• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

মানব-চরিত্র সম্পর্কে এরিস্টটল, হবস ও রাসেল

  সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার

০৪ অক্টোবর ২০২০, ১৬:৫৩
সিদ্ধার্থ শংকর
সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার। (ছবি : সংগৃহীত)

এরিস্টটল(৩৮৫ BC-৩২৩ BC), টমাস হবস(১৫৮৮-১৬৭৯) ও বার্ট্রান্ড রাসেল(১৮৭২-১৯৭০)ছিলেন তিন যুগের নামকরা তিনজন দার্শনিক। এরিস্টটল ছিলেন গ্রীসের মানুষ আর হবস ও রাসেল ব্রিটেনের। তিনটা ভিন্ন বাস্তবতা এবং তিন ধরণের সমাজ-রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর তিনজন বেড়ে উঠেছিলেন এবং সত্যিকার অর্থে তিন ধরণের মনস্তত্ব থেকে তাঁদের দার্শনিক বোধ গড়ে উঠেছিলো যা আমরা পেয়েছি তাঁদের লেখা যথাক্রমে Nicomachean Ethics, Leviathan এবং Human Society in Ethics and Politics গ্রন্থে। এই তিনটা গ্রন্থই কালোত্তীর্ণ সৃষ্টি। প্রথমটা নৈতিকতা সংক্রান্ত আর পরের দুটো মানুষের মনস্তত্ব ও নৈতিকতার সংমিশ্রণ। একাডেমিক চর্চার বাইরেও এই গ্রন্থগুলোর ভূমিকা ব্যাপক। কারণ মানব-চরিত্র, সমাজ, রাষ্ট্র, এবং মূল্যবোধ নিয়ে গ্রন্থ তিনটিতে যে আলোচনা হয়েছে তা সন্দেহাতীতভাবে সব ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য খুব প্রয়োজন। বিশেষ করে রাষ্ট্র, ব্যক্তি, ও সমাজের মধ্যে যে অবধারিত সম্পর্ক আছে তারই নানামুখী বাস্তবতা নিয়ে এ গ্রন্থগুলো অবশ্যই নির্দেশনা মূলক। আগেই বলে রাখা ভালো মানব-চরিত্র সম্পর্কে তাঁদের যুক্তি ও দার্শনিক বিচার তিন জনেরই স্বতন্ত্র। এরিস্টটল জোর দিয়েছেন শুদ্ধাচারের পক্ষে, হবস করেছেন মানব চরিত্রের ক্লিনিক্যাল অটপ্সি আর রাসেলের অবস্থান ‘না ঘরকা না ঘটকা’ অর্থাৎ মানুষকে তিনি বলেছেন একটা ‘সেমি-গ্রেগরিয়াস’ বা আধা-সামাজিক প্রাণী। মানুষ সিংহের মতো নিঃসঙ্গ জীবনে অভ্যস্ত না, আবার মৌমাছি বা পিঁপড়ের মতো পুরোপুরি সামাজিকও না। এজন্যই তার দরকার পড়েছে এক ধরণের নৈতিক নির্দেশনা। তাই রাসেলের ক্ষেত্রে মানব চরিত্রকে একটা কাঠামোবদ্ধ জায়গায় আনতে নৈতিক শিক্ষা বিশেষকরে রাজনৈতিকনৈতিকতার বিশেষ প্রয়োজন।

অবস্থান, দেশ, কাল, পরিবেশ, পরিস্থিতি, সংস্কৃতি, গোত্র-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সবখানে বিচিত্র মানুষের দেখা পাই। প্রতিটা মানুষের চরিত্র আলাদা। ব্যক্তিত্ব, পছন্দ, চাওয়া, বিচারবোধ সবকিছু ভিন্ন ভিন্ন। সারাজীবন ধরে কত বিচিত্র মানুষের সাথে আমাদের কাজ করতে হয়। এমনকি আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের দু’জন মানুষের মধ্যেও বন্ধুত্ব দেখি, দেখি বিয়ে বা সংসার। হয়তো জীবনের দীর্ঘ সময় এক ছাদের নিচে কাটিয়ে দেয়া মানুষ দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজের। চারপাশে আমরা যাদের দেখি তারা কেও নরম স্বভাবের, কেও মেজাজি, কেও অত্যাচারী, কেও ভীষণ পজেসিভ, কেও নারসেসিস্ট, ইগোইস্ট, আলট্রুইস্ট, স্যাডিস্ট, মেসোসিস্ট, শর্ট-টেম্পার্টড, বহিমিয়ান, ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই মানব-চরিত্র নিয়ে সাধারণ কোন সূত্র আবিষ্কার করে ফেলা অতি দুরহ কাজ। এবং সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজের একটি। যেমন খুব সহজেই বলে ফেলা যায় একটা ভারী বস্তু ওপর থেকে ছেড়ে দিলে বিনা বাধায় সেটা মাটিতে পড়বেই। চোখ বন্ধ করে বলা সম্ভব দুই অনু হাইড্রোজেন এক অনু অক্সিজেনের সাথে মিশে এক অনু পানি হয়। অথচ মানব-চরিত্রের এমন কোন তকমা দেয়া শুধু কঠিনই না বরং ভীষণ ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।

এরিস্টটল এই কাজটি করতে গিয়ে বেশ সরলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ‘মানুষ একটা সামাজিক প্রাণী’ -এ ধরণের একটা সরলোক্তির প্রতিবাদ জানিয়েছেন রাসেল। An Outline of Intellectual Rubbish প্রবন্ধের শুরুতেই রাসেল লিখেছেন, “ আমরা শিখেছি মানুষ একটা সামাজিক প্রাণী”। কিন্তু আমি সারাজীবন তিনটা মহাদেশের বহু দেশে এ কথার স্বপক্ষে আলামত সংগ্রহের চেষ্টা করেছি কিন্তু পরিতাপের বিষয় একথা বিশ্বাস করার কিছু পাইনি।বরঞ্চ এর বিপরীতে পেয়েছি মানুষের ভেতর নিদারুণ উন্মত্ততা”। এরিস্টটলের এই সরল উক্তির পেছনে ছিল মানব চরিত্রের মনস্তাত্বিক বিচিত্রতা উপেক্ষা করা। আদতে মানুষ অতি বিচিত্র আর নানামুখী বাস্তবতার এক আশ্চর্য সম্মীলন। কাজেই কিছুতেই যেন মানুষের ওপর একটা সাধারণ লেভেল সেঁটে দেয়া সম্ভব না। আমরা প্রথমেই এরিস্টটলের দিকে দৃষ্টি দেই।

মানুষের জ্ঞানের ইতিহাসে এরিস্টটল ছিলেন অতুলনীয়। বলা যায় তাঁর বহুমুখী চিন্তা বিশেষ করে রাষ্ট্রচিন্তা, যুক্তিবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, অধিবিদ্যা এমনকি কাব্যতত্ব নিয়ে যে বিপুল রচনা সম্ভার আছে তা নানা বিতর্কের জন্ম দিলেও বিভিন্ন কারণে তা মূল্যবান। বিশ্বজগৎ সংক্রান্ত তাঁর ভূ-কেন্দ্রিক মতবাদ যুগ যুগ ধরে মানুষের বিশ্বাসের বিষয়বস্ত ছিল। তাছাড়া রাষ্ট্রচিন্তা নিয়ে তাঁর ভাবনা এতো বছর পরেও মানুষের কাছে অনেক গুরুত্বের। সামাজিক বিজ্ঞানে তাঁর বহুমুখী তত্ব আড়াই হাজার বছর ধরে ভাবনার বিষয়বস্তু হয়ে জ্ঞানীদের কাছে সম্মানের জায়গা করে নিয়েছে। তবে তাঁর বহু সৃষ্টির মাঝে ৩৪০ BC –তে লিখিত Nicomachean Ethics নীতিবিজ্ঞানের অন্যতম এক আকর গ্রন্থ।

Nicomachean Ethics মানব চরিত্র ও নৈতিকতা সংক্রান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বই। সম্ভবত লাইসিয়ামে এরিস্টটলের বক্তৃতার ওপর এটি রচিত যার নামকরণ করা হয়েছে তাঁর পুত্র নিকমিকাসের নামানুসারে এবং বইটা উৎসর্গও করা হয়েছে তাঁর বাবার নামে যার নামও ছিল নিকমিকাস। দশটা ভাগে ( Book) লেখা বইটার মূল বিষয়বস্তু আবর্তিত হয়েছে প্লেটোর বইয়ে আলোচিত সক্রেটিসের উত্থাপিত নানান প্রশ্নকে কেন্দ্র করে। তিনি মনে করতেন নৈতিকতা কোন তাত্বিক বিষয় না কারণ মুখ্যত এটা মানুষের আচরণ তথা ব্যবহারিক দিক। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে কতো সুন্দরভাবে অন্যের সাথে বসবাস করতে পারে সেটার একটা নৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়েই বইটা লেখা। অবশ্য এরিস্টটল Eudemonia নামেও আরেকটা বই লেখেন যার বিষয়বস্তুও ছিল নৈতিকতা। এ’দুটো বইয়ের অনেক কিছু মিল আছে। বলতে গেলে এরিস্টটলই প্রথম যিনি মানুষের নৈতিকতা নিয়ে সর্বপ্রথম ভাষ্য রচনা করেন। BOOK- ১ এ নীতিবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও এর পাঠ-পদ্ধতি, সাথে সাথে সুখ এবং জীবনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হিসেবে ‘ভালো’র ব্যাখ্যা; BOOK- ২ এ নৈতিক সদগুণ ও এর মধ্যবর্তী অবস্থান সংক্রান্ত মতবাদ; BOOK- ৩ এ নৈতিক উদেশ্য ও তার দায়বদ্ধতা; BOOK- ৪ এ বিশেষ সদগুণ সংক্রান্ত আলোচনা; BOOK- ৫ এ ন্যায় বিচার; BOOK- ৬ এ বুদ্ধিবৃত্তিক সদগুণ; BOOK- ৭ এ আত্মসংযম ও অসংযমিতা; BOOK- ৮ও ৯ এ বন্ধুত্ব এবং BOOK- ১০ এ সুখ ও জীবনের লক্ষ্য এবং সাথে সাথে নীতিবিজ্ঞানের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে তিনি আলোচনা করেন।

এরিস্টটল শুরু করেছেন মানব জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য নিয়ে; বলেছেন চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে ‘সুখ’ যেটা গ্রীক ভাষায় ইউডমনিয়া। মানুষের ব্যবহারিক জীবনের পরম উদ্দেশ্য হলো এই ইউডমনিয়া। তিনি মনে করেন ‘ভালো’ শব্দটা ন্যায় বা সুখের দিক থেকে কোন ধরণের মনোভাবের(disposition) বিষয় না, বরং ভালো বিষয়টা একটা উদ্দেশ্যমূলক প্রক্রিয়া যা নির্ভর করে মানুষের নৈতিক আচরণ বা সমস্ত কর্মকাণ্ডের ওপর। একটা কাজকে আমরা কখন ন্যায় বলি? বা কখন আমরা বলি তুমি কাজটা ‘ঠিক’ করেছ। তাঁর মতে, একটা কাজের ফলাফল যদি ভালো হয় তাহলেই আমরা বলতে পারি কাজটা ঠিক হয়েছে। এরিস্টটলের নীতিতত্বের মূল কথা হল মানুষের নৈতিক আচরণ হবে ঠিক দুটো বিপরীত ও চরম আচরণের মাঝামাঝি অবস্থা। অর্থাৎ তিনি অবলম্বন করেছেন একটা ‘মধ্যপন্থা’। মধ্যপথ বা মধ্যপন্থা হলো দুটো চরম অবস্থার মাঝামাঝি। তাঁর ভাষায় সদগুণ হল পাপাচারণ ও সদাচারণ-ঘাটতির মাঝামাঝি একটা পথ। Nicomachean-এ এসংক্রান্ত একটা তালিকা দিয়েছেন এরিস্টটল যেখানে মানুষের নানাবিধ আচরনের একটা আদর্শিক অবস্থান তুলে ধরেছেন। যেমন আমরা ধরে নিই, মানুষের ‘ভয়’ ও ‘আস্থা’ থেকে জন্ম হয় হঠকারিতা ও কাপুরুষতা। কিন্তু এ দুয়ের মধ্যবর্তী অবস্থান হচ্ছে ‘সাহস’, এই সাহসই তাঁর কথায় মাঝের অবস্থান তথা সঠিক নৈতিক আচরণ; ঠিক সেরকমভাবে আনন্দ ও বেদনার মধ্যবর্তী অবস্থান হল সংযম। আনন্দ ও বেদনার দু’টো চূড়ান্ত রূপ আত্ম-প্রশ্রয় ও অসংবেদনশীলতাকে পরিহার করে মধ্যবর্তী অবস্থানকে গ্রহণ করার প্রতি তিনি নৈতিক নির্দেশনা দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো সুখ বলতে তিনি যা বোঝাচ্ছেন তার ভেতর কী কী অন্তর্ভুক্ত? সারাজীবন ধরে অর্জিত সকল ভালোর ভেতর সুখ নিহিত যেমন স্বাস্থ্য, সম্পদ, জ্ঞান কিম্বা বন্ধুত্ব – এসব বিষয়ের ভেতর দিয়ে গড়ে তুলতে হবে জীবনের পূর্ণতা। তবে অনেক ক্ষেত্রে এই নির্বাচনের ব্যাপারটা ভুলও হতে পারে।

ভালো জীবন কাকে বলে? এরিস্টটল মনে করেন, যে জীবন সদগুণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় সেই জীবনই ভালো জীবন। কাজেই তাঁর মতে প্রতিটা মানুষের চরম লক্ষ্য হচ্ছে এই সদগুণাবলী অর্জন করা। একটা কথা স্মরণ করতে হবে, এরিস্টটলের নীতিশিক্ষা খ্রিষ্টান ধর্মীয় নীতিশিক্ষার সমার্থক না। তাঁর চিন্তা প্রভাবিত হয়েছে প্রাচীন গ্রীক ভাবনা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে। সবচেয়ে বড় কথা হলো তিনি মনে করতেন মানুষ একটা ভীষণ সামাজিক প্রাণী, এবং মানুষের ভেতর নিশ্চয় এমন বৈদ্ধিক গুণাবলী আছে যা তাকে অন্যসব প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। আমরা ‘মানুষ’ বলবো কাকে? সোজা কথায় যারা অমানুষ না তারাই মানুষ। কারা অমানুষ না? তিনি বলছেন, যাদের বিচারিক খমতা আছে, বুদ্ধি বিবেচনা আছে, আছে চিন্তা শক্তি, অনুভূতি, এবং কর্মোদ্যোগ তারাই মানুষ।

কিন্তু সত্যি কি তাই? এ ব্যাপারে হবস কী বলে দেখা যাক। হবসের গ্রন্থ Leviathan প্রকাশিত হয় ১৬৫১ সালে। এটা প্রাথমিকভাবে দর্শন ও রাজনীতির ওপর লেখা। তবে শুধু এগুলোই না অধিবিদ্যা, মনস্তত্ব, জ্ঞানবিদ্যা, নৈতিকতা, ধর্ম কিম্বা ভাষা সংক্রান্ত আলোচনাও এর নানা অংশে ছড়িয়ে আছে। হবস তাঁর দার্শনিক ভাবনার বিকাশ ঘটিয়েছেন বস্তুবাদ থেকে যার মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন সবকিছু পরিচালিত হয় একটা প্রাকৃতিক নিয়মের ভেতর দিয়ে। এক ধরণের যান্ত্রিক সাদৃশ্যমানতা দিয়ে তাঁর আলোচনা শুরু হয়েছে।

হবস মনে করেন সামাজিক সমঝতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপুঞ্জ গঠনের মাধ্যমে জন-শান্তি এবং সামাজিক সংহতি প্রতিষ্ঠা সম্ভব এবং এই আদর্শ রাষ্ট্রপুঞ্জ সার্বভৌম শক্তি দ্বারা পরিচালিত হওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অনুমোদনের মাধ্যমে এটা সম্ভব বলে হবস মনে করেন। তাঁর ভাষায় এই কমনওয়েলথ বা সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জ একজন কৃত্তিম মানুষের সাথে তুলনীয়, যার শারীরিক নীতিকৌশল ঐ রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কিত। কমনওয়েলথকে তিনি একটা অতিকায় মানব শরীরের সাথে তুলনা করেছেন, তিনি মনে করেন এটা একটা কৃত্তিম মানুষ যার আত্মা হলো সার্বভৌমত্ব, শরীরের জোড়া লাগানো গিটগুলো অফিসার, পুরষ্কার বা শাস্তি তার স্নায়ুসকল, সম্পদ হলো শক্তি, নিরাপত্তা হচ্ছে ব্যবসা, কাউন্সিলর হচ্ছে স্মৃতিশক্তি, আইন ও সমতা তার বিবেক ও ইচ্ছা, প্ররোচনা হচ্ছে তার অসুস্থতা, এবং যুদ্ধ হচ্ছে তার মৃত্যু।

হবস কেন Leviathan শব্দটা ব্যবহার করেছেন তা আমরা অনুমান করতে পারি। আসলে Leviathan হচ্ছে বাইবেলে বর্ণিত হিব্রু শব্দ যা তুলনা করা হয়েছে একধরণের সামুদ্রিক দৈত্যের সাথে। তিনি একটা রাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থা বোঝাতে এই ধরণের তুলনা করেছেন। তিনি মনে করেন সামাজিক সংহতি, নিরাপত্তা, এবং গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে এ ধরণের অতিকায় দৈত্যতুল্য কারো দরকার। কেন দরকার সেটাই মুখ্য বিষয়। কারণ হবস মনে করেন মানুষ প্রকৃতিগত ভাবে অত্যন্ত নিচু এবং ইতর প্রাণী। সাথে সাথে তিনি বলেছেন মানুষ প্রকৃতিগতভাবে দারুণ অসামাজিক। কাজেই তার নিয়ন্ত্রণ ভীষণ প্রয়োজন। হবস ছিলেন পুরোপুরি বস্তুবাদী। তিনি মনে করতেন এই বিরাট বিশ্বজগৎ এবং তার ভেতর মানুষ, সবকিছুই চলছে একটা প্রাকৃতিক নিয়মে। নিয়মটা কোন আধিভৌতিক না বরং সেটা এই জগতসৃষ্ট। বস্তুর গতি ও অন্যের সাথে তার নিরন্তর মিথস্ক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সবকিছুকে দেখতে হবে। মানুষ হচ্ছে স্রেফ একটা যন্ত্র যাদের আবেগ, অনুভূতি, প্রেম, ভালোবাসা ইত্যাদি পরিচালিত হয় নিছক যন্ত্রের নিয়মে। এবং সেটা কার্যকারণ নিয়মের সুতায় বাঁধা। মানুষ প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে যা করে তা নিছক তার নিজের স্বার্থেই করে। ঠিক সেরকমভাবে হবস কমনওয়েলথ বা এই সমাজটাকে একটা যন্ত্রের সাথে তুলনা করেছেন যা বস্তুত মানব শরীরের থেকে বৃহৎ এবং কৃত্তিম। তবে সেটা অবশ্যই পরিচালিত হয় সেই অব্যর্থ প্রাকৃতিক নিয়মে। হবসের ধারণা ছিল সম্পূর্ণ এরিস্টটল বিরোধী এবং গ্যালিলিও ও কেপলারের কাছাকাছি। তবে এটা ঠিক হবস মানব চরিত্র সংক্রান্ত যে নিয়মের কথা বলছেন তার যথেষ্ট প্রমাণ তিনি দিতে পারেননি। Leviathan চারভাগে ভাগ(Book) করেছেন হবস। প্রথমভাগ মানুষ সংক্রান্ত(Of man),দ্বিতীয় ভাগ রাষ্ট্রপুঞ্জ(Of Commonwealth), তৃতীয়ভাগ খ্রিস্টীয় রাষ্ট্রপুঞ্জ(of Christian commonwealth ),এবং চতুর্থ ভাগ অন্ধকারাচ্ছন্ন রাষ্ট্র (Of The kingdom of darkness) সম্পর্কিত। হবস প্রথম চ্যাপ্টারেই মানুষের সাথে যন্ত্রের তুলনা করেছেন এবং সবকিছু অবরোহিক পদ্ধতির ভেতর দিয়ে সেই সিদ্ধান্তের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন। হবস দাবি করেন মানুষের চরিত্র সংক্রান্ত তাঁর ধারণা একমাত্র আত্ম-জিজ্ঞাসার ভেতর দিয়েই প্রমাণ করা সম্ভব।

প্রশ্ন হচ্ছে হবসের এই ধারণা বাস্তবতার সাথে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ? বলতে দ্বিধা নেই, মানব চরিত্রের এই নির্মোহ ও মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যা ‘হয়তো’ অনেকাংশে ঠিক। প্রতিটা মানুষ যে যেখানেই আছে সেখান থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধটা বাঁচার, যুদ্ধটা প্রজন্ম রক্ষার। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকে থাকার অদম্য ইচ্ছা প্রতিটা প্রাণীর। এর মতো মৌলিক দাবি হয়তো খুব কমই আছে। এ কারণেই মানুষকে হতে হয়েছে স্বার্থপর আর সমাজের চোখে নিচু বা ইতর। ইতিহাসের লম্বা খেরো খাতায় এর প্রমাণ আছে পদে পদে। তবে তাই যদি হয় তাহলে মানুষের মহত্ব কোথায়? মানুষ তো ইতর প্রাণীর মতো সর্বদা স্বার্থ নিয়ে থাকতে পারে না। থাকলে এই সমাজ, সম্পর্ক ও নৈতিকতার কোন স্থান থাকতো না। সম্ভবত এর একটা সুন্দর সমাধানের দিকে আমরা যাবো রাসেলের কাছে।

টমাস হবসের লেভিয়েথন লেখার ঠিক তিনশ বছর পর তারই স্বদেশী এক ব্রিটন জগৎখ্যাত দার্শনিক রাসেল লিখেছেন Human Society in Ethics and Politics। আধুনিক সমাজ দার্শনিক রাসেল বহুমাত্রিক ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হলেও মানুষ, মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট, রাজনীতি, ও একটা রাজনৈতিক আদর্শ তৈরি করতে তিনি ছিলেন ভীষণভাবে সচেষ্ট। তিনি মনে করতেন নৈতিকতার ধারণা কিছুতেই রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার বাইরে চিন্তা করা সম্ভব না। কাজেই একটা রাষ্ট্র কাঠামো ও তার সামগ্রিক বিন্যাসের ওপর ব্যক্তি মানুষের নৈতিক ভাবনা গড়ে উঠতে পারে। কাজেই আমাদের ভাবতে হবে মানুষের চারিত্রিক কাঠামোটা কী ধরণের। রাসেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই লেখেন Why Men Fight নামে অসাধারণ একটা গ্রন্থ। তিনি এখানে লিখছেন, “মানুষের সব কর্মধারার মূল উৎস দু’টোঃ প্রণোদনা (impulse) ও কামনা(desire)”। তিনি মনে করেন সমস্ত সংঘর্ষের উৎস হলো প্রণোদনা বা ইম্পালস। পৃথিবীর খুব যুদ্ধই সংঘটিত হয়েছে কামনা বা ডিজায়ারের কারণে। তিনি লিখছেন, “The war has grown, in the main, out of the life of impulse, not out of reason or desire.” । মানুষের এক ধরণের চারিত্রিক সংকীর্ণতা আছে, যেমন আমার যা আছে তাই ভালো আর অন্যের যা আছে তাই মন্দ। আমি যেটা বুঝি সেটাই সত্যি অন্যরা ভুল। আমার বিশ্বাস, আমার ধর্ম, আমার চিন্তা, আমার রাজনীতি ইত্যাদি অন্যের থেকে উন্নত। এটাই সামাজিক দ্বন্দ্বের কারণ, কারণ যুদ্ধ বা অশান্তির। ১৯৫৪ সালে লেখা রাসেলের Human Society গ্রন্থটি অত্যন্ত সাড়া জাগানো। বলা যায় এটাই নীতিবিদ্যা সংক্রান্ত তাঁর সবশেষ বই। ১৯১০ সাল থেকে শুরু হয়ে বেশ কিছু বাঁক খেয়ে শেষ হয় ১৯৫৪ সালে। তিনি মনে করেন মানুষের বুদ্ধি ও প্রণোদনার মাঝে যে দ্বন্দ্ব আছে তার নিরসনের জন্য দরকার নীতিবোধ। মানুষ যদি সিংহের মতো নিঃসঙ্গ হতো কিম্বা পিঁপড়ে বা মৌমাছির মতো সামাজিক হতো তাহলে তার জন্য নীতিকথার দরকার ছিল না। বস্তুত মানুষ হচ্ছে এই দুই ধরণের প্রাণীর মাঝামাঝি একটা কিছু। এজন্যই তিনি বলেছেন মানুষ হচ্ছে এক ধরণের আধা সামাজিক প্রাণী।

রাসেল এখানে হিউমের মতো অবস্থান নিয়েছেন, হিউমের অবস্থান ছিল “Reason is, and ought, only to be the slave of the passions.”। অর্থাৎ মানুষের বুদ্ধি (reason) তার প্রবল অনুরাগের(passion) অধীন। তাঁর মতে, মানুষের ইচ্ছা, আবেগ বা প্রণোদনা এসব গুলোই হচ্ছে কোন কাজের মূল চালিকা শক্তি। এখানে বুদ্ধি শুধুমাত্র একটা রেগুলেটরের ভূমিকা পালন করে মাত্র। রাসেল কেমন পৃথিবী দেখতে চান তার নির্দেশনা আমরা পাই এই কথাগুলোর ভেতর, “is one where emotions are strong but not destructive, and where, because they are acknowledged, they lead to no deception either of oneself or of others. Such a world would include love and friendship and the pursuit of art and knowledge.” । তিনি মনে করেন, এমন একটা পৃথিবী হবে যেখানে মানুষের সীমাহীন আবেগ থাকবে কিন্তু সেই আবেগ থাকবে নিয়ন্ত্রিত। ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের বন্ধনে এবং জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত বিশ্বই হবে রাসেলের কাঙ্ক্ষিত সমাজ। তবে এই বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হচ্ছে রাসেলের নোবেল গ্রহণ বক্তৃতা। যে বক্তৃতার ভেতর আমরা পাই মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্টের একটা মনস্তাত্বিক কাঠামো।

Politically Important Desires নামে ঐ বক্তৃতায় রাসেল বলেন রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ আকাঙ্ক্ষাকে দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক। প্রাথমিক আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে খুবই মৌলিক এবং জীবন ধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। খাদ্য, বস্ত্র কিম্বা বাসস্থান ছাড়া একটা জীবন কিছুতেই সম্ভব না কাজেই এগুলো পূরণ অত্যাবশ্যক। তবে এগুলোর একটা সীমাবদ্ধতা আছে, যেমন পেটপুরে কেও খেয়ে ফেললে তাকে আর খাওয়ানো সম্ভব না। কিন্তু মাধ্যমিক বা সেকেন্ডারি আকাঙ্ক্ষাগুলো বস্তুত সীমাহীন। এগুলোকে রাসেল চার ভাগে ভাগ করেছেনঃ অধিকারলিপ্সা(acquisitiveness), প্রতিদ্বন্দ্বিতা (rivalry), যশলিপ্সা (vanity), এবং ক্ষমতানুরাগ (love of power)।

মানুষের চাওয়া সীমাহীন। বস্তুগত প্রাপ্তির জন্য মানুষ কী না করে! একবার দুর্ভিক্ষপীড়িত এস্তনিয়া থেকে দুটো শিশুকে রাসেল বাড়িতে এনে রেখেছিলন। তাদের যথেষ্ট খাবার-দাবার থাকা সত্বেও পাশের জমিতে গিয়ে আলু চুরি করতো তারা। বিষয়টা মোটেও হাস্যকর নয়। আমাদের দেশের রাঘব বোয়ালরা যেভাবে টাকা চুরির খেলায় মত্ত তাতে করে এই সত্যটা প্রকট হয়ে উঠে। আমেরিকান ধনাঢ্য ব্যক্তিত্ব রকফেলারের জীবনও এমন ঘটনায় পূর্ণ। ছোটবেলার তীব্র দারিদ্র্যতার সাথে তাকে যুদ্ধ করতে হয়েছিলো।পরে গিয়ে তিনি আমেরিকার ধনীদের মধ্যে অন্যতম ধনী এবং দাতা হয়ে উঠেছিলেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা মানুষের স্বভাবজাত। সম্পদ, শিক্ষা, সম্মান, অবস্থান ইত্যাদির প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইচ্ছা লাগামহীন। দ্বিতীয় প্রথম বা বিশ্বযুদ্ধ ছিল দেশগুলোর সীমাহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার খেলা। অন্যদিকে যশের প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরন্তন। ছোট্ট শিশু যখন দেখে তার দিকে অন্যদের আগ্রহ কম তখন সে স্বভাবতই ক্ষিপ্ত হয়। কে না যশ চায়? খুব নামকরা ডাকাত-কে ছিঁচকে চোর বললে অসম্মানিত হয়। যে যেকাজই করুক না কেন সে নিশ্চিতভাবে চাই যশ বা খ্যাতি। একবার এক ইতালির যুবরাজকে মৃত্যুশয্যায় একজন ধর্মযাজক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তার জীবনে কোন আক্ষেপ রয়ে গেলো কিনা! সম্পদে পরিপূর্ণ ঐ যুবরাজ নাকি বলেছিল, “একবার সুউচ্চ অট্টালিকার ছাদে সম্রাট আর পোপকে একই সাথে পেয়েছিলাম, কিন্তু আমি তাঁদের দুজনকে সেখান থেকে একসাথে ফেলে দেয়ার সুযোগ হেলায় হারিয়েছিলাম। যেটা করতে পারলে সারাজীবন আমি একজন নামকরা মানুষ হয়ে ইতিহাসে জায়গা করে নিতাম”। মানুষের কী বিচিত্র যশলিপ্সুতা!! তবে উপর্যুক্ত বিষয় ছাড়াও মানুষের সবচেয়ে তীব্র বাসনা হলো ক্ষমতানুরাগ। ক্ষমতা হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত বিষয় পুরনের সক্ষমতা। যে যতো সহজে তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারে সে তত ক্ষমতাবান। ক্ষমতার নানাবিধ প্রকরণের মাঝে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রাযুক্তিক, ধর্মীয় ইত্যাদি অন্যতম। রাসেল অবশ্য ক্ষমতা নিয়ে আলাদা করে ১৯৩৮ সালে Power নামে একটা বই লেখেন। ব্লুচার ১৮১৪ সালে নেপলিয়ানের প্রাসাদ দেখে বলেছিলেন “আহা, এতো কিছু থাকতেও নেপলিয়ান মস্কোর দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন”। সত্যি সত্যি ক্ষমতার প্রতি মানুষের উদগ্র বাসনা সীমাছাড়া। আমাদের দেশে দেখা যায় ছোট্ট গলির নেতা হওয়া থেকে রাষ্ট্রীয় নেতা হওয়ার প্রতি মানুষের কী খাপছাড়া নাছোড়বান্দা। পাড়া, মহল্লা, গ্রাম্, ইউনিয়ন পরিষদ, অথবা জেলা পরিষদের নেতা হওয়ার যে লাইন দেখা যায় তা আমাকে কিছুতেই বিস্মিত করে না। কারণ ক্ষমতা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির মাঝে সবচেয়ে প্রভাবশালী। তবে রাসেল বলেন প্রকৃতিগতভাবে মানুষের এই অবস্থানের কারণেই দরকার পড়েছে নীতিশিক্ষার।

তবে ইতিহাসের এই তিন প্রবাদ পুরুষের চিন্তা থেকে মানুষ সম্পর্কে বিশেষ কোন সরল ধারণায় পৌঁছানো খুবই দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। কারণ পৃথিবীর আশ্চর্যতম আবিষ্কার হলো মানুষের মন। কাজেই সেই মনের খবর এবং তার গভীর সূত্র জেনে ফেলা কিছুতেই সহজ কাজ না। এরিস্টটল, হবস এবং রাসেলের বইতিনটা এই প্রচেষ্টারই একটা অংশ। সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার , অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

ওডি/

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড