• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বো নদীর তীরে একদিন

  পাপিয়া শারমিন

১৯ জুন ২০১৯, ১৯:১৩
কালগারি
বো নদীর উপর নির্মিত দৃষ্টিনন্দন পিস ব্রিজ (ছবি : লেখক )

বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী ভিসাতে আমেরিকা আসছি ৩ বছর হলো। বলতে গেলে নড়াইল থেকে সোজা নিউইয়র্ক। পাশের দেশ ভারত তো অনেক দূরে থাক কখনো স্কুল কলেজের পিকনিকে পর্যন্ত যাওয়া হয়নি আমার। আমেরিকা আসার পর মনে হলো ল্যান্ড অফ অপরচুনিটির কিছুটা কাজে লাগাই। এরপর টুকটাক ঘুরতে শুরু করলাম। হঠাৎ একদিন মনে হলো এই দেশটাকেতো বিদেশ বিদেশ লাগে না। বিদেশ ভ্রমণ করতে হবে। অন্তত একটু অভিজ্ঞতা তো থাকুক। প্লান করলাম কানাডিয়ান রকিস দেখতে যাবো। এটাই আমার প্রথম ভ্যাকেশন। টিকিট কনফার্ম করার পর থেকে উত্তেজনায় আমার ঘুম হারাম হবার জোগাড়।

১০ জুন বিকেলে আমার বিমান ধরতে হবে। কালগারি পৌঁছাতে রাত ১১টা বেজে যাবে। সেদিন দুপুর দুইটার মধ্যেই আমি বাকশো পেটারা নিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। বাসা থেকে বের হতে যাব ঠিক তখনই এয়ার কানাডা থেকে মেইল এলো। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে আজকের ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। নতুন সময় কাল সকাল ১০টায়। কালগারি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেজে যাবে বিকেল ৪টা। এদিকে এয়ারবিএনবি তে এ্যাকোমডেশনের জন্য পে করেছি । ১১ তারিখের বান্ফ ন্যাশনাল পার্ক ডে ট্যুর পে করেছি। কোনটারই টাকা ফেরত পাবো না।

এদিকে আবার ছুটিও খুব বেশিদিন না। পুরো একটা দিন নষ্ট হলো। বাইরে তখন মুষল ধারে বৃষ্টি পড়ছে। আমার মনের ভেতর অবশ্য তখন ঝড়ই চলছিল বলা যায়। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম। কতক্ষণ ছিলাম মনে নেই। হুট করে মাথায় এলো কথাটা। দ্রুত কল করলাম এয়ার কানাডার কাস্টমার কেয়ারে। পাক্কা ত্রিশ মিনিট লাইনে থাকার পর তাদের এজেন্টকে পেলাম। অনেক সময় লাগলো তাকে পুরো ব্যাপারটা বোঝাতে। অবশেষে সে আমাকে একটা টিকিট মেইল করলো। আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৫টা ২০ মিনিটে। ঘড়িতে বাজে সাড়ে তিনটা। এখনই ছুটতে হবে আমার।

কালগারি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে।

কালগারি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে লেখক

উবার নিয়ে প্রায় উড়েই চললাম লাগরডিয়া বিমানবন্দরের দিকে। বোর্ডিং পাসের জন্য লাইনে থেকে যখন আমার টার্ন আসলো তখন জানতে পারলাম আমেরিকান এয়ার লাইন্সের এই ফ্লাইটও ক্যানসেল হয়েছে। দৌড়ে গেলাম এয়ার কানাডার বোর্ডিং পাসের লাইনে। ঘটনা শুনে এরা দায় এড়ানোর জন্য বললো, যেহেতু আমেরিকান এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট ক্যানসেল হয়েছে তাই দায়টাও তাদেরই। আবার দৌড়ে এলাম আমেরিকান এয়ার লাইন্সের বোর্ডিং পাসে। এবার এরা শুরু করলো ধানাই পানাই। আমার মূল টিকিট এয়ার কানাডার হওয়ায় তারা কিছুই করতে পারবে না।

এবার আর রাগ সামলে রাখতে পারলাম না। বিশাল মেজাজ খারাপ হলো আমার ফ্লাইট ক্যানসেল শুনে আমিতো বাড়িতেই ছিলাম। তাহলে ভুলভাল বলে আমাকে এয়ারপোর্টে এনে এমন নাটক করছে কেন। দিলাম সেই ঝাড়ি। এবার আমেরিকান এয়ার লাইন্সের এজেন্ট রাজি হলো আমার সাথে যেয়ে এয়ার কানাডার এজেন্টের সাথে কথা বলতে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে একটা টিকিট মিললো সাড়ে সাতটার ফ্লাইটের। টরেন্টোতে রাতে থাকতে হবে। কালগারি পৌঁছাতে সকাল দশটা বেজে যাবে। তাতেও আমি রাজি হলাম। কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয়। ৭টা ২০ এ শুনি এই বিমানে আমার জায়গা হবে না। যেতে হবে পরেরটাতে। সেটা সাড়ে নয়টায়।

কালগারি

কালগারি ডাউনটাউন। (ছবি : লেখক)

অপেক্ষা আর অপেক্ষা। সময়ই যেন কাটতে চায় না। শেষ অবধি প্লেনে উঠলাম রাত ১০টা ৩০ এ। ছাড়তে ছাড়তে ১১টা বেজে গেল। অথচ এই সময় আমার কালগারি থাকার কথা। বিমানবন্দরেই সাত ঘণ্টা শেষ। টরেন্টো যেতে দেড় ঘণ্টা লাগলো। কালগারি সংযোগ ফ্লাইট সেই সকাল ৬ টায়। সময়টাকে কাজে লাগালাম। ট্যাক্সিতে করে বের হয়ে পড়লাম টরেন্টো সিটি দেখতে।

কালগারি আসলাম ৯টা ৪০ মিনিটে। নিউইয়র্কে তখন বেলা ১১টা ৪০ বাজে। তারমানে আমি ২৮ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে আছি। উঠবো এয়ার বি এন বির বাসায়। আরও ৪০ মিনিটের যাত্রা শেষে অবশেষে পৌঁছুলাম। ফ্রেশ হয়ে ফোন দিলাম কালগারি ট্যুর এজেন্সিকে। আমার আজকের প্যাকেজ রিজার্ভ করা ছিল সেটা মিস করে ফেলেছি। আমার সকাল ৭টায় শুরু করার কথা ছিল সবকিছু। ফ্লাইট ক্যানসেলের কথা শুনে খুব দুঃখ প্রকাশ করলো তারা। জানালো এটাতো নন-রিফান্ডেবল প্যাকেজ টাকা ফেরত পাবো না। তবে চাইলে আগামী সপ্তাহে সেইম প্যাকেজটা নিতে পারি। সেটার সিট খালি আছে।

কালগারি

হেড স্কাল্পচারের সামনে লেখক

একটা সমাধান অবশ্য আছে জানালো। দুপুর ১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত কালগারি শহর ঘুরে দেখার সুযোগ। শহরটা অবশ্য আমি একাই ঘুরে দকেহতে পারতাম। তবুও এই অফারটাই লুফে নিলাম। কথায় আছে না ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’। ১২ ঘন্টা রকি মাউন্টেইন ঘুরে দেখার ১০০ ডলারের প্যাকেজের পরিবর্তে পেলাম ৩ ঘন্টার সিটি ট্যুর ! সময় তখন ১১:৩০। ভাবলাম ৩০ মিনিট রেস্ট করি। হঠাৎ পেট থেকে মাথায় সিগনাল আসলো যে সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। বেরিয়ে পরলাম কালগারি ঘুরে দেখার জন্য।

কালগারি শহরটা অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর ছবির মতন সাজানো। আজকের সিটি ট্যুরের গ্রুপটাও অনেক ছোট। মাত্র ছয়জন। ট্যুরগাইড সহ ৭ জন মোট।

প্রথমে দেখতে গেলাম স্টুডিও বেল । স্টুডিও বেল কে বলা হয় ন্যাশনাল মিউজিক সেন্টার । কানাডার মিউজিক হিস্ট্রি এবং পুরানো সবরকম বাদ্য যন্ত্রের একটা সুন্দর সংগ্রহ। সঙ্গীতপ্রেমীদের অবশ্যই স্টুডিও বেল ঘুরে দেখা উচিত । স্টুডিও বেল এর আর্কিটেক্চার ডিজাইন খুবই অত্যাধুনিক। স্টুডিও টি কালগারি ডাউনটাউনের ফোর্থ সাউথ-ইস্ট স্ট্রীট আর এইট এভিনিউ এর কর্নারে ৫ তলা ভবন।

কালগারি

স্টুডিও বেল এ পৃথিবীর সব বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহ আছে

এরপর দেখতে গেলাম কালগারি পাবলিক লাইব্রেরি। তবে কালগারি সেন্ট্রাল লাইব্রেরিটা বেশ নাম করা। সেখানে যাবার মতো সময় ছিল না হাতে। নতুন পাবলিক লাইব্রেরিটাও দারুণ। আধুনিক স্থাপত্য নকশায় নির্মিত কাঠের চার তলা ভবন। গতবছর নভেম্বরে এটির উদ্বোধন হয়েছে। ২৪৫ মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার খরচ হয়েছে লাইব্রেরিটা তৈরি করতে। লাইব্রেরির প্রতি দুর্বলতা আমার ছোটবেলা থেকেই। এত চমৎকার একটা লাইব্রেরির প্রেমে না পড়ে থাকা দায়।

আমাদের পরের গন্তব্য কালগারি মিউনিসিপল বিল্ডিং, কালগারি টাওয়ার, কালগারি অলিম্পিক প্লাজা, ওমেন আর পারসনস মন্যুমেন্ট। এই সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলো ঘুরে আমরা গেলাম পিচ ব্রিজ দেখতে। বো নদীর উপর নির্মিত হয়েছে এই পিচ ব্রিজ। কালগারি শহরটাই গড়ে উঠেছে এই বো নদীর তীরে। কালগারি শব্দের অর্থ স্বচ্ছ পানি। বো নদীর পানির রঙ হালকা সবুজ এবং স্বচ্ছ। হয়তো নদীর পানির নামের জন্যই এই শহরের নাম হয়েছে কালগারি।

কালগারি

কালগারি নিউ সেন্ট্রাল লাইব্রেরি। (ছবি : লেখক)

এই নদীটির জন্ম রকি মাউন্টেনে। রকি মাউন্টেনের বরফ গলা পানিই বো নদীতে বয়ে চলে। বো নদীর এই পিচ ব্রীজের ভিন্নতা হল পানির ভেতর থেকে ব্রীজে কোন সাপোর্ট নেই ,শুধু দুই পাড় থেকে ভিত্তি। এই ব্রীজ টা শুধুমাত্র পথচারীদের জন্য। সিটি ট্যুরের শেষ আকর্ষণ ছিল রিভার পয়েন্ট পার্ক থেকে কালগারি সিটি ভিউ। বো নদীর পাড়েই পাহাড়ের উপর থেকে পুরো কালগারি ডাউনটাউন টা দেখা যায়।

বিকাল চারটা বাজে। সিটি ট্যুর প্যাকেজের সময় শেষ । কিন্তু আমার মন ভরেনি। তাই ভাবলাম একা একটু ঘুরে দেখি। ট্যুর গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম সন্ধ্যা কখন হয় ? উত্তর পেলাম, ‘টেন পি এম’। অন্ধকার হতে শুরু হয় কখন ? এবারও উত্তর পেলাম ‘টেন পি এম’! আমার ইচ্ছা বো নদীতে সূর্যাস্ত দেখবো। আমার মনে হলো চাইনিজ ট্যুর গাইড বুঝতে পারছে না আমি কী জানতে চাচ্ছি। তাই আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘সানসেট কয়টায় ?’ এবার একটু উচ্চস্বরে উত্তর আসলো, ‘টেন পি এম !’

কালগারি

কালগারি মিউনিসিপল বিল্ডিং এর সামনে লেখক

তখন আমার ভুলটা বুঝতে পারলাম। আমার ধারণাতে ছিল না যে কালগারিতে সূর্যাস্ত রাত ১০ টায় হয়। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে ডাউনটাউনের মধ্যে সাবওয়ে (ট্রেন) ফ্রী সবার জন্য। আমি হেড স্ক্লাপচার সহ আরও কিছু জায়গা ঘুরে,ডিনার করে ৮টায় এয়ার বি এনবি তে ফিরলাম। পরের দিন সকাল ৭টা বাজে আবার পিক আপ লোকেশনে থাকতে হবে ,তাই আর ১০ টার সূর্যাস্ত দেখা হল না। অসম্ভব ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম সূর্যাস্তের ঘণ্টা দুই আগেই।

তবে যতই গোছানো আর পরিস্কার শহরে ঘুরি না কেন নিউইয়র্কের বাসিন্দারা নিউইয়র্ককেই ভালবাসে।

ওডি/এসএম

দেশ কিংবা বিদেশ, পর্যটন কিংবা অবকাশ, আকাশ কিংবা জল, পাহাড় কিংবা সমতল ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা অথবা পরিকল্পনা আমাদের জানাতে ইমেইল করুন- [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড