• বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গণতন্ত্রের পরিপূর্ণতা পেতে নৈতিকতারও দরকার

  রহমান মৃধা

২৬ জুলাই ২০২৩, ১৪:৪৮
গণতন্ত্রের পরিপূর্ণতা পেতে নৈতিকতারও দরকার
ফাইজারের প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের সাবেক পরিচালক রহমান মৃধা (ছবি : সংগৃহীত)

সুইডেনের অষ্টম বৃহত্তম শহরের নাম লিনসোপিং। আমি লিনসোপিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি (১৯৮৫-৯০), সে বহু বছর আগের কথা। আমার মা লিনসোপিং-এ মারা যান ২০০৬ সালে এবং মায়ের কবরস্থান সেখানে। আমি প্রায়ই মায়ের কবর জিয়ারত করতে সেখানে যাই। লিনসোপিং আমার দূর পরবাসের প্রথম বাসস্থান। এখানের অনেক কিছুর সঙ্গে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

লিনসোপিং-এ গেলেই এক দুই রাত সেখানে থেকে যাই। এবার উঠেছি হোটেলে। সকালের নাস্তায় ছোট্ট একটি বাচ্চা শিশুর সঙ্গে তার বাবা মায়ের হৃদ্যতা, কথোপকথন দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মেয়েটির বয়স দুই বছর হবে। বাবাকে বেশ বিরক্ত করছে।

বাবা একবার বললেন, কফি খেয়ে তোমার সঙ্গে পুরো সময় দিবো। মেয়েটির দেরি সহ্য হচ্ছে না। হঠাৎ বাবা মেয়েটিকে বললেন বাবা তুমি যদি ধৈর্য না ধরো তাহলে তো অপেক্ষা করা শিখতে পারবে না! এ কথাটি শুনে মেয়েটি বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো অপেক্ষা করা না শিখলে কী হবে?

মেয়েটির বাবা তখন একটি উদাহরণ দিলেন। ধরো তুমি একটি পার্কে গেছো দোলন খেতে, যেয়ে দেখলে যে আরেকটি বাচ্চা দোলন খাচ্ছে। তুমি যদি দেরি না কর তখন দোলনাটা তো তুমি শত চেষ্টা করলে বা কান্নাকাটি করলেও পাবে না। তোমাকে দেরি করতে হবে এবং যখন তোমার সময় হবে ঠিক তখনই তুমি দোলনায় চড়তে পারবে। যদি তুমি এখন থেকে অপেক্ষা করা বা ধৈর্য ধরা শেখো তাহলে দেখবা বড় হলে তোমার মন খারাপ হবে না।

এ কথা শোনার পর মেয়েটি চুপচাপ বাবার কফি পান করা অবধি বসে রইল। বাবা কফি শেষ করে মেয়েটির হাত ধরে চলে গেল। আমি পুরো বিষয়টি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলাম এবং মুগ্ধ হয়ে বিষয়টি ভাবতে শুরু করলাম। এভাবে তো আমাকে কেউ ধৈর্য ধরা শেখায়নি। তবে শত বার শুনেছি ধৈর্যশীলকে আল্লাহ পছন্দ করেন।

আল্লাহকে দেখিনি, বাবা-মা সহ কতকিছু দেখেছি অথচ আল্লাহর কথা বলে অপেক্ষা বা ধৈর্য ধরা শেখানো হয়েছে। এখনও ধৈর্য ধরা শিখতে পারিনি তবে মেয়েটির বয়স মাত্র দুই বছর অথচ সে ধৈর্য ধরা শিখল একটি চমৎকার বাস্তবতার মধ্য দিয়ে।

মনের কথা খুলে বলার আরেক নাম বাঁক স্বাধীনতা। আর যুক্তির মধ্য দিয়ে কিছু শেখা বা জানা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার নাম স্বাধীনতা। তাহলে কি শুধু স্বাধীনতা গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র? না। আমি মনে করি গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রে দরকার বাঁক স্বাধীনতা, স্বাধীনতা এবং নৈতিকতা।

কথিত আছে প্রাচীন গ্রিস গণতন্ত্রের জন্মভূমি। তবে আধুনিক কালের প্রতিনিধিত্বমূলক পরোক্ষ গণতন্ত্র নয়, প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র। বলা যেতে পারে আধুনিক গণতন্ত্র বিকশিত হয় প্রথমে ইংল্যান্ডে। স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের দীর্ঘ সংগ্রামের পর রাজতন্ত্রের চূড়ান্ত পতন হয় এবং জনগণের বিজয়ের ফসল হিসেবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

এরপর গণতন্ত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে গোটা ইউরোপ এবং শেষে গোটা বিশ্বে শুরু হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। আজও দেশে দেশে চলছে সে সংগ্রাম। এখনও ইংল্যান্ড, সুইডেনসহ বহু দেশে রয়েছে রাজতন্ত্রের ছোঁয়া; যেখানে রাজা বা রানি হন উত্তরাধিকারসূত্রে। তবে এই রাজতন্ত্র সেই রাজতন্ত্র নয়, এটি হলো নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র। নখদন্তহীন সিংহ। গণতন্ত্র বর্তমান রাজতন্ত্রকে খাঁচার মধ্যে আটকে ফেলেছে।

রাজতন্ত্র পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে গণতন্ত্রের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। তাই উভয়ের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ নেই। রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে এই যে সমন্বয় এটি পরস্পর বিরোধী চিন্তার সমন্বয়ের ফসল। এতে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, হয়েছে ঐশ্বর্যময়। চিন্তা আর বিপরীত চিন্তার সংঘর্ষ ও চূড়ান্ত পর্যায়ে সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই সমাজ এগিয়ে চলছে।

গণতন্ত্রের এ সংঘর্ষ যদি তখন সমাজ মেনে না নিত, আজকের এই উন্নত আধুনিক পৃথিবী নির্মাণ করা সম্ভব হতো না। তাই বলা যেতে পারে জীবনমানের উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন নীতিমালার কেন্দ্রে থাকতে হবে পরিবর্তন এবং মত-দ্বিমতের সম্পর্ক। একটি সমাজ বা দেশের জনগণের যদি কিছু বলার অধিকার না থাকে তবে কারো কিছু করার কোনো অধিকার থাকার কথা নয়। অথচ দুর্নীতি, ঘুষ, গুম, খুন, ধর্ষণ চলছে দেদারসে।

বাধা তো এসব ক্ষেত্রেও রয়েছে, তা সত্ত্বেও এসব কিছু মানুষ ঝুঁকি নিয়ে করছে। এগুলো যখন করা সম্ভব সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে, তাহলে প্রতিবাদ কেন করা যাবে না? এমনটি প্রশ্ন করে বসলেন আমার এক সুইডিশ বন্ধু।

উত্তরে বললাম বন্ধু প্রতিবাদ করতে হিম্মত লাগে কিন্তু কুকর্ম করতে হিম্মত লাগেনা, কুকর্ম করতে কাপুরুষ হলেই চলে। প্রতিবাদ লোকালয়ে ঘটে আর কুকর্ম-অপকর্ম ঘটে রাতের অন্ধকারে। বন্ধু আমার বিশ্লেষণে মুগ্ধ হলেও হঠাৎ পাল্টা প্রশ্ন করলেন, তোমাদের দেশে দিনে দুপুরে ভোট চুরি করে কর্তৃপক্ষের সামনে, তারা নিশ্চয়ই কাপুরুষ নয়? উত্তরে বললাম না, তারা রাজনীতিবিদ। কারণ পলিটিক্স মানেই তো ট্রিকস, তাইতো ভোটের আগের দিন সমস্ত ভোট ব্যালট বাক্সে ঢুকে যায়। যে কথাগুলো আমি লিখলাম এ কথাগুলো আমি ইতিমধ্যেই লিখে ফেলেছি, এর জন্য কিন্তু আমিই দায়ী। আবার যে কথাগুলো আমি এখনো লিখিনি তবে ভাবছি লিখব এবং মনে মনে চিন্তাও করছি কী লিখব। এর জন্যও কিন্তু আমি দায়ী বিবেকের কাছে।

বাক স্বাধীনতা এবং তার প্রকাশের দায়ভার আমার। এর ভালোমন্দের জন্য আমি পরিবার, সমাজ বা দেশের কাছে জিম্মি। যখন তখন যা খুশি তাই বলতে বা লিখতে পারি না। আবার সমাজ বা দেশের ক্রান্তিকালে যদি আমি নীরবতা পালন করি তাহলে কিন্তু আমি অন্যায়ের পক্ষে। শুধু লেখক বা কবি-সাহিত্যিকই নয়, সমাজের প্রতিটি মানুষেরই কথা বলা এবং লেখার স্বাধীনতা থাকতে হবে। সর্বস্তরের মানুষের কথা শুনতে হবে। সব রাজনৈতিক সংগঠন এবং সরকারকে একত্রে বসতে হবে। রাজনৈতিক সংগঠনকে কালের স্পন্দন বুঝতে হবে আর কালের স্পন্দন বুঝতে পারলেই মানুষের মনের স্পন্দন বোঝা সম্ভব।

বস্তুত রাজনীতির জন্য প্রয়োজনীয় যে জ্ঞান, তার উৎস হলো জনগণ এবং তারা সাধারণ মানুষ। এখন জনগণ ছাড়া কি গণতন্ত্র সম্ভব? না, আদৌ তা সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ গণতন্ত্রের দেশে যদি কেউ অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে, গুজব ছড়ায়, সমাজের ক্ষতিকর আচরণ করে তবে তাকে সংশোধন করতে হবে। কিন্তু একেবারে মেরে ফেলা যাবে না, কারণ যদি কেউ দ্বিমত পোষণ করে, আর তাকে যদি মেরে ফেলা হয় বা জেল-হাজতে ঢোকানো হয় তবে শেষে দেখা যাবে জেল-হাজতের বাইরে কেউ আর বেঁচে নেই।

কেউ যদি আমার কথা পছন্দ না করে, তাহলে আমার বক্তব্য খণ্ডন করার মতো যুক্তি দেখাতে হবে এবং নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করতে হবে। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনবো। এমনও হতে পারে তার যুক্তির কাছে আমি পরাজিত হয়ে আমি নিজেই তার অনুসারী হয়ে গেছি। কিন্তু তা না করে আমাকে বন্দি করে জেলে ঢুকানো হলো বা ভয় দেখানো হলো বা মেরে ফেলা হলো। আমাকে হত্যা করে ফেললেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? আর দশ জনের মতো আমিও বেঁচে থাকতে চাই। আমারও তো রয়েছে সংসার, পিতা-মাতা, সন্তান, ভাই-বোন, সমাজ আর রাষ্ট্র; যাদের প্রতি আমারও রয়েছে দায়, রয়েছে ঋণ, রয়েছে ভালোবাসা।

তবে হ্যাঁ, আমার বক্তব্যটা উপস্থাপন করতে হবে শালীন ও যুক্তিপূর্ণ ভাষায়। বক্তব্যের সঙ্গে যদি কেউ দ্বিমত পোষণ করে তার জবাবটি দিতে হবে একইভাবে আলোচনা-সমালোচনা, যুক্তিতর্ক এসবের অনুশীলন ছাড়া কোনো জাতি উন্নতির ধাপে পৌঁছাতে পারে না। এটি একটি প্রমাণিত সত্য। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ থেকে এগুলো বিলীন হতে চলেছে, কারণ কী?

দেশ স্বাধীন হবার পর আজ অবধি কোনো সরকারই জনগণের মনের ভাষা বোঝেনি, তবে বুঝেছিলেন শেরে বাংলা, ভাসানি, বঙ্গবন্ধু। তাইতো তারা স্বাধীনতার নায়ক-মহানায়ক হতে পেরেছিলেন। আমরা কোটি কোটি জনগণ যেমন বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, প্রাণ দিয়েছিলাম, তিনিও স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করে তার প্রতিদান দিয়েছেন।

এখন কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সকলেই কাজ করবে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এ সত্য ভুলে গেলে চলবে না। এখন যারা ক্ষমতায় আসছে কেবল তারাই নিজেদেরকে দেশপ্রেমিক মনে করছে আর বাকিদেরকে মনে করছে রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী, রাজাকার আরও কত কী!

মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কারাগারে বন্দি রেখে অনেক রাষ্ট্রীয় নেতাকে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে যা অন্যায়। আর কতকাল ধরে চলবে এই অত্যাচার? এই প্রতিহিংসা পরায়ণ রাজনীতি? এটাই কি স্বাধীনতা? এটাই কি মানবাধিকার? প্রশ্নগুলো কার কাছে করবো? এমন মানুষও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

আমরা গ্রাম-গঞ্জের মানুষ ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তর অবধি ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। ক্ষোভে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছি। এখন আমাদের কাজ নতুন প্রজন্মদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে ভবিষ্যৎ দেখানো। দেশের প্রায় সাড়ে তিন কোটি তরুণ বেকার। দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা এখন প্রায় ছয় কোটি। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন হয়ে বর্তমান পর্যন্ত যা কিছু সামাজিক আলোড়ন হয়েছে সবই সম্ভব হয়েছে তরুণদের কারণে। অথচ সেই তরুণরা আজ বঞ্চিত বাক স্বাধীনতা থেকে, স্বাধীন মত প্রকাশ থেকে, ভোটাধিকার থেকে। ফলে তাদের মধ্যে নতুন নতুন চিন্তা ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটছে না।

আমরা এগিয়ে যাবার নতুন পথও খুঁজে পাচ্ছি না। তাদেরকে বাদ দিয়ে দেশ গড়া যেমন সম্ভব হতে পারে না ঠিক তেমনি সমাজের লেখক, প্রকাশক, বুদ্ধিজীবী ও ভিন্নমতের মানুষ হত্যা করে দেশ চালানো সম্ভব নয়। লেখক, প্রকাশক, বুদ্ধিজীবী ও ভিন্নমতের মানুষ হত্যার মতো জঘন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে কি জাতীয় সংসদে বা মন্ত্রিসভায় কার্যকর আলোচনা হয়েছে? একজন লেখক কখনো কখনো সমগ্র মানবজাতির ওপরই সুদূরপ্রসারী ও শক্তিশালী অবদান রাখতে পারেন।

একটি মহল প্রতিবাদী লেখকদের মেরে ফেলতে চাইছে অথচ সংসদেও সে বিষয়ে নির্ভীক কোনো আলোচনা নেই, বিরোধীদলের তেমন প্রতিবাদ নেই। কীভাবে মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান ক্রমেই উন্নত স্তরে পৌঁছাবে যদি বিরোধী দলের তেমন প্রতিবাদ না থাকে?

বিরাজমান জ্ঞানের সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত নতুন জ্ঞানের সংঘর্ষের ফলেই মানব সমাজের জ্ঞান বৃদ্ধি ঘটে। অতএব, মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত এই নতুন জ্ঞান তাকে প্রকাশ করতে দিতে হবে। তা না হলে সমাজে জ্ঞান-বৃদ্ধি ঘটবে না এবং সমাজ একদিন একটা বদ্ধ ডোবায় পরিণত হবে। প্রশ্ন হলো, বিরাজমান জ্ঞানের সঙ্গে নতুন জ্ঞানের সংঘর্ষ কীভাবে হবে?

আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্ক হলো সেই মাধ্যম, যা এই সংঘর্ষ তৈরি করে। বিতর্ক একটা সমাজ এবং দেশের মানুষের মাঝে গতি তৈরি করে। এ গতিই সমাজ এবং দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

ইউরোপ যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব উন্নতি করছে, তার মূলে ছিল বিতর্ক ও অন্যায়-অবিচার-বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কারভাবে দেখতে পাই যে, ঐতিহাসিক কয়েকটি ঘটনা আজকের এই আধুনিক পৃথিবীর জন্ম দিয়েছে। যেমন পুনর্জাগরণ, ফরাসি বিপ্লব, শিল্প-বিপ্লব প্রভৃতি। অর্থাৎ এসব ঘটনা না ঘটলে শিল্প-বিপ্লব কখনোই মানবজাতির পক্ষে আজকের এই উন্নত জীবন অর্জন সম্ভব হতো না। কারণ, এই ঘটনাগুলো ব্যক্তির চিন্তা, কর্ম ও সৃজনশীলতার পথ খুলে দিয়েছিল।

কয়েক বছর আগে ফরাসির প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের তিন বছরের সাজা হয়, কারণ তিনি দুর্নীতি করেছিলেন কোনো এক সময় যা আমাদের দেশে কোনো ব্যাপারই না। ফরাসি দার্শনিক ভলটেয়ারের বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে গেল, ‘আমি তোমার বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি কিন্তু তোমার বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমি আমার জীবন দিতে প্রস্তুত।'

আমরা ভুলে গেছি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শিক্ষা, ভুলতে শুরু করেছি স্বাধীনতা আন্দোলনের শিক্ষা। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত অধিকারের জন্য কথা বলতে পারার নাম স্বাধীনতা। নিজের মতো করে ব্যক্তির কথা বলা, কথা শোনা ও কথা লেখার অধিকারের নাম স্বাধীনতা।

এসব অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে মূল্যহীন হবে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, ব্যর্থ হবে শহীদদের চরম আত্মত্যাগ। ২০২৩ সালে এসে সেটা দেখা যাচ্ছে, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ তরুণদের মনে রাখেনি। তরুণদের মনে রেখেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এ আইনে বন্দিদের বেশির ভাগই তরুণ। এ কারণে তরুণরা আন্দোলন করছে তরুণ বিরোধী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে।

নতুন প্রজন্ম এ সরকারকে বিশ্বাস করতে চেয়েছিল। অনলাইনে বেশিরভাগ লেখকই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনুকূলে। কিন্তু কী হয়েছে? সরকার তাদের পরিত্যাগ করেছে। অনেকের অপমৃত্যু সরকার ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে।

অনেক লেখক-সাংবাদিক-শিল্পী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। সরকার আর রাষ্ট্র এক নয়। অথচ সরকার আর রাষ্ট্রকে এক করে ফেলা হয়েছে। সরকারের বিরোধিতাকে রাষ্ট্রবিরোধী বলে আখ্যায়িত করে দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে। তাহলে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর দোষ কোথায় ছিল?

পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা ১৯৭০ সালে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারলো অথচ আমরা সেই রকম একটি নির্বাচন করার যোগ্যতাও হারিয়েছি। আজ তরুণদের সকল অধিকার হরণ করে নিয়ে তাদেরকে বোবা করে দেওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে জবানের স্বাধীনতা ধ্বংস করা হচ্ছে। সত্যকে সঠিকভাবে প্রকাশ করার মতো সাহস জাতির কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

স্বাধীন করেছিলাম বাংলাদেশ পরাধীন হয়ে বেঁচে থাকার জন্য নয়, এ বিষয় আমরা একমত নিশ্চয়ই। আমরা যদি একমত সত্যিই হই তবে গণতন্ত্রের বেস্ট প্র্যাকটিসে বাঁধা কেন?

আমরা দৈনন্দিন নানা সমস্যার সমাধানে বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হই। সব সমস্যার ভিন্নতা ভেদে বিজ্ঞানেরও কিছু আলাদা সুপ্রতিষ্ঠিত শাখা গড়ে উঠেছে। যেমন পদার্থবিদ্যা যেমন প্রকৃতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, রসায়ন বিভিন্ন মৌলের পারস্পরিক পরিবর্তন এবং জীববিজ্ঞান শারীরতত্ত্বের ওপর কাজ করে, ঠিক তেমনি নৈতিকতা মানুষ ও প্রাণীর আচরণ এবং মানসিক প্রক্রিয়া সম্বন্ধে অনুধাবন করে থাকে।

বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতোও এটা যথেষ্ট তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে পরীক্ষা ও গবেষণামূলক একটি বিজ্ঞান। যদি শুধু নৈতিকতা নিয়ে গবেষণা করি গবেষণা হয়তো শেষ হবে নৈতিকতা শেখা হবে না। কারণ আমাদের জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি কার্যকলাপের ওপর আমাদের আচরণের প্রভাব রয়েছে। নৈতিকতা মানুষের মানসিক প্রক্রিয়া এবং আচরণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে পারে। নৈতিকতা মানুষের মনের কার্যকলাপ, সংগতি, বিচ্ছিন্নতা, অনুভূতি ও মানসিক সমস্যার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান প্রদান করে।

সমাজে যারা মানসিক বৈকল্যের শিকার, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সেবার জন্য আমাদের নৈতিকতার জ্ঞান দ্বারস্থ হতে হয়। কেননা, নৈতিকতা জীবন, সমাজ তথা গণতন্ত্রের বড় একটা অংশ, এটাকে উপেক্ষা করে বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আর এ জন্য নৈতিকতার প্রচার ও প্রসার অবশ্যই প্রয়োজন। গণতন্ত্রে যদি নৈতিকতা না থাকে তবে সে গণতন্ত্র পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারবে না।

লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।

[email protected]

(মতামত পাতায় প্রকাশিত লেখা একান্ত লেখকের মত। এর সঙ্গে পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।)

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড