• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

প্রবন্ধ

সূফী কবিতায় প্রেম

  নাজমুন নাহার

২১ অক্টোবর ২০১৯, ১৭:৫১
প্রচ্ছদ
ছবি : প্রতীকী

২০০৬ সালে এমেরিকাতে সবচাইতে বেশী বিক্রিত যে বইটি সেটি মোটেই এমেরিকার কবি এমিলি ডিকসন, ফ্রস্ট কিংবা এমারসনের নয়। সেটি অবশ্যই সুফি মিস্টিক কবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীর। ৬০৪ হিজরি ৬ই রবিউল আউয়াল খোরাসানের (বর্তমানে আফগানিস্থান)বলখ রাজ্যে রুমির জন্ম। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মাওলানা, মারিফতের জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। পারসিয়ান সাহিত্যের গভীরে অনুসন্ধান করেছেন এবং আমরা প্রচুর সুফী কবিতা পাই যার আবেদন সময়কে অতিক্রম করে।

ত্রয়োদশ শতকের পুরোটা জুড়ে তৎসময়ের সংস্কৃতির ভাবজগতে মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি আর তার কাব্যর সুললিত সুর অনুরণিত করেছে। হতে পারে রুমি তার কবিতায় এই ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়েছেন যা বিশ্বময় অনুরণিত হয়েছে। রুমি বলেন একজন ভালোবাসাকে চর্চা করতে পারে কিন্তু নিঃশেষ করতে পারে না। ইসলাম ধর্মে ভালোবাসার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে এবং রুমি ও অন্যান্য সুফি কবিগণের বেলায় বলা যায়– ভালোবাসা তথা প্রেমই সুফি কবিদের অন্তর্জগত এবং বহির্জগতকে নিয়ন্ত্রন করেছে। সুফিরা ভালোবাসা বলতে কি বুঝান? তাদের কবিতায় কি করে ভালোবাসা ক্রমশ আধ্যাত্মিকতায় রূপান্তরিত হয়?

যেমন কোরআন দিয়েও শুরু করা যায় এই আলোচনা। ভালোবাসার জন্য রয়েছে কত যে কবিতা কত যে গাঁথা কিন্তু শবদটা যখন শুধুই ভালোবাসা তথা প্রেম তখন এমন যে ভালোবাসা শুধু স্রষ্টা এবং সৃষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা নয়। পদ্যগুলোতে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভালোবাসাকেই শুধু নির্দিষ্ট করা হয় নি কিন্তু ভালোবাসা একটি ধ্রুব সত্যকেই বুঝিয়েছে। কোরআনে দুটো ভিন্ন প্রকৃতির ভালোবাসাকে নির্দিষ্ট করে। যেমন প্রথমত স্রষ্টা চান তার সৃষ্টি বিশেষ করে মানুষ তাকে ভালোবাসুক তাদের এই যে স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা তার ভালোবাসাকেই বুঝতে চেষ্টা করুক।

আর দ্বিতীয়ত স্রষ্টাকে যারা ভালোবাসে তাদের প্রতি স্রষ্টার অফুরান ভালোবাসা ঝর্ণার মতো প্রবাহিত হয়। কোরআনের আয়াতে আছে তিনি তাদের ভালোবাসেন যারা তাঁকে ভালোবাসে।এর থেকে সুফিরা জানেন যে ভালোবাসা তো শেখার ব্যপার নয়- ভালোবাসা সৃষ্টিকর্তার করুণার ফল এবং এটি আসে ঈশ্বর থেকেই। মাওলানা জালালুদ্দিন রূমি বলেন, ‘ভালোবাসাই ভালোবাসার উৎস তৈরী করে এবং দয়িত যদি না চাইতো তাতেও ভালোবাসার সন্ধানে মানুষ আকুল হতো না।’ আবার কোরানের বাণীতে সৃষ্টিকর্তার সাথে সৃষ্টির ভালোবাসার যে অনাবিল সম্পর্ক তা স্বার্থহীন এবং অপার্থিব। একে সবসময় ভাষা দিয়ে ব্যাখ্যা করা না গেলেও সুফি কবিগণ অজস্র শক্তিশালী শব্দ ব্যবহার করেছেন যা শুধুমাত্র কোরআন এবং হাদিসের উপর নির্ভরতা ছিলো না সেখানে নিজস্ব ভাষা বা ভিনভাষায় ও তারা সেই ভালোবাসা প্রকাশ করার উপায় খুজেছেন।

যখন ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসাকে অনুরাগ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয় সেখানে রোমান্টিক প্রেমের ভাষা নির্দ্ধিধায় আধ্যাত্মিক যাত্রা রূপক ভাষা হিসেবে অভিযোজিত করা যায়। সুফি কবিতায় আধ্যাত্মিক প্রার্থনাকারীদের সম্মেলন হয় তাঁদের বলা হয় ইশ্বরের প্রেমিক। যেখানে স্রষ্টা বিলাভড তথা অতীব প্রিয়পাত্র। সুফি কাব্য গান গাথায় স্রষ্টা তথা ঈশ্বরের সাথে তার বান্দার ভালোবাসাবাসির গভীর রূপে লীন হবার রূপটি স্বচ্ছন্দেই চোখে পড়ে । যেমন রুমি তার একটি কবিতায় বলেন- Lovers share a sacred decree– to seek the Beloved. They roll head over heels rushing toward the Beautiful One like a torrent of water.

প্রথম দিকে সুফিজমের বিষয়টিতে প্রেম জীবাত্মা এবং পরমাত্মার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। যেখানে স্বর্গীয় প্রেম এবং পার্থিব প্রেম নিয়ে দ্বিধান্বিত অনেকটাই। এই বিষয়টির উত্তরণ ঘটেছে– অব ধরণের যেমন প্রগাঢ় প্রেম, ঈশক, কোরআনে বহুবার উচ্চারীত হয়েছে। যেমন কোরআনে বহুবার হাবিব, মাহবুব ইত্যাদি শব্দ দিয়ে স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা নির্দেশ করা হয়েছে। আবার ইশক শব্দটি সূফী কবিতায় অজস্রবার উচ্চারীত হয়েছে। স্রষ্টার প্রতি প্রগাঢ় অনুভব, ভালোবাসা দিওয়ানা এবং একই সাথে স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা তবে সৃষ্টির প্রতি সে যেনো অপরিহার্য গুণ।

স্রষ্টার আদেশ নির্দেশ পালন অথবা কৃতজ্ঞতা প্রকাশই শুধু মাত্র ভালোবাসার প্রকাশ নয়। আবার এমনও নয় যে তার উদ্দেশ্যে নিজে সন্যাসকে ব্রত হিসেবে নেয়া।এটি না অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন না রমন অথবা সম্ভোগের আনন্দ কিন্তু তীব্রতম ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দয়িতের এবং ভালোবাসা তো আসেই প্রতিক্রিয়ার ফল হিসেবে।

ভালোবাসাকে পুনরায় ইশক নাম দেয়া এবং প্রথম দিকের সূফী কবিগণ কোরানের সমৃদ্ধ ভান্ডার থেকে ভালোবাসা ঈশক নানান নাম এবং অনুভুতির ছায়ায় নতুন নতুন নাম দিয়ে সমৃদ্ধ করলেন। পরমাত্মার প্রতি মিলনের আকাঙ্ক্ষাকে রাবেয়া বসরী অন্তরাত্মার মিলনের তীব্রতম প্রয়াসকে চতুষ্পদী শ্লোকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেন– Two loves I give thee, love that yearns. And love because thy due is love. My yearning, my remembrance turns To Thee, nor lets it from thee rove.

এখানে রাবেয়া স্রষ্টার প্রতি তীব্রতম ভালোবাসাকে প্রকাশ করেছেন নিজের ভেতরে এবং যে প্রেম দায়িত্বের ভেতরে অথবা কর্মের ভেতরে নিহিত থাকে সেটি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট রাখা– যেমন Chittick লিখেন- Love pertains to the experiential dimension of Sufism, not the theoretical; it must be experienced to be understood. Sufism connects experiential knowledge to the belief that nothing is dearer to God than that man loves him.

সুফিজমের সাথে অভিজ্ঞতার একটি সংযোগ রয়েছে এবং সুফিজম বিশ্বাস করে যে স্রষ্টার ভালোবাসার সাথে অন্য কিছুর তুলনা হয় না। মিস্টিক কবি রুমির সময়কালের ইউনুস ইমরির বয়ানে তোমার ভালোবাসা আমাকে আমা হতে ছিন্ন করেছে যাকে চেয়েছি কামনা করেছি সে তুমি দিন রাত জ্বলেছি দাবানলে

তুমি কোথায় হে ঈশ্বর ইউনুস ইমরির নিকট ভালোবাসা সবচাইতে শক্তিশালী। যখন ভালোবাসাকে গভীর আবেগের সাথে বর্ণনা করা হয় এবং মেটাফরিক ভাষায় ছন্দ উপমা উতপ্রেক্ষার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় অদৃশ্য সেই আধ্যাত্মবাদের দিকে অসীমের যাত্রা বখরা দিয়ে হুকুমত করো অথচ খুজছো তোমার প্রেমিক তোমার পদ্ম পাতায় ছুয়েছে আমার মাথা খরস্রোতা জল আমি অরূপে রূপ খুজে ফিরি (রুমি ) এখানে স্রষ্টাকে দুটো অভিধায় অভিষিক্ত করা হয়েছে।

প্রথমত তিনি সুন্দর– দ্বিতীয়ত এই কবিতা স্বাভাবিক ভাবে প্রেমের কবিতা হিসেবে ধরা যাবে। এখানে রুমি যা করেন তা হলো তিনি দেখান যে ভালোবাসার এই যে বোধ তা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। যে পুত পবিত্র প্রেম এখানে একই সাথে সেটি তাঁর দেয়া নির্দেশও এবং এই ভালোবাসা খরস্রোতা নদীর মতো প্রবাহিত হতে থাকে। অন্য একটি কবিতায় দেখা যায় যদিও সেটিকে মনে হবে প্রেম এখানে চর্চিত হয়েছে বেশী এটি আসলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভালোবাসা নির্দেশ করে। সুখের দিনে হৃদয়ের অর্গল খুলে দেয় মেঝেতে দু’জন নেশাতুর ওয়াইন বন্দী ব্যপক রূপে দেখলাম এবং ছিলাম ছুয়ে আমার সমস্ত মুখ হয়ে গেলো চোখ সবগুলো চোখ ক্রমশ হাত- যদিও কবিতায় প্রচলিত প্রতীক ব্যবহৃত হয়েছে– যেমন মদ্যপান হলো আধ্যাত্মিকতার প্রতি তন্ময় হওয়া– যেনো শরাবুন তহুরা পান করা– এবং কবি একই সাথে ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং আধ্যাত্মিকতার চর্চা করেছেন। রুমির এই বোধের সাথে অন্য কোনো কিছুর তুলনা করা যেতে পারে না। কারণ অর্থের ভেতরে রয়েছে গুড়ার্থ , অবগুন্ঠনের ভেতর রয়েছে অবগুন্ঠন। অনুবাদক জোনাথন ওটার মনে করেন অন্যান্য সূফী কবিদের মতোন রুমিও তার কবিতায় গভীর ভাবে যে কথাটি বলতে চেয়েছেন সেটি একটিই গল্প– যেখানে আত্মা খুঁজে ফেরে তার প্রেমাস্পদকে। রুমির নিকট ভালোবাসা অথবা ইশক এর দুটো রুপ রয়েছে। যেমন প্রথমত মানব মানবীর মধ্যে প্রেম হতে পারে এবং দ্বিতীয়ত যেটি সেটি হলো প্রকৃত ভালোবাসা– Love left toward God রুমি কোনো একটি শ্লোকে বলেন– প্রেম সৃষ্টার প্রতি ধাবিত– অথচ স্রষ্টারতো কাউকে প্রয়োজন নেই ।

ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে অন্য যে প্রেম তা ক্ষণস্থায়ী অথবা আকষ্মিক। Love be it real or metaphorical Ultimately takes human to God দুটো শ্লোকে বলেন সুফিজমের দুটো বেসিক বিশ্বাস পাওয়া যায়। প্রথম শ্লোকে প্রেম ঈশ্বর আরোপিত এবং দ্বিতীয়টিতে Love takes human to God প্রেমই প্রমাষ্পদকে ঈশ্বরের দিকে ধাবিত করে। যেখানে কুরআনে বলা আছে– প্রেম স্রষ্টার আরোপিত আবার অনেক সুফী মনে করেন আধ্যাত্মিকতার দিকে যাত্রাপথে স্রষ্টার সাথে মিলনের যে আকাঙ্ক্ষা– সেই মিলন পথের যাত্রার পথিক মানব/মানবী মসনবী রুমির অনন্য মাস্টার পিস এখানে রুমি বলেন God is primarily known through love এবং ইসলামে বলা হয় God is love কিন্তু প্রেমই স্রষ্টার একমাত্র চাওয়া নয়। তিনি ক্ষমাশীল , জ্ঞানের আধার , জীবন শক্তি এবং ইচ্ছের মালিক। সকল উপাদানের মধ্যেই তাকে পাওয়া যায় বা দৃশ্যমান হয়। অথবা বলা যায় পার্থিব অপার্থিব, সুক্ষ্ম, গোচর এবং অগোচরের সকল সৌন্দর্য তার মধ্যেই বর্তমান এবং সেখানেই দৃশ্যমান– এটি হৃদয় স্বীকৃত যে “কবি ঈশ্বর সর্বত্র স্বীকৃত। যেমন Annemarie Schimmel বলেন– কোরআনের একটি আয়াতে আছে যেদিকেই ফেরা হবে ঈশ্বরের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যাবে। সবই যেনো ঈশ্বরের মুখ।

Schimmel তাওহীদ তাদের ব্যাখ্যা শুরুহয়েছে “দুই জোড়া ওয়াইনের উপর্যুক্ত প্রতীকবাদ ব্যবহার করে। যেমন তিনি তার বান্দাকে ভালোবাসেন। আবার বলেন ভালোবাসা হলো আশা-নিরাশা এবং প্রয়োজন। আবার স্রষ্টার ভালোবাসা তার নবীর প্রতি বার বার উচ্চারীত হয়েছে এবং স্রষ্টার ভালোবাসা শেষ নবীর প্রতি এবং সৃষ্টির ভালোবাসা স্রষ্টার প্রতি এবং তার ভালোবাসা নবীর প্রতি। মোটের উপর স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করতে তার মাহবুবকে ভালোবাসর কথা বার বার এসেছে এবং এখন বলা যায় যে স্রষ্টা ভালোবাসেন তার প্রিয় নবীকে। নবীর প্রতি স্রষ্টার ভালোবাসার প্রাবল্য– যেমন একটি কবিতায় রুমি লিখেছেন- But for thee I would not have made the celestial spheres.

কারণ ভালোবাসা চায় তার প্রমিক/প্রেমিকার কাছে শুধুই নিষ্কাম বিশুদ্ধ ভালোবাসা। ভালোবাসাই কাম্য এবং প্রয়োজন। আবার দেখা যায় খোদা এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তার নবীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্যই শুধুমাত্র এবং বলেন- But for thee I would not have made the celestial spheres. আপনি না এলে পৃথিবীতে আমি কিছুই সৃষ্টি করতাম না।

মোটের উপর স্রষ্টার যে অবিরাম ইচ্ছের বহিপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় – নবী এবং তার প্রিয় বান্দাদের জন্য তার ভালোবাসাকে প্রকাশ করার জন্য তিনি এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং এই যে সমস্ত পৃথিবী তৈরী হয়েছে, ঘুরছে আপন অক্ষপথে শুধুমাত্র ভালোবাসার জোরেই।

রুমি লিখেন, The creatures are set in motion by Love, Love by Eternity-without-beginning; the wind dances because of the spheres, the trees because of the wind. এবং যখন আমরা সূফী কবিতা পড়ি এবং এই যে অসীমের দিকে যে যাত্রা সে সূফী কবিতাগুলোতেই পাওয়া যায় এবং সূফীবৃন্দ সেই অনন্ত অসীমের যাত্রী।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড