• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য 'হাতে ভাজা মুড়ি'

  নজরুল ইসলাম শুভ, সোনারগাঁও, নারায়ণগঞ্জ

০৬ মে ২০১৯, ২০:০০
মুড়ি ভাজার কাজে ব্যস্ত এক নারী (ছবি : দৈনিক অধিকার)

প্রতি বছরই রমজান মাসে সব শ্রেণির মানুষের ইফতারিতে মুড়ি ছাড়া চলেই না। বিশেষ করে ইফতারিতে যে কোনো মানুষের কাছে খাবারের তালিকায় মুড়ি অবশ্যই থাকা চাই। সুস্বাদু ও স্বাস্থ্য সম্মত হওয়ায় মানুষের কাছে হাতে ভাজা মুড়ির এখনও রয়েছে আলাদা কদর।

শহর কিংবা গ্রামে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিব পরিবারের অন্যতম ইফতার আয়োজনে মুড়ির প্রাধান্য উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে আধুনিক যান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের জীবন মানের অনেক অগ্রগতি হওয়ায় প্রাচীন ঐতিহ্যের অনেক কিছুই বিলুপ্ত প্রায়। এর মধ্যে অন্যতম হলো হাতে ভাজা মুড়ি।

হাতে ভাজা মুড়ি হাতে তুলে দেখাচ্ছেন মুড়ি ব্যবসায়ী (ছবি : দৈনিক অধিকার)

কালের আবর্তে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে আসায় এবং কারখানায় উৎপাদিত হওয়ায় সোনারগাঁওয়ে বিলুপ্ত প্রায় হাতে ভাজা মুড়ি।

তবে ৮০ দশকের শুরুতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার শম্ভুপুরা ও পিরোজপুর দুইটি ইউনিয়নের ১০টি গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে হাতে ভাজা মুড়ির বেশ ধুম ছিল।

সারা বছর গ্রামগুলোতে কমবেশি মুড়ি ভাজা হলেও রমজান মাসে ছিল হাতে ভাজা মুড়ির বিশেষ চাহিদা। এ কারণে মুড়ি শিল্পে জড়িত নারী-পুরুষরা তখন দিনরাত ব্যস্ত সময় কাটাতেন।

দিনরাত অবিরাম চলত মুড়ি ভাজার কাজ। সে সময় সোনারগাঁওয়ের চাহিদা মেটানোর পর এই মুড়ি পাইকারি দরে হাত বদল করে ইঞ্জিনচালিত নৌকায়, কাঠের তৈরি বিভিন্ন নৌ-যানে ও মালবাহী ট্রাকে করে চলে যেত রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় হাঁট বাজারে।

তৎকালীন সময়ে মুড়ি ভাজার কাজে জড়িতরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন এখন অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা স্বাবলম্বী হওয়ায় অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। তবে গ্রামীণ ঐতিহ্য রক্ষায় ও রমজান উপলক্ষে এখনও সোনারগাঁওয়ে পিরোজপুর ও শম্ভুপুরা দুইটি ইউনিয়নের মঙ্গলেরগাঁও, তাতুয়াকান্দি ও দুর্গাপ্রসাদ এলাকার কিছু কিছু পরিবারে চলছে হাতে ভাজা মুড়ির কাজ।

(ছবি : দৈনিক অধিকার)

বাজারজাত করণের উদ্দেশ্যে বস্তায় ভরানো মুড়ি (ছবি : দৈনিক অধিকার)

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রমজান উপলক্ষে সোনারগাঁও উপজেলার স্থানীয় দুর্গাপ্রসাদ, তাতুয়াকান্দি ও মঙ্গলেরগাঁওসহ কয়েকটি গ্রামে কিছুকিছু পরিবারে এখনও চলছে হাতে ভাজা মুড়ির কাজ।

তবে নব্বইর দশকে হাতে ভাজা মুড়ির ব্যাপক চাহিদার কারণে গ্রামগুলোর মূল নাম হারিয়ে মুড়ি পল্লিতে পরিণত হয়েছিল। সে সময় প্রায় ৩ শতাধিক পরিবারের নারী-পুরুষ মুড়ি ভাজার কাজে যুক্ত হয়ে সংসারের সচ্ছলতা এনেছেন।

সোনারগাঁওয়ে যে মুড়ি ভাজা হয় তার বেশিরভাগই মালা, লোতা, বহুরী, ইরি, বি-২৯, বি-২৮, রত্না ও বোরো ধানের মোটা চাল দিয়ে। মুড়ি ব্যবসায়ীরা বরিশাল ও সিলেটের স্থানীয় ধানের বাজার থেকে এ ধান সংগ্রহ করে প্রথমে আধা সিদ্ধ করে থাকে।

এরপর আবার পুরোপুরি সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে তা দিয়ে চাল বানানো হয়। এরপর সে চাল থেকে তৈরি হয় হাতে ভাজা মুড়ি। এখানকার মানুষ দুই ধরনের পদ্ধতিতে মুড়ি ভেজে জীবিকা নির্বাহ করে।

সচ্ছলরা নিজেরাই বাজার থেকে ধান কিনে চাল তৈরিসহ মুড়ি ভেজে বাজারজাত করেন। এতে তারা বেশি লাভবান হয়। এরা প্রতি মণ মুড়িতে প্রায় ৪০০-৫০০ টাকা আয় করেন। অন্যদিকে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন আড়ৎদারের কাছ থেকে চাল নিয়ে মুড়ি ভাজে।

তবে মুড়ি তৈরিতে জ্বালানি কাঠ আনুসঙ্গিক কিছু খরচ বাদে মণ প্রতি তাদের ২৫০-৩০০ টাকা আয় হয়। সাধারণত দুইজন পূর্ণ বয়স্ক মহিলা প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই মন চাউলের মুড়ি ভাজতে পারেন। তবে এ কাজে নারী শ্রমিকরাই বেশি সময় দেন এবং আর্থিক সচ্ছলতা পাওয়ায় তারা বেশ সুখী।

দুর্গাপ্রসাদ এলাকার আব্দুল মালেক নামে একজন মুড়ি ব্যবসায়ী বলেন, দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে তিনি মুড়ি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সারা বছরই তিনি সোনারগাঁও উপজেলার পানাম নগরী এলাকায় বিভিন্ন মুদি দোকানে হাতে ভাজা মুড়ি সরবরাহ করে থাকেন।

(ছবি : দৈনিক অধিকার)

মুড়ি ভাজার কাজে ব্যস্ত এক নারী (ছবি : দৈনিক অধিকার)

তবে প্রতি বছরই রমজান মাসের কয়েকদিন পূর্বেই হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা ৩-৪ গুণ বেড়ে যায়। বাজারে রাসায়নিক মিশ্রিত কারখানায় উৎপাদন করা মুড়ি রমজান মাসে কেউ খেতে চায় না। হাতে ভাজা মুড়ির বাজার দর ১০/১৫ টাকা বেশি হলেও রোজাদার ব্যক্তিরা এই মুড়িই বেশি পছন্দ করে।

সেজন্য হাতে ভাজা মুড়ির রয়েছে আলাদা কদর। তিনি আরও বলেন, সোনারগাঁওয়ে ৮০ এর দশকে স্থানীয় তাতুয়াকান্দি, চৌধুরীগাঁও, কাজিরগাঁও, দুর্গাপ্রসাদ, মঙ্গলেরগাঁও, দুধঘাটা, কোরবানপুর, খাসেরগাঁও, পাচানী ও চরগোয়ালদী এলাকার মানুষ মুড়ি ভাজাকে তাদের পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন।

সে সময় মুড়ি ভাজার সঙ্গে জড়িত ছিল প্রায় ৩ শতাধিক পরিবার। তখন মুড়ি ভাজা একটি শিল্পে পরিণত হয়েছিল। মুড়ি ভাজার সঙ্গে জড়িত অনেক পরিবার তখন থেকেই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। যার ফলে এখানে গরিব মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।

দুর্গাপ্রসাদ এলাকায় হাতে মুড়ি ভাজার সঙ্গে জড়িত সাথী বেগম (৩১) জানান, বর্তমানে কারখানায় মুড়ি উৎপাদন হওয়ার কারণে এবং মানুষের জীবনমানের অনেকটা পরিবর্তন ঘটায় এখন হাতে ভাজা মুড়ি তৈরির কাজে কেউ যেতে চায় না।

তবে কারখানায় তৈরির চিকন মুড়ির চেয়ে হাতের ভাজা মুড়ির দাম একটু বেশি। এতে কোনো ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হয় না। যার ফলে এখনও হাতে ভাজা মুড়ির আলাদা কদর রয়েছে সব মানুষের কাছে।

ওডি/এএসএল

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড