• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

হুমকির মুখে যমুনাসহ ৪০ নদী

  সোহেল রানা, সিরাজগঞ্জ

১৪ এপ্রিল ২০১৯, ২৩:০০
নদ-নদী
হারিয়ে যেতে বসেছে সিরাজগঞ্জের নদ-নদী (ছবি- দৈনিক অধিকার)

হারিয়ে যেতে বসেছে সিরাজগঞ্জের নদ-নদী। চলনবিল অধ্যুষিত সিরজগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ছোট-বড় ৪০টি নদী। নদীগুলো ছিল এ জেলার প্রাণ। সময়ের পরিবর্তনে ২৪টির অস্তিত্ব এখন বিলীন। বাকি ১৬টি করতোয়া, ইছামতি, গুমানী, গোমতী, আত্রাই, ভদ্রাবতী, গোহালা, বড়াল, নন্দকুজা, গারুদহ, কাকন-কানেশ্বরী, স্বরসতী, বাঙ্গাল, মুক্তাহার, ঝবঝবিয়া ও ফুলজোড় নদী মৃতপ্রায়। এর কারণ অপরিকল্পিত সড়ক-মহাসড়ক, বাঁধ, ক্রসবাঁধ, কালভার্ট, সুইচগেট, উৎসমুখ ভরাট, দখল-দূষণসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ।

জেলার পূর্বদিকে প্রবাহিত যমুনা নদীর বুকে বিশাল বিশাল চর জেগে ওঠায় যমুনাও তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। নদীটি পশ্চিম তীরে সিরাজগঞ্জ ও পূর্ব তীরে টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর-তারাকান্দি-চৌহালী উপজেলার দিকে ঢুকছে। গ্রাস করছে বসতভিটা-ফসলি জমি। নিঃস্ব হচ্ছে চর এলাকার হাজার-হাজার পরিবার। নদীটি দু-পাড়ের মানুষের দুঃখ। বেলকুচি-শাহজাদপুরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক হুরাসাগরটিও মরাখালে পরিণত হচ্ছে। বিলুপ্তির পথে মৎস্য সম্পদ। এক সময় যমুনা ও চলনবিলের মাছ উত্তরাঞ্চলের চাহিদা মিটিয়েও ভারতে রপ্তানি হতো। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে দ্রুত খনন করা না হলে নদীগুলো হারিয়ে যাবে।

যমুনা নদী (ছবি- দৈনিক অধিকার)

জানা যায়, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, সলঙ্গা,তাড়াশ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, নাটোরের গুরুাসপুর, সিংড়া, বড়াইগ্রাম ও নওগাঁর আত্রাই নিয়ে বৃহত্তর চলনবিল। চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১ হাজার ৮ বর্গ কিলোমিটার। চলনবিলে ছোট-বড় প্রায় ৪০টি নদী ও ১২০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ২২টি খাল। সময়ের পরিবর্তনে ২৪টি নদী এখন বিলীন। অস্তিত্ব হারিয়েছে খালগুলো। চলনবিলের স্রোত ও নাব্যতা হারিয়ে ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে বিলের আয়তন দাঁড়ায় মাত্র ৩৬৮ বর্গ কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে মূল বিলটির আয়তন দাঁড়ায় ১৫.৯ থেকে ৩১ কি.মি। এছাড়া বিলের গভীরতা ১.৫৩ মিটার থেকে ১.৮৩ মিটার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে জানা গেছে, ৩০ বছর আগেও চলনবিলে প্রবাহিত নদ-নদীতে বছরজুড়েই ৬-১২ ফুট পানি থাকত। বছরের পুরো সময়ই চলত নৌ। বছরের পর বছর পলি জমে নদীগুলো ভরাট হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব ও ১৯৮০ এর দশকে পদ্মার উৎমুখে অপরিকল্পিত সুইচগেট নির্মাণের কারণে চলনবিলের নদ-নদী, বিল, জলাশয়, খালগুলো পলি জমে ভরাট হয়েছে। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে নাটোরের বনপাড়া পর্যন্ত মহাসড়ক নির্মাণের পর পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা বেড়েছে। গেল কয়েক বছরে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এতে বিলের দেশি প্রজাতির প্রায় ৫০ ধরনের মাছের অধিকাংশই বিলুপ্তি হয়েছে। বিলুপ্ত মাছের মধ্যে রয়েছে- কই, শিং, মাগুর, কাঁকিলা, শোল, বোয়াল, চিতল, মোয়া, হিজল, তমাল, জারুল বাতাসি, টেংরা, গোলসা, নন্দই, পুঁটি, সরপুঁটি, খলিশা, চেলা, ডানকানা, টাকি, বাইটকা, বাউস, কালোবাউস, চ্যাকা, বাইম, বউমাছ, গোঁচৌ, গোরপুইয়া, কুচিয়া, কচ্ছপ, কাছিম ও কাঁকড়াসহ অনেক।

গারুদহ নদী (ছবি- দৈনিক অধিকার)

হুরাসাগরের যৌবন ফেরাতে মৎস্য বিভাগ থেকে কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নদীর খনন কাজ তামাশা ছাড়া অন্য কিছুই না বলে মনে করেন হুরাসাগর পাড়ের বাসিন্দরা।

সলঙ্গা থানার প্রবীন স্কুল শিক্ষক কালিপদ কুণ্ডু বলেন, এক সময় চলনবিল বিলে মাছ আর পানি ছিল সমান। চলনবিলের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া গারুদহ, ফুলজোড়, করতোয়া নদীতে বড় বড় জাহাজ চলত। বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা হাটের দিন জাহাজে করে মালামাল পরিবহন করতো। হাজার হাজার জেলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন শুষ্ক মৌসুমে নদীর বুকে ধান চাষ হচ্ছে। গত ৩০ বছরে চলনবিলের গভীরতা অনেকাংশে কমে গেছে। চলনবিলের বুকে এখন চাষ হচ্ছে- ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা, রসুন, পিঁয়াজসহ নানা সবজি। পানির স্তর খুব গভীরে নেমে গেছে, শ্যালো মেশিনেও পানি পাওয়া হচ্ছে না।

চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সমন্বয়ক মিজানুর রহমান জানান, চলনবিল দ্রুতই ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। জীব- বৈচিত্র হুমকির মুখে পড়ছে। চলনবিল রক্ষায় সরকারের কাছে ২৬ দফা দাবি করা হয়েছে। আশ্বাস ছাড়া সরকার কার্যকর কোনও ভূমিকা রাখছে না।

হরাসাগর নদী (ছবি- দৈনিক অধিকার)

বাংলাদেশ জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ফেডারেশনের সহ-সভাপতি দীপক কুমার কর জানান, যে নদী ঘিরেই একটি সভ্যতা গড়ে ওঠেছিল। গড়ে ওঠেছিল বন্দর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অথচ সেসব নদীই মৃতপ্রায়। নদী মরে যাওয়ার কারণে মানুষ ও পরিবেশের ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ছে। যমুনা ও পদ্মাসহ বিলের প্রধান সব নদী ও খাল ড্রেজিংয়ের আওতায় এনে পানির প্রবাহ তৈরি ও ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। দখল বন্ধ ও বেদখল হওয়া জায়গা উদ্ধার করতে হবে। বিলের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধক ব্রিজ, কালভার্ট, ক্রসবাঁধ, সুইচগেটসহ সব অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করতে হবে। ঐতিহ্যবাহী চলনবিলের নদী-উপনদীগুলো রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া না হলে ভবিষ্যতে এর অস্তিত্ব থাকবে না।

যমুনার বুকে ধু-ধু বালুচর: বর্ষায় ভয়ঙ্কর রূপ নেয়া যমুনা বর্তমানে নাব্যতা হারিয়ে মরাখালে পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই যমুনার বুকে কচ্ছপের পিঠের মতো অসংখ্য ছোট-বড় চর জেগে উঠেছে। চরের ছোট-ছোট চ্যানেলগুলো মানুষ হেঁটে পার হচ্ছেন। এতে বাড়ছে জেলেদের দুঃখ। যমুনা শাখা নদীতে নৌকা না চলায় মাঝি-মাল্লারা হাহাকার করছেন। একসময় সিরাজগঞ্জ জগন্নাথগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ-টাঙ্গাইল, ভূয়াপুর, টাঙ্গাইল-বেলকুচিতে স্টিমার-লঞ্চ চলত। কিন্তু পলি জমে চর জেগে ওঠায় নৌরুটগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কোথাও অনেক পথ ঘুরে চরপাড়ি দিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছে নৌযান। বড় আশঙ্কার বিষয়, মাঝ নদীতে বিশাল চর জেগে উঠায় নদীর গতিপথে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশালী শফিকুল ইসলাম জানান, সিরাজগঞ্জর উত্তরে কাজীপুর থেকে দক্ষিণে চৌহালী পর্যন্ত প্রায় ৮২ কি.মি দৈর্ঘ্য যমুনা নদীর। পূর্বে টাঙ্গাইল-পশ্চিমে সিরাজগঞ্জের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত যমুনার প্রস্থ প্রায় ১৫.কিমি.। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে লক্ষ লক্ষ টন পলি জমে। এ জন্য স্থায়ী-অস্থায়ীসহ যমুনার বুকে অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। এতে নদীটি আঁকা-বাঁকা ও বিভিন্ন চ্যানেল বিভক্তি হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বড় দুটি চ্যানেল পূর্ব-পশ্চিম তীর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় তীর এলাকাগুলো ভাঙনের মুখে পড়ছে। সরকার ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদী খনন করার উদ্যোগ নিয়েছে। বাস্তবায়ন হলে নদী পূর্বের যৌবন ফিরে পাওয়ার পাশাপাশি তীর ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ নদীগুলোও খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরইমধ্যে করতোয়া, ফুলজোড়, হুরাসাগর ও বাঙ্গাল নদীর ১২২ কি.মি খননের জন্য চুড়ান্ত করা হয়েছে। চলতি বছরে দরপত্র আহবান করা হবে।

ওডি/এসএ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড