• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

মাহফুজামঙ্গল : কাব্যধারার এক নতুন মাত্রা

  শব্দনীল

০১ জানুয়ারি ২০২০, ১৪:৩২
ছবি
ছবি : মাহফুজামঙ্গল

মজিদ মাহমুদের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘মাহফুজামঙ্গল’ প্রকাশ হয় ১৯৮৯ সালে। কাব্যগ্রন্থটি হাঁটিহাঁটি পা পা করে ত্রিশে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। সময়ের বিচারে হয়তো খুব বেশিদিন নয় আবার কমও নয়। এই দ্বন্দ্ব কালের কাছে রেখে মধ্য যুগের দিকে তাকালে ‘মাহফুজামঙ্গল’-এর উৎপত্তি খুঁজে পাবো।

মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে মঙ্গলকাব্যের সূচনা। মঙ্গলকাব্যে দেবতার আরাধনা, মাহাত্য-কীর্তন করা হতো। বিশেষ করে হিন্দু দেবতা, যারা ‘নিম্নকোটি’ নামে পরিচিত ছিল তাদের মাহাত্ম বর্ণনায় রচিত হতো এই কাব্যগুলো। যা ধার্মিকদের শ্রবণে মঙ্গল এবং বিপরীতে অমঙ্গল হতো বলে ইতিহাসবিদেরা মনে করেন।

এবার প্রশ্ন আসতে পারে বিশ শতকের আশির দশকে এসে একজন তরুণ কবি মঙ্গল-অমঙ্গলের কী দেখেছিলেন যার জন্য মধ্য যুগীয় কাব্য বৈশিষ্ট্য এনে কবিতা রচনা করেছেন এবং কেনোই বা কাব্য গ্রন্থের নাম রেখেছেন ‘মাহফুজামঙ্গল’।

মজিদ মাহমুদ যে সময় এই গ্রন্থের কবিতা রচনা করেছিলেন তখন দেশ ছিলো অস্থিতিশীল। চলছিলো স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন। হতে পারে দেশের সাথে তিনিও কণ্টকময় সময়ে ছিলেন। ব্যক্তিপর্যায় থেকে সমগ্রতায় পরিবর্তন আনতে চাচ্ছিলেন। সেখান থেকেই দেবীবন্দনা নয় কিন্তু মাহফুজা নামে এক নারী শক্তি ও সৌন্দর্যে অনুরাগ পোষণ করে লিখেছেন ‘মাহফুজামঙ্গল’।

যদিও মাহফুজামঙ্গলের প্রকাশকাল আশির দশক বলাটা ঠিক হবে না। বলা যেতে পারে কাব্যগ্রন্থটির সূচনা লগ্ন। কারণ গ্রন্থটি যাত্রা শুরু করে মাত্র ২০টি কবিতার সমন্বয়ে এবং দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ১৪ বছর পরে তৃতীয় সংস্করণে (২০০৩) সংযুক্ত হয় নতুন একটি অধ্যায় ‘উত্তরখণ্ড’। এতে নতুন কবিতা স্থান পায় ৫৫টি। নয় বছর পর (২০১২) চতুর্থ সংস্করণে যুক্ত হয় আরো একটি অধ্যায় ‘যুদ্ধমঙ্গলকাব্য’। এ অধ্যায়ে যুক্ত হয় ৮টি কবিতা। তার মানে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে এই গ্রন্থ রচিত হয়। বর্তমান সময়ে যা ‘পূর্বখণ্ড’, ‘উত্তরখণ্ড’ ও ‘যুদ্ধমঙ্গলকাব্য’ পর্বে বিভক্ত। কাব্যগ্রন্থটিতে এই মুহূর্তে ৮৩টি কবিতা আছে।

গ্রন্থটি বিশেষ কাব্যধারার সৃষ্টি করেছে। যা তার বিষয়ে, আঙ্গিকতায় এমনকি অলংকারেও বিদ্যমান। গ্রন্থের কবিতাগুলোর দিকে চোখ রাখা হয় তবে দেখতে পাওয়া যাবে পূর্বখণ্ডে চৌদ্দ চরণ, উত্তরখণ্ডে পূর্বখণ্ডের চেও ছোট চরণের কবিতা এবং যুদ্ধমঙ্গলকাব্যে গদ্যরীতির ব্যবহার।

‘মাহফুজামঙ্গল’-এ একজন মাহফুজা বহুমাত্রিক ভাবের আধার। এখানে দেখতে পাওয়া যায় তাকে বহুবিচিত্র রূপে। মাহফুজাকে উপলক্ষ করে কবি লিখেছেন মনুষ্য জীবনের বহুমুখী বৈচিত্র্যের আখ্যান, ধর্মীয় অনুষঙ্গ, সুন্দর ও উন্নততর মূল্যবোধের উদ্দীপ্ত ইতিহাস।

মজিদ মাহমুদ সুফিবাদী বাউলের মতো সমস্ত ধর্মকে একপাত্রে নিয়ে এসে নিজের ভেতর ঈশ্বরের খোঁজ করেছেন। মাহফুজামঙ্গলে উঠে আসে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধসহ নানান ধর্মীয় মিথের ব্যাবহার। তিনি প্রচলিত মিথকে ভেঙে নতুন করে উপস্থাপন করেন তার কবিতায়। তিনি শিল্প-পদক্ষেপে সাহসী ও অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন। গ্রন্থের নারী চরিত্রটি কবির কাছে ঈশ্বররে চেয়ে গুরুত্ব মনে হয়েছে। তিনি মূলতো মানুষকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এই জন্য ‘কুরশিনামা’ কবিতায় বলছেন- ঈশ্বরকে ডাক দিলে মাহফুজা সামনে এসে দাঁড়ায় আমি প্রার্থনার জন্য যতবার হাত তুলি সন্ধ্যা বা সকালে সেই নারী এসে আমার হৃদয়-মন তোলপাড় করে য়ায় তখন আমার রুকু আমার সেজদা জায়নামাজ চেনে না সাষ্টাঙ্গে আভূমি লুণ্ঠিত হই ----------------------------- নারী পৃথিবীর কেউ নও তুমি তোমাকে পারে না ছুঁতে আমাদের মধ্যবিত্ত ক্লেদাক্ত জীবন মাটির পৃথিবী ছেড়ে সাত-তবক আসমান ছুঁয়েছে তোমার কুরশি..

অন্যদিকে তিনি নারী-পুরুষের প্রেমকে বলছেন ইবাদত। কারণ আমাদের পার্থিবে আগমনও ঘটে এই সম্পর্কে, এমনকি সুখের নির্জাস নিয়ে নিঃশেষ হই আমরা। তিনি এবাদত কবিতায় বলেছেন-

মাহফুজা তোমার শরীর আমার তছবির দানা আমি নেড়েচেড়ে দেখি আর আমার এবাদত হয়ে যায় তুমি ছাড়া আর কোনো প্রার্থনায় আমার শরীর এমন একাগ্রতায় হয় না নত তোমার আগুনে আমি নিঃশেষ হই..

মাহফুজা বা নারীকে সবাই নিরিবিলি পরিবেশে সান্নিধ্য পেতে চায়। কিন্তু এখানে কবি চেয়েছেন ভিন্ন ভাবে। ইসলাম ধর্ম মতে আমাদের দু’কাঁধে ফেরেশতা থাকে। মাহফুজার সাথে কবি ব্যক্তিগত সময় কাটাতে চেয়েছেন শুধু নিজের উপস্থিতিতে। কারণ, অন্যের উপস্থিতি হয়তো কিছুটা বিব্রতবোধে প্রেমের উপস্থাপন বা মাহফুজার প্রতি সঠিক ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারবেন না। তাই তিনি ঈশ্বরের কাছে আবেদন করছেন দু’কাঁধের ফেরেশতার ছুটির জন্য। তিনি আড়িপাতা কবিতায় বলছেন-

প্রভু তোমার ফেরেশতাদের কিছুদিন ছুটি দাও মাহফুজার সঙ্গে এবার আমি ঘুরতে চাই আমার ভ্যক্তিগত জীবনের মাঝে আর কাউকে থাকতে দিও না..

কবি মানব সৃষ্টির আদি কথা বলতে চেয়ে লিখেছেন বল উপাখ্যান এবং আপেল কহিনি। এই দুটি কবিতার দিকে লক্ষ করলে দেখতে পাবো সৃষ্টির শুরু এবং বিকাশের লক্ষ্যণ বিদ্যমান। তিনি আপেলকে শুক্রাণু বা ডিম্বাণুর সাথে তুলনা করেছেন। তিনি আপেল কাহিনি কবিতায় বলছেন-

সৃষ্টির শুরুতে তুমি একটি অখণ্ড আপেলের মতো ছিলে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তোমার রক্তিমগণ্ডের আভা অরণ্যের মধ্য দিয়ে হাজারো গিরিপথ অতিক্রম করে তুমি সমুদ্রের দিকে নামতে থাকলে

কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতার উপমা ও প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন নানা নাম। যা অলংকরনে কবির মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। এই সকল নাম বা প্রতীক ব্যবহারে তিনি শুধু দেশীয় শব্দের মধ্যে থাকতে চাননি। ব্যবহারও করেছেন অনেক বিদেশি শব্দও। যেমেন এবাদত কবিতায় নব্য-ইসমাইল, দেবীতে ইংর‌্যান্ডের রাণী, মাতাল ডোমে ন্যান্সি রিগান, ক্রেমলিন, রাইসা, সিআইএ, কেজিব। তোমারই মানুষে বেগিন, ব্রেজনেভ, রিগান।

মাহফুজামঙ্গল কাব্যগ্রন্থটি কবির যৌবন উচ্ছ্বাসের দলিল। তবুও গ্রন্থটিকে বলা যায় বাংলাসাহিত্যের এক অনন্য উপহার।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড