• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ফ্রাঞ্জ কাফকা : এক সফল অসমাপ্তির গল্প 

  সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার

০৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৯:৩১
করোনা
ছবি : সংগৃহীত

৩ জুন ১৯২৪ সাল। অস্ট্রিয়ার ক্লোস্টারনিওবার্গের ছোট্ট শহর কিয়ারলিং। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত কৃশকায় শরীরটা মৃত্যু থেকে যেন অল্প একটু দূরে! লিখছেন শেষ ইচ্ছে বাইশ বছরের অকৃত্তিম বন্ধু ম্যাক্স বডকে। এটা একটা উইলও বটে। ম্যাক্স বড হচ্ছেন তাঁর সহপাঠী, বন্ধু, ভক্ত, অনুসারী ও লিটারারি এক্সিকিউটর। লিটারারি এক্সিকিউটর হলো মৃত্যু পরবর্তীতে যাকে কপি রাইট ও ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইট দেয়া হয়। লিখছেন, “প্রিয় বড, আমি আর কোনোদিন হয়তো ফিরবো না, তুমি আমার প্রকাশিত-অপ্রকাশিত লেখা, লেখার ডাইরি, চিঠি, ম্যানুস্ক্রিপ্ট, ছবি ইত্যাদি নিঃসঙ্কোচে সব পুড়িয়ে দিও”। সমকালীন চিন্তা জগতের অনেক ভাবনার সাথে যিনি জড়িয়ে আছেন ভীষণভাবে; দুঃখ, বেদনা, হতাশা, আনন্দ, প্রেম, বিরহ, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি সর্বোপরি মানব অস্তিত্বের বিচিত্র সম্মীলন যার লেখার মধ্যে মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়ে চলেছে বিগত একশো বছর ধরে, তিনি বিশ শতকের বিখ্যাত দর্শন-সাহিত্য জগতের অদ্বিতীয় স্রষ্টা ফ্রাঞ্জ কাফকা(১৮৮৩-১৯২৪)।

পেন্সিলে লেখা এই নোটটা কাফকা তুলে দিয়েছিলেন কর্তব্যরত চিকিৎসক আর ডোরা ডিয়ামেন্টের হাতে। ডোরাকে কাফকা ভালবাসতেন একসময়। মৃত্যুর পাশে থাকা এ’দুজন দেখেছিলেন একটা ভীষণ সম্ভাবনাময় জীবনের সফল অসমাপ্তি। কাফকার দারুণ এক ভক্ত ও চেক অনুবাদক মেলিনা জেসেনিস্কা ম্যাক্স ব্রডকে লিখেছিলেন, “কাফকার এই সন্ন্যাসবাদ এক ধরণের ভীরুতার পরিচায়ক”। শেষকৃত্য শেষে বাবা হারম্যান এবং মা জুলিয়া ডাকলেন ব্রডকে। অপলেট হাউজ এপার্টমেন্টের সিঁড়ি বয়ে উপর তলায় পৌঁছানো মাত্র তারা ব্রডকে বললেন, তাদের ছেলের পড়ার টেবিলে যেতে। টেবিলের ওপর যত্রতত্র ছড়ানো কাগজপত্রের নিচে ব্রড খুঁজে পেলেন মহামূল্যবান সব ডকুমেন্ট – কাফকার অপ্রকাশিত নোটবুক, ড্রাফ্‌ট আর ডাইরি। কাফকার বাবা হারম্যান জোর করে ব্রডের দিয়ে সই করিয়ে নিলেন তার ছেলের সব অপ্রকাশিত লেখা প্রকাশের জন্য। ব্রড কাফকার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন, করলেন হয়তো তাঁর বাবার জন্য। তবে কিছু কিছু বিশ্বাসঘাতকতাও যে ভালো ফলাফল বয়ে আনে এটাই তার প্রমাণ। ব্রড ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত তাঁর উপন্যাস, এবং রচনাসমগ্র প্রকাশ করেছেন যার ফলশ্রুতিতে মানুষ জানতে পারে মাত্র চল্লিশ বছর বয়েসের একটা মানুষ জীবনকে কতো একান্তভাবে উপলব্ধি করেছেন, কত বেদনা আর কত অস্বস্তির মাঝে জীবন চলতে পারে এক ঠিকানাহীন অনির্দেশ্য যাত্রায়। আসলে কাফকা সত্যি খুব ক্ষণজন্মা এক প্রতিভার নাম যার চিন্তা তথা লেখনী আধুনিক বিশ্বের অসংলগ্নতা আর গভীর বিচ্ছিন্নতাবোধ-কে টেনে তুলেছেন কলম-তুলিতে।

ম্যাক্স ব্রড মারা যান ১৯৬৮ সালে। মারা যাবার পর কাফকার হাজার খানিক অপ্রকাশিত লেখা তার ব্যক্তিগত সহকারী ইস্টার হপিকে দিয়ে যান। তা নিয়ে ২০০৮ সালে ন্যাশনাল লাইব্রেরী অব ইসরাইল-এর সাথে এক আইনি লড়াই শুরু হয়। বলা হয়, এগুলো ইসরাইলের জাতীয় সম্পদ। যেহেতু কাফকা ছিলেন ইহুদী বংশীয় তাই তাঁর সব ফেলে রাখা লেখাগুলো ইসরাইলের সম্পদ বলে আদালত রায় দেয়। ২০১২ সাল থেকে সেগুলো ইসরাইলের ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে রক্ষিত আছে। তার আগে ইস্টার হপি অবশ্য কাফকার The Trial উপন্যাস প্রায় ২ মিলিয়ন ডলারে জার্মান লিটারারি আর্কাইভে বিক্রি করে দেন। ফ্রাঞ্জ কাফকা কি দার্শনিক ছিলেন? এই প্রশ্নটা বিশ্বের তাবৎ মানুষের। অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে তিনি কি একজন নিহিলিস্ট? আরো একধাপ এগিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, তিনি নিশ্চয় একজন অ্যানারকিস্ট। এসব প্রশ্ন অনেকের মতো আমারও। তিন দশক আগে আমি যখন তাঁর মেটামরফোসিস পড়ি তখন সেই প্রশ্নটা বার বার মনের ভেতর উঁকি দিতে থাকে। একটা অলঙ্কারের আড়ালে আধুনিক সমাজ কীভাবে মানুষকে একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র গ্রেগর সামসার জীবন দিয়ে সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন কাফকা। মানুষের নিসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা, বন্ধুহীনতা, গ্লানি, হতাশা কীভাবে অন্ধকার করে ফেলে একটা জীবনকে তার অপূর্ব প্রকাশ হলো মেটামরফোসিস। মেটামরফোসিস মানে রূপান্তর, পাল্টে যাওয়া। সমাজ আমাদের কীভাবে পাল্টে দেয়, সম্পর্ক আমদের কেমন করে নতুন বাস্তবতা তৈরি করে বিশেষ করে আধুনিক জীবন আমাদের কেমন করে জীবন থেকে জীবনের বিচ্ছিন্ন করে তোলে তার এক রূপক চিত্র মেটামরফোসিস। আমার মনে হয়েছে, এটাই অস্তিত্ববাদ দর্শনের মূলসূত্র। মানুষের জীবন থেকে যখন তার বেদনা বড় হয়ে উঠে, বহুমাত্রিক অনস্তিত্ব যখন তাকে গ্রাস করে তখন গ্লানি আর হতাশার ফল্গুধারা বয়ে চলে নিরবিচ্ছিন্নভাবে, কাফকা সেটাই প্রকাশ করেছেন তাঁর সমস্ত রচনাসমগ্রে। অনেকেই বলছেন, কাফকা যদিও কোনদিনই নিজের মুখে বলেননি তাঁর লেখার মধ্যে গভীর কোন দর্শন লুকিয়ে আছে, তবু সময়, প্রেক্ষাপট, বাস্তবতা, এবং তাঁর মন-জাগতিক প্রকৃতি ব্যাখ্যা করলে অবশ্যই সমস্ত চিন্তার মধ্যে অস্তিত্ববাদী ভাবনা খুঁজে পাওয়া যাবে প্রতি পরতে পরতে। ফ্রাঞ্জ কাফকা ১৮৮৩ সালের ৩ জুলাই চেকশ্লভকিয়ার প্রাগে জন্মেছিলেন একটা জার্মান-ইহুদী পরিবারে। প্রাগ তখন ছিল অস্ট্র-হাংগেরিয়ান সাম্রাজ্যের বহিমিয়ান অঞ্চল এখন যেটা চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। বাবা হারম্যান কাফকা ছিলেন ব্যবসায়ী এবং বেশ এক রোখা আর বদমেজাজি। হারম্যানের বাবা ছিলেন ওসেকের নামকরা ধর্মীয় কসাই।কাফকার মাও ছিলেন একটা ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে তবে তাঁর বাবা থেকে বেশি শিক্ষিত। বাবা মার ছয় সন্তানের ভেতর কাফকা ছিলেন সবার বড়। ইল্লি, ভাল্লি ও ওটলা নামে তিন বোনের সবার বড় ছিলেন তিনি। অনেকে ভেবেছিলো তিন বোনের নিরাপত্তার জন্য কাফকা অভিভাবকের ভূমিকা পালন করবেন। উল্টে বোনেরা তাকেই সামলাত ভীরু স্বভাবের কারণে। তিন বোন সবাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মারা যায়। বোনগুলোর ভেতর ওটলার সাথে ছিল সবচেয়ে ভালো খাতির। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত নিঃসঙ্গ ছিলেন তিনি। বাবার সাথে ছিল ভীষণ বৈরি, বাবা-ছেলের এতো দূরত্বের কথা ইতিহাসে খুব কম মানুষেরই জানা। ১৯১৯ সালের নভেম্বরে বাবার কাছে লেখা তাঁর চিঠিগুলো এর প্রমাণ। ৪৭ পৃষ্ঠার দীর্ঘ চিঠি পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে আর্নেস্ট কাইজার ও এথিন উইল্কিন্স অনুবাদ করে Letters to His Father নামে বই প্রকাশ করেন।

কাফকা প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন Deutsche Knabenschule German boys' elementary school থেকে। বলতে গেলে ১৩ বছরের ভেতরই তাঁর ধর্মীয় শিক্ষা শেষ হয়। ১৯০১ সালে তিনি মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন প্রাগের Deutsche Karl-Ferdinands-Universität–তে যেখানে তিনি পড়েন রসায়ন ও আইন। তবে এসময় তিনি জার্মান স্টাডিস ও ইতিহাস বিষয়ে পড়াশুনা করেন। সে সময় বন্ধুদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন দর্শন, ও সাংবাদিকতার ওপর পড়াশুনা করা। তবে তাদের মধ্যে কাফকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন ম্যাক্স বড। বড আইন নিয়ে পড়ালেখা করেন। বড লিখেছেন, কাফকা ছিলেন বেশ লাজুক স্বভাবের এবং কথা বলতেন খুবই কম। তবে যে কথাগুলো তিনি বলতেন তার গভীরতা ছিল অনেক। কাফকার গ্যাটের ওপর ছিল বেশ পড়াশুনা, তাছাড়া প্লেটোর ওপরও তিনি ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেন। ১৯০৬ সালে তিনি আইন বিষয়ের ওপর ডিগ্রী লাভ করেন। এর পরপরই তিনি একটা ইন্সিওরেন্স কোম্পানিতে চাকরি পান। তবে এ ধরণের চাকরি করতে গিয়ে তিনি অস্বস্তি আর নানামুখী ঝামেলা পোহান। প্রতিদিন ১৪ ঘণ্টা করে কাজ করে কিছুতেই লেখাপড়া করার সময় থাকতো না। এক বছর পর তিনি সেখান থেকে ইস্তফা দিয়ে বহিমিয়াতে Worker's Accident Insurance Institute এ কাজ শুরু করেন। এখানে অবশ্য তাঁর লেখাপড়া করার বেশ সুযোগ ছিল। কারখানার শ্রমিকদের দুর্ঘটনার পর তাদের হারিয়ে যাওয়া হাত পা বা অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিষয়ে বীমা নিয়ে তাঁর কাজ করতে হতো।

১৯১১ সালে কাফকা প্রাগে একটা ফ্যাক্টরির যৌথ মালিক হয়েছিলেন। প্রথম দিকে খুব আগ্রহ থাকলেও পরে তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কারণ এ’কাজে তাঁর বিস্তর সময় নষ্ট হচ্ছিলো। ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে সেনাবাহিনীতে যোগদান করার জন্য চাপ আসে। কিন্তু দেশের জন্য তাঁর এর থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে বলে তাঁর এমপ্লয়ার তাঁকে ছাড়েনি। ইতোমধ্যে কাফকা হয়ে ওঠেন নিরামিষভোজী। ১৯১৭ সালে ধরা পড়ে ক্ষয় রোগ টিউবারক্লসিস। পরের বছর স্বাস্থ্যগত কারণে তাঁকে অবসরে পাঠানো নয়।

কাফকার ব্যক্তিগত জীবন ছিল অনেকাই বহুগামীতায় পূর্ণ। এর ভেতর ফেলিস ব্যুয়ার নামে একজনের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল গভীর। ব্যুয়ার এক ফোন কোম্পানিতে চাকরি করতেন, ছিলেন ব্রডের আত্মীয়। ১৯১২ সালের আগস্টে তার সাথে দেখা হওয়ার মুহূর্তটা কি আসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন! লিখছেন, “১৩ আগস্ট যখন তাকে প্রথম দেখি, সে তখন বসে ছিল একটা টেবিলের পাশে। প্রথমে তার দেখে আমার কোন কৌতূহল জাগেনি। সুশ্রী, হালকা মুখ, গলার কাছে খোলা, ঢিলে জামা, সাধারণ ড্রেসে দেখতে তাকে অপূর্ব লাগছিলো”। এর পরবর্তীতে ৫ বছর তার সাথে কাফকার যোগাযোগ ছিল মূলত চিঠির মাধ্যমে। এর পর জুলিয়া উহারজেক নামে একজন অশিক্ষিত হোটেলকর্মীর সাথে প্রেম হয়েছিলো। সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন এমনকি বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করার পরেও বিয়ে হয়নি। মেয়েটা ছিল একজন জৈন, যার ফলে কাফকার পরিবার মেনে নেয়নি। সালটা ছিল ১৯২০। তবে মেলিনা জেসেনিস্কার সাথে তাঁর গভীরতা ছিল অত্যন্ত তীব্র আর গাঢ়। মেলিনা ছিলেন একজন চেক সাংবাদিক। ১৯২৩ সালের জুলাই মাসে কাফকা যান বাল্টিক সাগরের কাছে গ্রাল মুরটেজ-এ বেড়াতে। ডোরা ডিয়ামান্ট নামে এক কিন্ডার গার্টেনের এক শিক্ষকের সাথে পরিচয় হলে তাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ডোরা ছিলেন গোঁড়া ইহুদী। বার্লিনে ৭ মাস তারা একসাথে থাকেন। এই ডিয়াই কাফকার মৃত্যুশয্যায় পাশে ছিলেন। ধীরে ধীরে কাফকা তাঁর যৌন জীবন থেকে ফিরে আসেন। ইতোমধ্যে তাঁর মনে হয়েছে মানুষের যৌন জীবন অত্যন্ত ঘৃণার আর পরিত্যক্তের। সম্ভবত তিনি শারীরিকভাবে ভীষণ অক্ষম হয়ে পড়েন।

কাফকার মনোজাগতিক পরিব্যাপ্তি বোঝার জন্য কয়েকটা বিষয় উপলব্ধি করা জরুরী। কাফকা যেখানে জন্মেছিলেন সেখানে চলছিল এন্টি-সিমেটিজম আন্দোলন, ভয়ে ভীত ছিল ইহুদীরা। উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রাগে চেক জাতীয়তাবাদের প্রবল উত্থান ঘটতে থাকে। চেকরা জার্মান শাসিত হ্যাপ্সবার্গ সাম্রাজ্যকে ঘৃণা করতে থাকে। কাফকার পরিবার জার্মান ভাষায় কথা বলতো। বাবা ব্যবসায় ক্ষতির আশঙ্কায় “খুব বেশি ইহুদী” বা “খুব বেশি জার্মান” এর কোনটায় ছিলেন না। তিনি চাইতেন তাঁর বাবা সম্পূর্ণ ধর্ম নিরপেক্ষ থাকুক, যদিও ইহুদী সংস্কৃতি দিয়ে তিনি প্রভাবিত ছিলেন। বাবার সাথে দারুণ মানসিক দূরত্ব আর ভেতরে ঘৃণাবোধ থাকলেও তিনি একই বাড়িতে থাকতেন। একরাশ ঘৃণা থাকলেও প্রকাশ্যে কোনদিন তিনি প্রকাশ করতেন না।

কাফকার ডাইরি পড়ে বোঝা যায় তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল স্পিনজা, ডারউইন, নিটসের ওপর। ১৮৯৯/ ১৯০০ সালে তিনি প্রচুর পড়াশুনা করেন এঁদের ওপর। লিখেছেনও প্রচুর। তবে ভয়ে এসব লেখা তিনি নষ্ট করে ফেলেন। তাঁর প্রতি বাবার মনোভাব কিছুটা পরিবর্তন হতে থাকে ১৯০৬ এর থেকে বিশেষ করে আইনের ডিগ্রী নেওয়ার পর। কাফকা এসময় লেখালেখি শুরু করে বিরতিহীন ভাবে। The Judgment লিখতে শুরু করে তিনি একবার রাত ১০ টায় বসে পরের দিন সকাল ৬ টা পর্যন্ত একটানা ৮ ঘণ্টা টেবিল ছেড়ে ওঠেননি। আগেই বলেছি কাফকার লেখার পরিধি সীমাহীন। এতো বিস্তর লেখা খুব কম মানুষ এতো অল্প সময়ে লিখেছেন। তাঁর বিখ্যাত তিনটি উপন্যাস The Trial, The Castle, America প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯২৫, ২৬ ও ২৭ সালে। বিখ্যাত ছোট গল্পগুলির ভেতর The Judgement Meditation ১৯১৩, In the Penal Colony ১৯১৪, The Metamorphosis ১৯১৫, A Country Doctor ১৯১৬, A Report to an Academy, Letters to His Father ১৯১৯, The Burrow ১৯২৩, Josepine the Singer, or the Mouse Folk , A Hunger Artist ১৯২৪, The Giant Mole ১৯৩১,The Great Wall of China , Investigations of a Dog, Before the Law, Blumfield, an Elderly Bachelor ১৯৩৩, Description of a Struggle ১৯৩৬, Letters to Milena , ১৯৫২, Letters to Felice , ১৯৬৭,Letters to Ottla and the Family, ১৯৭৪, Letters to Friends, Family and Editors, ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হয়।

এক্সপ্রেসানিজম বা আবেগবাদ বা অভিব্যক্তিবাদ উনিশ শতকের অন্যতম এক সাহিত্য ও শিল্প আন্দোলন। জার্মানে এর সূত্রপাত। অবশ্য জগতখ্যাত ডাচ চিত্রকর ভিন্সেন্ট ভেনগগের চিন্তার ভেতর দিয়ে এর যাত্রা শুরু। মানুষের অনুভূতি, আবেগ, কল্পনা, ভয়, উদ্বেগ, ঘৃণা, দুঃখ, জ্বরা, এমনকি মানসিক প্রশান্তি যখন কাব্যাকারে একান্ত মাধুরী দিয়ে প্রকাশ করা হয় তখন বস্তু সত্য থেকে কাব্য সত্য বড় হয়ে দাঁড়ায়। এটাই শিল্প। সম্ভবত কলা কৈবল্যবাদ বস্তু সত্য থেকে শিল্পকে এইভাবে ছুটি দিয়েছে। যুক্তি থেকে এই মুক্তি অনেক সময় সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দর্শন অনেক ক্ষেত্রে বস্তু সত্যের আগল থেকে মুক্ত হয়ে ভাবজগতে প্রবেশ করে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। আমাদের রবিঠাকুরের সাহিত্য ও সৌন্দর্য ভাবনার পুরটাই এক্সপ্রেসানিজমের নানা ভঙ্গিমা। ‘সৌন্দর্য প্রয়োজনের বাড়া’— রবিঠাকুরের এই উক্তির মাঝ দিয়ে এক্সপ্রেসানিজমের হৃদ-স্পন্দন প্রকাশ পেয়েছে। সেতো না হয় সাহিত্য। কিন্তু দর্শন? দর্শনের যুক্তি-ব্যূহ কি ভেদ করা সম্ভব? সম্ভব। অস্তিত্ববাদ যেখানে মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের সাথে জড়িত, ভালোবাসা আর প্রেমের সাথে জড়িত কাজেই যেখানে তো যুক্তি- জাল থাকবে না। বলা হয় কাফকার চিন্তার সাথে এই অভিব্যক্তিবাদের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। অস্কার কোকোস্কা ছিলেন উনিশ শতকের অস্ট্রিয়ান কবি, শিল্পী ও বিখ্যাত নাট্যকর। তাঁর চিত্রকর্ম মানুষের জীবনের ভেতরের ক্ষতকে তুলে এনেছে। দগ দগে ঘার ওপর মলমের প্রলেপ দিয়ে তৈরি করেছেন এক অসম্ভব জীবনবোধ। কাফকা নিজেই বলেছেন, “আমি সব বুঝিনা। আমার কাছে মনে হয়েছে শিল্পীর ভেতরের যে গভীর বিশৃঙ্খল জীবনধারা সেটা তার তুলির ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে”।

কাফকার জগত ভীষণভাবে বিশৃঙ্খলাময়। আগেই লক্ষ্য করেছি জীবনের মানে তাঁর কাছে সম্ভবত সরল পদ্যের না। বহু বাঁকা পথের কিনারায় জীবনের আশ্রয়। ১৯১২ সাল থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত তাঁর পরিপক্ব লেখার ভেতর দিয়ে বিশৃঙ্খল চিন্তার সুশৃঙ্খল মানে প্রকাশ পেয়েছে? কাফকার প্রতিটা লেখা অত্যন্ত অর্থবহ। একটা রূপকের আড়ালে ভীষণ এক সত্য লুকিয়ে থাকে। যেমন তাঁর মাত্র দুই পৃষ্ঠার একটা ছোট গল্প Before the Law তে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের জন্য বিচার প্রার্থনা কতো দুরহ ব্যাপার। কতো কঠিন আগল পেরিয়ে ন্যায় বিচার পেতে হয়। কারণ বিচারের দরোজায় যে প্রহরী দাঁড়িয়ে থাকে সে কিছুতেই ঢুকতে দেয়না। এক দুই তিন এভাবে অগণিত প্রহরী একের পর এক বাধা দিতে থাকে সাধারণ মানুষের। বিচারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরী তাই বলে উঠে, “No one else could ever be admitted here,”।

কাফকার ছোট গল্পসমগ্র বইয়ের সম্পাদক জন আপডাইক ভুমিকায় তাঁকে নিয়ে এক সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরেছেন, তিনি লিখছেন, “THE century since Franz Kafka was born has been marked by the idea of "modernism" -- a self-consciousness new among centuries, a consciousness of being new. Sixty years after his death, Kafka epitomizes one aspect of this modern mind-set: a sensation of anxiety and shame whose center cannot be located and therefore cannot be placated; a sense of an infinite difficulty within things, impeding every step; a sensitivity acute beyond usefulness, as if the nervous system, flayed of its old hide of social usage and religious belief, must record every touch as pain. In Kafka's peculiar and highly original case this dreadful quality is mixed with immense tenderness, oddly good humor, and a certain severe and reassuring formality. The combination makes him an artist; but rarely can an artist have struggled against greater inner resistance and more sincere diffidence as to the worth of his art.”

কাফকা অস্তিত্ববাদী ধারার এক বিসংবাদী দার্শনিক কারণ তাঁর চিন্তার ভেতর অনেকেই খুঁজে পেয়েছেন অসংলগ্নতা। তবে চিন্তার অসংলগ্নতা থাকলেও সমাজের অসংলগ্নতা তো আছে, এটা কে অস্বীকার করবে? আর এই অসংলগ্নতাকে তিনি তুলে ধরেছেন সাঙ্ঘাতিক এক বোধ থেকে। এক উদ্ধারহীন বাস্তবতা উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। কোন সময় সরাসরি, কোন সময় রূপকের আড়ালে। পরিশেষে আপডাইকের কথায় শেষ করি, “he spoke for millions in their new unease; a century after his birth he seems the last holy writer, and the supreme fabulist of modern man's cosmic predicament”.

লেখক : সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার, অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড