• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আবেগ ও মননশীলতায় উজ্জীবিত কবি

  মামুন মুস্তাফা

০২ জানুয়ারি ২০২০, ১৩:৪১
কবিতা
ছবি : কবি বঙ্গরাখাল

স্বাধীন বাংলাদেশে জনমানুষের স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক-সামাজিক-নৈরাজ্যের ব্যাপক ও ক্রমবর্ধমান প্রভাব অনেকখানি প্রতিফলিত হয়েছে নব্বই দশকের কাব্যউদ্যানে। সুতরাং নব্বইয়ের কবিতায় নতুন প্রতীক-উদ্ভাবন, বিজ্ঞানমনস্কতা, তত্ত্বগভীরতা, শিকড়-ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কার প্রচেষ্টা থাকলেও সেখানে উপমা-উৎপ্রেক্ষা-প্রতিরূপক কবিসত্তার অহং ও সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞাকে চারিত্রমণ্ডিত করে না বরং বিকেন্দ্রিক ও অনিশ্চিত করে তোলে এবং শব্দকে গ্রহণ করে অর্থচ্যুতির স্বেচ্ছা সংকল্পে। যদিও নব্বইয়ের তরুণ কবিদের মধ্যে এমন ধারণা সুস্পষ্ট যে এ-সময়পর্বের কবিতা পূর্ববর্তী কাব্যাদর্শ অতিক্রম করে নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টির পথ তৈরি করে চলেছে। এদেরই কাব্যাভিমুখে এসে নব্বই পরবর্তী শূন্য দশকের কবিরা যেন হোঁচট খেলেন।

শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশের কথার সূত্র ধরে বলতে হয়, একটি সৎ ও মহৎ সৃষ্টির ভেতরে মানবজীবন ও পরিবেশের প্রতিচিত্র ধরা পড়ে। কবিতার মধ্যে কৃত্রিমতা থাকলে তা আর শেষ পর্যন্ত ভাল কবিতা হয়ে ওঠে না। নব্বই দশকের পথ ধরে পরবর্তী শতাব্দীর প্রথম দশকে যেসব কবির আবির্ভাব ঘটলো তাদের ভেতরেও কবিকৃতির এক ধরনের উগ্রতা দেখা গেল। কিন্তু তাদের পূর্ববর্তী অগ্রজ কবিদের থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল কবিপ্রতিভা এখনও সময়ের ব্যাপার।

ইতোমধ্যে বর্তমান শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক চলছে। এ দশকেও আরো কিছু নবীন কবিদের দেখা মেলে। যাদের শব্দশিল্প, অনুভবভেদ্য চিন্তাশৈলী নিজস্ব কাব্যভাষার নির্মাণের অভিঘাতে শিল্পিত হয়ে উঠতে দেখি। নতুন শতাব্দীর এসব কবিগণও বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য থেকে সরে আসেননি বরং শিল্পের দায় স্বীকার এবং এর চাহিদার সঙ্গে মানবিক উৎকর্ষতা সন্নিবেশনে ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী। তাদেরই একজন কবি বঙ্গ রাখাল।

এই কবি সময়কে জীবনের অনুষঙ্গ মেনে চিত্তের মৌনতা ও দ্রোহকে কবিতার ক্যানভাসে তুলে আনেন যা যাপিত জীবনের পরম্পরা ও সমূহ সত্যটিকে নিবিড় পর্যবেক্ষণসহ উদ্ভাসিত করে। কবির মনোজলোকে কামনাবাসনার জটিল আবর্তে তাকে পরিগ্রহ হতে দেখি। তখন কবিতা হয়ে ওঠে রূপবিশ্বের অমেয় আধারের শক্তিশালী এক রূপকল্প। তবে এ বিষয়টি কবি বঙ্গ রাখালের গদ্যফর্মে লিখিত কবিতার মধ্যে বেশি পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিগণ নিরীক্ষাপ্রবণও বটে। বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উত্তর আধুনিকতাকে ধরতে গিয়ে এ সময়ের কবিরা নিরীক্ষার আশ্রয় নেন। ফলে বিশ্বমানবতার জয়গান করতে গিয়ে মতাদর্শবিহীন গন্তব্যকে ছুঁতে পথ হাঁটেন তাঁরা। একুশ শতকের শূন্য দশকের কবিদের যদিও রয়েছে প্রচ্ছন্ন যুগসৃষ্টির অন্বেষাকাক্সক্ষা, কিন্তু তাঁরা কতটুকু উতরে যেতে পেরেছেন তাও বিবেচ্য বিষয়। আর তাই পরিবর্তন প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে প্রচলিত ভাবনার সাথে নতুন চিন্তার সংঘাত এঁদের কবিতায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। বঙ্গ রাখালের কবিতাকেও কখনো কখনো উদ্দেশ্যহীন ভাবে গন্তব্যমুখি হতে দেখা যায়। এই দ্বন্দ্ব মূলত কবির দৃষ্টিভঙ্গিগত এবং সামষ্টিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে স্পষ্ট। সাম্প্রতিক কবিদের কবিতার নিবিড় পাঠে এই সত্য নিদারুণ ভাবে উঠে আসে। তথাপি বঙ্গ রাখালের কবিতায় মা-মাটি-মানুষের গন্ধ যে নেই তা বলা যাবে না। বিশেষত এই কাব্য লণ্ঠনের গ্রাম-এর ‘পদ্মপুরাণ : অর্ধেক জীবন অর্ধেক ছেদন’ পর্বের কবিতাগুলোতে তা প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। আসুন বঙ্গ রাখালের কিছু কবিতা পড়ে আসি...

সাধুঙ্গম ব্রিজের তামাশা দেখতে দেখতে সামনের দিকে হেঁটে যাই পলাশ গায়ে রূপসীনদী। জলের ভেলায় মাছেরা গঙ্গাবতী শয্যা পেতে, মায়ার আকাশ শুষে নেয় সর্বনাশের স্বৈরাচারী ঠোঁট। চৈত্রের হাওয়ায় ঝিনুকদহের নদী গোগ্রাসে গিলে খায় পারফিউম সাধুর সঙ্গমডায়াসী হাসি।

নীলকণ্ঠি আমি - অনেক নৈকান্তিক বেআব্রু আত্মার লাশ খুঁজি মর্মান্তিক মাটির গহীনে। লোবান, আতরের দৃশ্যে ঘোড়া হাঁকাই হাড় আর প্লাটিনামে বেসুরো পথ। চোখের পাতায় প্রেমিকা সুতীব্র ঘোষক সেজে- কান্নার স্বর খুঁজতে খুঁজতে হয়ে যায় বনহংসির মায়াবী নদীর কিংবা মাছদেহে লেগে থাকা চোখ, মাটির পুতুল ভেঙ্গে সাধু, খেয়ে যায় প্রেমিকার পবিত্র শরীর।

শহর মন্দাক্রান্ত শহরের বামদিকে, পাতকুলীনের নিরোধ বাহুতে- অষ্টাদশীর রক্ত ছড়ানো গাঁজার ধোয়া। লাজুক মেধাবী মেয়ের বুকের কাছে- নিরন্তর পাতিঘুঘুর ঘুমভাঙ্গা সকাল। আস্তিনে চড়ুই প্রতীকী হাত ঝুলিয়ে কুষ্ঠের হাসি হেসে আবগানি হয়ে ওঠে। অন্যরকম আরব্য ইতিহাস মাথার নদীতে সাঁতার কেটে স্বপ্নের ফেরি করে। সুঠামদেহী ইতিহাস মামা খোকন সোনা বলে ঠায় দাঁড়ায় প্রাচীরে, আত্ম জিজ্ঞাসার মুখোমুখি। আমি ভাষার পরিভাষা জানতে পাথরের দেয়াল ঘেষে ক্লান্ত মুখে দ্রুত গল্প বলি আর শহরের নরম গণিকা নারীর ব্রার মধ্যে ঢুকে যাই জলসার অবিশ্বাস্য বিষণ্ণ বাবু।

চোখ তুমি চলে যেও রাতের অন্ধকারে শিয়ালের চোখে খুঁজে নিও প্রতারনা সঞ্চয় আর গভীর রাতে চিৎকার দিয়ে বলো বেদনার রাতে শকুনের চোখে তাকাতে নেয় কেননা সেই চোখ পোড়াই আর জলে ভাসায় নির্বাক প্রতীক্ষা।

টুকে নেও জীবন নোট নিঃসঙ্গ পৃথিবীর রোগশয্যায় মহাপিতা, ঐশ্বর্যের প্রতীক ঝুলিয়ে দৌঁড়ে গেলেন মাঠের দিকে- জানা নেই বিষাদের ভাষা কিংবা স্মৃতির মিনারে অপ্রকাশ্য আকাশপাখির সময় হারানো সুলতার চিঠি, স্বপ্নচাঁপা কুসুমরাত্রির নদী হয়ে যাওয়া গল্প... বাঁশির সুর চুরে করে পাখিদের ঠোঁটে ওঠে মাউথওয়ার গানের চাঁদবুড়ির চর্কাকাটা গল্পের বিম্বিত আয়নার উঠপাখি, অলিন্দে আরশিনগরের পড়শি ফিস ফিসিয়ে বলে- টুকে নেও জীবনের নোট।

আস্ফালনটুকু মিথ্যেয় ছিলো আগুন জ্বেলে নাগরিক মেয়ে জ্বালিয়ে দেয় পৃথিবীর শীত। জ্বলন্ত সূর্য্যও আগুনকন্যার চিরন্তর চোখের মধ্যে জাকপ্রেভের কিংবা সিমন দ্যা বোভোয়ারের জীবন তুলে দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজিয়ে স্বজনের নাম ধরে ডাকে- নারীও চোখে রাখে বেঁচে থাকার পয়গম্ব, যতক্ষণ না আন্নার বাড়িতে ফোঁটে বিষণেœর নিষ্ঠুর নাক্ষত্রিক বোকা আয়ভান।

জীবন কেমন ছিলো হাঁসপাখির ক্ষুধার্ত পেট তুলে ধরে কাঁপনের গ্লাস। শঙ্খধ্বনির ঝাঝালো সুর- কাকিমার মনে তোলে কাকার কাঁপন। স্মৃতির অতীত গেরুয়াপ্রলাপ কানে গোজে হলুদের জলভরা প্রেম- মন্দিরে মন্দিরে আঁছড়ে মারে জলউদ্ভিদের কৃষাণীজীবন।

নিঃসঙ্গ নদীর বুকে জলের নৌকা কাঠের চৌদিকে নদীদের ঠোঁটের শেষ প্রান্তে- পাখিদের ফল খাওয়া আলোয় ঘুমায় টেবিলের ঘুমন্ত শৈশব আর ময়নাপাগলের মাজারে লোবানজ্বেলে কায়েসপাগলা দৃশ্যের অভিনয় করে- বাহুর চৌদিকে চাদর ঝুলিয়ে- শ্রীযুক্ত শ্রমজীবী-মাইলের পর মাইল হেঁটে বুকের মন্দিরে জ্বালায় বাবার আরশিকদহন- বাবা স্বপ্নচৈত্রের মাঠ।

লোকমুখে শুনেছেন- ঠোঁট তার জীবন্ত কুমড়ো ডালের বড়া। সন্ধ্যারাতে স্বজনহারা পাখির ঘরে ফেরা হাহাকারী জীবনেও ক্লান্তির হাসি- মুছে ফেলে কারিগরি চোখের পাতা- মাকে বলে শাড়ীর নীচের জীবন লুকিয়ে রাখিস- পাহাড়ও ইতিহাস বদলে বাজতে পারে নিঃসঙ্গতার ভূমিনূপুর।

মুগ্ধ নির্জতায়- হোসেন লিপি কামারশালার নিভন্ত যৌবনে যে কবি বুনে যায় মুক্তিযুদ্ধের গান তার কবিতা খাতায় জমা হয় বিসর্জনের চরিত্র। কখনো পাড়ার বউরা মাথার ঘোমটা তুলে যশোদার ছেলের হাতের কাছে রেখে যায় লোবানের ঘ্রাণ। স¤্রাট ঘুমায়- আমলকী বাগান নিমজ্জিত হয়। একদা মাঠের সোনালী আঁশ বুকে রেখে বুক সাধুহাটির মানুষদের হয়ে বিনিদ্রায় কাটায় রাত। রাত নিজের মানচিত্রকে চিনিয়ে দেয়। গায়েনের মুখে বিমর্ষস্বদেশ। পা-ুল হয়ে আছে মাটির উত্তপ্ত পৃথিবীবায়ু। ভেতরে ভেতরে গহীন হাহাকার। ক্ষয়ে যায় জুতার তালু। নতমুখে যে কবি নাগরিক আলোয় দেখে নেই- সন্ন্যাসীমুখ। বদলের হাওয়ায়- কখনো কখনো বদলে দেয় প্রিয় বধূর উন্নাসীচোখ। গত রাতেও জেগে জেগে গল্পের প্লট সাজিয়ে ধানচারারা আগাম বার্তা পাঠায় মরালের কাছে- কী করে আয়নায় দেখা যাবে মুখ? মরালের জ্বর। কফিনে মোড়া গল্প আড্ডায়, শোনা যায় ডাক- হোসেন, হোসেন, হোসেন।

বালিকার জলে বৃষ্টি ঝরে তোমাদের পানাপুকুর জুড়ে মাছদের বাস হলেও, ক্ষমতাশালীদের পাতা মোড়া দেহ ভেসে থাকে জলের ওপর আর বৃষ্টিস্নাত সকাল ফেরি করে পাড়ার বালিকাদের কান্না ঝরা চোখের জল... বৃষ্টির মেলে ধরা শরীর বালিকার নিরেট চেহারা ভাজে নির্জনতার পাহাড় হয়ে কণ্ঠে ধরে বৈরাগ্যের ফিকির...

অভিজ্ঞ পুকুর সর্বনাশা বর্ষণে পাতার শরীরে তোলে শিশ্নের আবেগী চুম্বন

নেড়ে যায় মাথা বিদ্বান পাতা হাজার বছর।

প্রিয় অন্ধতা আমার প্রিয় অন্ধতা আমার,বাবারও প্রিয় কালো রং। আন্ডারগ্রাউন্ড পিতা রাতের আঁধারে চষে বেড়াতেন মানুষের জীবন। সেই বুঝহীন সময় থেকেই অন্ধকার ভালোবসি। বাবার মত আমিও রোগী-রোগশয্যায় বসে পলাতক কুকুরের মত শ্যাওলা ধরা স্বপ্ন মাথায় গুজে আমি এখন রাত্রির অন্ধকারে পৃথিবীর পথে পথে হাঁটি-আঁচমকা অন্ধগলি ঢুকে যাই বুকের মধ্যে আর ল্যামপোস্ট থায় দাঁড়িয়ে বুকের মধ্যে শূন্যতা পুষে জ্বালিয়ে দেয় বাতি।

পদ্মকে মরণের মত ভালোবাসি, কোটিদেশ জড়িয়ে ধরে শুষে নেয় ওর বুকের উত্তাপিত ঘ্রাণ। গলা শুকিয়ে কাঠ।ক্ষণিক আলোয় চোখে, পিঠে পেচিয়ে ধরে কামনার বিষাধর সাপ। অসহ্য যন্ত্রণায় বিস্ফারিত বুক ফালি ফালি হয়।তাবুর নিচেয় অন্ধকার নৌকা পার করে ‘নিঠুর দরদীয়া বন্ধু রে’...এই সুতীব্র ভালোবাসাকে পদ্ম দুর্বলতা ভেবে-কাছে ডেকে ছিল গভীর অন্ধকার রাতে আর রাতের আঁধারে পেটিকোটের পাড়ছেঁড়া ফিতের গিট খুঁলে অন্ধকারকে বিদ্ধফলার মত বুকের মধ্যে গেথে নিয়েছিল। কপালের ঘাম মুছিয়ে আমার বড় চুলে হাতের আঙ্গুল দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছিল অন্ধপল্লির আশফাশ জীবন।সব কি ভ্রান্তি, সব কি ভুল, নাকি কুহক মায়ায় ও আমাকে কাছে ডেকে ছিল। আজ ওর বুক জুড়ে অন্য কেউ ঘুমায়। অন্য কেউ ওকে আজ অর্চনা বলে ডাকে। একদিন আমিও ছিলাম ওর বুক জুড়ে-দুফোটা চোখের জল আর অব্যক্ত কথার ঝুলি আজ ওর ঢ্যাবকা চোখে জাগায় আস্বাদের নীলচর। হাই রে নারী তুই বেসিয়ার নিচেয়ও লুকিয়ে রাখিস ছলনার বহুরূপী ছল।

ভালোবাসা তোমাকে এতটাই ভালোবাসি যে, তোমার চলার স্নিগন্ধমিহি পদচ্ছাপের ক্রন্দনধ্বনি আমার জীবন্ত করে তোলে আর স্বপ্নোচ্ছ্বাস জাগায় মনের মধ্যে যা বাঁচতে শেখায় আমরণ তোমাকেই ভালোবেসে।

হেঁটে যাবো দুজন পথ প্রিয় এক স্বদেশী ফটো চোখের সামনে ধরে- ভাবি বহুদূর ভবিতব্য ভাষা। গহীন অরণ্যের অসম্ভব কষ্টের হাসিও হেসে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছি বুকের ভার। বিস্মৃতির পাহাড় বুকের কোণে আলপিন হয়ে হেঁটে চলে নৈপূন্যের ছলে। গতবছর রমজান মাসে তোমার শরীরি ঘ্রাণ পেয়েছি ফুলের টবে, গ্রামের গাছে কিংবা আমার বিছানা- শার্টে। অদ্ভুত ঘ্রাণ- স্তনের ডগায় চাঁদের ফোঁটা অবিরাম ভেঁজায় আমার যৌবনকাল। যখন বোনের ঘামাচি ভেবে গেলে দিয়েছি লালচে জাদুভেলকির বাকসবন্দি সকাল। তবুও তুমি অবারিত দুঃখ বুকে চেপে মমতায় ছুঁয়ে গেছো আমার শরীর। এখনো ভাবি- তুমি ভেবো না, আবার আমরা হেঁটে যাবো দুজন পথ...

কচ্ছপ ওড়নাস্কার্ফ মুড়িয়ে পথে পাতাদের গজিয়ে ওঠা সোনালী ভোরের ভাঁজে লুকানো থাকে নদীদের বিবেকী আয়নায় গতরীগহর। তোমার জোসনায় ওড়ানো খোঁপাহীন চুলে ধ্রুবউচ্চারণ ডিমের খোসায় রেখে দেয় কাজলরেখার অশ্রুসিক্ত চোখের রাক্ষুসী মানবীশরীর। মা রান্না ঘরের আগুনে লুকায় সেমিটিক ভোরের স্নিগ্ধগোলাপ আর হাওয়ায়বাজিরাত মাঠের শরীরে জাগায় হাইব্রীড কচ্ছপ...

বুবুজান, বাবার একই স্বার্থ আপা, তুমি জেনে রেখো যারা রাস্তায় নামে নিজেদের দাবির শতভাগ আদায়ের আগুনবৃষ্টি ঝরিয়ে, তাদের ঘরেও চলতে থাকে-একুশ ইঞ্চি রঙিন কালার টিভি। অরণ্যের কাছে তারা ডুবন্ত দেহ ঝুলিয়ে ছুঁটে আসে, কুঁচ লুকানো মায়ের নারিকেল তেল, বোতলের কাছে। মা নারিকেল তেলের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে বোতলে কুঁচ পুড়ে রাখতেন আর হৃদয়ে পুষে রাখতেন পিতার চলে যাওয়া পথের চিহ্নিত আচড়ের দাগ। অজস্র চুম্বনের রেখা কিংবা সীমারেখা মা,বাবার জন্য লুকাতো ভ্যানিটিব্যাগের উত্তপ্ত ছায়ায়।বাবার পায়ের কাছে কল্পনাতরু জিরাফের ভালোবাসা হয় আর মায়ের আসন তোমার আর আমার মত সাফামারওয়া পাহাড়ের ন্যায় ছোটাছুটি করে-দু’পায়ে লুকানো উজ্জ্বল মুহুর্তে খুঁলে যাওয়া সেলফোনে,বেজে ওঠা রিংটোনে, ভিজে যাওয়া চোখের পাতা।

পদ্মকে নদীর ইষৎ কল্পনায় মাটির চোখে জ্বলে ওঠে আলতারাঙানো নিথর পা। সেপায়ে জড়ানো নুপূর। লালশাড়ীর ভাঁজে ভাঁজে নূরের আগমনী ধ্বনি। ছল ছলিয়ে ওঠে নদীর ঢেউ। তৃষ্ণার্ত নূর নিঃশব্দে ঝুকে পড়ে-পদ্মের বুকে।ঘুমে ভেজা চোখের পাতা আর নেশাচুর রং চুয়িয়ে চুয়িয়ে পড়ে পদ্মের শরীর। সদ্যফোটা ব্রা’র নিচেয় সৌন্দর্য্যের ডালিম ছড়ায় সুঘ্রাণের হরিণীঘ্রাণ।নখর দেখিয়ে যে জানোয়ার প্রতিরাতে ধর্ষণ করে পদ্মের আনন্দোচ্ছ্বাস কিংবা তিলে তিলে গড়ে তোলা অরুপগল্পের ভেসে আসা সাম্পান। পদ্মের নদী জুড়ে অসুখ।সেই সাম্পানে আজ হন্তারক যাত্রী-ঝেপে ঝেপে মেপে নেয় বীর্যের গতি।

আজন্ম নিষেধের দিকে... মদের বোতল পদ্ম হাতে রেখে-বাবা সিগ্রেট ঠোঁটে নেয়।অতঃপর আয়নার সামনে নিজেকে দেখে-কালো শার্টে জাড়ানো শরীর-খণ্ডিত হয়ে ওঠে জোসনায় রক্তাক্ত। গরুর মাংসে ডুবে যায় রাতের বহুজাতিক ভালো লাগা আর ভালোবাসার তুমি আর আমি। নেইলপলিশ বন্ধুরা ইশাদের গলায় কিংবা খোঁপায় তুলে দেয় পুষ্পজুতা যেমন একাধিক প্রেমিক এই পুষ্প পরিয়েছে তাদের প্রেমিকাদের প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে। যারা ঝাঁপির স্বর্পে মাতাতে চায় রাষ্ট্রের অশান্ত বিকেল কিংবা দৃষ্টির সবুজ চোখ, অরণ্যের শহর দেখিয়ে ইশাদের নেতা বানায় আবার অন্ধ রাতের ছায়ায় সিগ্রেট বানিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে ঠোঁট বাকিয়ে।তীক্ষ্ম বুকের ব্যথায় উড়ে যায় সারস, বিছিয়ে রাখা আপাদের বিছানায়-গল্প বলার কৌনিক অপঠিত গল্প।

রাষ্ট্রযন্ত্র অনেকটা ভালোবাসাহীন স্বামীর মত। যেমন করে ভালোবাসার পরিবর্তে ধর্ষিত হয় প্রতিরাতে নারীর প্রত্যাশিত আবেগী মন। হৃদপিণ্ডে নড়ে-চড়ে ওঠা গভীর আকুলি-বিকুলি সুরেলা খেলা করে, আমার রাষ্ট্রকে রাত্রবলার অস্বস্থির অভিমান। ক্রুশবিদ্ধ রাজাও জানে না, রাষ্ট্রের অধিকার তাদের হাতে নেই, তোমাদের স্ত্রীদের জঙ্ঘা কিংবা ঘাটলার অধিকার আজ বহুজাতিক পুরুষের হাতে, তারা নির্মম গতরে সুযোগ বুঝে বাড়িয়ে দিবে শরীরী উত্তাপ।

আমি জেনে গেছি বুদ্ধের হর্ষবিষাদের মুখোশ্রীর কালো কালিমার মানে।তাই অরন্যাচারী হয়ে হাঁটতে চাই-নিষেধের দিকে। মা হাওয়ায় শ্রেষ্ঠ নারী, যে আমাকে গন্ধম খাইয়ে মুক্তি দিয়েছিল আর এর চেয়ে বড় শিল্প কিই বা হতে পারে-শরীরে ভিতরে শরীর রেখে আমরণ জ্বলন্ত মুদ্রায় আমি ঠোকর খেয়ে র্দীঘতায় হাঁটছি পথ...

‘কাজলরেখার অশ্রুসিক্ত চোখের রাক্ষুসী মানবীশরীর’, ‘রাধার মনে চূড়ান্ত বর্ষা এলে/কৃষ্ণের চোখে ভাসে ধানবীজ’, ‘ভেজা চুলের জল কি এখনো গড়িয়ে পড়ে তোমার শরীর বেয়ে’ - এসব বাক্য নির্মাণ বলে দেয় কবি বঙ্গ রাখাল বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারায় এ ভাঁটিবাংলার মানুষের জীবনচরিত আঁকতে চেয়েছেন। তবে কবি বঙ্গ রাখালের পাঠকেরা এটুকু আবিষ্কার নিশ্চয়ই করবেন যে, তার কবিতা দুরূহ হয়ে উঠেছে। কবিতার ক্ষেত্রে তাঁর এই আড়াল আরোপিত নয়, বরং সহজাত। সন্দেহ নেই বর্তমান সময়ের কবিতা আকাশ ছুঁতে গিয়ে বা ‘রূপালি আগুন ভরা নক্ষত্রের’ দিকে আকাক্সক্ষার দৃষ্টি মেলে দিতে চেয়েই সার্থকতার কথা ভেবেছে। জীবনের নানারঙা ভাষ্য কতটা তাঁদের হাতে ধরা দিয়েছে কিংবা সেসব ভাষ্য তাঁদের আদৌ আকাক্সক্ষাকিত কিনা সেটা যেমন বিবেচ্য, তেমনি বিবেচ্য ব্যক্তিমনের অন্তর্লোক উদ্ঘাটনের চেষ্টায় কতটা গভীরে পৌঁছাতে সক্ষম তাঁরা। কবি বঙ্গ রাখাল তাঁর কবিতার দুরূহতার মতো এক্ষেত্রে নিজেই যেন দুর্বোধ্য হয়ে ওঠেন।

মূলত বাস্তব জীবনের চেয়ে জীবনের আলোআঁধারির কুহক বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিতার মনোযোগের কারণ হয়ে উঠেছে। সেই কুহকের বেড়াজালে নিজেকেও বন্দী করেন কবি। কিন্তু প্রতারক সময়ের কাছ থেকে নিশ্চিত প্রাপ্তি বুঝে না পাওয়ার কারণেই সম্ভবত বর্তমান প্রজন্মের কবিতা নৈর্ব্যক্তিক নিরাসক্তির শিকার- আর এটাই বর্তমান কবিতার প্রধান প্রবণতা। সেই প্রবণতার বিচারে বঙ্গ রাখাল একজন সার্থক কবি। কবিদের লক্ষ্য যেমন দার্শনিকতার, তেমনি বিজ্ঞানচেতনার নিরাসক্তির মধ্য দিয়ে অর্জিত কবিতার অনুভূতিকে রূপ দেয়া। সত্যের প্রকাশ যদি কবিতার একটি মুখ্য বিষয় হয়ে থাকে সেক্ষেত্রেও আবেগ ও মননশীলতার সমন্বয় ঘটানো সম্ভবত একালের কবিতার অন্বিষ্ট। সুতরাং বঙ্গ রাখালের কবিতায় পাঠক যেমন বিজ্ঞানচেতনার নিরাসক্তি খুঁজে পাবেন, তেমনি আবেগ ও মননশীলতার উজ্জীবনও উপলব্ধি করবেন।

বাংলাদেশের কবিতায় গত পাঁচ দশকে কাব্যচর্চার উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতা প্রবাহমান। সে ধারাবাহিকতার স্রোতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের কবি ও কবিতার উত্থান। জীবনানন্দ দাশ যে মহৎ কবিতা সৃষ্টির প্রতি জোর দিয়েছিলেন, তা লিখতে হলে প্রয়োজন ব্যাপক অভিজ্ঞতা ও পড়াশোনা। সাম্প্রতিক কবিতার প্রকরণগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে এই সময়ের কবিদের অধিক পাঠাভ্যাসের কোন বিকল্প নেই। আমার জানা মতে, বঙ্গ রাখাল সেই পাঠাভ্যাসের মধ্য দিয়েই আছেন। সুতরাং তাঁর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টির দ্বারাই একদিন তিনি তার কবিতার স্বাতন্ত্রিকতা খুঁজে পাবেন, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

কবির কোনো দশক থাকতে নেই। তবু কবিকে চিনে নিতে তার সময়কালকে উচ্চারণে বাধ্য হতে হয়। অতএব একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের কবি হিসেবে বঙ্গ রাখালকে কবিতায় নিজস্ব স্বর সৃষ্টিতে অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছুটা সময়। বঙ্গ রাখালের কবিতায় এমন কিছু উপাদান পাঠক পাবেন যা বলে দেয় বঙ্গ রাখাল ভবিষ্যতের কবি। তার কাব্যযাত্রা অক্ষয় হোক।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড