হিমেল শাহরিয়ার
কেমন গেল নোবিপ্রবি’র ২০১৮ সাল? অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষার এই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ উপকূলীয় অক্সফোর্ড খ্যাত নোবিপ্রবিও জন্ম দিয়েছে নানা ঘটনা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বীজ বপন করা হয়েছিল ২০০১ সালে। অতঃপর ২০০৬ সালে জন্ম নেয় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। ২০১৮ সালে এসে সাফল্য এবং উন্নয়নের সর্বোচ্চ ছোঁয়া পেয়েছে বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. এম অহিদুজ্জামানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়।
নানান সাফল্য আর সৌন্দর্যে সারাটি বছর নোবিপ্রবি ক্যাম্পাস সবাইকে আকর্ষণ করে গেলেও এই বছর আমরা হারিয়েছি একটি ফুল, যার নাম সৃজন, পুকুরের পানিতে ডুবে যার মৃত্যু হয়।
নোবিপ্রবি শিক্ষকের বাংলাদেশে কালো রসুনের প্রবর্তন, তিন শিক্ষার্থীর প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক লাভ, নতুন ৫টি বিভাগ বৃদ্ধি, নোবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতি গঠন, শিক্ষক সমিতি নির্বাচন, ১৩৩ কোটি ৬২ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা, নৈঋতের মতো মন মাতানো নানা আয়োজনে সরব ছিল এই সবুজ আঙ্গিনা।
অন্যদিকে, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, বছরজুড়ে পরিবহন সংকট, প্রক্টরের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন, নোটিশ ছাড়াই ভর্তির সময় আসন সংখ্যা বৃদ্ধি, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন মৌলিক সমস্যা সমাধানের দাবিতে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় আন্দোলনের মতো বহু ঘটনায় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন সরব ছিল স্লোগান ও প্রতিবাদে।
এসব কিছু ছাপিয়ে নবীনদের বরণ, বসন্তবরণ, নববর্ষ বরণ, পিঠা উৎসব, নারী দিবস, বিশ্ব পরিবেশ ও ফার্মাসিস্ট দিবস, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির মানসে বিভিন্ন সময় আয়োজিত হয় বিভিন্ন সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম। এর মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে নোবিপ্রবি, দেশে একটি ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার মিশন নিয়ে।
আর ২০১৮ সালে ঘটে যাওয়া এসব বিষয় নিয়েই দৈনিক অধিকারের আজকের এই আয়োজন ‘ফিরে দেখা নোবিপ্রবি’।
প্রথম বর্ষের ওরিয়েন্টশন : অন্যান্য বছরের মতো ২০১৮ সালে নবীনদের বরণ করে নেওয়ার প্রথার ব্যত্যয় হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় বছরের শুরুতেই জানুয়ারি মাসে নবীনবরণ অনুষ্ঠিত হয়।
কালো রসুনের প্রবর্তন : মানব স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী কালো রসুন তৈরিতে সক্ষম হন নোবিপ্রবি’র বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সুবোধ কুমার সরকার। তিনি নোবিপ্রবি-বিজি-১ (ডিএল-বিজি), নোবিপ্রবি-বিজি-২ (ডিএস-বিজি), নোবিপ্রবি-বিজি-৩ (সিএল-বিজি) নামে তিনটি কালো রসুন তৈরি করেন। তার এই অর্জন নোবিপ্রবি’র গৌরব।
সৃজনের মৃত্যু : ২৫ জুন দুপুরে বন্ধুদের সাথে ক্যাম্পাসের নীল দিঘীতে গোসল করতে যায় সৃজন। সাতার না জানার কারণে পানিতে ডুবে তার মৃত্যু হয়। বন্ধুরা অনেক খোজাখুজি করেও তাকে উদ্ধার করতে পারেনি, পরে ফায়ার সার্ভিস দীর্ঘ ৩ ঘণ্টা চেষ্টার পর তার লাশ উদ্ধার করে।
পরিবহন সংকট ও অনিয়ম : বিগত বছরগুলোতে পরিবহন সংকট দেখা না দিলেও ২০১৮ সালে এ সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। শিক্ষার্থী অনুসারে বাস না বাড়ানোয় এই সমস্যা দেখা দেয়। তবে আশার কথা নতুন ১টি বাস বিশ্ববিদ্যালয় পরিবহন শাখায় যুক্ত হওয়ায় মোট বাস সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬টি, যা দূর হতে আগত শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল আশার আলো।
নৈঋত : অত্যন্ত উৎসাহ ও জাঁকজমক পরিবেশে নোবিপ্রবিতে পালিত হয় স্নাতকদের সমাপনী অনুষ্ঠান। যার নাম দেওয়া হয় ‘নৈঋত’। ২১ জুলাই থেকে শুরু হয়ে এ উৎসব শেষ হয় ২৩ জুলাই। নৈঋতের আয়োজনে ছিল র্যালি, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। যেখানে সংগীত পরিবেশন করে লালন ব্যান্ড, দীর্ঘ রাত পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা মেতে থাকেন আনন্দোৎসবে, চার বছরের স্মৃতি রোমন্থনে স্মরণীয় রাখে পুরো দিবসটি।
তিন শিক্ষার্থীর প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক প্রাপ্তি : দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের নিজ নিজ অনুষদে সেরা রেজাল্টধারী ১৫৯ জন শিক্ষার্থীকে ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’ দেওয়া হয়, সেখানে নোবিপ্রবির ৩ শিক্ষার্থী তাদের ভালো ফলের জন্য ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’ লাভ করেন। তারা হলেন- কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মো. ইব্রাহীম খলিল, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ফারজানা চৈতী, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের তাসনিমা ফারজানা। তারা নোবিপ্রবি’র গর্ব।
আন্দোলনের ডামাডোল : ২০১৮ সাল ছিল আন্দোলনের বছর। এপ্রিলে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে সারা সারাদেশ ফুঁসছিল তখন নোবিপ্রবিও ছিল জাগ্রত। শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে আন্দোলন করতে থাকে। হাতে লেখা ফেস্টুন ও প্লেকার্ড নিয়ে নানা স্লোগানে সারাদেশে চলমান আন্দোলনের যৌক্তিকতায় সমর্থন জানায় তারা। পরে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে এ আন্দোলন স্থগিত করে সারাদেশের ও নোবিপ্রবি’র শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষক সমিতি নির্বাচন : ১৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ঐ নির্বাচনে জয়লাভ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শিক্ষক জোট (নীল দল)। সভাপতি হিসেবে অধ্যাপক গাজী মহসিন, সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন, সহসভাপতি ড. নাহিদ আক্তার এবং যুগ্ম সম্পাদক হন নুরুজ্জামান ভুঁইয়া। সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন- শুভ ভৌমিক, সঞ্জিতা দেওয়ানজি, সালাউদ্দিন মিল্লাত। শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া পূরণে ও ঐক্যবদ্ধভাবে শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায় তারা কাজ করে যাবেন এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।
সাংবাদিক সমিতির প্রথম কমিটি গঠন : বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরুর প্রায় একযুগ পর ২০১৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে নোবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতি। প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন নাজমুস সাকিব সাদি এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন কামরুল হাসান শাকিম।
সর্বোচ্চ ভর্তি আবেদন : অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছর নোবিপ্রবিতে রেকর্ড সংখ্যক (১৩৪০ আসনের বিপরীতে) ৭০ হাজার ২৯৮টি আবেদন জমা পড়ে এবং প্রতি আসনের বিপরীতে লড়েছেন ৫২ জন শিক্ষার্থী।
ভর্তি পরীক্ষা ও নোয়াখালীবাসীর আতিথেয়তা : এ বছর নোবিপ্রবি ভর্তি পরীক্ষায় আগত ভর্তিচ্ছুদের জন্য আতিথেয়তার এক অনন্য নজির স্থাপন করে নোয়াখালীবাসী। বিভিন্ন স্থান থেকে আগত শিক্ষার্থীদের জন্য থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, ছাত্রসংগঠন। এছাড়াও ভর্তিচ্ছুদের জন্য প্রতি কেন্দ্রে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থাও করা হয়। ভর্তিচ্ছুদের জন্য নোয়াখালীবাসীর এই আতিথেয়তা পুরো দেশে সাড়া পেলে।
নতুন যোগ হওয়া জীববিজ্ঞান, আইন বিভাগসহ পাঁচটি বিভাগ নিয়ে বর্তমানে ২৯টি বিভাগ হওয়ায় ২০১৮ তে যেন তারুণ্য নেমে এসেছিল নোবিপ্রবিতে।২০১৮তেই সেজেছে নীল দিঘীর পাড়, রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ, উড়েছে প্রজাপতি, পাখিরাও গাইতে শুরু করেছে গাছের ডালে ডালে। হাতছানি দিয়ে ডাকছে নবাগতদের, ধারণ করছে ছয় হাজার মেধাবী মুখ।
শুরু হওয়া নতুন বছর কেমন দেখতে চান এমন প্রশ্ন করা হলে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাখদুম ফাত্তাহ বলেন, আমি চাই উন্নয়ন কাজ গুলো দ্রুত এগিয়ে যাক, পরিবহন ও আবাসিক সমস্যাসহ অনান্য সমস্যার সমাধান হোক আর অ্যাকাডেমিকের পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলো যেন যথাযথভাবে পালন করা হয়।
নতুন বছরের নতুনত্বের, নিজের ও সামগ্রিক কার্যক্রমকে নতুন করে ভাবার এবং উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ, সময়ের গতিময়তায় এই বছরটিও অতীত হবে তখন সেই ২০১৯ এর স্মৃতি যেন আমাদের ঠোঁটের কোনে একচিলতে মৃদু হাসি এনে দেয় এমনটাই প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড