• রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা: সাম্প্রতিক সঙ্কট ও সম্ভাবনা

  হাসিবুল হাসান

১৭ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:২৫
হাসিবুল হাসান
হাসিবুল হাসান

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের শিক্ষা পরিস্থিতির সময় কালকে আমরা যদি বিশ্লেষণ করি সমস্যা ও সংকটের আঙ্গিকে তাহলে নিঃসন্দেহে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় যে দেশের শিক্ষা পরিবেশ বর্তমানের ন্যায় এত জটিল ও কঠিন সময় আগে কখনো পার করেনি। বলা হচ্ছে শিক্ষা সংকট এখন আর্থিক সংকটের চেয়েও কোন অংশে কম নয়। শিক্ষায় বহুমাত্রিক সংকট ও অব্যবস্থাপনা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। আর এই সংকট একদিনে তৈরি হয়নি। রাষ্ট্র ধীরে ধীরে এই শিক্ষা সংকট তৈরির পিছনে কাজ করেছে। তাই সমাধান করার জন্যও রাষ্ট্র ব্যতীত দ্বিতীয় কোন প্রতিষ্ঠান নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় রাষ্ট্র এই সংকট সমাধান করে সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলার কোন আন্তরিকতায় আমরা দেখছি না। উল্টো রাষ্ট্রের সদিচ্ছার অভাবে এই সঙ্কট আরও ঘনীভূত করে তুলছে। শিক্ষা নিয়ে যে আসলে নানাবিধ সংকট বর্তমান একটু পিছনে গেলে আমরা সেটা দারুণ ভাবে দেখতে পাই। সমকালীন শিক্ষার চতুর্মুখী সমস্যা বিশ্লেষণ করে শিক্ষাবিদ মনিরুল ইসলাম বলেন রাষ্ট্রীয় উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য বিতর্কিত করে তুলেছে। জমে থাকা সমস্যাগুলো সমাধান নেই আশাজাগানিয়া তেমন সম্ভাবনাও নেই। লেখক প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শিক্ষায় সমস্যা কিভাবে তৈরী হয়েছে ব্যাখ্যা করেন তিনি বলেন ‘শিক্ষা হবে সার্বজনীন, শিক্ষা হবে সহজলভ্য, শিক্ষা কোন পণ্য হতে পারে না এটি হবে সর্বস্তরের মানুষের অধিকার,কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমাগতভাবে পণ্যের দিকে এগিয়ে গেল। সিরাজুল ইসলাম স্যারের এই ছোট্ট বিশ্লেষণ শিক্ষার মৌলিক সমস্যাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। রাষ্ট্র হবে মানুষের জন্য, কিন্তু সেটা না হয়ে হয়েছে উল্টো।

সবার জন্য শিক্ষা না হয়ে হয়েছে সমাজের কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্য। অবশ্য কাগজে-কলমে শ্লোগান মিছিল-মিটিংয়ে সর্বজনীন কথাটি জোর দিয়ে বলা হচ্ছে। দেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করেছে দুই বছর আগেই বিগত ৫০ বাদ দিয়ে আমরা সাম্প্রতিকতম এই দুই বছরের তথ্যাদি বিশ্লেষণ করলেও অগ্রগতির কোন চিত্র আমরা দেখি না। শিক্ষায় যে কত সমস্যা নিয়ে টিকে আছে এটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া প্রকৃত সত্য অনুধাবন করাটা অত সহজ নয়। শিক্ষায় চলমান ব্যর্থতার বিপক্ষে যুক্তি তর্কেরও অভাব নেই। ক্ষমতাসীনদের অভিযোগ যারা শিক্ষায় এতো সমস্যা দেখেন তারা রাজনৈতিক ভাবে তাদের প্রতিপক্ষ। তারা এটা কেন বোঝেনা যে তাদের নিজেদের দলের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য চিৎকার শিক্ষার ব্যর্থতা নিয়ে। কিছুদিন আগে সরকারের মধ্যে থেকে খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন শিক্ষাব্যবস্থা একবারে ধবংশ করে ফেলা হয়েছে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার জোর দিয়ে বলেন শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতার উপর ভর দিয়েই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র। শাসকগোষ্ঠীকে বুঝতে হবে শূন্যস্থান কখনো ফাঁকা থাকে না সেটা যেভাবেই হোক পূরণ হয়ে যায়। একদিকে চলমান শিক্ষাটা রাষ্ট্রের জন্য ধমনীতে প্রয়োজনীয় রক্ত দিতে পারছে না অন্যদিকে এই কাজটাই করতে চাই বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র। শিক্ষাপপ্রতিষ্ঠান যেখানে ব্যর্থ বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র সেখানেই সফল হতে চায়। শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতার ওপর ভর করেই সত্যিকার অর্থেই একজন আলোকিত মানুষ তৈরীর আন্দোলনে এগিয়ে যাবে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য আলোকিত মানুষ তৈরী করা। জীবনের জন্য রসদ সরবরাহ করে জাতীয় উন্নতির উন্মেষ ঘটাবে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আদতে সেটা পারেনি। হয়েছে ব্যর্থ। সচেতন মহল থেকে সংস্কার চিন্তার প্রসঙ্গ আসলেও যুগে যুগে সংস্কার পরিবর্তনের নামে হয়েছে কালক্ষেপণ, বাজেট বরাদ্দের নামে শূন্যতা সৃষ্টি এবং অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন প্রচেষ্টা। শিক্ষাব্যবস্থায় সঠিক সিদ্ধান্ত একটি দেশকে বহুদূর এগিয়ে নিতে পারে ইতিহাসে রয়েছে এর হাজারো নজির কিন্তু আমাদের দেশ বিগত ৫০ বছরে কি হলো? এর কোনো উত্তর নেই! ফ্লাশব্যাকে এর কোন উত্তর নেই। দেশে প্রচুর গবেষক আছে মন্ত্রণালয় এবং সেখানেও রয়েছে ফলাফলে শূন্যতা। টেকসই পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্রের কোনো চিন্তাভাবনা আছে বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় না । সরকার টিকে আছে ক্ষমতায় আরও বেশিদিন কিভাবে টিকে থাকা যায় সেটা নিয়ে। এভাবে দিনের পর দিন শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের দিকে চলে গেল আমাদের দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের চোখের সামনে অথচ কেউ কিছুই টের পেল না। শুধু শুধু চিৎকার কাগজে-কলমে হলেই সমাধান হবে না । সমাধানের জন্য শাসন সংগঠনের আন্তরিকতা ছাড়া শিক্ষা নিয়ে টেকসই পরিবর্তন সমাধান সম্ভব নয়। দেশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় আমরা যে শিক্ষা সমস্যাগুলো এখন সবচেয়ে বেশি দেখি মোটাদাগে কয়েকটি নমুনা উল্লেখ করা যেতে পারে। গবেষণা বলছে আশি ৮০% শিক্ষকের রয়েছে যোগ্যতা, ঘাটতি এনটিআরসি বিড়ম্বনা, শিক্ষকদের কারিকুলাম এই প্রবণতা অত্যাধিক। শিক্ষকদের দক্ষতার অভাব, তাদের যোগ্যতা ঘাটতি এনটিআরসির নামের নতুন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রচেস্টা এক নতুন অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।।

শিক্ষকদের নামমাত্র পাঁচদিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠানো হবে শ্রেণিকক্ষে পুরোনো বই দিয়ে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করার চেষ্টা। শিক্ষানীতি কে পাশ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এমপিও শিক্ষা জাতীয়করণ না করে তালবাহানা করা, অথচ বিশ্বের কোথাও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাত বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়নি যা হয়েছে বাংলাদেশ। শিক্ষা আইনের বাস্তবায়ন করা যেটা না থাকাটা বড় একটা সমস্যা। ২০১০ সাওেলর শিক্ষানীতিতেও রয়েছে পুরোনো কথার পুণরাবৃত্তি। শিক্ষকদের জব স্যাটিসফেকশন না থাকায় শুধু শুধু কাঠের গাভী থেকে দুধ আশা করা। নোট গাইড বাণিজ্যের বিষয়ে সরকারের দীর্ঘদিনের নীরব ভূমিকাও শিক্ষায় বড় সমস্যা মনে করে অনেকে। শিক্ষার বহুমুখীকরণ কাগজে-কলমে সংস্কারের কথা বলে অর্থের প্রশ্নে বিশৃংখলা শ্রেণীর কথা বিবেচনায় না এনে ধনী গরিবের জন্য আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। বলা হয়ে থাকে দেশে বিদ্যুৎ প্রকল্পের অফিসারদের মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়াটাও একটা বড় সমস্যা। শিক্ষা প্রশাসন ক্যাডার তৈরি না করে ডেপুটেশনে অফিসার নিয়োগ করা গবেষকদের মূল্য না দেওয়া, অপর্যাপ্ত গবেষণা। শিক্ষক সংগঠন গুলোর সমস্যাগুলো সম্পর্কে আন্তরিকতার অভাব। শিক্ষা সংস্কারে পৃথিবীর কোথাও শিক্ষা নিয়ে মনো শিক্ষার মতো তালবাহানা হয় কিনা অজানা। শিক্ষক স্মারকলিপির প্রতি অবহেলা। শিক্ষকদের সম্মান করে সংস্কৃতিকে দৃষ্টতা প্রদর্শন। অপরাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতি জিইয়ে রাখা। কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর বোর্ডের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া। প্রকৃত মেধাবীদের অবমূল্যায়ন করে কোটা সংস্কৃতিকে চালু রাখা। অশিক্ষিত ও বখাটেদের কমিটিতে জায়গা করে দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব বলয় তৈরি করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, প্রশ্নপত্র ফাঁস, মেধাবী অভদ্র শিক্ষকদের প্রাধান্য, রাজনৈতিক বিবেচণায় ভিন্নমতের শিক্ষকদের কোণঠাসা করে রাখা শিক্ষায় মৌলিক সমস্যা গুলোর অন্যতম। সরকারি বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বেতন বৈষম্যের কোন সমাধান না করা বারবার আশ্বাস দিয়ে প্রতারণা করা শিক্ষার মৌলিক সমস্যা গুলোর একটি। রাষ্ট্রের জন্য শিক্ষকদের প্রকৃত গুরুত্ব বুঝতে না পারা, স্বল্প বেতনের শিক্ষকদের যাপিত জীবন সম্পর্কে সরকারের স্পষ্ট ধারণা না থাকা। প্রশাসনের অদক্ষতা, অযোগ্যতা, এমপিওর নামে দীর্ঘসূত্রিতা এমপিও হলে দশ পার্সেন্ট কর্তন। ননএমপিও সমস্যা বেতন হীনতার নামে প্রহসন। বদলির নামে আয়নাবাজি, মিনিস্টার নামে অর্থনৈতিক লুটতরাজ। পরিদর্শকদের দ্বারা হয়রানি প্রতিষ্ঠানে আর্থিক বিশৃঙ্খলার বিষয়ে উদাসীনতা। পরিদর্শকদের দ্বারা হয়রানি এমপিওভুক্তিতে হয়রানি, উচ্চতর স্কেল পেতে হয়রানি, নিয়োগ কমিটির নামে লুটপাট নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে বাটপারদের পদায়ন সকল প্রকার নিয়োগে অবৈধ টাকার লেনদেন স্বজনপ্রীতি আত্মীয়করণ অথর্ব লোকদের লোভীদের দ্বারা নিয়োগ বোর্ড গঠন। শিক্ষক রাজনীতি, জাল সনদ এর বিষয়ে সরকারের উদ্দেশ্য প্রণোদিত আচরণে সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষায় সবচেয়ে বড় সমস্যা । মন্ত্রী যায় মন্ত্রী আসে কিন্তু শিক্ষায় যা হয়েছে তাই রয়ে যায় কখনো কখনো নতুন কাটাছেঁড়া সমস্যা বাড়িয়ে তোলে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের শিক্ষায় সমস্যা কেবল বেড়েই চলেছে।

সমাধান নেই তেমন কোনো সম্ভাবনাও নেই। চারিদিকের প্রচলিত প্রতিধ্বনী কেবল সমস্যার কথা জানান দিচ্ছে এত সব সমস্যার মধ্যে আমরা যদি এখনই কার্যকর ও টেকসই পরিবর্তন মুখী কোন সমাধান সূত্র আবিষ্কার করতে না পারি তাহলে সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়ে সম্ভাবনা হবে তিরোহিত। হাঁড়িতে যেটুকু সম্ভাবনা ছিল সেটুকু অ¤øান হয়ে যাবে অচিরেই আমরা কি এখনো সেই আশাতেই থাকবো।

লেখক হাসিবুল হাসান গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষা গবেষক

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড