফেক নিউজ নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় গুজবের প্রচার সবচেয়ে বেশি হলেও অন্য নানা অঞ্চলে এর উপস্থিতি দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী ৪০% ফেক নিউজ ইন্টারনেটে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম দ্বারা ছড়িয়ে পড়ছে, যার মধ্যে এশিয়া মহাদেশে ফেসবুক আর হোয়াটস অ্যাপের ভূমিকা মুখ্য। গুজবের প্রচার নতুন কোন ঘটনা নয়, তবে সঠিক সংবাদ প্রচারমাধ্যমের অনুকরণে এর সম্প্রচার অভিনব বটে; যার ফলে কোনটি সঠিক খবর আর কোনটি ভুল তা সবসময় বুঝে ওঠা বেশ মুস্কিল হয়ে পড়ে। ২০১৭ সালের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির জরিপ অনুসারে গুজব হতে পারে শুধুই ব্যঙ্গাত্মক, কিংবা লক্ষ্যকৃত ও প্রতারণামূলক যা মানুষের মাঝে বিদ্বেষ আর কলহের জন্ম দিতে পারে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিপথে ধাবিত করতে পারে। দ্বিতীয় ধরণের গুজবের মধ্যে থাকতে পারে অসৎ রাজনৈতিক প্রজ্ঞাপন, অহেতুক ষড়যন্ত্র ও উস্কানিমূলক বার্তা, ভুল বৈজ্ঞানিক তথ্য, মিথ্যা পরিসংখ্যান, প্রতারণাপূর্ণ বিজ্ঞাপন, আংশিক ভুল খবর, ইত্যাদি।

করোনাভাইরাস দুর্যোগের সময়ও গুজবের, প্রধানত মিথ্যা বৈজ্ঞানিক তথ্যের অপপ্রচার বেড়েই চলেছে। মিশিগান ইউনিভার্সিটির গবেষণার মাধ্যমে দেখা গিয়েছে যে এই গুজব প্রচারের জন্য নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটও খোলা হয়েছে, যেখানে এই খবরগুলোকে বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নাম করে প্রকাশ করা হয়। আবার এর সাথে নানা খুঁটিনাটি ভুল তথ্যও যোগ করে দেওয়া হয় যাতে করে সাধারণ নাগরিক একে নির্ভরযোগ্য খবর ভেবে বিভ্রান্ত হয়ে বসে। বাংলাদেশের তরুণ কিছু সংগঠন ও ওয়েবসাইট, যেমন ইউনিসেফের বাংলাদেশ ইয়ুথ ভলান্টিয়ার প্লাটফর্ম, ইয়ুথ পলিসি ফোরাম, বাংলাদেশ ইন করোনা ডট কম, ইত্যাদি করোনা ভাইরাস সঙ্ক্রান্ত এই গুজবের কুপ্রভাব থেকে বাঁচানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সঠিক তথ্য প্রচার করছে। ‘বাংলাদেশ ইন করোনা’-এর ওয়েবসাইটে গেলে পাওয়া যাবে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া গুজবের কিছু নমুনা। এই ফেক নিউজের মধ্যে সম্পূর্ণ গুজব ছাড়াও এমন কিছু সূত্র দেওয়া থাকে যা এক দেখায় ভুল তথ্যের সূত্র বলে বোঝা যায় না। অন্যান্য বিশ্বাসযোগ্য সংস্থান থেকে সম্প্রচারিত সঠিক সংবাদের সাথে যথাযথভাবে তুলনা করলে তবেই বোঝা যায় যে এই তথ্যগুলো ভুল।

রাজনীতি এবং চিকিৎসা ক্ষেত্র ছাড়াও আরও বিভিন্ন বিষয়ে গুজবের প্রচার ভীতিকর। গত চার-পাঁচ বছরে গুজবের ওপর ভিত্তি করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা বেড়েছে। ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শখানেক হিন্দু বাড়ির ওপরে হামলা চালানো হয় এবং সতেরটি মন্দিরে ভাঙচুর করা হয় একটি ইসলামবিরোধী ফেসবুক পোস্টের কারণে। পরে দেখা যায় যে হিন্দু ব্যক্তিটির যে পোস্টটির কারণে আক্রমণ করা হয়েছিলো, সেই ব্যক্তিটির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট অনেক আগেই হ্যাক করা হয়েছিলো। ২০১৭ সালে রংপুরে এবং ২০১৯ সালে ভোলায় একই রকম আরও দুটি হামলা হয় যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউই প্রকৃতপক্ষে ফেসবুকে ইসলামবিরোধী কোন মতামত প্রকাশ করেননি। এই তিনটি ঘটনার ক্ষেত্রেই অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো সামাজিক মাধ্যমগুলোতে, যার কারণে তাদের ওপর এই নির্মম আক্রমণগুলো ঘটে।

ফেসবুকে নাগরিক-সাংবাদিকতা বৃদ্ধি এই ধরণের গুজব ছড়িয়ে পড়ার একটি কারণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো কেবল সংবাদ সম্প্রচারের মাধ্যমই বদলে দেয়নি, এর সাথে পরিবর্তন এসেছে সংবাদ গ্রহণের উৎসেও। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস অ্যাপ, ইত্যাদির মাধ্যমে খুব কম সময়ে যে কেউ একটি বার্তাকে খবর হিসেবে ছড়িয়ে দিতে পারে। এই তথ্যগুলোর সত্যতা যাচাই করার জন্য যে ধরণের ডিজিটাল শিক্ষার দরকার তা অনেকেরই নেই। অনলাইনে খবর যাচাই করতে হলে কতগুলো দিকে মনোযোগ দেওয়া অতি প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে কোন ওয়েবসাইট থেকে তথ্যগুলো গ্রহণ করা হচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখা। অনেকেই চাঞ্চল্যকর গুজবের প্রচারের মাধ্যমে পাঠকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে থাকে। সুতরাং ইন্টারনেটে কোন খবর পেলেই সেটি যে সঠিক তা ভাবার কোন কারণ নেই। সম্পূর্ণ গুজবের পাশাপাশি সাধারণ ব্যক্তিরা যখন বিভিন্ন তথ্য প্রচার করে থাকেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তখন তা আংশিকভাবে ভুল বা ভীষণ পুরনোও হতে পারে যা বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে একদম ভুল বা অপ্রযোজ্য। বিজ্ঞান বিষয়ক তথ্যের ক্ষেত্রে এ ধরণের গুজব বেশি লক্ষ্য করা যায়। অনেক সময়ে বিভিন্ন রাজনীতিবিদও এমন খবর প্রচার করে থাকেন যা আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা। এর অন্যতম উদাহরণ হলো টুইটারে সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক কিছু বার্তা যা প্রকাশ করার পরপরই টুইটার ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলে। অতএব, বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো যাচাই করে নেওয়াও অতি আবশ্যক। এ বিষয়ে শীঘ্রই সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। ফেক নিউজের সমস্যাটি মোকাবেলা করার জন্য শুধুমাত্র সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকেই নয়, সাংবাদিক আর রাজনীতিবিদদেরও সক্রিয় ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। রয়টার্সের রিপোর্ট অনুযায়ী জনগণ কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেনামা সূত্র থেকে প্রচারিত গুজব নিয়েই চিন্তিত নয়, বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং সংবাদ প্রেরক ওয়েবসাইট নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছে। এই ধরণের সংশয়াপন্ন দৃষ্টির গোচর থেকে বেড়িয়ে আসতে হলে প্রয়োজন স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু তত্ত্বানুসন্ধান ও বিবৃতি প্রদান। ভিন্ন ভিন্ন সংবাদ সূত্র থেকে একেকরকমের খবর পেলে পাঠকদের মনে অভিশঙ্কার আবির্ভাব হওয়া আশ্চর্যজনক নয়। সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। রাজনীতিবিদদেরও সাবধানতা অবলম্বন করে মতামত প্রকাশ করা দরকার, কেননা অনেকেই রাজনৈতিক নেতাদের মন্তব্যগুলোকেই সঠিক তথ্য বলে গ্রহণ করে নেয়। সত্য জ্ঞাপনের দায়িত্ববোধ কাঁধে নিয়েই তাঁদের প্রতিটি ভাষ্য উপস্থাপন করা যথাকর্তব্য। ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারার অধীনে আক্রমণাত্মক বা মানহানিকারক মিথ্যা তথ্য ও উপাত্ত ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে পূর্বোক্ত ক্ষেত্র বিশেষে জনসাধারণের বাক স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। দেশের শান্তি ও দেশবাসীর নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে অনুরূপ আইনের আওতায় এনে ফেক নিউজের নিরোধ করাও প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে সরকারসহ সাধারণ জনগণেরও বিশেষভাবে সোচ্চার হয়ে ওঠা উচিত। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় এমন কোন খবর দেখলে উত্তেজিত না হয়ে প্রথমে খবরটিকে যাচাই করে দেখা দরকার। নিজেদের দায়িত্বে প্রতিটি খবরের সূত্র ও বিষয়বস্তু বিবেচনা করে তবেই তার ওপর ভরসা করা উচিত। বিশেষত বিদ্যালয়গুলোতে ভুল খবরের বিস্তার এবং এর বিরুদ্ধে মোকাবেলার উপায় সম্পর্কে জানানো প্রয়োজন। দেশের বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক সংগঠনগুলো বাংলাদেশে গুজবের প্রচার সম্বন্ধে গবেষণা করলে বর্তমান পরিস্থিতির ভিত্তিতে ভবিষ্যতে আরও কি কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে তা পরিষ্কার হয়ে উঠবে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে অল্ট নিউজ, ইন্ডিয়া টুডে, ক্যুইন্ট, ফ্যাক্টলি, ইত্যাদি ওয়েবসাইটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরা গুজবের পাশাপাশি সঠিক তথ্যটি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ-ভিত্তিক এমন তথ্য যাচাইকারী ওয়েবসাইট বা অ্যাপ উদ্ভাবন করা হলে জনসাধারণের পক্ষে গুজব বা ফেক নিউজ চেনা ও এর থেকে সতর্ক থাকার প্রক্রিয়াটি আরেকটু সহজ হয়ে উঠতে পারে।

লেখক: দেবারতি রায়,বিএ . এলএলবি (স্নাতক ৩য় বর্ষ), নালসার ইউনিভার্সিটি অফ ল, হায়দ্রাবাদ

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড