• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

করোনার চেয়ে মারাত্মক ভাইরাস ক্ষুধা

  খালিদ ফেরদৌস

০৫ এপ্রিল ২০২০, ১৯:২৬
খালিদ ফেরদৌস
খালিদ ফেরদৌস

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ঝাঁকে ঝাঁকে ডলফিন খেলা করছে, ক্যানবেরার পথ-ঘাটের দখল নিয়েছে ক্যাঙারু। শহরে ধূলা-বালির বাড়াবাড়ি নেই, ধোঁয়া-কার্বন নিঃসরণ কমে গেছে। নগর জীবনে ব্যক্তিগত গাড়ির লাইটে সুখের নীল বাঁধছে পাখি। দূরের বাড়ির বালিকা কিংবা রেলিঙের দোয়েল চোখে আসে স্পষ্ট। বিলিয়ন ডলার খরচ করে যে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা যায়নি তা এখন সমাধানের পথে। সারাবিশ্বে প্রকৃতি তার জীব-বৈচিত্র‍্য ফিরে পাচ্ছে। তারপরও এমতাবস্থায় সরকারসহ আপামর জনসাধারণের একান্ত মনোবাঞ্ছা- যেকোনো মূল্যে দেশকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্ত করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যাওয়া। কারণ আমাদের মতো বিকাশমান অর্থনীতি বা দরিদ্র দেশে দীর্ঘদিন এমন পরিস্থিতি বিরাজ করলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জনজীবনে নেমে আসবে ঘোরতর অন্ধকার। পরবর্তীতে এই ঘোর ঘোঁচানো পড়তে হবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের সামনে। ঘরে বসে থাকলে আমাদের অর্থনীতি সচল রাখা কঠিন। তবে আপাতত করোনা ভাইরাসের প্রতিরোধ সরকারসহ জনগণের প্রধান এজেন্ডা হওয়া উচিৎ।

কিন্তু করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কিছুক্ষেত্রে অতি সচেতনতা বা উৎসাহ দেখে দেশের মানুষ খুব হতাশ হয়েছে। তাদের হাতে রাস্তা-ঘাটে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে মার-ধর, কানধরে উঠবসের শিকার হচ্ছে। যা দেখে খুব লেগেছে। কিছু কিছু জনগণের অসচেতনতা যেমন করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বিশৃংখলা তৈরি করছে ; তেমন তাদেরকে যৌক্তিক কারণ ছাড়া মারাটাকেও জনরোষের সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার এক বৃদ্ধকে মাস্ক না পরার কারণে উঠবস করানোর ছবিটি ভাইরাল হয়ে সরকারের করোনা ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলার আন্তরিক প্রচেষ্টাকে কিঞ্চিৎ প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

বাংলাদেশের সংবিধান বা বিদ্যমান আইন প্রজাতন্ত্রের সেবকদের (পাবলিক সার্ভেন্ট) এই অধিকার দেয়নি। কেউ যদি আইন বা আদেশকে অমান্য করে তবে দেশের আইন-আদালত নির্দেশিত পন্থায় তার বিহিত করতে হবে। আইন অমান্য করা বা শৃংখলাবিরোধী কোনো কাজ হেতুতে বিদ্যমান আইনে শাস্তি আছে, জমিমানা আছে। তাদেরকে এটা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলার যদি চরম অবনতি ঘটে তবে মন্দের ভালো হিসেবে অনেক সময় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা মারধর করার পন্থা বেছে নেয়। আর এটা তারা নিরূপায় হয়ে করে আইন বাস্তবায়নের শেষ ধাপ হিসেবে। তারমানে এহেন কর্মকাণ্ড আইন প্রয়োগের প্রথম ধাপে হতে পারে। যা করোনা ভাইরাস সংক্রমণ কেন্দ্রিক উদ্ভুত পরিস্থিতিতে হর-হামেশে করা হচ্ছে। যা সচেতন মানুষ হিসেবে কারো কাম্য নয়। কারো কারো কথা শুনে মনে হচ্ছে, তারা ঝেটিয়ে-পিটিয়ে এদেশ থেকে করোনা ভাইরাস দূর করবে। পেপার-পত্রিকা, স্যোসাল মিডিয়াতে প্রকাশিত ভিডিও, ছবি বা খবর পড়ে যা বোঝা যায়- এখন পথে-ঘাটে যাদেরকে হেনস্তা করা হচ্ছে তাদের অধিকাংশ কোনো না কোনো জরুরি কাজে বাইরে বের হয়েছে। সচেতন সমাজ যারা একটু অর্থনীতি বুঝে তারা স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছে- দীর্ঘদিন শ্রমজীবী মানুষকে ঘরে বন্দি করে রাখা সম্ভব নয়। হোম কোয়ারেন্টিন বা লক ডাইন করে উন্নত বিশ্ব পর্যন্ত হিমসিম খাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশের পক্ষে কর্মজীবী মানুষদের কাজ থেকে বিরত রেখে অর্থনীতি সচল রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিছুদিন পর শ্রমজীবীদের বাইরে যাবার বিধিনিষেধ বা কড়াকড়ি উঠিয়ে দিয়ে সীমিত পর্যায়ে হলেও তাদেরকে কাজ করতে দিতে হবে। তথ্য মতে- বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় কোটি খানেক শ্রমিক গার্মেন্টস-এ কাজ করছে। এর বাইরে বিভিন্ন শ্রমজীবী চার কোটি লোক নানা কাজে নিয়োজিত আছে। এই বিশাল সংখ্যার মানুষ এখন করোনা পরিস্থিতির কারণে কাজ করতে পারছে না। আর বাইরে বের হবার কড়াকড়ি যদি দীর্ঘদিনের জন্য চলতে থাকে তাহলে করোনার চেয়ে বেশি মানুষ মরবে না খেয়ে, পুষ্টিহীনতা ও ডায়বেটিসসহ নানা ধরনের শারীরিক রোগে। মনে রাখতে হবে মানুষের বাইরে যাওয়া প্রয়োজন শুধুমাত্র কর্মের জন্য নয়। সুস্থ-সবল থাকতে মানুষের খোলামেলা পরিবেশে চলাফেরাও প্রয়োজন আছে। যদিও ঘরে থাকার বিষয়টা ক্ষণিকের। আরও কিছুদিন জনগণকে ধৈর্য ধরে সরকারের স্বাস্থ্যবিধি ও নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।

তারপরও করোনা পরিস্থিতিকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে কোনোভাবে ক্ষুধাকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। এখন পৃথিবীতে করোনার চেয়েও ভয়াবহ একটি ভাইরাস রয়েছে সেটির নাম ক্ষুধা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছিলো প্রায় ৮২ কোটি মানুষ এবং মারা গেছে প্রায় ৯০ লাখ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বে প্রতিদিন গড়ে ক্ষুধার কারণে মারা যায় প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। এই ভাইরাসটির কাছে করোনা শুধু নয় মরণ ব্যাধি এইচআইভি/এইডস ভাইরাসও নস্যি। কারণ করোনা ভাইরাসে গত তিন মাসে মারা গেছে মাত্র চল্লিশ হাজারের কাছাকাছি মানুষ। আরো ভয়াবহ তথ্য, প্রতি পাঁচ সেকেন্ডে একজন শিশু এবং প্রতি তিন সেকেন্ডে প্রায় দুইজন মানুষ ক্ষুধার কারণে মারা যায়। প্রতিদিন প্রায় সাড়ে আট হাজার শিশু ক্ষুধার্ত হয়ে মারা যায়।

ক্ষুধা যে কেবল দারিদ্র‍্য বা কর্মসংস্থানহীনতার কারণে হয় সেটিও প্রণিধানযোগ্য নয়। শুধু কর্মসংস্থান এবং পরিশ্রম মানুষকে ক্ষুধা থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম নয়। বিষয়টির স্বপক্ষে আফ্রিকার নারীদের মাঝে প্রচলিত একটা উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে। আফ্রিকান এক নারী আক্ষেপ করে বলেছিল, 'পরিশ্রম যদি দারিদ্র্য দূর করার একমাত্র উপায় হতো, তাহলে আফ্রিকান নারীরা হয়ে যেত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনী।' অর্থাৎ আফ্রিকার মহিলারা প্রচুর পরিশ্রম করে কিন্তু ন্যার্য মজুরি পায় না। এটা আফ্রিকার দেশগুলো কপালে জুটেছে দীর্ঘকাল কোনো রাষ্ট্রের কলোনি হয়ে থাকার কারণে। আজ তারা সেইসব সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে ভৌগোলিকভাবে মুক্তি কিন্তু রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে তাদের রাহুমুক্ত হয়নি। এই কারণেই মূলত তারা নানাভাবে শোষিত ও বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষুধা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে খাদ্য অব্যবস্থাপনা, অপচয়, যুদ্ধ বা মহামারীর জন্য। কিছু কিছু দরিদ্র দেশে মূলত ভূ-রাজনৈতিক কারণে ক্ষুধা মহামারী রূপ নেয়। মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিকভাবে প্রভাববিস্তারের বলি হয়ে ইয়েমেনে লাখ লাখ মানুষ মারা যায় ক্ষুধার কারণে। সিরিয়া, ইরাক, সোমালিয়া, রুয়ান্ডা, রিপাবলিক অব সেন্ট্রাল আফ্রিকা, নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকার অনেক দেশে রাজনৈতিক প্রভাব ও বৈষয়িক সিদ্ধিযোগের কারণে ক্ষুধা প্রধান আর্থ-সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। যা লাখো মানুষের প্রাণ সংহারের কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলেছে, ক্ষুধার যে চিত্র বা তথ্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে উঠে এসেছে, বাস্তবে তার চেয়ে ভয়াবহ চিত্র বিদ্যমান সেখানে। যদিও করোনা ভাইরাস মহামারি যেভাবে বিশ্ব অর্থনীতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে তাতে দরিদ্র দেশগুলোর ক্ষুধা পরিস্থিতি আরো অবনতি হবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এই ক্ষুধা নামক ভাইরাস দূর করার প্রতিষেধক বিশ্বের মানুষের জানা। ক্ষুধার প্রতিষেধক খাদ্য ও সুযোগের সমতা। নানা পদক্ষেপ, কৌশল, চুক্তি বা অভীষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করেও এটা নিশ্চিত করতে বর্তমান বিশ্ব বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল দেশগুলো প্রতিদিন যে পরিমাণে খাবার নষ্ট করে, তা দিয়ে আফ্রিকার অনেক দেশের লাখো লাখো অভুক্ত মানুষের তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যেত। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো অতিরিক্ত উৎপাদিত খাদ্যশস্য-ফল বা খামারে পালন করা পশু-পাখি হত্যা বা নষ্ট করে ফেলে। এই অতিরিক্ত অংশ যদি দরিদ্র দেশগুলোর মাঝে বিতরণ করা হতো তবে বিশ্ব খাদ্য ও ক্ষুধা পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন হতো। অর্জিত হতো জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) লক্ষ্য। আরো অর্জিত হতো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউএনএফপিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের অভীষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কিন্তু জানা অদৃশ্য এক কারণে এই লক্ষ্য অর্জন শুধু কাগুজে কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়ে গেছে। যদিও জাতিসংঘ গ্রহীত কিছু পদক্ষেপ ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং নারী ক্ষমতায়নে ভালো ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে তা প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে নগণ্য। বিষয়টা নিয়ে বিশ্বকে নতুনভাবে ভাবতে হবে। করোনা ভাইরাসের মহামারি নতুন করে ভাববার অবারিত সুযোগ এনে দিয়েছে। যা কোনোভাবে হাতছাড়া করা যাবে না। বিশেষ করে জাতিসংঘের ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচটি দেশকে মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের অতি লাভ ও লোভ এবং ভূ-রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তারের মনোভাব থেকে সরে আসতে হবে। তাহলে খুব সহজে বিশ্ব ক্ষুধা ও দারিদ্র্য পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।

যা হোক, বাংলাদেশে এখন যে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে এটা ইতিহাসে প্রথম। কার্যত সেবাপ্রতিষ্ঠান বাদে সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ। সকল ব্যবসা-বাণিজ্য স্তবির হয়ে আছে। মানুষ বাইরে বের হতে পারছে না। সবাই ঘরের ভেতর জেলখানার মতো বন্দি জীবন যাপন করছে। এই অসহ্য বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে কেউ কেউ বের হচ্ছে বিভিন্ন জরুরি কাজে। এই জন্য বলা যাবে না সবাই সৌখিনতা বা বেড়ানোর মানসিকতা নিয়ে হয়েছে। প্রয়োজন বিবেচনা না করে যাকে-তাকে ধরে পথে-ঘাটে হেনস্তা করা যাবে না। ভুললে চলবে না, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্ত থেকে সুস্থ থাকা যেমন জরুরি, শারীরিকভাবে ফিট বা সুস্থ থাকা জরুরি। এই কথা চিন্তা করেই কিন্তু জাতিসংঘ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার পর ছয়তম মৌল মানবিক চাহিদা হিসেবে চিত্তবিনোদনকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাই একটা সময় পর দেশে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা কমে গেলে সুস্থ ও নিরোগ রাখতে মানুষের ভেন্টিলেশনের সুযোগ রাখতে হবে অর্থাৎ মেডিকেল স্বাস্থ্যবিধি মেনে আশেপাশের খোলা পরিবেশে সীমিত আকারে হলেও চলতে-ফিরতে দিতে হবে। তা না হলে করোনা ভাইরাস আক্রমণের চেয়ে মানুষ বন্দি থেকে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। বিশেষ করে ডায়বেটিস ও হার্টের রোগীকে হাঁটতে চলছে না দিলে তাদের অবস্থা খুব খারাপের দিকে যাবে। তবে একটা কথা সবাইকে মনে রাখতে আগামী এপ্রিল এর প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই সময় করোনা পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে। তাই সকলকে নিজের ও দেশের স্বার্থ চিন্তা করে সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক আগামী কিছুদিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। নিজ ও সমাজের অস্তিত্বের প্রয়োজনে বাসায় থাকাকে মনে করতে হবে হ্যাপি হোম কোয়ারেন্টিন।

দেশের স্বার্থে সবসময় মনে জপতে হবে, করোনা সমাজের মানুষের কাছে ভয়ার্ত অবস্থার সৃষ্টি করেছে। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে তাদের কেউ কেউ বলছে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখিনি। তারা এও বলছে, যুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীকে মাঝে মাঝে দুর্ভাগ্যক্রমে দেখতাম ; কিন্তু এখন আমাদের শত্রু করোনা ভাইরাসকে দেখি না। বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার ও তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষের মাধ্যমে দৈনন্দিন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পেয়ে মানুষ বিধাতাকে ভুলতে বসেছিল। মানবজাতি নিজেদেরকে খুব শক্তিশালী ভাবতে শুরু করেছিল। বিশ্বের নানাপ্রান্তে ধর্মের ধুয়ো তুলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছিল। কিন্তু এখন অতি ক্ষুদ্র যা সাধারণ চোখে তো নয়ই, অত্যাধুনিক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া দেখা যায় না যে করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯, তার কাছে সবাই অসহায়। তাহলে একবার ভাবুন- যিনি এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন সে কতটা শক্তিশালী। তাই যে যত শক্তিশালী হোন না কেন চোখ মাটিতে নামান এবং ভাবুন আপনি কত ক্ষুদ্র। যে ইউরোপ-আমেরিকা সবসময় ধর্মকে নয় কর্মকে গুরুত্ব দেয়, তারাই এখন এই ভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য আকাশের কাছে নিজেদের সপে দিয়েছে।

আরো একটা গভীর উদ্বেগের বিষয়, করোনাভাইরাস প্রতিরোধ নিয়ে ক্ষমতাসীন জোট সরকারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে ইউরোপের দেশ কসোভোয় সরকারের পতন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আলবিন কুর্তির বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে শরিক দল এলডিকের একজন সদস্যের উত্থাপিত অনাস্থা ভোটে এই ঘটনা ঘটে। বেশ কদিন ধরেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বরখাস্তের জের ধরে জোটের মধ্যে টানাপোড়েন চলছিল। খবর এএফপির।

করোনা ভাইরাসের করাতলে বিশ্বে যে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব আরো অনেক দেশ আর্থিক ও রাজনৈতিক সংকটে পড়তে পারে। যা বর্তমানে তেমন একটা আচ করা যাচ্ছে না। এই সংকট উত্তরণে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং তার টেকসই বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

সুখের সংবাদ, করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে রফতনিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতন দিতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বলেছে, সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকা মহানগরীসহ দেশের ৬৪ জেলায় অতি দরিদ্রদের ৬ হাজার ৫০০ শত মেট্রিক টন চাউল ও নগদ ৫ কোটি পঞ্চাশ লক্ষ টাকা বরাদ্ধ করা হয়েছে। ৫ মার্চ নতুন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। নিঃসন্দেহে এটা একটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। যা শিল্প-কারখানাকে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়তা করবে। তবে কৃষকদের জন্যও আলাদা একটা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা সময়ের দাবি। রাজনৈতিক অঙ্গনে আশার কথা মাননীয় তথ্যমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ বলেছেন, বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল মিলে জনগণের পাশে থাকব। করোনা পরিস্থিতিতেই মূলত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়েছেন।

অন্যদিকে লক ডাউনে কানাডায় দিচ্ছে বাড়ি ভাড়া ও ঘরে বসে বেতন সুবিধা, আমেরিকা দিচ্ছে প্রতিজন ১০০০ ডলার। নরেন্দ্র মোদির সরকার নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য প্রায় দুই লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের নাগরিকদের দিচ্ছে ফ্রী চাল। করোনা মহামারীর মধ্যে গরিব ও নিম্ন আয়ের এক কোটি মানুষকে মাসে মাসে ১২ হাজার রুপি করে দেবে পাকিস্তান। খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে চার মাস ধরে দেয়া হবে মানবিক এই পরিষেবা। এই সময়ে একজন পাবে মোট ৪৮ হাজার রুপি। বিশ্বে কয়েকটি দেশে করোনা পরিস্থিতি অবণতি হলেও বেশকিছু দেশে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশেও সরকারের নানামুখী তৎপরতা ও জনগণের অভাবনীয় ছাড়ায় ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।

সবশেষে একটা কথা বলা যায়, করোনা, এডিস, ইবোলা, নিপাহ এমন কী এইচআইভি/এইডস ভাইরাসের চেয়ে মারাত্মক ভাইরাসের নাম ক্ষুধা। এই ক্ষুধা কথা বিবেচনা করে দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ বা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে সমস্যা টেকসই সমাধানের জন্য। না হলে সব ইতিবাচক তৎপরতা মাঠে মারা যেতে বাধ্য। সেটা কারোই প্রত্যাশা নয়। সবার একান্ত চাওয়া সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় সক্ষম হোক। আবার উন্নয়ন ও অগ্রগতির চলমান ধারা ফিরে পেয়ে ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যমুক্ত হয়ে দেশ হয়ে উঠুক সুখী ও সমৃদ্ধ।

লেখক: এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক, গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ।

(মতামত বিভাগে প্রকাশিত সকল মন্তব্য একান্তয় লেখকের ব্যাক্তিগত অভিমত )

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড