মুনীরুল ইসলাম ইবনু যাকির
সাইয়িদুনা ইবরাহিম আলাইহিস সালামের পুরো জীবনটাই ছিল ঈমানি পরীক্ষায় ঘেরা। আর সমস্ত পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণও হয়েছিলেন চমৎকারভাবে। কিন্তু জীবনসায়াহ্নে মহান আল্লাহ তাকে এমন এক মহাপরীক্ষার সম্মুখীন করলেন, পৃথিবীতে ইতঃপূর্বে কোনো মানব নিপতিত হয়নি যে পরীক্ষায়। পবিত্র কুরআনে এসেছে,
আল্লামা ইবনু কাসির (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জানান যে, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইবরাহিম (আ.) যখন তার পিতৃভূমি থেকে হিজরত করলেন, তখন তিনি তার প্রভুর কাছে চেয়েছিলেন যে, তিনি যেন তাকে সৎকর্মশীল সন্তান দান করেন। তাই আল্লাহ তায়ালা তাকে একজন ধৈর্যশীল পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। এটা ছিল ইসমাইলের ব্যাপারে, কেননা তিনি ছিলেন ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ঔরসে জন্ম নেয়া প্রথম সন্তান। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই যে, ইবরাহিমের ঘরে ইসমাইলই প্রথম জন্মগ্রহণ করেছিলেন। [ইবনু কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১/১৫৭-১৫৮]
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ ٱلسَّعۡيَ অর্থাৎ ‘যখন সে তার সাথে হাঁটাচলার উপযোগী হলো’—এর অর্থ হচ্ছে, যখন সে বড় হয়েছিল এবং তার বাবার মতই নিজেই নিজের দেখাশোনা করতে পারত। মুজাহিদ (রহ.) বলেন, ‘যখন সে তার সাথে হাঁটাচলার উপযোগী হলো’ এর অর্থ হচ্ছে, যখন সে বড় হয়ে উঠেছিল এবং বাহনে চড়তে পারত, হাঁটতে পারত এবং তার বাবার মত কাজ করতে পারত। আরবি ভাষাবিদ ফাররা বলেন, ‘যবেহের সময় ইসমাইলের বয়স ছিল ১৩ বছর। ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ‘ঐ সময় তিনি কেবল সাবলকত্বে উপনীত হয়েছিলেন।’ [তাফসির কুরতুবি, ১৫/৯৯]
এমতাবস্থায় ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নে দেখলেন যে, তাঁকে তার ছেলেকে কুরবানি করার আদেশ দেয়া হচ্ছে। নবিদের স্বপ্নও ওহি। তাদের বাহ্যিক দৃষ্টি বন্ধ থাকলেও অন্তর্দৃষ্টি খোলা থাকে। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা তাঁর খলিলকে, তার প্রিয়পুত্র কুরবানি করার আদেশ দিয়ে পরীক্ষা করছিলেন, যে পুত্রকে তিনি পেয়েছিলেন তার বৃদ্ধাবস্থায়। তারপর শিশু অবস্থায় তাকে এবং তার মাকে মরুভূমিতে রেখে আসার আদেশ পেয়েছিলেন। এমন একটা বিজন প্রান্তরে যেখানে ছিল না কোন জনমানবের সাড়া। ছিল না কোন শ্যামল বৃক্ষরাজি। আর না ছিল কোন পাখ-পাখালি। ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালন করলেন এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে তাদেরকে সেখানে রেখে আসলেন। আর আল্লাহ তাদের জন্য অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে রিযিক পাঠালেন। এত কিছুর পরেও, তার ঘরে প্রথম জন্ম নেয়া ও তার একমাত্র পুত্রকে কুরবানি করার জন্য যখন আদেশ করা হলো, তিনি তখন তাঁর প্রভুর ডাকে সাড়া দিলেন প্রিয় সন্তানকে কুরবানি করতে উদ্যত হলেন। তারপূর্বে তিনি তার ছেলেকে ব্যাপারটা সম্বন্ধে বললেন—‘হে আমার পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি (আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য কুরবানি করছি)। এখন, তুমি কী মনে কর!’ ধৈর্যশীল সন্তান সাথে সাথেই জবাব দিল, ‘বাবা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা-ই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল হিসেবেই পাবেন।
আল্লাহ বলেন,فَلَمَّآ أَسۡلَمَا وَتَلَّهُۥ لِلۡجَبِينِ ‘তারপর তারা উভয়ে নিজেদেরকে (আল্লাহর ইচ্ছার কাছে) সমর্পণ করল, এবং সে তাকে তার পার্শ্বে কাত করে শুইয়ে দিল।’ এখানে বলা হয়েছে, ‘যখন তারা উভয়ে নিজেদেরকে সমর্পণ করল’ এর অর্থ হচ্ছে তারা দু’জনে যখন নিজেদেরকে আল্লাহর আদেশের কাছে সমর্পণ করল। ‘এবং সে তাকে শুইয়ে দিল’ এর অর্থ হচ্ছে তিনি ইসমাইলকে মাটির দিকে মুখ করে রাখলেন। এখানে বলা হলো যে, তিনি তাকে পেছন থেকে যবেহ করতে চাইলেন, যেন তিনি যবেহ করার সময় তার মুখটা দেখতে না পান। এটা হলো ইবনু আব্বাস ও মুজাহিদ (রহ.) এর মত। ‘তারা উভয়ে নিজেদের সমর্পণ করল’ এর অর্থ হচ্ছে ইবরাহিম (আ.) বললেন, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এবং ‘আল্লাহু আকবার’ আর ছেলেটি বলল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ - কেননা সে মৃত্যুবরণ করতে যাচ্ছিল। মুফাসসির সুদ্দি এবং অন্যান্যরা বলেন যে, ইবরাহিম (আ.) ইসমাইলের গলদেশে ছুরি চালান, কিন্তু ছুরি চলছিল না। বলা হয় যে, ছুরি ও তার গলার মাঝখানে একটা তামার পাত রাখা হয়েছিল (এ ব্যাপারে আল্লাহই ভালো জানেন।) তারপর তা প্রত্যাহার করা হয়েছিল যখন আল্লাহ বললেন,
﴿ قَدۡ صَدَّقۡتَ ٱلرُّءۡيَآۚ﴾ [الصافات: ١٠٥]
‘হে ইবরাহিম! তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছ!’ এর অর্থ হচ্ছে উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে, তোমাকে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং তোমার প্রভু তোমাকে যে আদেশ করেছেন, তা পালন করার ব্যাপারে তোমার ইচ্ছা ও আনুগত্য প্রমাণিত হয়েছে। তোমার পুত্রের পরিবর্তে বিকল্প কুরবানির ব্যবস্থা করা হবে, যেমন ভাবে তুমি তোমার নিজের শরীরকে আগুনের শিখায় সমর্পণ করেছিলে এবং তোমার অতিথিদের সম্মান জানাতে তোমার সম্পদ খরচ করেছিলে, তা স্মরণ রেখে। তাই আল্লাহ বলেন,
﴿ إِنَّ هَٰذَا لَهُوَ ٱلۡبَلَٰٓؤُاْ ٱلۡمُبِينُ﴾ [الصافات: ١٠٦]
‘নিশ্চয় এটা ছিল স্পষ্ট পরীক্ষা’ অর্থাৎ এটা যে একটা পরীক্ষা ছিল তা পুরোপুরি স্পষ্ট। নিঃসন্দেহে এখানে মূল উদ্দেশ্য যবেহ ছিল না, বরং উদ্দেশ্য ছিল পিতা-পুত্রের আনুগত্য ও তাকওয়ার পরীক্ষা নেওয়া। সে পরীক্ষায় উভয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন শতভাগ।
﴿ وَفَدَيۡنَٰهُ بِذِبۡحٍ عَظِيمٖ﴾ [الصافات: ١٠٧]
‘আমি তাকে একটা বড় কুরবানি দিয়ে মুক্ত করলাম’ এর অর্থ হচ্ছে আমি তার ছেলের মুক্তিপণের ব্যবস্থা করলাম, তার পরিবর্তে যবেহ করার জন্য বিকল্প হিসেবে। বেশিরভাগ আলিমের মতে, এটা ছিল শিং বিশিষ্ট খুব সুন্দর সাদা একাটা ভেড়া। ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, ‘এটা ছিল এমন একটা ভেড়া যা চল্লিশ বছর ধরে জান্নাতে বেড়িয়েছে।’ [ইবনু কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১/১৫৭-১৫৮]
চলবে...।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড