• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর-৩

যাবিহুল্লাহ কে, ইসমাইল না ইসহাক?

  মুনীরুল ইসলাম ইবনু যাকির

০৭ আগস্ট ২০১৯, ১১:০৪
Safa
সাফা-মারওয়ার বর্তমান দৃশ্য, যেখানে হাজিরা সাঈ করেন। ছবি : উইকিপিডিয়া

ইসলামি বিশ্বাস হচ্ছে—নবী ইবরাহিম আলাইহিস সালামের বড় ছেলে ইসমাইল আলাইহিস সালামকে কুরবানির জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। অর্থাৎ, ইসমাইল হচ্ছেন ‘যাবিহুল্লাহ’। এটি সরাসরি কুরআন দ্বারা প্রমাণিত, আর এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা রয়েছে। পূর্বোল্লিখিত সুরা সাফফাতের ৯৯ থেকে ১১২ নং আয়াতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়কেননা, আল্লাহ তায়ালা ইসমাইল আলাইহিস সালামের ব্যাপারে সুসংবাদ, তার বেড়ে ওঠা এবং কুরবানির ঘটনাবলি বর্ণনার পর বলেছেন,

وَبَشَّرۡنَـٰهُ بِإِسۡحَـٰقَ نَبِيًّ۬ا مِّنَ ٱلصَّـٰلِحِينَ

‘এরপর আমি তাকে সুসংবাদ দিয়েছিলাম ইসহাকের, সে ছিল এক নবী, সৎকর্মশীলদের অন্যতম।’ [সুরা সাফফাত : ১১২]

এখানে পুরো কুরবানির ঘটনা বর্ণনা করার পরে ২য় সন্তান অর্থাৎ ইসহাক আলাইহিস সালামের জন্মের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। সুতরাং কুরবানির ঐ ঘটনার সময় ইসহাক আলাইহিস সালামের জন্মই হয়নি।

ইমাম ইবনু কাসির (রহ.) তার তাফসির গ্রন্থে এ সকল আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করেন, যা নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে যে, ইসমাইল আলাইহিস সালামকেই কুরবানির জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, ইসহাক আলাইহিস সালামকে নয়। যেমন :

  • ইসমাইল (আ.) ছিলেন তার প্রথম সন্তান, যার ব্যাপারে ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল। মুসলিম ও আহলে কিতাবগণের ঐকমত্য অনুসারে তিনি হলেন ইসহাক আলাইহিস সালামের চেয়ে বড়। কোন কোন নথিতে আছে যে, তাকে তার প্রথম জন্ম নেয়া ছেলেকে কুরবানি দিতে বলা হয়েছিল।
  • সাধারণত প্রথম ছেলে অন্যদের চেয়ে বেশি প্রিয় হয়ে থাকে, আর তাই তাকে কুরবানি করার আদেশ পরীক্ষার জন্য অধিকতর উপযোগী।
  • ইসমাইল আলাইহিস সালামের ব্যাপারে বলা হয়েছিল,

﴿فَبَشَّرۡنَـٰهُ بِغُلَـٰمٍ حَلِيمٍ۬

(হিজরতের পর) তাকে আমি পরম ধৈর্যশীল একজন পুত্র সন্তানের (ইবরাহিম খলিলের প্রথম সন্তান—ইসমাইলের) সুসংবাদ দিলাম। [সুরা সাফফাত : ১০১]

আর ইবরাহিম (আ.) কুরবানি করার মনস্থ করেছিলেন ধৈর্যশীল সন্তানেরই। আর এর পরে একই সুরায় ফেরেশতারা ইবরাহিমের কাছে ইসহাকের সুসংবাদ নিয়ে আসেন। তারা বললেন,

﴿قَالُواْ لَا تَوۡجَلۡ إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَٰمٍ عَلِيمٖ﴾

‘আমরা আপনাকে একটি পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি, যার অনেক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থাকবে।’ [সুরা হিজর: ৫৩]

ইবরাহিম আলাইহিস সালামের বয়স যখন ৮৬ বছর তখন ইসমাইল আলাইহিস সালাম বিবি হাজেরার গর্ভে এবং বয়স যখন ৯৯ তখন বিবি সারার গর্ভে ইসহাক জন্মগ্রহণ করেন। ইবরাহিম (আ.) সর্বমোট ২০০ বছর বেঁচে ছিলেন। [তাফসির ইবনে কাসির, ৪/১৬, তাফসিরে কুরতুবি, ২/৯৮-৯৯]

এখানে সুরা সাফফাতে ইসমাইলকে ধৈর্যশীল বলে বর্ণনা করা হয়েছে, যা এই পটভূমিতে যথার্থ। [তাফসির ইবনু কাসির, ৪/১৫] আর আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের সমসাময়িক সময়ের ইহুদিরা জানত যে, আরব ভূমিতে একজন নবী আসছেন এবং তারা তার জন্য রীতিমত অপেক্ষা করছিল। কিন্তু তিনি যেহেতু ইসহাক (আ.) থেকে বিস্তৃত বনি ইসরাইলের বংশধারায় জন্মগ্রহণ না করে, ইসমাইল আলাইহিস সালামের বংশধারায় জন্মগ্রহণ করলেন তখন তারা তা সহ্য করতে পারল না।

সহিহ বুখারিতে ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক তাঁর বড় ছেলে ইসমাইল আলাইহিস সালামকে মক্কার মরুভূমিতে রেখে আসার ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে

সাঈদ ইবনু জুবায়র (রা.) থেকে বর্ণিত ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ইবরাহিম (আ.) হাযেরা এবং তাঁর শিশু সন্তান ইসমাইল আলাইহিস সালামকে সাথে নিয়ে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হলেন, এ অবস্থায় যে, হাযেরা শিশুকে দুধ পান করাতেন। অবশেষে যেখানে কাবা ঘর অবস্থিত, ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাঁদের উভয়কে সেখানে নিয়ে এসে মাসজিদুল হারামের উঁচু অংশে যমযম কূপের উপরে অবস্থিত একটি বিরাট গাছের নিচে তাঁদেরকে রাখলেন। তখন মক্কায় না ছিল কোনো মানুষ, না ছিলো কোনোরূপ পানির ব্যবস্থা। তিনি তাদেরকে সেখানেই রেখে গেলেন। তিনি তাঁদের কাছে রেখে গেলেন একটি থলের মধ্যে কিছু খেজুর এবং একটি মশকে কিছু পরিমাণ পানি।

এরপর ইবরাহিম (আ.) ফিরে চললেন ...।

এদিকে ইসমাইলের মা ইসমাইলকে স্বীয় স্তন্যের দুধ পান করাতেন এবং নিজে ঐ মশক থেকে পানি পান করতেন। অবশেষে মশকে যা পানি ছিল, ফুরিয়ে গেল। তিনি নিজে পিপাসিত হলেন, এবং তাঁর (বুকের দুধ শুকিয়ে যাওয়ায়) শিশু পুত্রটি পিপাসায় কাতর হয়ে পড়লো। তিনি শিশুটির প্রতি দেখতে লাগলেন। পিপাসায় তার বুক ধড়ফড় করেছে। অথবা বর্ণনাকারী বলেন, সে মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। শিশুপুত্রের এ করুণ অবস্থার প্রতি তাকানো অসহনীয় হয়ে পড়ায় তিনি সরে গেলেন আর তাঁর অবস্থানের সংলগ্ন পর্বত ‘সাফা’কে একমাত্র তাঁর নিকটমত পর্বত হিসাবে পেলেন। এরপর তিনি তার উপর উঠে দাঁড়ালেন আর ময়দানের দিকে তাকালেন। এদিকে সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন, কোথাও কাউকে দেখা যায় কি না। কিন্তু তিনি কাউকে দেখতে পেলেন না।

তখন ‘সাফা’ পর্বত থেকে নেমে পড়লেন। অবশেষে ময়দান অতিক্রম করে ‘মারওয়া’ পাহাড়ের নিকট এসে তার উপর উঠে দাঁড়ালেন। তারপর এদিকে সেদিকে তাকালেন, কাউকে দেখতে পান কি না। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলেন না। এভাবে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করলেন। ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নবি (সা.) বলেছেন, এজন্যই মানুষ (হজের বা উমরার সময়) এ পাহাড়দ্বয়ের মধ্যে সাতবার চক্কর দিয়ে থাকে।

হঠাৎ যেখানে যমযম কূপ অবস্থিত, সেখানে তিনি একজন ফেরেশতা দেখতে পেলেন। সেই ফেরেশতা আপন পায়ের গোড়ালি দ্বারা আঘাত করলেন অথবা তিনি বলছেন, আপন ডানা দ্বারা আঘাত করলেন। ফলে পানি বের হতে লাগল। তখন হাযেরা আলাইহাস সালাম এর চারপাশে নিজ হাতে বাধা দিয়ে একটি হাউযের ন্যায় করে দিলেন এবং হাতের কোষ ভরে তাঁর মশকটিতে পানি ভরতে লাগলেন। তখনও পানি উপচে উঠতে থাকলো।

বর্ণনাকারী বলেন, তারপর হাযেরা পানি পান করলেন, আর শিশু পুত্রকেও দুধ পান করালেন, তখন ফেরেশতা তাঁকে বললেন, ‘আপনি ধ্বংসের কোনো আশংকা করবেন না। কেননা এখানেই আল্লাহর ঘর রয়েছে। এ শিশুটি এবং তাঁর পিতা দু’জনে এখানে ঘর নির্মাণ করবে এবং আল্লাহ তাঁর আপনজনকে কখনও ধ্বংস করেন না।’ ঐ সময় আল্লাহর ঘরের স্থানটি জমিন থেকে টিলার ন্যায় উঁচু ছিলো। বন্যা আসার ফলে তার ডানে বামে ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। এরপর হাযেরা এভাবেই দিন যাপন করছিলেন…। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং : ৩১২৫; সংক্ষেপিত]

এই ঘটনাটি বাইবেলের আদিপুস্তক (Book of Genesis) ২১ : ১৩-১৯-এও বর্ণিত হয়েছে। এভাবে যখন ইসমাইল (আ.) পরিণত বয়সে পৌঁছুলেন তখন আল্লাহ তায়ালা তার খলিলকে আদেশ করলেন ইসমাইলকে কুরবানি করতে। আর বাইবেলের বিবরণ থেকেও এটা প্রমাণ হয় যে, তখনও ইসহাক আলাইহিস সালামের জন্মই হয়নি। বাইবেলের বর্ণনামতে ইসমাইল (আ.) ছিলেন ছোট ভাই ইসহাক আলাইহিস সালামের ১৪ বছরের বড়। [বাইবেল, বুক অব জেনেসিস, ১৬ : ১৬ ও ২১ : ৫ দ্রষ্টব্য]

এ কারণে আল-কুরআন, সহিহ হাদিস, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও উম্মাহর সর্বসম্মত সুস্পষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে এভাবে মুসলিম উম্মাহ নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে যে, ইসমাইল আলাইহিস সালামই হচ্ছেন যাবিহুল্লাহ।

চলবে...।

আগের পর্ব- কুরবানি ইবরাহিম খলিলের সুন্নাহ

প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ব্যখ্যা, সমাজের কোন অমীমাংসিত বিষয়ে ধর্মতত্ত্ব, হাদিস, কোরআনের আয়াতের তাৎপর্য কিংবা অন্য যেকোন ধর্মের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সর্বপরি মানব জীবনের সকল দিকে ধর্মের গুরুত্ব নিয়ে লিখুন আপনিও- [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড