• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

হাদিসশাস্ত্রের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

  মুনীরুল ইসলাম ইবনু যাকির

০৮ আগস্ট ২০১৯, ১৩:০৭
Hikmah_01
দ্বিতীয় হিজরি শতাব্দিতে বাগদাদের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ‘বাইতুল হিকমা’য় জ্ঞান-গবেষণায় লিপ্ত মুসলিম বিদ্বানরা। ছবি : উইকিপিডিয়া

১. হাদিস কী?

আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে মানব জাতির হিদায়াতের জন্য দু’টি নীতি গ্রহণ করেছেন। ‘কিতাবুল্লাহ’ ‘রিজালুল্লাহ’ কিতাবুল্লাহ তথা আসমানি কিতাবসমূহ। আর ‘রিজালুল্লাহ’ তথা মানব জাতির পিতা আদম (আলাইহিস সালাম) থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরিত নবি ও রাসুলগণ। আল্লাহ তায়ালা শুধু গ্রন্থই নাযিল করেননি, তেমনি শুধু রাসুল প্রেরণ করেও ক্ষান্ত হননি। বরং সর্বদা উভয় ধারা অব্যাহত রেখেছেন। এর বড় একটা শিক্ষা হলো, মানুষের নির্ভুল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য শুধু গ্রন্থ-কিতাবই যথেষ্ট নয়, শিক্ষক ছাড়া আবার শুধুমাত্র শিক্ষকও যথেষ্ট নয়, গ্রন্থ-কিতাব ছাড়া।

এ জন্যই যখন আরব ছিল শিল্প-সাহিত্যের সূতিকাগার, তখনও আল্লাহ তায়ালা কিতাব সহকারে রিজাল পাঠিয়েছেন। যাতে কিতাবের শিক্ষাকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বাস্তবায়ন করতে পারেন। আর কেবল মানুষই মানুষের প্রকৃত শিক্ষাগুরু হতে পারে। গ্রন্থ কখনও গুরু বা শিক্ষক হতে পারে না, তবে শিক্ষার মৌল অংশ অবশ্যই এ জন্যই সালাফরা বলতেন,

مَنْ كَانَ شَيْخُهُ كِتَابَهُ فَخَطَؤُهُ أَكْثَرُ مِنْ صَوَابِه

‘কিতাবই যার একমাত্র শিক্ষক, সঠিকের তুলনায় ভুলই হয় তার বেশি

আভিধানিক অর্থে হাদিস মানে কথা, বাণী, আলোচনা, সংবাদ, খবর, কাহিনী ইত্যাদি পরিভাষায় ‘হাদিস’ বলতে বুঝায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যাবতীয় কথা, কাজ, অনুমোদন, সমর্থন এবং তাঁর অবস্থার বিবরণকে। হাদিসকে সুন্নাহ নামেও আখ্যায়িত করা হয়। যদিও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সুন্নাহ এবং হাদিসের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু ব্যাপকভাবে সালাফরা হাদিসকে সুন্নাহ এবং সুন্নাহকে হাদিস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ উসুলুস সুন্নাহয় হাদিসের সংজ্ঞায়ন করেছেন যে, ‘সুন্নাহ হলো কুরআনের ব্যাখ্যা, সুন্নাহ হলো কুরআনের দলিল’ ইমাম আওযায়ি (রহ.) ইবনু আতিয়্যাহ (রহ.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ‘জিবরিল (আ.) নবিজির ওপর নাযিল করেছেন কুরআন, আর সুন্নাহ হলো তার ব্যাখ্যা

ব্যাপকার্থে সাহাবি, তাবিয়ি ও তাবি-তাবিয়িদের কথা, কাজ ও অনুমোদনকেও হাদিস বলা হয়। সাহাবিদের হাদিসকে বলা হয় মাওকুফ, তাবিয়িদের হাদিসকে বলা হয় মাকতু। আর যে হাদিস বর্ণনা পরম্পরায় নবি (সা.) পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাকে বলা হয় মারফু হাদিস।

২. ক. হাদিসশাস্ত্রের উৎপত্তি

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবজাতির নিকট সর্বশেষ রাসুল, তারপরে কোনো নবি ও রাসুল আসবে না, তাহলে তিনি সবার নিকট কিয়ামত পর্যন্ত কীভাবে দীন পৌঁছাবেন, কারণ তিনি একা, তার হায়াত মাত্র তেষট্টি বছর

এটা অসম্ভব যে, তিনি সবার নিকট সশরীরে গিয়ে দীন পৌঁছাবেন। এটা অবাস্তব যে, সকল মানুষ তার নিকট এসে দীন শিখবে। তবে এটা যৌক্তিক ও বাস্তব যে, তিনি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করবেন, যার সাথে তার সাক্ষাত হবে, কিংবা যারা তার নিকট আসবে, তাদেরকে তিনি দীন শেখাবেন। এরপর তারা পরবর্তীদের শেখাবে, যারা তার সাক্ষাত পায়নি, কিংবা তার নিকট উপস্থিত হতে পারেনি। এভাবে সমগ্র বিশ্বে সবার নিকট কিয়ামত পর্যন্ত দীন পৌঁছবে। কেউ বলতে পারবে না, আমার নিকট দীন পৌঁছেনি, কিংবা দীন শেখার সুযোগ আমি পাইনি। উসুলে হাদিসের পরিভাষায় এ পদ্ধতির নাম علم الرواية অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতির নিকট রিসালাত পৌঁছে দেওয়ার পদ্ধতিকে ‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ’ বলা হয়।

‘ইলমুর রিওয়াইয়া’র পদ্ধতিতে সবার নিকট দীন পৌঁছবে, কিন্তু দীনের স্বকীয়তা ও অক্ষুণ্নতা বহাল রাখার জন্য এ পর্যন্ত যথেষ্ট নয়। কারণ এ পদ্ধতিতে দীনের বাহন মানুষ, মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়তাদের থেকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ভুল হতে পারে। তাই পৌঁছানো দীন সঠিক কি-না যাচাইয়ের উপায় থাকা জরুরি। তাহলে দীনের অক্ষুণ্নতা বজায় থাকবে ও সঠিকভাবে আল্লাহর ইবাদত আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব হবে। উসুলে হাদিসের পরিভাষায় এ পদ্ধতির নাম علم الدراية অর্থাৎ সহিহ, যয়িফ ও জাল হাদিস চিহ্নিত করার নীতিকে ‘ইলমুদ দিরায়াহ’ বলা হয়।

২. খ. ইলমুর রিওয়াইয়াহ

স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) ইলমুর রিওয়াইয়ার সূচনা করেন। এরপর ধীরে ধীরে তার পরিসর বর্ধিত হয়। নবি (সা.) বলেন,

«بَلِّغُوا عَنِّى وَلَوْ آيَة»

‘আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছে দাও[1]

«لِيُبَلِّغْ الشَّاهِدُ مِنْكُمُ الْغَائِبَ»

‘তোমাদের উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়”।[2]

«تَسْمَعُونَ مِنِّى، وَيُسْمَعُ مِنْكُمْ، وَيُسْمَعُ مِمَّنْ يَسْمَعُ مِنْكُمْ»

‘তোমরা আমার কথা মনযোগ সহকারে শোনো, (কারণ) তোমাদের থেকেও অন্যরা শুনবে এবং যারা তোমাদের থেকে শুনবে তাদের থেকেও অন্যরা শুনবে[3]

«نَضَّرَ اللَّهُ امْرَأً سَمِعَ مِنَّا شَيْئًا فَبَلَّغَهُ كَمَا سَمِعَ»

‘আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে সমুজ্জ্বল করুন, যে আমার কথাগুলো শুনেছে, এরপর যথাযথভাবে অপরজনের নিকট তা পৌঁছে দিয়েছে[4]

এ কারণেই হাদিস বর্ণনার ধারা আরম্ভ হয়। সাহাবিগণ রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে প্রকাশিত কথা, কর্ম, সমর্থন ও তার গুণগান যথাযথভাবে তাদের পরের স্তরের বর্ণনাকারীদের নিকট বর্ণনা করেন। পরবর্তী স্তরের বর্ণনাকারীগণ তাদের পরবর্তী বর্ণনাকারীদের নিকট, তাদের পরবর্তী স্তরের বর্ণনাকারীগণ তাদের পরবর্তী বর্ণনাকারীদের নিকট... বর্ণনা করেন

২. গ. ইলমুদদিরায়াহ

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن جَآءَكُم فَاسِقُ بِنَبَإ فَتَبَيَّنُوٓاْ

‘হে ইমানদারগণ, যদি কোন পাপাচারী তোমাদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও[5]

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,

«مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ»

‘যে আমার উপর মিথ্যা বলল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়[6]

এ জন্য সাহাবিগণ হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। কোনো হাদিস সন্দেহ হলে যাচাই করতেন। কখনো বর্ণনাকারীর নিকট সাক্ষী তলব করতেন। যেমন মুগিরা ইবনু শুবা যখন বললেন, ‘নবি (সা.) নাতির পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে দাদিকে এক ষষ্ঠাংশ মিরাস প্রদান করেছেন, তখন আবু বকর (রা.) তার নিকট সাক্ষী তলব করেন তখন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রা.) তার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন[7] মাওলা আলি (রা.) হাদিসের শুদ্ধতার জন্য কখনও বর্ণনাকারী থেকে কসম নিতেন। তাদের উদ্দেশ্য কখনো হাদিসের পথ সংকীর্ণ কিংবা রুদ্ধ করা ছিল না, বরং তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভুল ও মিথ্যার সুযোগ নষ্ট করা, যেন সবাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কোনো হাদিস সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে সতর্ক হয়।

সাহাবিগণ হাদিসের শুদ্ধতা রক্ষার স্বার্থে হাদিসের সনদ তলব করেনকারণ মানুষ যখন দলেদলে ইসলামে প্রবেশ করছিল, তখন একটি কুচক্রী মহল দীনের প্রতি মানুষের আগ্রহ দেখে মিথ্যা হাদিস বর্ণনা আরম্ভ করে, তাই হাদিস গ্রহণ করার পূর্বে বর্ণনাকারীর অবস্থা জানা আবশ্যক হয়ে যায়। তখন মুসলিম সমাজে প্রসিদ্ধ ছিল যে,

«إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِينٌ، فَانْظُرُوا عَمَّنْ تَأْخُذُونَ دِينَكُمْ»

‘নিশ্চয় এ ইলম দীনের অংশ, অতএব পরখ করে দেখ কার থেকে তোমরা তোমাদের দীন গ্রহণ করছ’[8]

মুহাম্মাদ ইবনু সিরিন রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

«لَمْ يَكُونُوا يَسْأَلُونَ عَنِ الإِسْنَادِ، فَلَمَّا وَقَعَتِ الْفِتْنَةُ، قَالُوا: سَمُّوا لَنَا رِجَالَكُمْ، فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ، فَيُؤْخَذُ حَدِيثُهُمْ، وَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ الْبِدَعِ، فَلَا يُؤْخَذُ حَدِيثُهُمْ».

‘তারা (সাহাবাগণ) সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন না, কিন্তু যখন ফিতনা (উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত) সংঘটিত হল, তারা বলল, তোমরা আমাদেরকে তোমাদের বর্ণনাকারীদের নাম বল, আহলুস সুন্নাহ হলে তাদের হাদিস গ্রহণ করা হবে, আর বিদয়াতি হলে তাদের হাদিস ত্যাগ করা হবে[9]

উকবাহ ইবনু আমির (রা.) তার সন্তানদের উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘হে আমার সন্তানেরা, আমি তোমাদেরকে তিনটি বিষয় থেকে নিষেধ করছি, ভালো করে স্মরণ রেখো: নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি ব্যতীত কারো থেকে হাদিস গ্রহণ কর না, উলের মোটা কাপড় পরলেই দীনদার হবে না, আর কবিতা লিখে তোমাদের অন্তরকে কুরআন বিমুখ করো না[10]

আনাস ইবনু মালিক (রা.) স্বীয় ছাত্র সাবিত আলবুনানিকে বলেন, ‘হে সাবিত! আমার থেকে গ্রহণ কর, তুমি আমার অপেক্ষা নির্ভরযোগ্য কাউকে পাবে না, কারণ আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে গ্রহণ করেছি, তিনি জিবরিল থেকে গ্রহণ করেছেন, আর জিবরিল আল্লাহ তায়ালা থেকে গ্রহণ করেছেন।’[11]

৩. ক. ইলমুল জারহ ওয়াত-তা’দিলের যুগ

সাহাবিদের যুগ থেকেই রাবিদের যাচাই-বাছাই করা আরম্ভ হয়। কারো হাদিস তারা প্রত্যাখ্যান করেন, কারো হাদিস সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেন। ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ মুজাহিদ ইবনু জাবর থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট বুশাইর আদাবি এসে বলতে লাগল: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন...।’ কিন্তু ইবনু আব্বাস তাকে হাদিস বলার অনুমতি দেননি, তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করেননি। সে বলল, ‘হে ইবনু আব্বাস, আপনি কেন মনোনিবেশ করছেন না? আমি রাসুলের হাদিস বলছি, আপনি শুনছেন না!’ ইবনু আব্বাস বললেন: ‘আমরা এক সময় যখন কাউকে বলতে শুনতাম: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তার দিকে আমরা মনোযোগ দিতাম, কিন্তু লোকেরা যখন কঠিন ও নরম বাহনে আরোহণ করল (হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রশংসিত ও নিন্দনীয় উভয় পন্থা অবলম্বন করল), তখন থেকে শুধু পরিচিত বস্তুই আমরা গ্রহণ করি[12]

এভাবে সাহাবিদের যুগ শেষ না হতেই সনদ তলব করা আরম্ভ হয় এবং علم الجرح والتعديل তথা ‘সমালোচনা শাস্ত্রে’র সূচনা হয়তারা সহিহ হাদিস ও সিকাহ রাবি চিহ্নিত করার কতক নীতি তৈরি করেন, যা সবার নিকট প্রসিদ্ধ হওয়ার কারণে স্বতন্ত্র গ্রন্থে জমা করার প্রয়োজন হয়নি।

. . ইলমুল হাদিসের বিকাশের যুগ

যখন সাহাবা আজমায়িন দাওয়াত ও জিহাদের উদ্দেশ্যে পূর্ব-পশ্চিম বিচরণ করেন, বিভিন্ন দেশের তাবিয়িগণ তাদের থেকে ইলম হাসিল করার সুযোগ পান। কিন্তু তারা কিছু সমস্যারও মুখোমুখি হন, যেমন: মানুষের স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া, লেখালেখির উপর নির্ভরতা বাড়া, ধীরে ধীরে সনদ দীর্ঘ হওয়া, মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে রাবি ও হাদিসের সনদ বাড়া, কিছু বাতিল ফিরকার আত্মপ্রকাশ ঘটা ইত্যাদি

তাবিয়িগণ এসব সমস্যার সমাধানের জন্য হাদিসশাস্ত্রের সুরক্ষার স্বার্থে সাহাবিদের থেকে শেখা নীতির সাথে নতুন কতিপয় নীতি তৈরি করেন। যেমন: রাবি ও সনদ যাচাই করা, তারা রাবিদের অবস্থা, নাম, উপাধি, উপনাম, জন্ম ও সফর ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করেন। রাবিদের দেশ সফর, অবস্থান, মৃত্যু এবং প্রত্যেকের ভালো-মন্দ জানা, তাদের স্মৃতিশক্তি ও হাদিসের উপর দক্ষতার কথা সংরক্ষণ করেন। এভাবে তারা গ্রহণযোগ্য ও পরিত্যক্ত রাবিদের পৃথক করেন।[13]

তারা সনদকে দীনের অংশ মনে করেন, কারণ সনদ (বর্ণনাকারীদের বর্ণনা পরম্পরা) হলো সহিহ, দুর্বল ও জাল হাদিস পার্থক্যের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। ইমাম মুসলিম সহিহ মুসলিমের ভূমিকায়[14] আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক থেকে বর্ণনা করেন:

«‏الْإِسْنَادُ مِنْ الدِّينِ، وَلَوْلَا الْإِسْنَادُ لَقَالَ مَنْ شَاءَ مَا شَاءَ ‏»، ‏ وقَالَ أيضاً: «‏بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْقَوْمِ الْقَوَائِمُ» ‏يَعْنِي الْإِسْنَادَ».

‘সনদ দীনের অংশ, যদি সনদ না থাকত তাহলে যে যা ইচ্ছা তাই বলত।’ অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আমাদের ও পূর্ববর্তীদের মাঝে রয়েছে সিঁড়ি (অর্থাৎ সনদ)

এ যুগে হাদিসের কতক পরিভাষা সৃষ্টি হয়, যেমন মুদাল্লাস, মুরসাল, মুত্তাসিল, মারফু, মাওকুফ, মাকতু ইত্যাদি তাবিয়িগণ রাবিদের গুণাগুণ নির্ণয়ে বিভিন্ন পরিভাষা গ্রহণ করেন, যেমন যয়িফ, কাযযাব, সিকাহ, আদিল, যাবিত ইত্যাদি। এছাড়াও তাবিয়িগণ বিভিন্ন দেশ থেকে হাদিসের সনদগুলো জমা করে পরখ করেন ও এক হাদিসের সাথে অপর হাদিস তুলনা করেনএভাবে হাদিসের শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন। কিন্তু তখনও হাদিস যাচাইয়ের নীতিগুলো স্বতন্ত্র কোনো কিতাবে লিপিবদ্ধ হয়নি, কারণ হাদিসের প্রত্যেক ছাত্রের নিকট তা প্রসিদ্ধ ছিল।

৪. হাদিসশাস্ত্রের স্বর্ণযুগ

দ্বিতীয় হিজরির শেষার্ধ থেকে চতুর্থ হিজরির প্রথমার্ধ পর্যন্ত সময়কে ইলমুল হাদিসের স্বর্ণযুগ বলা হয়। তৃতীয় শতাব্দিতে মুহাদ্দিসগণ হাদিসের কিতাব রচনায় মনোযোগী হন। এ সময় হাদিসের মূল কিতাবগুলো রচনা করা হয়। যেমন: ইমাম মালিকের আলমুয়াত্তা, আহমাদ ইবনু হাম্বলের আলমুসনাদ, বুখারির আসসাহিহ, মুসলিমের আসসাহিহ, আবু দাউদের আসসুনান, তিরমিযির আসসুনান, নাসায়ির আসসুনান, ইবনু মাজাহর আসসুনান-সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিতাব।

এসময় অনেক মুহাদ্দিস علم الرجال ‘ইলমুর রিজাল’ বা রাবিদের জীবনীর উপর একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন, যেমন: ইমাম বুখারি রচনা করেন আততারিখুল কাবির, আততারিখুল আওসাত, আততারিখুস সাগির, কিতাবুয যুয়াফা; ইয়াহইয়া ইবনু মায়িন রচনা করেন আততারিখ; ইবনু সাদ লিখেন আততাবাকাতুল কুবরা; ইমাম নাসায়ি রচনা করেন কিতাবুয যুয়াফা; ইবনু আবি হাতিম আলজারহু ওয়াত তাদিল; ইবনু হিব্বান কিতাবুস সিকাত ইত্যাদি রচনা করেন। এসব কিতাবে তারা রাবিদের নাম, কে সিকাহ কে দুর্বল, কে গ্রহণযোগ্য কে পরিত্যক্ত ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করেন।

[1] বুখারি, আসসাহিহ : ৩৪৬১।

[2] বুখারি, আসসাহিহ : ১০৫

[3] আবু দাউদ, আসসুনান : ৩৬৫৯।

[4] তিরমিযি, আসসুনান : ২৬০০

[5] সুরা হুজুরাত, ৪৯ : ৬

[6] বুখারি, আসসাহিহ : ১১০; মুসলিম, আসসাহিহ : ৩।

[7] আবু দাউদ, আসসুনান : ২৮৯৪; তিরমিযি, আসসুনান : ৪১৯-৪২০।

[8] মুসলিম, আসসাহিহ : ১/১৪; ভূমিকাংশ।

[9] মুসলিম, আসসাহিহ : ১/১৪; ভূমিকাংশ।

[10] তাবারানি, মুজামুল কাবির : ১৭/২৬৮, হাইসামি, মাজমাউয যাওয়ায়িদ: ১/১৪০।

[11] তিরমিযি, আসসুনান : ৩৮৩১।

[12] মুসলিম, আসসাহিহ : ১/১৩; ভূমিকাংশ।

[13] দেখুন: বুখারি, আসসাহিহ : ৬৪০৩।

[14] মুসলিম, আসসাহিহ : ১৫-১৬।

প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ব্যখ্যা, সমাজের কোন অমীমাংসিত বিষয়ে ধর্মতত্ত্ব, হাদিস, কোরআনের আয়াতের তাৎপর্য কিংবা অন্য যেকোন ধর্মের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সর্বপরি মানব জীবনের সকল দিকে ধর্মের গুরুত্ব নিয়ে লিখুন আপনিও- [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড