• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (পর্ব-১)

  মুনীরুল ইসলাম ইবনু যাকির

০৮ জুলাই ২০১৯, ২১:৩৪

আসছে হজের মৌসুম। পৃথিবীর চারিদিক থেকে কাবা অভিমুখে যাত্রারম্ভ করেছেন হাজি সাহেবগণ। মুখে মুখে গুঞ্জরিত হচ্ছে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। প্রাণের কাবা, আর কতদূর—প্রাণে প্রাণে এই আকুতি। সেই কালো গিলাফ, মাকামে ইবরাহিম, রুকনে ইয়ামানি, হাজরে আসওয়াদ, মিনা, মুযদালিফা, আরাফাত—সব যেন ডাকছে হাতছানি দিয়ে। ৪ জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের হজ ফ্লাইট। ছলছল আঁখিতে স্বজনেরা বিদায় জানাচ্ছেন আল্লাহর মেহমানদের। দৈনিক অধিকার পাঠকদের জন্য হজ নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক আয়োজন ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’। আমরা এখানে আলোচনা করবো হজ সংশ্লিষ্ট নানান বিষয় নিয়ে। আজকে থাকছে তার প্রথম পর্ব।

হজ কী? হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ইচ্ছা’ বা ‘সংকল্প’ করা। পারিভাষিক অর্থে হজ হলো—বৎসরের নির্দ্দিষ্ট দিনে, নির্দ্দিষ্ট পোশাকে, নির্দ্দিষ্ট স্থানে উকুফ বা অবস্থান, বাইতুল্লার তাওয়াফ, পশু কুরবানি, নির্দ্দিষ্ট স্থানে কংকর নিক্ষেপ এবং সাফা-মারওয়া টিলাদ্বয়ের সাঈ। হজ হলো ইমান ও আমলের আভায় জীবন উদ্ভাসিত করার এক পাঠশালা। যে পাঠশালায় আল্লাহর সাথে গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের সম্পর্ক। আনুগত্যের নানামুখী সুষমায় সিক্ত হয় তাদের মন। আল্লাহর সামনে দীনতা হীনতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঔজ্জ্বল্য পায় তাদের হৃদয়।

হজের ইতিহাস হজের বিধিবদ্ধ নিয়ম এসেছে সাইয়িদুনা ইবরাহিম আলাইহিস সালাম থেকে। ইবরাহিম (আ.) জন্ম নিয়েছিলেন, পেশাদার ও বংশানুক্রমিক পূজারী এক বংশে। তাঁর বাপ-দাদা ছিল বংশের পন্ডিত-পুরোহিত ব্রাহ্মণ। কিন্তু শৈশবেই ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ভাবতে শুরু করলেন চন্দ্র, সূর্য, তারকা নিতান্ত গোলামের মতই উদয়-অস্তের নিয়ম অনুসরণ করছে। মূর্তি তো মানুষের নিজের হাতে পাথর দিয়ে গড়া। দেশের শাসক আমাদের ন্যায় একজন সাধারণ মানুষ। এরা রব হয় কেমন করে? ভাবতে ভাবতে তিনি একসময় সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন—বস্তুত আমার ‘রব’ কেবল তিনিই হতে পারেন যিনি সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন, সকলেই যার মুখাপেক্ষী এবং যার হাতে সকলেরই জীবন-মৃত্যু ও লাভ-ক্ষতির উৎস। এসব কথা ভেবে ইবরাহিম (আ.) স্বজাতির উপাস্য মূর্তিগুলোকে পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করলেন— إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ ‘তোমরা যাদেরকে আল্লাহর শরিক বলে মনে কর, তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’ [সুরা আল- আনয়াম, ৭৮] إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ

‘আমি সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবল সেই মহান সত্ত্বাকেই ইবাদাত-বন্দেগির জন্য নির্দিষ্ট করলাম, যিনি সমস্ত আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ [সুরা আল-আনয়াম, ৭৯] এরপর আল্লাহ তাকে বললেন, أَسْلِمْ ‘ইসলাম গ্রহণ করো’ প্রত্যুত্তরে তিনি পরিষ্কার ভাষায় বললেন, أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ ‘আমি ইসলাম কবুল করলাম—বিশ্বজগতের রবের উদ্দেশ্যে নিজেকে উৎসর্গ করলাম।’ [সুরা আল-বাকারাহ, ১৩১] আর এই স্বীকৃতিই তিনি তার সংগ্রামমুখর জীবনে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। আল্লাহর জন্যই শত বছরের পৈত্রিক ধর্ম এবং তার যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠান, ধ্যান-ধারণা, আকিদাহ-বিশ্বাস পরিত্যাগ করেছেন। নিজের বংশ, পরিবার, নিজের জাতি ও মাতৃভূমি ত্যাগ করেছেন। নিজের জীবনকে উপেক্ষা করে আগুনের বুকে ঝাঁপ দিয়েছেন। দেশত্যাগ ও নির্বাসনের দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন, দেশের পর দেশ পরিভ্রমণ করেছেন। নিজের জীবনের এক প্রতিটি মূহুর্তকে আল্লাহর তাওহিদ প্রচারের কাজে কাটিয়েছেন। বৃদ্ধ বয়সে যখন সন্তান লাভ হলো তখন তাঁর জন্যও একই দীন এবং একই কাজই নির্ধারিত করলেন। কিন্তু এসব কঠিন পরীক্ষার পর আর একটি শেষ ও কঠিন পরীক্ষা অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল। যে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম সব কিছু অপেক্ষা আল্লাহকেই বেশি ভালবাসেন কিনা, তার ফয়সালা হতে পারতো না। সেই কঠিন এবং কঠোর পরীক্ষার সামনে এসে পড়লো। বৃদ্ধ বয়সে একেবারে নিরাশ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর যে সন্তান লাভ হয়েছিল, সেই একমাত্র সন্তানকেও আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানি করতে পারেন কিনা, তারই পরীক্ষা নেয়া হলো। হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এ পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হলেন এবং আল্লাহর নির্দেশ লাভ করার সাথে সাথে যখন তিনি নিজের পুত্রকে নিজের হাতে যবেহ করতে প্রস্তুত হলেন, তখন চূড়ান্তরূপে ঘোষণা করা হলো যে, এখন তুমি মুসলিম হওয়ার দাবিকে সত্য বলে প্রমাণ করেছ। আল্লাহর কাছেও তাঁর এ কুরবানি কবুল হলো এবং তাকে বলে দেয়া হলো যে, এখন তোমাকে সারা দুনিয়ার ইমাম বা নেতা বানিয়ে দেয়া যেতে পারে, এখন তুমি সম্পূর্ণরূপে যোগ্য হয়েছো। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা সেই প্রেক্ষাপটটাই তুলে ধরেছেন— وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا قَالَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ ‘আর যখন ইবরাহিমকে তার রব কয়েকটি ব্যাপারে পরীক্ষা করলেন এবং সে সেই পরীক্ষায় ঠিকভাবে উত্তীর্ণ হলো তখন তাকে জানিয়ে দেয়া হলো যে, আমি তোমাকে সমগ্র মানুষের ইমাম (অগ্রবর্তী নেতা) নিযুক্ত করেছি। তিনি বললেন, আমার বংশধরদের থেকেও কি? আল্লাহ বললেন, যালিমদের জন্য আমার ওয়াদা প্রযোজ্য নয়।’ [সুরা আল-বাকারাহ, ১২৪]

এভাবে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে দুনিয়ার নেতৃত্ব দান করা । ইসলামের বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত করার জন্য এবং বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্ব গ্রহণ করে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার জন্য তাঁর কয়েকজন সহকর্মী একান্ত আবশ্যক হয়ে পড়লো। এ ব্যাপারে তিনজন ব্যক্তি সাইয়িদুনা ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সহযোগী স্বরূপ কাজ করেছেন। একজন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র সাইয়িদুনা লুত (আ.), দ্বিতীয়জন তার জ্যেষ্ঠপুত্র সাইয়িদুনা ইসমাঈল (আ.) এবং তৃতীয়জন হলেন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র সাইয়িদুনা ইসহাক (আ.)। ভ্রাতুষ্পুত্রকে তিনি ‘সাদুম’ (ট্রান্স জর্দান) এলাকায় দায়িত্ব দিলেন। এখানে সেকালের সর্বাপেক্ষা ইতর - লম্পট জাতি বাস করতো। সেখানে একদিকে সেই জাতির নৈতিকতার সংস্কার সাধন এবং সেই সাথে দূরবর্তী এলাকাসমূহেও ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোই ছিল তাঁর কাজ। ইরান, ইরাক এবং মিসরের ব্যবসায়ী দল এ এলাকা দিয়েই যাতায়াত করতো। কাজেই এখানে বসে উভয় দিকেই ইসলাম প্রচারের কাজ সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন করা তাঁর পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক হয়েছিল। কনিষ্ঠ পুত্র হযরত ইসহাক আলাইহিস সালামকে তিনি কেনান বা ফিলিস্তিন এলাকায় নিযুক্ত করলেন। এটা সিরিয়া ও মিসরের মধ্যবর্তী স্থান, তদুপরি এটা সমূদ্র উপকূলবর্তী এলাকা বলে এখান থেকেই অন্যান্য দেশ পর্যন্ত ইসলামের আওয়াজ পৌঁছানো সহজ ছিল। এ স্থান থেকেই ইসহাক আলাইহিস সালামের পুত্র ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এবং পৌত্র ইউসুফ আলাইহিস সালামের মারফতে ইসলাম মিসর পর্যন্ত পোঁছেছিল।

ইবরাহিম আলাইহিস সালামের জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে হিজাযের মক্কা নগরীতে দায়িত্ব দিলেন এবং দীর্ঘকাল যাবত নিজেই তাঁর সাথে থেকে আরবের কোণে কোণে ইসলামের শিক্ষা বিস্তার করেছিলেন। তারপর এখানেই পিতা-পুত্র দু’জনে মিলে পৃথিবীর প্রথম ঘর, ইসলামের বিশ্বকেন্দ্র পবিত্র কাবা প্রতিষ্ঠা করেন। আল্লাহ তায়ালা নিজেই এ কেন্দ্র নির্দিষ্ট করেছিলেন, নিজেই এটা গড়ে তোলার স্থান ঠিক করেছিলেন। পবিত্র কাবা সাধারণ মসজিদের ন্যায় নিছক ইবাদাতের স্থান নয়, প্রথম দিন থেকেই এটা দীন ইসলামের বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের প্রচার কেন্দ্ররূপে নির্ধারিত হয়েছিল। কাবা ঘর নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল এই যে, পৃথিবীর দূরবর্তী অঞ্চলসমূহ থেকে তাওহিদে বিশ্বাসী সকল মানুষ এখানে এসে মিলিত হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে এক আল্লাহর ইবাদাত করবে, আবার এখান থেকেই ইসলামের বিপ্লবী পয়গাম নিয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে যাবে। বিশ্ব মুসলিমের এই জমায়েত বা সম্মেলন এর নামই হলো ‘হজ’। চলবে, ইনশাআল্লাহ।

প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ব্যখ্যা, সমাজের কোন অমীমাংসিত বিষয়ে ধর্মতত্ত্ব, হাদিস, কোরআনের আয়াতের তাৎপর্য কিংবা অন্য যেকোন ধর্মের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সর্বপরি মানব জীবনের সকল দিকে ধর্মের গুরুত্ব নিয়ে লিখুন আপনিও- [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড