• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গুজবে সচেতন সমাজের পাগলকাণ্ড ‘গণপিটুনি’ 

  আয়াজ উর রাহমান

২২ জুলাই ২০১৯, ১৭:৪২
গণপিটুনি
গণপিটুনি (ছবি : প্রতীকী)

গুজবে দেশে গণপিটুনির নামে নিরীহ মানুষ হত্যা যেন বেড়েই চলেছে। ‘ছেলেধরা’ সন্দেহ হলেই পিটিয়ে মারতে হবে এ যেন সচেতন সমাজের নতুন এক পাগলকাণ্ড। আর এ ধরনের পাগলকাণ্ডে গত চার দিনে সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে সাতজনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করেছে সমাজের সচেতন মানুষেরা।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব বলছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি থেকে জুন) ৩৬ জন এবং গত চার দিনে ৭ জন মিলিয়ে মোট ৪৩ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন।

এছাড়া আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে গত ছয় মাসে গণপিটুনিতে নিহত ৩৬ জনের মধ্যে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি ১৭ জন। এ ছাড়া ঢাকায় নয়জন, খুলনায় পাঁচ, সিলেটে দুজন, বরিশালে দুজন এবং রাজশাহীতে একজন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন।

গত শনিবার রাজধানীর বাড্ডায় ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তাসলিমা বেগম। তার মৃত্যুতে দেশে নতুন করে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। জন্ম নিয়েছে সামাজিক মাধ্যমে নতুন বেদনার!

এ বিষয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন মানুষ তাদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। কেউ সচেতনমূলক পোস্ট দিচ্ছেন কেউ আবার এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিচ্ছেন। কেউ কেউ অপরাধীদের কীভাবে বিচার হওয়া উচিৎ তা নিয়েও অনেকটা রাগ ঝাড়ছেন।

এদিকে এই ঘটনার রেশ না কাটতেই ওই দিন রাতে সাভারের অজ্ঞাত আরেক নারী গণপিটুনিতে নিহত হন। গতকাল রবিবার নওগাঁর মান্দায় পুকুরে মাছ ধরা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ছেলেধরার গুজব রটিয়ে ছয়জনকে গণপিটুনি দেওয়া হয়।

মানবাধিকার কর্মীদের দাবি, দেশে নানা কারণে দিনকে দিন মানুষ প্রতিহিংসা পরায়ণ হচ্ছেন। শুধু তাই নয় অপরাধের চেয়ে অপরাধীদের প্রতি বাড়ছে ঘৃণার মাত্রা। বিচারকাজে ভরসা কমায় মানুষ নিজেই যেন বিচার হাতে তুলে নিয়েছেন। এ যেন এক ভয়ঙ্কর পাগলকাণ্ড।

এদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে গত শনিবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে গুজব ছড়ানোকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটেছে।

গুজব ছড়িয়ে ও গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ বলে উল্লেখ করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, দ্রুতই জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার অনুরোধ করছি।

ঘটনার সূত্রপাত, নেত্রকোণা শহরের নিউ টাউন এলাকায় এক যুবকের ব্যাগ থেকে পাওয়া ছয়-সাত বছর বয়সী এক শিশুর কাটা মাথা পাওয়া থেকে। ওই ঘটনায় কোনো কিছু না বুঝেই বা আইনি আশ্রয় না নিয়েই উৎসুক জনতা ঘটনাস্থলে আইন নিজের হাতে তুলে নেন। গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করেন ওই যুবককে।

জানা যায়, অজ্ঞাত ওই যুবক ব্যাগে শিশুর কাটা মাথাসহ হরিজন পল্লী এলাকায় ঘোরাফেরা করছিল। বিষয়টি হরিজনদের দৃষ্টিগোচর হয়। পরে তাকে ধাওয়া করে নিউ টাউন পুকুরপাড়ে ধরে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। এতে ঘটনাস্থলেই ওই যুবকের মৃত্যু হয়।

নেত্রকোণা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তাজুল ইসলাম, নাজমুল হাসান (তদন্ত), উপপরিদর্শক (এসআই) আওয়াল সরদার, শাখাওয়াত হোসেন, আলমগীর হোসাইনসহ মডেল থানার পুলিশ সদস্যরা খবর পেয়ে পরে ঘটনাস্থলে ছুটে যান।

এ বিষয়ে নেত্রকোণা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এসএম আশরাফুল ইসলাম জানান, কাটা মাথা শিশু ও নিহত যুবকের পরিচয় শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া কেউ তাদের চিনতে পারলে পুলিশকে দ্রুত অবগত করতে সর্বসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

এদিকে এই ঘটনায় সকলের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া যেন শুধুই দেখা যায় যুবকের ব্যাগে পাওয়া শিশুর কাটা মাথা নিয়ে। আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন অনেকে। ফেসবুকে একটি শিশুর এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর দিকেই নজরবন্দি থাকেন সবাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলে এই নিয়ে আবেগঘন স্ট্যাটাস। তবে শিশুর কাটা মাথা ব্যাগে পাওয়ার জেরে ওই যুবককে আইনের হাতে তুলে না দিয়ে কেন ঘটনাস্থলেই তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হল, এটা যেন তখন দৃষ্টিগোচরই থাকে সবার নজরে।

এ বিষয়ে দৈনিক অধিকারের নেত্রকোণা জেলার সংবাদদাতার দেওয়া তথ্যে জানা যায়, শিশুর কাটা মাথা পাওয়ার জেরে যুবককে পিটিয়ে হত্যার বিষয়ে পুলিশ বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। তবে এখনও কেউ গ্রেফতার হননি। পরে এ বিষয়ে জানতে নেত্রকোণা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে ফোন দেওয়া হলেও ব্যস্ত থাকায় কথা বলতে পারেননি তিনি।

অন্যদিকে এ ঘটনার পর পরই পদ্মাসেতুতে কাটা মাথা লাগবে বলে সারাদেশে ছড়ানো গুজব যেন মানুষের মাঝে বিশ্বাসের জন্ম নেয়। ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে শুরু হয় গণপিটুনিতে উৎসুক জনতার হত্যাকাণ্ড। শনিবার বিভিন্ন স্থানে পাঁচজনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার খবর পাওয়া যায়।

ওই দিন রাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে অজ্ঞাত একজন (বয়স আনুমানিক ৫৫) নিহত হয়েছেন। উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের দেওড়াছড়া চা–বাগান এলাকার কয়েকজন চা–শ্রমিক বলছেন, গুজবের ওপর ভিত্তি করে উত্তেজিত কিছু লোক ওই ব্যক্তিকে পিটুনি দেন। অবশ্য পুলিশ নিহত ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি।

একই দিন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে গণপিটুনিতে নিহত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সিরাজ। সিদ্ধিরগঞ্জের ওসি শাহীন পারভেজ জানান, সিরাজ কোনো ছেলেধরা নন। তিনি বোবা ও বধির ছিলেন।

পদ্মাসেতুতে কাটা মাথার সৃষ্ট গুজব প্রসঙ্গে নেত্রকোণার পুলিশ সুপার জয়দেব চৌধুরী জানান, শিশু সজীব মিয়ার (৭) মাথা কাটার বিষয়টি একটি নির্মম ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড। ছেলেধরা বা পদ্মা সেতু গুজবের সঙ্গে ঘটনাটির কোনো সম্পর্ক নেই। এই ঘটনায় অভিভাবকদের আতঙ্কিত না হওয়ার জন্যও সবাইকে অনুরোধ করেন তিনি।

তিনি বলেন, অপরিচিত হলেই সন্দেহ করে কাউকে মারা যাবে না। এ ধরণের ভুল সিদ্ধান্তে নিজেও অপরাধী হয়ে যেতে পারেন। তাই এলাকা, পাড়া-মহল্লায় অপরিচিত ব্যক্তিকে নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হলে আগে তার সাথে কথা বলুন। নয়তো শুধু সন্দেহের জেরেই চলে যেতে পারে নিরীহ মানুষের জীবন।

‘ছেলেধরা’ সৃষ্ট ভীতি মন থেকে ঝেরে ফেলার পরামর্শ দিয়ে পুলিশ সুপার আরও বলেন, রবিন ছিল শিশু সজীবের প্রতিবেশি এবং এলাকার চিহ্নিত মাদকাসক্ত যুবক। গণপিটুনি দিয়ে রবিনকে না মারলে প্রকৃত ঘটনা সহজেই জানা যেত। অপরাধ যে কেউ করতে পারে এবং তার জন্য আইন-আদালত রয়েছে।

আট বছর আগে ২০১১ সালের জুলাই মাসে ঢাকার সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশি গ্রামে ‘ডাকাত সন্দেহে’ গণপিটুনিতে ছয় ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছিল। ওই ঘটনা নিয়ে তখন সারা দেশে তুমুল আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনার আট বছরেও বিচারকাজ শেষ হয়নি। এ ঘটনায় আসামি ৬০ জনই জামিনে আছেন। ঢাকার একটি আদালতে এই মামলার বিচারকাজ চলছে।

এ মামলার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের একজন শাকিলা জিয়াসমিন বলেন, এখন ওই মামলার দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তার জেরা চলছে। আগামীকাল ২৩ জুলাই পরবর্তী তারিখ রয়েছে। তার জেরা শেষ হলে আরেকজন তদন্ত কর্মকর্তার জেরা বাকি থাকবে। তিনি আশা করেন, আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে বিচারকাজ শেষ হয়ে যাবে।

এছাড়া ২০১১ সালের ২৭ জুলাই নোয়াখালীতে নিরীহ কিশোর মিলনকে ডাকাত সাজিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও সে সময় ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল।

ছেলেধরা সন্দেহ হলেই গণপিটুনিতে হত্যা এ বিষয়ে ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের বার্তা সম্পাদক অনুপম দেব কানুনজ্ঞ দৈনিক অধিকারকে বলেন, ‘আমাদের চিন্তাভাবনা, ঠিক-বেঠিকের বোধ খুব সিলেকটিভ৷ আমরা ক্রসফায়ারকে সমর্থন করি, কিন্তু এক মাকে ছেলেধরা সন্দেহ করে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে বলে কষ্ট পাই৷ একদিকে আইনের শাসন নাই দেশে, বিচারের ফাঁক গলে অপরাধীও পার পেয়ে যায়। মানুষ নানা কারণে জীবনমান নিয়ে হতাশ, প্রতিবাদের ক্ষমতাও নেই৷ ফলে যেকোনো কিছুতেই মানুষ নিজের ক্ষোভ অন্যের ওপর ঢেলে দিতে চায়৷ কিন্তু সে কখনও চিন্তা করতে চায় না, সঠিক পথে না গিয়ে শর্টকাটে সমাজ ঠিক করা যায় না।'

তিনি আরও বলেন, সমস্যা যদি বিচার ব্যবস্থায় থাকে, সেটা ঠিক করতে হবে, শর্টকাটে না৷ আজকে যারা অন্যায় সমর্থন করছেন, কাল কেউ নিজের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাকেই সন্ত্রাসী, ছেলেধরা সাজিয়ে গণপিটুনি দেবে না, নিশ্চয়তা কী?

সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে অতি দ্রুত গুজব ছড়িয়ে পড়ছে এমন বিষয়ে গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের করণীয় বিষয়ে অনুপম দেব বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমের মধ্যে মূল তফাত হলো, বস্তুনিষ্ঠতা৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনোকিছু শেয়ারে কারো কোনো দায়বদ্ধতা নেই৷ কিন্তু সাংবাদিকদের এই জায়গায় বিশাল দায়িত্ব৷ সঠিক তথ্য তুলে ধরা, স্রোতের সঙ্গে ভেসে না যাওয়া৷ কিন্তু এখন রাজনীতিসংশ্লিষ্টতার কারণে মানুষের কাছে গণমাধ্যমও আস্থার সংকটে পড়েছে৷ ফলে কোনো সংবাদকেও মানুষ সহজে বিশ্বাস করতে চায় না৷ এর ফলে গুজব সহজে ছড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে৷

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড