• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ভালোবাসা দিবসের আড়ালে মুছে যাওয়া ১৪ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ইতিহাস

  নাবিলা বুশরা

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:০৬
১৪ ফেব্রুয়ারি
১৪ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ইতিহাস (ছবি: সংগৃহীত)

কলা ভবন থেকে শিক্ষা ভবন অভিমুখে ছাত্রদের মিছিল... স্লোগানে মিছিলে উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয়... সামরিক শাসন মানি না... মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল কর... করতে হবে... শ্লোগান মিছিল চলাকালীন হঠাৎ করেই গুলিতে প্রকম্পিত চারিদিক... মিছিলে পুলিশে ট্রাক তুলে দিয়ে শুরু হয় বর্বরতার এক ভয়াল নিদর্শন।

স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের হিংস্র পুলিশ বাহিনীর উন্মত্ততায় একে এক লুটিয়ে পরে জাফর, জয়নাল, দিপালী সাহা। আহতদের আহাজারীতে হাসপাতালগুলোতে তৈরী হয় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের... কলাভবনেও গুলি টিয়ার সেলের আঘাতে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর চলে নৃশংস হামলা। গ্রেফতার হয় হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা.. কারফিউ জারি। ১৫ ফেব্রুয়ারী সারাদেশে হরতাল। ওইদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হয় জবি ছাত্র আইয়ুব ও কাঞ্চন। বছর দুই পর এই মধ্য ফেব্রুয়ারীতেই হত্যা করা হয় বাকশাল সমর্থিত জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক, সমাজবিজ্ঞান শেষ বর্ষের ছাত্র রাউফুন বসুনিয়াকে।

কী ছিল মজিদ খানের শিক্ষানীতিতে?

সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ ক্ষমতারোহণ করে। স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত সকল গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হয় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার সাহায্যে মানুষের চিন্তাশক্তির উদ্ভাবনী ক্ষমতা বাড়বে, তাদের মাঝে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মানসিকতা জেগে উঠবে এমন সকল ব্যবস্থাই বন্ধ করে দেওয়ার পায়তারা চলছিল সে সময়। আর এরই সূত্র ধরে এরশাদও প্রণয়ন করেছিল মজিদ খান শিক্ষানীতি।

সে সময় ড: মজিদ খানের শিক্ষানীতিতে সাধারণ ও উচ্চশিক্ষা সংকোচনের ও ব্যয় বহুল করার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল। পরিকল্পনাগুলো ছিল-

- শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে কর্মমুখী-উৎপাদনমুখী শিক্ষার উপর বিশেষভাবে গুরুত্বের কথা উল্লেখ করা হলো।

- প্রথম শ্রেণী থেকে আরবি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলো। মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসারের প্রস্তাবনা হাজির করা হলো। এর উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটানো। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ত্বরান্বিত করতে সুপারিশ করা হলো “….. অর্থাৎ শিক্ষার বেতনের ৫০ ভাগ শিক্ষার্থীদের থেকে আদায় করা হবে।” রেজাল্ট খারাপ হলেও ৫০ শতাংশ বেতন দিলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হলো।

- বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে টুঁটি চেপে ধরতে বলা হল, “বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রের মতই স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়েছে। ফলে গবেষণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনার কেন্দ্র হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃত ভূমিকা থেকে সরে গেছে।” অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়কে এখন রাষ্ট্রের অধীনেই চলতে হবে।

স্বাভাবিকভাবেই গণবিরোধী এ শিক্ষানীতি এদেশের সংগ্রামী ছাত্র সমাজ মেনে নিতে পারেনি। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্রজনতা। শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলন এক পর্যায়ে রাজনৈতিক আন্দোলন তথা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের রূপে পরিণত হয়।

মিছিল

১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সচিবালয় অভিমুখে এগিয়ে চলা মিছিল। (ছবি: সংগৃহীত)

শিক্ষানীতিবিরোধী উত্তাল ছাত্র আন্দোলন

১৯৮২ সালের ২৬ মার্চ, এরশাদ সরকার গঠনের দুদিন পরেই ছাত্ররা সাভারে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করতে গিয়ে সামরিক স্বৈরতন্ত্র বিরোধী স্লোগান দেয়। সে শ্লোগান মিছিলে সেনানিবাস থেকে সৈন্যবাহিনী ছুটে এসে ছাত্রদের উপর নির্মম নির্যাতন চালায়।

মিছিল

১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩। ছাত্রদের মিছিলে বাধা দিতে পুলিশের রাস্তায় ব্যারিকেড। (ছবি: সংগৃহীত)

পরবর্তীতে ৮ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ নির্বিচার লাঠিচার্জ করে। এর প্রতিবাদে ১৪টি ছাত্র সংগঠন মিলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলে আন্দোলনের দৃঢ় শপথ নেয়। এই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারেই ১৪ ফেব্রুয়ারি কুখ্যাত মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে কলাভবনে বিশাল ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

আন্দোলন

আন্দোলনের ডাক (ছবি: সংগৃহীত)

সমাবেশ শেষে স্মারকলিপি প্রদানের উদ্দেশ্যে সচিবালয় অভিমুখে মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি কার্জন হল ও শিক্ষাভবনের সামনে পৌঁছানো মাত্রই পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। নিহত হয় জয়নাল, জাফরসহ আরও অনেকে।

১৪ ফেব্রুয়ারি

সচিবালয় অভিমুখে মিছিল শুরু হলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন জয়নাল (ছবি: সংগৃহীত)

শিশু একাডেমীর অনুষ্ঠানে যোগদান দিতে গিয়ে নিহত হয় শিশু দিপালী, তাঁর লাশ গুম করে ফেলে পুলিশ। জয়নালের গুলিবিদ্ধ দেহকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে তবে শান্ত হয় নির্দয় পুলিশের দল। ১৫ তারিখ আন্দোলন আরো ছড়িয়ে পড়লে নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। চট্টগ্রামে প্রতিবাদী কাঞ্চন নিহত হয় ১৫ তারিখ। গ্রেফতার-নির্যাতনের সীমা ছাড়িয়ে যায়। সরকারি হিসেবেই গ্রেফতারের সংখ্যা দেখানো হয় ১৩৩১ জন। যদিও বাস্তব পরিস্থিতি ছিল আরও বেশিমাত্রায় ভয়াবহ।

আন্দোলনের চিত্র

মিছিলে বাধা দিতে পুলিশের ব্যারিকেড। ছাত্রদের উপর পুলিশের হামলা। (ছবি: সংগৃহীত)

১৪ ফেব্রুয়ারি শহীদ ছাত্রদের মরদেহ জানাজার জন্য অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে রাখা হলে সেখানেও হামলা চালায় পুলিশ। ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। প্রাণহীন শহীদদের লাশ সূর্যসেন হল পর্যন্ত বয়ে নিয়ে গেলে হলের গেট ভেঙ্গে যৌথবাহিনী ছিনিয়ে নেয় লাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র কর্মচারীদের রুমে ঢুকে তাদের ওপর যৌথবাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়ন চলতে থাকে।

দাবানলের মত এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। পরদিন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ যোগ দেয় আন্দোলনে। তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাতিল করতে বাধ্য হয় স্বৈরাচারী সামরিক সরকার।

ইতিহাসের রক্তাক্ত এই আন্দোলনের দিনের কথা আজকের নতুন প্রজন্ম ভুলতে বসেছে। আজও অনেকের কাছেই অজানা এই দিন। জাফর, জয়নাল। দিপালীরা থেকে যায় অন্তরালেই। তাদের কথা ভেবে হয়ত কিছু মানুষ আজও শুধু স্মৃতি হাতড়ায়। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গনতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে গিয়ে যারা জীবন দিয়েছে তাদের কথা আজ হারিয়ে গেছে ভালোবাসা দিবসের আড়ালে।

সেই সময়ে মোহন রায়ানের লেখা কবিতায় শিমুল মুস্তাফার আবৃত্তিতে 'তোমাকে মনে পড়ে যায়' কবিতার আংশিক কিছু লাইন-

"ওই তো, ওই তো সবার আগে তুমি মিছিলে কি সুঠাম তোমার এগিয়ে যাবার ভঙ্গিমা প্রতিটি পা ফেলছো কি দৃঢ় প্রত্যয়ে কি উচ্চকিত তোমার কন্ঠের শ্লোগান যেন আকাশ ফেটে পড়বে নিনাদে হাত উঠছে হাত নামছে মাথা ঝুকছে ঘাড় দুলছে চুল উড়ছে বাতাসে ওই তো, ওই তো আমাদের ঐক্যের পতাকা হাতে এগিয়ে যাচ্ছ তুমি"...

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড