• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গৌতম বুদ্ধ ও শোপেনহাওয়ার : ‘মম দুঃখের সাধন যবে করিনু নিবেদন’ 

  ড. সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার

১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৬:০৩
করোনা
ছবি : সংগৃহীত

জার্মানের ফ্রাঙ্কফুটে যে ঘরে তিনি পড়তেন তার দেয়ালে ছিল ইমানুয়েল কান্টের একটা ছবি আর টেবিলের ওপর গৌতম বুদ্ধের ছোট একটা স্ট্যাচু। লিখেছেন, “If I were to take the results of my philosophy as the standard of truth, I would have to consider Buddhism ..” পাশ্চাত্যের কোন দার্শনিক সম্ভবত ভারতীয় চিন্তা ও দর্শন সম্পর্কে প্রথম এ ধরণের কথা উচ্চারণ করেন। নিজেকে একজন বুদ্ধিস্ট মনে করতেন এবং তাঁর লেখায় ভারতীয় দর্শন ও এর এসেটিসিজম তাঁর ওপর সাংঘাতিক প্রভাব ফেলেছিল। এই মানুষটা জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ার (১৭৮৮- ১৮৮৩)। উনিশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে পাশ্চাত্যে বৌদ্ধদর্শন যখন পরিচিতি পেতে শুরু করে শোপেনহাওয়ার এর সাথে পরিচিতই শুধু হননি, ধীরে ধীরে এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন। কারণ বৌদ্ধদর্শন জগত ও জীবন সম্পর্কে যে গভীর নিহিলিস্টিক স্প্রিট ধারণ করেছে তার সাথে শোপেনহাওয়ার একমত পোষণ করেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে তিনি আরও বেশকিছু দার্শনিক বোধ যোগ করেন। ফলে তাঁর এই নতুন দর্শন দাঁড়িয়েছে একধরণের ‘নিহিলিস্টিক-এসেটিসিজম উইথ ব্লাঙ্ক অ্যাবসার্ডিজম’। সোজা কথায় এক বিশেষ ধরণের দার্শনিক সন্ন্যাসবাদ।

খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে ভারত নেপাল সীমান্তের কপিলাবস্তু নামে এক নগরের লুম্বিনি পার্ক নামে এক স্থানে মে মাসের পূর্ণচন্দ্রে গৌতমবুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন রাজা শুদ্ধধন আর মা মহামায়া। জন্মের ৫ দিনের মাথায় তাঁর নাম রাখা হলো সিদ্ধার্থ যার মানে “মনস্কামনা পূর্ণ”। নাম প্রদান অনুষ্ঠানে সেকালের রীতি অনুযায়ী ৮ জন প্রাজ্ঞ সাধু আসলেন যাদের ৭ জনই তাঁর ভাগ্য বিচার করে বললেন, বড় হয়ে হয় তিনি একজন নামকরা রাজা হবেন, না হয় জগতখ্যাত একজন তপস্বী পুরুষ হবেন। অন্যদিকে সবচেয়ে কনিষ্ঠ সাধু কন্দান্না বললেন, উনি সবকিছু পরিত্যাগ করে হবেন একজন প্রকৃত জ্ঞানি অর্থাৎ বুদ্ধ। খুব ছোটবেলায় একটা অন্যরকম ঘটনা ঘটলো। রাজা শুদ্ধধন এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। জমিতে লাঙ্গল দেয়া অনুষ্ঠান। চারিদিকে সাঁজ সাঁজ রব। মহা আয়োজন। সবাই অনুষ্ঠানে ব্যস্ত, ছোট্ট গৌতম অনুষ্ঠানের এক পাশে একটা গাছের নিচে সবার অলক্ষ্যে ধ্যান করছেন। সবাই হতবাক। এই পৃথিবীর কোন কিছুতে তাঁর নজর নেই, নেই কোন ভ্রূক্ষেপ। রাজা শুদ্ধধন এসে দেখলেন এই দৃশ্য। কি অভুভুতপূর্ব সেই মুহূর্ত! তবুও ছেলের এই অন্যমনস্কতা এবং বিষয়বস্তুর প্রতি নিরাশক্তভাব রাজাকে বিচলিত করলো। যার ফলে সিদ্ধান্ত নিলেন খুব তাড়াতাড়ি তাঁকে সংসারে প্রবেশ করিয়ে দিবেন। হলোও তাই। ১৬ বছরের মাথায় তাঁকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিলেন যশোধরা নামে এক সুন্দরী মেয়ের সাথে। যশোধরা ছিলেন তারই সমবয়সী এক নিকট আত্মীয়। রাজা শুদ্ধধনের যতো সহায়-সম্পদ ছিল সবকিছু যেন ঢেলে দেয়া হলো ছেলের সুখী করার জন্য। রাজ দরবারে তিনটা পদ্মপুকুর বানানো হলো, তিন ধরণের পদ্ম ফুটে যেন তাঁকে আনন্দ দিতে পারে; দরবারে বানানো হলো তিনিটা বড়বড় প্রাসাদ- ঠাণ্ডা, গরম আর বৃষ্টিতে যেন তাঁর শরীরের ওপর কোন খারাপ প্রভাব না পড়ে। সারাক্ষণ সঙ্গীত পরিবেশনা আর মনোরঞ্জনের কি অসম্ভব আয়োজন! কিন্তু ফলাফল হলো উল্টো। কিছুতেই যেন আটকে রাখা গেলো না ছেলেকে। তিনি দেখলেন এসবের ভেতর কোন আনন্দ নেই, নেই জীবনের পরম লক্ষ্যের সাধনা। জীবনের চরম লক্ষ্য সম্ভবত তিনি সেই বয়সেই বুঝতে পেরেছিলেন। বুঝেছিলেন জীবন মানেই দুঃখ, জীবন মানেই উদ্ধারহীন এক সাঙ্ঘাতিক বিপদসংকুল অবস্থা। বিয়ের পর ১৩ বছরের মাথায় জাঁকজমকপূর্ণ জীবনের অবসান হলো। এক সন্তানের পিতা হলেন তিনি, ছেলের নাম রাখা হলো রাহুল। রাহুল মানে বন্ধন। কিন্তু যে বন্ধনের বাঁধনে তাঁকে আটকে রাখার চেষ্টা করা হলো সেটা খুব বেশিদিন টিকলো না। বিপুল জাঁকজমক আর সম্পদের ভার তাঁকে ক্রমান্বয়ে বীতশ্রদ্ধ করে তুললো। সিদ্ধান্ত নিলেন গৃহত্যাগের। ছোট পৃথিবী থেকে তিনি বেরিয়ে পড়লেন বিশ্বালোকে, জীবনকে বুঝতে তিনি ঐশ্বর্যের থেকে বেরিয়ে আসলেন সাধারণ মানুষের জীবন-বোধে। ইন্দ্রিয়সুখ বা বস্তুগত আনন্দ সত্য উপলব্ধির অন্তরায়। তিনি সেটা বুঝে বেরিয়ে পড়লেন এক পরম সত্যের সন্ধানে, জীবনের চরম লক্ষ্যে। স্ত্রী-সন্তান রেখে তিনি এক অতি কষ্টকর এবং অকল্পনীয় দুঃসহ জীবনে ঝাঁপ দিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন জগত ও জীবনের পরম সত্য বুঝি এই ধন-ঐশ্বর্যের মাঝে লুকিয়ে নেই। তিনি বসেলন গভীর ধ্যানে, পরম সত্য উৎঘাটনের তপস্যায়। শুরু করলেন এক অসীম কৃচ্ছতাসাধন, মন্ত্রের সাধন কিবা শরীর পতন।

দীর্ঘ তপস্যা শেষে তিনি উপলব্ধি করলেন চারটি পরম সত্যের – দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, আছে দুঃখ থেকে নিবৃত্তি আর নিবৃত্তি লাভের উপায়ও। দুঃখ থেকে চির নিবৃত্তিকে তিনি বললেন নির্বাণ। দার্শনিক অধিবিদ্যা গৌতম বুদ্ধের কাছে বেশি একটা গুরুত্ব পায়নি, পায়নি তাঁর কারণ তিনি মনে করেছেন এই বিশ্বপ্রকৃতির যে গুঢ় রহস্য সেটা নিজের আপন উপলব্দধিতেই। মানুষ এই বিশ্বপ্রকৃতিতে চরম দুঃখে নিপতিত, তীরবিদ্ধ পক্ষী শাবকের ন্যায় তীব্র যন্ত্রণায় মর্মাহত। কাজেই এর থেকে উদ্ধার পেতে অন্য কোন চিন্তা সহায়ক হবেনা। তিনি মনে করতেন, এমনকি ঈশ্বর বিতর্কে মগ্ন থাকলে মানুষের দুঃখমুক্তি হবেনা। দুঃখ মুক্তির জন্য প্রয়োজন গভীর তপস্যা আর নিরন্তর সাধনা। H. G. Wells তাঁর Three Greatest Men in History, তে লিখেছেন, “In the Buddha you see clearly a man, simple, devout, lonely, battling for light, a vivid human personality, not a myth. He too gave a message to mankind universal in character. Many of our best modern ideas are in closest harmony with it. All the miseries and discontents of life are due, he taught, to selfishness. Before a man can become serene he must cease to live for his senses or himself. Then he merges into a greater being. Buddhism in different language called men to self-forgetfulness 500 years before Christ. In some ways he was nearer to us and our needs. He was more lucid upon our individual importance in service than Christ and less ambiguous upon the question of personal immortality.” (The Buddha and His Teaching, Venerable Narada Mahathera, p. 16) । বোধিবৃক্ষের তলায় নির্বাণ লাভের পর সাত সপ্তাহ ধরে তিনি জীবনের নানা রকম দার্শনিক সত্য আবিষ্কার করেন।

প্রথম সপ্তাহে তিনি যা আবিষ্কার করেন তা দর্শন ও পদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত পরিচিত বিষয়—কার্যকারণ তত্ব। আমরা এরিস্টটলের যে কার্যকারণ তত্বের সাথে পরিচিত তার থেকেও বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় গৌতমবুদ্ধের প্রতিত্যসমুৎপাদ নীতির মাধ্যমে। তিনি ধ্যান থেকে উঠে বললেন, পৃথিবীর প্রতিটা ঘটনারই কারণ আছে, কারণ ছাড়া কোন কিছু ঘটেনা। জন্ম, মৃত্যু, জ্বরা, ব্যাধি, ইচ্ছা, হতাশা, বেদনা, অনুভূতি, ক্ষয়, মনস্তাপ, ইদ্যাদি সবকিছুর কারণ আছে। দ্বিতীয় সপ্তাহ কার্যত তিনি নীরব ছিলেন এবং যে বোধিবৃক্ষের তলে বসে সত্য উপলব্ধি করেছেন তার দিকে একাগ্রভাবে তাকিয়ে সপ্তাহ পার করলেন। তৃতীয় সপ্তাহ কাটালেন সেখানেই। অনেকে তাঁর বুদ্ধুত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলে তিনি তাদের উত্তর দেন এবং সন্দেহ দূর করেন। চতুর্থ সপ্তাহে গৌতম বুদ্ধ বসলেন রত্নাগড় নামে একটা জায়গায় যেখান থেকে তিনি অভিধর্ম বা অভিধম্ম রচনা করেন। অভিধর্মের ভেতর বুদ্ধের বাণী ও দর্শন সন্নিবিষ্ট। বেলজিয়ান ইন্দোলজিস্ট এটিনি ল্যামটি জানাচ্ছেন, অভিধর্ম একটা বিশুদ্ধ ও সরল মতবাদ যার ভেতর সাহিত্য-অলঙ্কার নেই, নেই ব্যক্তিগত উপস্থাপনা। পঞ্চম সপ্তাহ তিনি চিরমুক্তির স্বাদ গ্রহণ করলেন, বোধিবৃক্ষের পাশেই একটা কলা গাছের নিচে বসে। তাঁর গভীর ধ্যানভঙ্গ হলে একজন ভক্ত তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “হে প্রভু, আপনি বলুন একজন মানুষ কীভাবে গভীর তপস্বী(ব্রাহ্মণ) হয়ে উঠেন বা কী কী শর্ত অনুসরণ করলে একজন ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠতে পারেন?” তিনি উত্তর দেন, “যিনি সমস্ত জীবনের কদর্যকে বর্জন করেন, যিনি আত্মদর্পী না, যার ভেতর নোংরামি নেই, আত্মসংযমী, জ্ঞানে উদ্ভাসিত, যিনি পবিত্রতার সাথে জীবনকে পরিচালনা করেন, তাকেই ব্রাহ্মণ বলে”। এরপর ষষ্ঠদিনে তিনি সর্পাকৃতি এক গাছের নিচে ধ্যানে বসেন। গাছের নাম ছিল মুকালিন্ডা। কথিত আছে সর্পরাজ নিচ থেকে উঠে গৌতম বুদ্ধের মাথার ওপর ফণা তুলে তাঁকে ঝড় থেকে রক্ষা করেন। ঝড় থেমে গেলে তিনি মানুষরূপী ভক্ত হয়ে পায়ের নিচে বসে জ্ঞান আহরণ করেন। ষষ্ঠ সপ্তাহের শেষে গৌতম বুদ্ধ বললেন, তিনিই প্রকৃত সুখী যিনি বস্তুগত লোভ লালসা সংবরণ করেন, ইন্দ্রিয় তৃপ্তিকে জয় করেন হাসিমুখে। কাজেই যিনি এই ‘আমিত্ব’ অতিক্রম করেছেন তিনি উপভোগ করবেন পরম আনন্দাবস্থা।

সপ্তম সপ্তাহে তিনি এর পাশেই আরেকটা বৃক্ষতলায় বসলেন এবং উপলব্ধি করলেন চরম আনন্দ অভিজ্ঞতা। ধ্যানভঙ্গ হলে তিনি উচ্চারণ করলেন, বহুবর্ষ ধরে আমি চলেছিলাম এক নিরন্তর অভিযাত্রায়, কেন পুনর্বার মানুষ ফিরে আসে? দেখলাম, দুঃখই এর কারণ। এ অনন্ত তৃষা তোমাকে উপলব্ধি করলাম শেষে। তুমি আর ফিরে এসো না। সব লালসার সমাপ্তি ঘটেছে, অজ্ঞতার হয়েছে অবসান। চিত্ত আজ উন্মুক্ত। সব আকাঙ্ক্ষার পরিশেষ আজ। (Thro’ many a birth in existence wandered I, Seeking, but not finding, the builder of this house. Sorrowful is repeated birth. O house builder, thou art seen. Thou shall build no house again. All thy rafters are broken. Thy ridgepole is shattered. Mind attains the Unconditioned. Achieved is the End of Craving)।এই উপমার ভেতর দিয়ে গৌতম বুদ্ধ জয় করেছেন দুঃখকে, দুঃখের কারণকে আর পৌঁছেছেন চিত্তের এক অনির্বচনীয় উপলব্ধিতে। মানুষের জীবনের লক্ষ্য কী? কী তার সমস্ত কর্মধারার ফলাফল? গৌতম বুদ্ধ তারই খোঁজ করেছেন একটা অন-অধিবিদ্যক (non-metaphyscical) দার্শনিক কর্মধারার পথে।

অন্যদিকে, ১৭৮৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শোপেনহাওয়ার পোল্যান্ডের ডাঞ্জিগে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল ডাচ বংশদ্ভুত। বাবা হেইনরিখ ফ্লোরিস শোপেনহাওয়ার ছিলেন ব্যবসায়ী এবং জাহাজের মালিক। ৫ বছর বয়েসে শোপেনহাওয়ারের পরিবার জার্মানের হ্যান্সিয়েক সিটির হামবুর্গে স্থানান্তরিত হন। তরুণ বয়েসে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তিনি ভ্রমণ করেন। ১৭৯৭ সালে দু’বছরের জন্য তিনি ফ্রান্সে ছিলেন, এরপর একটু বড় হলে থাকেন ইংল্যান্ডে। যারফলে ইউরোপের অন্যান্য ভাষা তাঁর দখলে আসে। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি কিছুদিনের জন্য উম্বলডন স্কুলে পড়াশুনা করেন। সেখানে খ্রিষ্টান ধর্মের কড়াকড়ি সারাজীবনের জন্য তাঁকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। আসলে শোপেনহাওয়ারের ভাবনা চিন্তা যেভাবে গড়ে উঠতে থাকে তাতে তিনি যে একজন জাহাজের ব্যবসায়ী কিম্বা কোন ব্যংকার হবেননা সেটা আগেই বোঝা গেছিল। ১৮০৫ সালে তাঁর বাবা সুইসাইড করে মারা গেলে অল্প কিছুদিনের জন্য তিনি ব্যবসার হাল ধরেন। ১৯ বছর বয়েসে ব্যবসা–পাতি গুটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর মা জোহানা হামবুর্গ ছেড়ে চলে যান উইমিয়ারে, সেখানে গিয়ে জোহানার সাথে বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক গ্যাটের সখ্য গড়ে ওঠে। গ্যাটে নিয়মিত জোহানার সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং কিছু দিনের মধ্যেই জোহানা সাহিত্য জগতে বেশ নাম করে ফেলেন। তিনি এরই মধ্যে কিছু উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী, গল্প ও প্রবন্ধ লিখে সবার কাছে পরিচিত হয়ে পড়েন। ১৮১০ থেকে ১৮২২ সালের মধ্যে মোট ২৪ খণ্ডে তাঁর সমস্ত লেখার সংকলন বেরোয়।

শোপেনহাওয়ার ইউনিভার্সিটি অব গর্টিঞ্জেন ও বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। ১৯০৮ সালে তিনি গর্টিঞ্জেনে আসেন এবং মেডিসিন ও দর্শনে পড়াশুনা শুরু করেন। দার্শনিক গটলব আর্নস্ট সিউজল তাঁকে প্লেটো কান্টের দর্শন পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি করেন। ১৮১১ থেকে ১৩ পর্যন্ত তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। এ’দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি দর্শন ও দর্শনের বাইরেও যেমন জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য, কাব্য, শরিরবিদ্যা, ইত্যাদি নানা বিষয়ের ওপর জ্ঞানার্জন করেন। এরপর তিনি ইউনিভার্সিটি অব জেনা থেকে The Fourfold Root of the Principle of Sufficient Reason অভিসন্দর্ভ লিখে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। এর পরপরই তিনি তাঁর পিএইচডি ডিগ্রীর বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে ১৮১৮ সালে রচনা করেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ The World as Will and Representation। ইতোমধ্যে তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীর আবেদন করেন, এর দু’বছর আগে হেগেল এখানে আসেন দার্শনিক ফিকটে চেয়ারে। বার্লিনে তাঁর চাকুরীটা মোটেই স্বস্তিদায়ক ছিল না। কারণ তিনি যে ক্লাসগুলো নিতেন ঠিক সে সময়েই হেগেলের ক্লাসগুলো থাকতো, এর ফলে তাঁর ক্লাসের উপস্থিতি ছিল উদ্বেগজনকভাবে কম। কিছুদিন পর মনঃকষ্টে তিনি ইতালি চলে যান। কিছুদিন সেখানে থেকে আবার ফিরে এসে বার্লিনে চাকুরীর চেষ্টা করেন। কিন্তু সেবার দারুণভাবে এক ঝামেলায় পড়েন। ক্যারোলিন মারগুয়েট নামে ৪৭ বছরের এক ভদ্রমহিলা তাঁর এপার্টমেন্টে থাকতেন। পেশায় তিনি ছিলেন দর্জি, নানারকম খরিদ্দারের সাথে মহিলা অতি উচ্চস্বরে কথা বলতেন এর ফলে শোপেনহাওয়ার পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটত। সম্পর্কের তিক্ততার ফলে বিষয়টা আদালত পর্যন্ত গড়ালে শোপেনহাওয়ারের বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ঢোকা হয়না। ১৮৩১ সালে কলেরা ছড়িয়ে পড়লে তিনি ফ্রাঙ্কফুটে গিয়ে উঠেন। এখানে তিনি প্রায় ২৭ বছর কাটান। কয়েকবছর পর তিনি On the Freedom of Human Will লেখেন যা তাঁকে দারুণ খ্যাতি এনে দেয়। এরপর তিনি লেখেন On the Basis of Morality। তবে এই বইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তিনি দর্শনের অতি শ্রদ্ধার মানুষগুলোকে বিশেষ করে ফিকটে ও হেগেলকে দারুণ অশ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। তবে তিনি এই সময়ে তাঁর The World as Will and Representation এর দ্বিতীয় ভলিউম প্রকাশ করেন। সালটা ছিল ১৮৪৪। ১৮৫৯ সালে এর তৃতীয় ভলিউম প্রকাশিত হয়। এর পরের বছর সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি সমস্ত সহায় সম্পদ প্রুসিয়ান সেনাদের কল্যাণে দান করে যান বিশেষ করে যারা ১৮৪৮ সালে বিপ্লবের সময় পঙ্গু হন বা অসহায় হয়ে পড়েন।

‘আমারই চেতনার রঙ্গে পান্না হলো সবুজ’

রবিঠাকুর বলছেন, ‘হৃদয় আজি মোর কেমনে গেলো খুলি/ জগত আসি সেথা করিছে কোলাকুলি!’ আমি জগতেরই অংশ, জগতের এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান। বিশ্ববীণার তারে যে সুর ধ্বনিত হয়ে চলেছে অবিরত সে সুরের মিড় আমার ভেতরেও অনুরণিত হচ্ছে। নিজের ভেতর এই বিশ্বজগত অনুভব করার কথা কাব্যিক ঢঙে রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করেছেন নানা কবিতায়, বিচিত্র গানে। কিন্তু শোপেনহাওয়ার সেই কথাটাকেই দার্শনিক তর্কের ভেতর দিয়ে প্রকাশ করেছেন The World as Will and Representation-এ। আমরা যখন গভীরভাবে নিজের ভেতর নিবিষ্ট চিত্তে প্রবেশ করি তখন কিন্তু নিজের সারবত্তার দিকেই দৃষ্টি দিইনা, অনুভব করি বিশ্বজগতকেও। কারণ ‘আমি’ এখানে বিশ্বশক্তির এক অকৃত্তিম ও আদি উপাদান। আমরা জানি জার্মান ভাববাদী দার্শনিকরা কার্টেশীয় রীতিতে ‘আত্ম-চেতনা’-কে ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ নিজের ভেতরের চেতনা হলো এক ধরণের আত্মক্রিয়া বা সেলফ-ক্রিয়েটিভ প্রসেস, ঠিক যেমনকরে আমরা পারমার্থিক সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করে থাকি। এর প্রক্রিয়াটা হলো দ্বান্দ্বিক যুক্তিধারা। জার্মান ভাববাদীরা মনে করতেন শুধুমাত্র ব্যক্তিক বা সামাজিক জীবনকেই এই প্রক্রিয়া আচ্ছাদিত করেনা বরং সমগ্র বিশ্বসত্তাও এই নিয়মের অধীন। শোপেনহাওয়ার এই অতি-বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যাকে সমালোচনা করে বলেছেন বিশ্বজগতের ঐ আদি ও চরম নীতি বুঝতে গেলে আরও গভীরে গিয়ে বুঝতে হবে, বিশেষকরে এই বহির্জগতের বিভিন্ন প্রকাশকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। শোপেনহাওয়ার পরিষ্কার করে বলেন, জগতের মূলে রয়েছে এক অবশ্যম্ভাবী ও অকৃত্তিম ইচ্ছা—যে ইচ্ছা উদেশ্যহীন, অন্ধ, অবৈদ্ধিক আর পরাক্রমশালী। ইচ্ছাই সবকিছুর সহজাত ভীত, ইচ্ছা অদম্য আর সকল কর্মধারার কেন্দ্রবিন্দু। একটা কথা মনে রাখা দরকার শোপেনহাওয়ার জগতকে যে ইচ্ছার অধীন বলেছেন সেই ইচ্ছা কিন্তু বুদ্ধি বা বিবেচনা বিবর্জিত। তিনি কান্টের বিরোধিতা করে বলেন, আমাদের শরীরটা এই পৃথিবীর অন্যান্য বস্তু সকলের ন্যায় একটা বস্তু। এই শরীরকে আমরা দুরকম ভাবে দেখিঃ আমরা আমাদের দেহকে অন্যান্য বস্তুর মতই একটা বস্তু বা পদার্থ মনে করি যেটা এই বিশ্ব প্রকৃতির অন্যান্য নিয়মের মতই চলে আবার সেই শরীরকেই আমরা বুঝতে পারি আমাদের ভেতরের সাক্ষাৎ চেতনার মাধ্যমে। এই চেতনার জন্যই আমরা দুঃখ পাই, বেদনায় মুষড়ে উঠি, ভালোবাসি কিম্বা ব্যথা পাই। আমার হাত নিছক একটা বস্তু দণ্ড মাত্র ঠিক একজন শল্য চিকিৎসকের কাছে অপারেশনের টেবিলে যেমন মনে হয়। কিন্তু সেই হাত নিছক দণ্ড আমার কাছেও মনে হলেও এই হাত শুধু আমার কাছে নিছক মৃত কোন দণ্ড নয়, ইচ্ছানুযায়ী এটাকে ব্যবহারও করি, ঘুরাই, কাজে লাগাই, লিখি কিম্বা প্রসারিত করে অন্যকে আলিঙ্গন করি। একথা দিয়ে শোপেনহাওয়ার বোঝাতে চান এই বিশ্বভুমিতে আমি আসলে দু’ধরণের ঘটনার ফলাফল যেটা একদিকে বস্তুগত অন্যদিকে ব্যক্তিগত তবে অবশ্যই এর কেন্দ্রবিন্দু হলো “ইচ্ছা”। মানুষের দুর্নিবার ইচ্ছা। তিনি মনে করেন মানুষ কোন কিছুর জ্ঞানলাভ করতে এই দ্বৈত-মুখী (Double-aspect) প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। একটা পাহাড় কিম্বা চাঁদ যখন দেখা হয় তখন তাদের বাহ্যিক অবয়ব আমাদের কাছে হাজির হয় কিন্তু আধিবিদ্যক দিকটা থেকে যায় লোক চক্ষুর অন্তরালে, ঠিক যেমন করে মেডিক্যাল সার্জন আমার হাত নিয়ে অপারেশন করেন। এজন্যই তাঁর মনে হয়েছে এই পৃথিবীর সবকিছু বুঝতে হবে এই দ্বৈত-মুখী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এবং মনে রাখতে হবে এই সকল কিছুর মূলে আছে চেতনা বা ইচ্ছা। শোপেনহাওরের দেকার্তের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদের একজন তীব্র সমালোচক ছিলেন। দেহ ও মনের যে দ্বৈরথ একে অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা সেটা শোপেনহাওয়ার অস্বীকার করে বলেন, আমারই চেতনার রঙ্গে পান্না হলো সবুজ, চুনি উঠলো রাঙা হয়ে...।

‘মম দুঃখের সাধন যবে করিনু নিবেদন’

গৌতম বুদ্ধ এবং শোপেনহাওয়ারের মাঝে তাহলে সাযুজ্যটা কোথায়? প্রথম দিকে মনে হবে এ’দুজনের বিশেষ কোন দার্শনিক মিল নেই। কিন্তু গভীরভাবে অনুধাবন করলে বোঝা যাবে কি প্রচণ্ড রকমের মিল দুজনের চিন্তায় অর্থাৎ শোপেনহাওয়ার কী সাঙ্ঘাতিক রকম প্রভাবিত হয়েছেন গৌতম বুদ্ধের ভাবনা দিয়ে। Peter Abelsen “Schopenhauer and Buddhism” ( Philosophy East and West, Vol.3, 1993, University of Hawai’I Press) প্রবন্ধে জানাচ্ছেন গৌতম বুদ্ধ এই বিশ্বজগতকে যে অনিত্য ও সদা পরিবর্তনশীল বলেছেন সেটাই বলেছেন শোপেনহাওয়ার। শোপেনহাওয়ারের মতে স্থান, কাল ও কার্যকারণ চূড়ান্তভাবে স্থায়ী নয়, নয় মানুষের অবস্থানও। সুতরাং আধাত্মসত্তা বলে যাকে আমরা যাকে জানি, এ’দুজনের কাছে তা সম্পূর্ণরূপে অর্থহীন। পরমসত্তা সত্যিকার অর্থে অজ্ঞাত। সবচেয়ে বড় কথা হলো শোপেনহাওয়ার বলছেন মানুষের জীবন হচ্ছে একধরণের প্যাসানের (Passion) দাস। ভয়, দুঃখ, আনন্দ, ঘৃণা সবকিছুর উৎপত্তি তাই দুর্দমনীয় প্যাসান। বুদ্ধ বলছেন আমাদের সব দুঃখের কারণ হলো আমাদের আকাঙ্ক্ষা আর কোনকিছু পাওয়ার জন্য আমাদের লালসা। ইচ্ছাটাই জগত। বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন মনে করেন মানুষের এই অনন্ত দুঃখের কারণ তার ‘পাপ’ নয় বরং এই চিরচেনা জগতের প্রতি আসক্তি।

শোপেনহাওয়ার ছিলেন একজন ইউরোপিয়ান বুদ্ধিস্ট। গৌতম বুদ্ধের মতো ১৮৫১ সালে On the Sufferings of the World এ তিনি বলেছিলেন, “Unless suffering is the direct and immediate object of life, our existence must entirely fail of its aim.”। অর্থাৎ দুঃখই জীবনের সার কথা। তাঁর মতে মানুষের ইচ্ছাই এ জগত চলেছে সামনের দিকে। মানুষের নিরন্তর কষ্ট তাকে সামনের দিকে জৈব বিবর্তনিক ধারায় এগিয়ে নিয়েছে। সুখ যেন ক্ষণস্থায়ী, যেন ‘অধরা মাধুরী’। কিছু সময় সুখের জন্য ইচ্ছা পূরণ করে আবার এগিয়ে চলে নতুন ইচ্ছায়। এক অবশ্যম্ভাবী নিরন্তর স্রোতের টানে এগিয়ে চলে সমগ্র জীবকুল। গৌতম বুদ্ধ যেমনটি বলেছেন জীবন এক চলমান দুঃখের সাগর, এই সাগর অতিক্রান্তের জন্য দরকার কঠোর সাধনা আর একাগ্র চিত্ত। বুদ্ধ বর্ণিত আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। আটটা কঠোর পথ। এবং চূড়ান্ত এই পথটাই নির্বাণ। শোপেনহাওয়ার বলেন ইচ্ছা অন্তহীন, যার পূরণ সম্ভব না। কেননা ইচ্ছা একের পর এক চলতে থাকে লাগামহীন সুতার টানে। সত্যি সত্যি জীবনের তাই মানে নেই। চেতনা সকল দুঃখের মুল, সকল কষ্টের চাবি। এ কারণেই তিনি এক ধরণের দার্শনিক সন্ন্যাসবাদ গ্রহণ করেছিলেন। গৌতম বুদ্ধ ও শোপেনহাওয়ার মানুষের জীবন ও এর চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে বিশেষ করে এর মুক্তি নিয়ে যা বলছেন তা অনেক বিতর্কে পূর্ণ হলেও মনে রাখতে হবে তাঁরা দুজনেই সত্যের একটা বড় দিক উন্মোচন করেছেন। পৃথিবীর অজস্র মানুষ এই দর্শনের অনুসারী।

ড. সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার , অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড