• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আমঝুপি নীলকুঠি : ইতিহাসের সোনালী স্মৃতি

  খাদিজা খাতুন স্বপ্না

১৭ জুন ২০১৯, ১২:৩২
নীলকুঠি
ডাক বহনকারী কবুতরের ঘর (ছবি : দৈনিক অধিকার)

মেহেরপুরের ভাটপাড়া নীলকুঠি ও সাহারবাটি নীলকুঠির মধ্যে আমঝুপি নীলকুঠি অন্যতম। আমঝুপি শুধু নীলচাষ বা নীলকরদের অত্যাচারদের কাহিনীতে ভরা নয় এখানে রয়েছে কলঙ্কজনক অধ্যায় ও ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল গল্পগাঁথা। বিট্রিশ রাজত্বকালে ইংরেজরা বিভিন্ন স্থানে নীলচাষের জন্য কুঠি গড়ে তুলেছিলেন সেসব কুঠির নাম দিয়েছিলেন নীলকুঠি।

বর্তমান আমঝুপি নীলকুঠিতে ঢুকতেই মনোমুগ্ধকর গেট, গেট পেরিয়েই আম্রকানন (আমবাগান এবং প্রাচীন ভবন যা আগে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং স্কুল ছিল)। হাতের বাম পাশে ডিসি ইকো পার্ক এবং বিশাল মাঠ তার পাশে বয়ে চলেছে কাজলা নদী।

১৯৬৫ সালের পর বঙ্গে কোম্পানি আইন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় বর্তমান মেহেরপুরসহ সমগ্র নদীয়া এ ইস্ট কোম্পানির শাসনভুক্ত ছিল। বিট্রিশরা এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের স্থায়ী ব্যবসায়িক ও প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলে। এরই ধারাবাহিকতায় খ্রিস্টীয় ১৯ শতকের প্রথমভাগের অন্যতম স্থাপত্যগুলোর মধ্যে অন্যতম মেহেরপুরের আমঝুপি নীলকুঠি। আমঝুপি নিলকুঠির মূলভবনটি আয়াতকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত। এ ভবনটি উত্তরমুখী করে নির্মাণ করা হয়েছে। এটির দৈর্ঘ্য ৩৭. ৬৪ মিটার এবং প্রস্থ ২০. ২৫ মিটার। এ ভবনে ছোট বড় মোট ১৩টি কক্ষ এবং সামনে পেছনে ২টা করে বারান্দা আছে। সামনে ও পেছনের বারান্দা থেকে অভ্যন্তরের কক্ষসমূহে প্রবেশের জন্য একাধিক প্রবেশপথ রয়েছে।

ছবি

এখানে রয়েছে কলঙ্কজনক অধ্যায় ও ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল গল্পগাঁথা (ছবি : দৈনিক অধিকার)

সামনে ও পেছনের বারান্দার ছাদে অ্যাজবেস্টসরের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ভবনের বিভিন্ন কার্নিসে বহু ভাজের নকশা রয়েছে। ছাদে বর্গা ব্যবহার করা হয়েছে এবং খড়ছড়ি বিশিষ্ট দরজা ও জানালার কপটগুলো কাঠের তৈরি। স্নেকপ্রুফ মেঝে বিশিষ্ট এ নীলকুঠির অভ্যন্তরভাগ গরম রাখার জন্য একটা ফায়ার প্লেস রয়েছে। সামনে ও পেছনের বারান্দায় নকশাযুক্ত পিলারসহ লোহার তৈরি রেলিং রয়েছে।

ভবনটির দুই পাশে রয়েছে সারি সারি নারিকেল গাছ আর গোলাপ বাগান। এই গোলাপ বাগানের মধ্যে নীলগাছও চোখে পড়ে। তার ঠিক সামনেই কাজলা নদী বরাবর বিশাল সানবাঁধানো ঘাট। ইংরেজদের নৌজান তখন এ ঘাটেই ভিড়ত। পশ্চিম পাশে আছে ডাকবহনকারী কবুতরের ঘর। সে সময় চিঠি আদান-প্রদানের জন্য তাদের যে সব কবুতর ছিল সেগুলো এ ঘরেই বসবাস করত।

আমঝুপি : ইতিহাসের সোনালী স্মৃতি

ইতিহাস একটি জাতির জীবনের ধারাবাহিক চলচ্চিত্র এবং তার সভ্যতার স্মারক। ইতিহাস গৌরব-গর্ব ও কলঙ্ক দায়কে একসূত্রে গেথে প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই ইতিহাসের সড়ক বেয়েই মানুষের চিরকালের যাওয়া-আসা। প্রবাহস্রোত এমনি করে বয়ে চলে কাল হতে কালান্তরে। ইতিহাসের এমনি এক ধূসর পথে সিমান্ত শহর মেহেরপুরের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আমঝুপি। এই পথে একদিন মোঘল সেনাপতি মানসিংহের বিজয় রথ ছুটেছে, এই পথে ভাস্কর পণ্ডিত বর্গীদল ধূলি উড়িয়ে গেছে লুণ্ঠনের কালো হাত বাড়িয়ে, বাঙলা-বিহার, উড়িষ্যার অধিপতি নবাব আলীবর্দ্দী খাঁর মৃগয়ার স্মৃতিও রয়েছে এইখানে। পলাশীর পরাজয়ের নীল-নকশাও রচিত হয়েছিল এইখানে- এই আমঝুপিতে। জনশ্রুতি আছে এখানেই রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে মীরজাফর ও ষড়যন্ত্রীদের শেষ বৈঠক হয়েছিল এবং তার ফলে শুধু নবাব সিরাজউদ্দোলারই ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেনি, বাঙালি হারিয়েছিল তার স্বাধীনতা।

ছবি

আমঝুপি নীলকুঠি (ছবি : দৈনিক অধিকার)

ইংরেজ আমলের সূচনাপর্বে বাংলার নির্যাতিত মানুষের নীল-রং-রক্তে গড়ে ওঠে আমঝুপি নীলকুঠি। কুঠিয়াল কেনি সিম্পসন ফার্গুসনের সতীর্থদের অত্যাচার-নির্যাতন-শোষণের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুঠি আমঝুপি। নির্যাতিত নীল চাষির দূর্বার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে একদিন বাঁংলার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হলো নীল চাষ। হাতবদল হয়ে আমঝুপি নিলকুঠি মেদেনীপুর জমিদারী কোম্পানির কাচারীতে পরিণত হলো। দেশভাগের পর জমিদারী উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে সে অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটল।

বিবর্তনের ধারা বেয়ে আরেক ইতিহাসের জন্ম হলো ১৯৭৮ সালের ১৩ মে। খুলনা বিভাগ উন্নয়ন বোর্ডের আমঝুপি অধিবেশনে এ ইতিহাস অতিতের শোষণ-নির্যাতন-বঞ্চনার স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়ে মানুষের রুচি শ্রম প্রগতির পথে অভিযাত্রার ইতিহাস। এই সভায় স্বীকৃতি পেল আমঝুপি পর্যটনকেন্দ্ররুপে। আঠার লাখ দুই হাজার টাকা ব্যয়ে আমঝুপি কুঠিবাড়ি সংলগ্ন এলাকায় আমঝুপি নামের বিলীয়মান স্মৃতিকে পূর্ণজাগ্রত করার প্রয়াশে আম্রকানন সৃষ্টিসহ একটি মনোরম পর্যটন কেন্দ্র রুপান্তরের প্রকল্প গৃহীত হয়।

ইতিহাসের আরেক কালান্তরে আমঝুপি আবার এক গৌরব ও স্বীকৃতির শিরোপা লাভ করে। তার এই আলোকাভিসার আজ যদি ইতিহাসের সরণি বেয়ে স্বকাল ও ভাবীকালের মানুষদের আকৃষ্ট করে তবেই তার এই পুনর্জন্ম সার্থক হবে সফল হবে এর স্বপ্নদ্রষ্টা ও পরিকল্পদের শ্রম ও সংকল্প। (আব্দুল মান্নান ভূইয়া) আমঝুপি নীলকুঠি মেহেরপুর জেলার তৎকালীন ইংরেজ নীলকুঠি ও বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এটি মেহেরপুর জেলা থেকে ৬ কিলোমিটার পূর্বে আমঝুপি নামক গ্রামে। এর পাশেই রয়েছে কাজলা নদী।

উপমহাদেশে নীলচাষের অবসানের পর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৭২ সালে এটি প্রথম সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনটি তৈরির শুরুর দিকে নীলকুঠি হিসেবে ব্যবহার করলেও ক্রমেই এটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ইতিহাসবিদদের মতে, এই নীলকুঠিটি খুব সম্ভবত ১৮০০-এর দশকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

ছবি

ভবনের বিভিন্ন কার্নিসে বহু ভাজের নকশা রয়েছে (ছবি : দৈনিক অধিকার)

আমঝুপি নীলকুঠিটির দুটি প্রবেশপথ রয়েছে। পুরো নীলকুঠি কমপ্লেক্সটি ৭৭ একরের বেশি জায়গাজুড়ে। কমপ্লেক্সের মাঝখানে কুঠির মূল ভবনটি ও এর দুই পাশে রয়েছে ফুল বাগান। মাঝখানের প্রধান ভবনটির ভেতর রয়েছে ১৫টি কক্ষ। এছাড়াও ভবনটিতে রয়েছে বড় হল রুম, খাবার কক্ষ, নাচঘর ও অতিথিদের থাকার কক্ষ। রয়েছে পিকনিক কর্নার যার শুভ উদ্বোধন করেন জনাব আবু হেনা, কমিশনার, খুলনা বিভাগ ২৬ জুন ১৯৮০ সাল।

জনশ্রুতি অনুসারে, এই নীলকুঠিতেই রবার্ট ক্লাইভ ও মীরজাফর বাংলার শেষ স্বাধীন নবান সিরাজউদ্দৌলাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের ষড়যন্ত্র করেছিল। তবে অনেক ইতিহাসবিদই এই ধারণাকে নাকচ করে দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারও গঠিত হয়েছিল বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননে যা এই নীলকুঠির কাছেই।

যাবেন কীভাবে এই মনোমুগ্ধকর নীলকুঠি দেখতে? চলেন যেনে নিই, ঢাকা গাবতলি এবং কল্যাণপুর থেকে সরাসরি বাসে মেহেরপুর যেতে পারবেন। আপনি যমুনা ব্রিজ এবং পাটুরিয়া ফেরী ঘাট দুই দিক দিয়েই যেতে পারবেন। ভাড়া পরবে জনপ্রতি ৪৫০ নন এসি এসি বাস ভেদে ভিন্ন রকম ৭০০-১০০০ টাকা। যেতে সময় লাগবে ৬-৭ ঘণ্টা। আপনি মেহেরপুর গেস্ট হাউস এবং আবাসিক হোটেলগুলোতে থাকতে পারবেন। আপনি রাতে গেলে পরের দিন সকালে সব ঘুরে আবার রাতে ব্যাক করতে পারবেন। মেহেরপুর থেকে ১৮ কি.মি দূরে ঐতিহাসিক মুজিবনগর (বৈদ্যনাথতলা আম্রকানন) আপনি সেটিও দেখে আসতে।

ওডি/আরএআর

দেশ কিংবা বিদেশ, পর্যটন কিংবা অবকাশ, আকাশ কিংবা জল, পাহাড় কিংবা সমতল ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা অথবা পরিকল্পনা আমাদের জানাতে ইমেইল করুন- [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড