• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আশ্বাস নয়, সীমান্তে হত্যা বন্ধ করতে হবে  

  মীর আব্দুল আলীম

২৭ জানুয়ারি ২০২০, ১৭:১৩
সীমান্ত
সীমান্তে বাংলাদেশিদের রক্তে রঞ্জিত কাঁটাতার (ছবি : সম্পাদিত)

‘বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে ২৪ ঘণ্টায় ৬ বাংলাদেশি খুন’- গত ২৪ জানুয়ারি দেশের পত্রিকাগুলো ফলাও করে ছেপেছে এমন সংবাদ। ২০১৯ সালেই সরকারি হিসাবে ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বেড়েছে ১২ গুণ। চলতি মাসে গত ১৫ দিনে বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে ১০ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে।

সর্বশেষ ২৩ জানুয়ারি নওগাঁর পোরশার হাঁপানিয়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে তিন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। ওই ঘটনায় বিএসএফ অবশ্য পতাকা বৈঠকে দুঃখ প্রকাশ করেছে। এমনটা হলে তারা সব সময় দুঃখ প্রকাশ করে ভদ্রতা দেখান!

সীমান্তে হত্যাযজ্ঞের পর ভারতের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হলেও বন্ধ হয়নি হত্যা। সীমান্ত বাংলাদেশির রক্তে রঞ্জিত হয়; নিয়ম মাফিক বৈঠক হয়, সীমান্ত হত্যা বন্ধের আশ্বাস দেওয়া হয় কিন্তু ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয় না। বারবার বাংলাদেশি নাগরিকের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। চোরাচালানে কেবল বাংলাদেশিরা নয়, ভারতীয়রাও জড়িত। তবে বলির পাঠা হয় কেবল বাংলাদেশি।

সম্প্রতি দিল্লিতে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন শেষে বিজিবি মহাপরিচালক সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বেড়েছে জানিয়ে বলেন, ২০১৯ সালে সীমান্তে ৩৫ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। তবে বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা আরও বেশি। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে ২০১৯ সালে সীমান্তে ৪৩ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে গুলিতে ৩৭ জন এবং নির্যাতনে ছয়জন। আহত হয়েছেন ৪৮ জন। অপহৃত হয়েছেন ৩৪ জন। ২০১৮ সালে নিহত হয়েছেন ১৪ জন। সরকারি হিসাব ধরলে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সীমান্ত হত্যা বেড়েছে ১২ গুণ। আর বেসরকারি হিসেবে তিন গুণের বেশি।

এ বিষয়ে সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, সীমান্তে হত্যা নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা দিল্লিকে জানানো হয়েছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে কিংবা আদৌ পাওয়া গেছে কি না, সেটি তিনি জানাননি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যন্ত কারও অঙ্গীকারই ঠিক থাকছে না। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধে তাদের প্রতিশ্রুতি ঠিক থাকে না কখনোই। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত প্রতিনিয়তই বাংলাদেশি নাগরিকের রক্তে রঞ্জিত হয়। সমঝোতা এবং চুক্তি লঙ্ঘন করে বিএসএফ সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা করছে। অবৈধভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, এমন ঘটনাও প্রায়ই ঘটছে। যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আমরা সীমান্তে ভারতের এ ধরনের অমানবিক, নিষ্ঠুর আচরণের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি। একই সঙ্গে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কড়া প্রতিবাদের দাবি জানাচ্ছি। বহুবার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর (বিএসএফ) যৌথ উদ্যোগে সীমান্ত হত্যা জিরো টলারেন্সে নামিয়ে আনার কথা বললেও তা সম্ভব হয়নি। বিশ্বের বহু দেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সীমান্ত রয়েছে। তা কোথাও দীর্ঘ কোথাও সংক্ষিপ্ত। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ ছাড়াও চীন ও পাকিস্তানের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একই ধরনের সীমান্ত রয়েছে কানাডা ও মেক্সিকোর। এ ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে চীনের দীর্ঘ সীমান্ত বিদ্যমান। কিন্তু এসব সীমান্তে সীমান্তরক্ষী কর্তৃক কোনো মানুষ হত্যা দূরে থাক, একটি গুলি ছোড়ার ঘটনাও শোনা যায় না। সীমান্তে পৌনঃপুনিক বাংলাদেশি হত্যার দায়ভার ভারত সরকারের। কারণ নির্দেশটা সেখান থেকেই আসছে। দেখামাত্রই গুলি এমন নির্দেশ অবশ্যই আছে, তাই বিএসএফ ন্যূনতম অপেক্ষা না করে এভাবে হত্যা করছে। বিএসএফের মতো একটা রেজিমেন্টেড বাহিনীর দায়িত্বই হলো অক্ষরে অক্ষরে নির্দেশ পালন করা। সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধের ব্যাপারে আগের নির্দেশটি প্রত্যাহার করতে হবে। সেটা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত যত প্রতিশ্রুতিই দেওয়া হোক সীমান্ত হত্যা চলতেই থাকবে। অর্থাৎ সত্যিকারভাবে ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না পাল্টালে সীমান্তে এভাবে বাংলাদেশের নাগরিক হত্যা বন্ধ হবে না। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় ৫০ বছরে সীমান্তে বিস্তর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বিএসএফ। প্রায় দিনই কোনো না কোনো সীমান্তে রক্তপাত যেন স্বাভাবিক ঘটনা। ইতঃপূর্বে ফেলানি নামের একজন কিশোরীকে বিএসএফ হত্যার পর সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখলে বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। তারপর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম ঢাকা আসেন। তাদের সঙ্গে বৈঠকে সীমান্তে হত্যার বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হলে তারা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আশ্বাস দেন যে, সীমান্তে হত্যার সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনা হবে। অর্থাৎ গুলি না চালিয়ে রাবার বুলেট জাতীয় অস্ত্র ব্যবহার করবে। আশ্বাসের পরও সীমান্তে গুলি শুধু চলছেই না, একদিনে একসঙ্গে চার স্থানে গুলি চালিয়ে চার বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের পরও সীমান্তে হত্যা বন্ধ হয়নি। ভারত বাংলাদেশের বন্ধু ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র। বাংলাদেশের ৩০টি সীমান্তবর্তী জেলা ভারতের সঙ্গে রয়েছে। এসব জেলা দিয়ে দুই দেশের মানুষের বিনা পাসপোর্টে যাতায়াত রয়েছে। প্রতিদিন দুই দেশের হাজারো মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে পরিবার-পরিজন বা নিকট আত্মীয়-স্বজনের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু ভারতীয় বিএসএফ সীমান্তে যে নির্যাতনের হলি খেলায় মেতে উঠেছে তাতে সে দেশের সচেতন মহল, মানবাধিকার সংগঠন, বুদ্ধিজীবীদেরও হতবাক করেছে।

সীমান্ত হত্যা বন্ধে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও নিতে হবে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে এ ক্ষেত্রে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আন্তরিক হবে কি না? এজন্য আমরা ভারতের রাজনৈতিক শুভবুদ্ধির প্রত্যাশা করি। আমরা মনে করি, সীমান্তে সৌহার্দ্য সম্প্রীতির পাশাপাশি বিএসএফের বেআইনি হত্যাকাণ্ড বন্ধে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত জরুরি। উভয়দেশের শান্তি রক্ষার্থে এবং সীমান্ত অপরাধ দমন করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দুই রাষ্ট্রের পারস্পরিক সৌহার্দ্যের কোনো বিকল্প নেই। আর এই কাজে ভারতকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে।

ওডি/এসএ

মীর আব্দুল আলীম লেখক : সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও গবেষক।
মতামত পাতায় প্রকাশিত লেখা লেখকের একান্ত মত। এর সঙ্গে পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।
চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড