মুনীরুল ইসলাম ইবনু যাকির
কুরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি
কুরবানি আল্লাহর প্রিয় একটি ইবাদত। আর কিতাব ও সুন্নাহ দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, কোন আমলই নেক হয় না, কিংবা কবুল হয় না, যতক্ষণ না দু’টি শর্ত পূরণ হয়—১. ইখলাসুন নিয়্যাহ তথা আমলটি যেন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহরই উদ্দেশ্যে হয়। ২. ইত্তিবাউস সুন্নাহ অর্থাৎ আমলটি যেন রাসুল (সা.)-নির্দেশিত পন্থায় হয়। সুতরাং যারা কেবল বেশি করে গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরবানি দেয়, অথবা লোকসমাজে নাম কুড়াবার উদ্দেশ্যে মোটা-তাজা অতিরিক্ত মূল্যের পশু ক্রয় করে এবং তা প্রদর্শন ও প্রচার করে থাকে তাদের কুরবানি যে ইবাদত নয় তা বলাই বাহুল্য।
তবে বাহ্যিকভাবে কুরবানি শুদ্ধ হওয়ার জন্য আরও কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন,
১. শরিয়ত-নির্দিষ্ট পশু হওয়া :
এমন পশু দ্বারা কুরবানি দিতে হবে যা শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থাৎ কুরবানির পশু যেন সেই শ্রেণি বা বয়সের হয় যে শ্রেণি ও বয়স শরিয়ত নির্ধারণ করেছে। সেগুলো হলো উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা। এগুলোকে কুরআনের ভাষায় বলা হয় ‘বাহিমাতুল আনয়াম।’
﴿وَلِكُلِّ أُمَّةٖ جَعَلۡنَا مَنسَكٗا لِّيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۗ﴾
‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানির নিয়ম করে দিয়েছি; তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’[1]
জাবির (রা.) বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
عَنْ جَابِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: لَا تَذْبَحُوا إلَّا مُسِنَّةً إلَّا أَنْ يَعْسُرَ عَلَيْكُمْ فَتَذْبَحُوا جَذَعَةً مِنْ الضَّأْنِ.
‘তোমরা অবশ্যই মুসিন্না (যে পশুর দুধদাঁত ভেঙেছে) কুরবানি করবে। তবে এটা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে (রিষ্টপুষ্ট) ছয় মাসের মেষ-শাবক কুরবানি করতে পার।’[2]
ইমাম মালিক (রহ.) এর মতে, কুরবানির জন্য সর্বোত্তম জন্তু হলো শিংওয়ালা সাদা-কালো দুম্বা। কারণ রাসুল (সা.) এ ধরনের দুম্বা কুরবানি করেছেন বলে সহিহ বুখারি ও মুসলিমের হাদিসে এসেছে। অধিকাংশ উলামাদের মতে, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কুরবানির পশু হলো উট, এরপর গরু, এরপর মেষ বা ভেড়া, এরপর ছাগল। আবার নর মেষ মাদী মেষ অপেক্ষা উত্তম।[3]
একটি উট ও গরু-মহিষে সাত ব্যক্তি কুরবানির জন্য শরিক হতে পারে।[4] অন্য এক বর্ণনামতে, উট কুরবানিতে দশজন শরিক হতে পারে। ইমাম শাওকানি (রহ.) বলেন, হজের কুরবানিতে দশ এবং সাধারণ কুরবানিতে সাত ব্যক্তি শরিক হওয়াটাই সঠিক।[5]
২. পশুর বয়স উপযুক্ত হওয়া :
কুরবানির পশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরি। উট পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু বা মহিষ দু’বছরের হতে হবে। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা হতে হবে এক বছর বয়সের। অবশ্য অসুবিধার ক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সী মেষ কুরবানি করা যায়। অন্য পশু পাওয়া গেলেও ছয় মাস বয়সী মেষ দ্বারা কুরবানি সহিহ হয়ে যাবে।
৩. কুরবানির পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হওয়া :
সাহাবি বারা ইবনু আযিব (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন : ‘চার ধরনের পশু দিয়ে কুরবানি জায়েয হবে না। ১. অন্ধ, যার অন্ধত্ব স্পষ্ট। ২. রোগাক্রান্ত; যার রোগ স্পষ্ট। ৩. পঙ্গু, যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং ৪. আহত; যার কোন অঙ্গ ভেঙে গেছে।’ সুনানুন নাসায়ির বর্ণনায় ‘আহত’ শব্দের স্থলে ‘পাগল’ উল্লেখ আছে।[6]
অতএব এ চার ত্রুটির কোন একটি ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কুরবানি বিশুদ্ধ হবে না। ইমাম ইবনু কুদামা বলেন, ‘এ বিষয়ে কোন মতভেদ আছে কিনা আমরা জানি না।’[7]
ত্রুটিগুলোর ব্যাখ্যা
১. স্পষ্ট কানা : যে পশুর একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে অথবা বেরিয়ে আছে। দৃষ্টিহীন হলে তো অধিক ত্রুটি হবে। তবে যে পশুটির চোখ সাদা হয়ে গেছে, কিন্তু নষ্ট হয়নি, সেটা দিয়ে কুরবানি শুদ্ধ হবে। কারণ, তা স্পষ্ট কানা নয়।
২. স্পষ্ট রোগা : যে পশুর ওপর রোগের চিহ্ন প্রকাশিত। যেটি চরতে অথবা খেতে পারে না; যার দরুন দুর্বলতা ও শারিরিক বিকৃতি হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে, চর্মরোগও একটি ত্রুটি, যার কারণে চর্বি ও মাংস খারাপ হয়ে তাকে। তেমটি স্পষ্ট ক্ষত একটি ত্রুটি, যদি তার ফলে পশুর ওপর কোন প্রভাব পড়ে থাকে। তবে, গর্ভধারণ কোন ত্রুটি নয়। গর্ভপাত বা প্রসবের টিকটবর্তী পশু একপ্রকার রোগগ্রস্থতা এবং তা একটি ত্রুটি। যেহেতু গাভীন পশুর গোশত অনেকের নিকট অরুচিকর, সেহেতু জেনেশুনে তা ক্রয় করা উচিত নয়। অবশ্য কুরবানির জন্য নির্দিষ্ট বা ক্রয় করার পর গর্ভের কথা জানা গেলে কুরবানি হবে। বাচ্চা মৃত হলে যবেহ না করেই খাওয়া যাবে। কেননা, মায়ের যবেহতে সেও হালাল হয়ে যায়।[8]
৩. দুরারোগ্য ভগ্নপদ : পঙ্গু, খোঁজা, যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট।
৪. দুর্বলতা ও বার্ধক্যের কারণে যার চর্বি ও মজ্জা নষ্ট অথবা শুষ্ক হয়ে গেছে।
উপরে উল্লেখিত হাদীসে মোট চারটি ত্রুটিযুক্ত পশুর কুরবানি সিদ্ধ নয় বলে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ উলামাগণের মতে, যদি ঐ ত্রুটিসমূহের অনুরূপ বা ততোধিক মন্দ ত্রুটি কোন পশুতে পাওয়া যায় তাহলে তাতেও কুরবানি শুদ্ধ হবে না; যেমন দুই চোখ অন্ধ বা পা কাটা ইত্যাদি।[9]
৪. পশুর মালিকানা :
যে পশুটি কুরবানি কারা হবে তার উপর কুরবানিদাতার পূর্ণ মালিকানা থাকতে হবে। অর্থাৎ কুরবানিদাতা যেন বৈধভাবে ঐ পশুর মালিক হয়। চুরিকৃত, আত্মসাৎকৃত, বন্ধকি পশু, কর্জ করা পশু বা পথে পাওয়া, অবৈধ ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রীত পশু দ্বারা কুরবানি আদায় হবে না। একই ভাবে অবৈধ মূল্য, যেমন সুদ, ঘুষ, প্রবঞ্চনা, ধোঁকা প্রভৃতির অর্থ দ্বারা ক্রীত পশুর কুরবানি জায়েয নয়। যেহেতু কুরবানি এমন একটি ইবাদত যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা হয়। আর কুরবানির পশুর মালিক হওয়ার ঐ সকল পদ্ধতি হলো পাপপূর্ণ। আর পাপ করার মাধ্যমে কোন প্রকার নৈকট্য লাভ সম্ভব নয়। বরং তাতে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ব্যতীত কিছু গ্রহণ করেন না।’[10]
কুরবানির পশু নির্ধারণে মুসলিম সবিশেষ যত্নবান হওয়া উচিত, যাতে পশু সর্বগুণে সম্পূর্ণ হয়। ইসলামের শায়ায়ির বা প্রতীকসমূহের অন্যতম এবং আত্মত্যাগ ও তাকওয়ার পরিচায়ক।
সুতরাং কুরবানির পশু ক্রয়ের সময় ত্রুটিমুক্ত দেখা ও তার বয়সের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত। যেহেতু পশু যত নিখুঁত হবে আল্লাহর নিকট তত প্রিয় হবে, সাওয়াবেও খুব বড় হবে এবং কুরবানিদাতার আন্তরিক তাকওয়ার পরিচায়ক হবে।
[1] সুরা হজ, ২২ : ৩৪
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড